হো চি মিন সিটি (সাইগন)
ভ্রমণকাহিনি সেভাবে লিখিনি যদিও ভ্রমণ কিছু কম করিনি। লিখেছিলাম ঘাটশিলা গিয়ে, প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণের স্মৃতি বিজড়িত ঘাটশিলা। কোথাও প্রকাশ করিনি। করেছিলাম ফেসবুকে সরাসরি।
ভ্রমণকাহিনি লেখার নিজস্ব ধরণ আছে, সেই ব্যাপারটাও খুব একটা আয়ত্তে নেই। ভিয়েতনাম সফর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, ইচ্ছেটা অন্তর্গত। তাই নাম দিলাম ভিয়েতনামের গল্প।
আমরা ২৪ নভেম্বর রওনা হয়েছিলাম কলকাতা বিমানবন্দর থেকে। তার আগে বেশ খানিকটা প্রস্ততিপর্ব। যাওয়া হয়েছে ইউকো ব্যাঙ্ক স্টাফ ক্লাব থেকে। স্টাফ ক্লাব থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে। যাচ্ছি ডট কম। সেই এজেন্সির মধ্যমণি সুভাষ কুন্ডু আমাদের সফরসাথী হলেন আমাদের গাইড করে নিয়ে যাবার জন্যে। পুরো বত্রিশ জনের একটি দল কলকাতা থেকে ভিয়েতনাম গামী উড়োজাহাজ ইন্ডিগোতে পা রাখলাম। রাতের প্লেন।. কলকাতা থেকে সাইগন। পুরো সাড়ে তিন ঘন্টার সময় কেটে গেল ঘুমিয়ে। ভিয়েতনামের ঘড়ির কাঁটা চলে ভারতীয় সময় থেকে দেড় ঘন্টা এগিয়ে। প্রায় মধ্যরাত হবে ঘুম ভাঙল। ঘোষণা হচ্ছে আমরা পৌঁছে গেছি। জানালার পাশে বসেছিলাম, দেখলাম আলোর মালা ঝিকমিক করছে। একটু পরেই তান সন নাঠ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (Tan Son Nhat) অবতরণ করল বিমানটি।
সব কিছু সারতে সারতে বেশ খানিকটা সময় গেল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর আমাদের স্বাগত জানাল সাইগন শহরের গাইড একটি তরুণী। আমাদের ইংরেজি উচ্চারণ যেমন ভারতীয়, তেমনই গাইডের ইংরেজি উচ্চারণ ভিয়েতনামী। তবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তার বেশ না বোঝার মত কিছুটা লম্বা নাম। সে সেটাকে ছোট করে দিল নিজেই। বলল — তোমরা আমাকে ‘কিম” বলেই ডেকো। সাদা লম্বা ভারি সুন্দর দেখতে একটি টুরিস্ট বাস এলো। সবাই উঠলাম। কিম তখন কথা বলতে শুরু করেছে। সাইগন শহরের তাপমাত্রা নিয়ে এবং তার ইতিহাসের ব্যাপারে টুকিটাকি কথা বলতে বলতেই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ওখানে পৌঁছে হোটেলের লাউঞ্জে বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা। প্রত্যেককে রুমের চাবি দেওয়া হলো এবং আমরা নিলাম ওয়াই ফাই এর পাসওয়ার্ড। আমাদের বত্রিশ জনের টিম। কিম বলে গেছে আগামীকাল সকাল সাড়ে আটটায় বেরিয়ে যেতে হবে। বেশ গরম। তাপমাত্রা দেখলাম সর্বোচ্চ বত্রিশ সর্বনিম্ন ছাব্বিশ। পুরোদমে এসি চালাতে হলো।
পরদিন সকালে উপাদেয় ও সৌজন্যমূলক প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। বাসের অপেক্ষায় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। আমি তখনও জানি না সাইগন সিটির আরেক নাম কি হো চি মিন সিটি? কিম এসে গেছে একেবারে সময়মত। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম — দুটো নামেই কি একই শহর? সে বলল — হ্যাঁ এইরকম প্রশ্ন তোমার মনে উঠতেই পারে। আমি বাসে সব বলব। যদিও ইটিনারিতে লেখা ছিল আমরা প্রথমে যাচ্ছি হো চি মিন সিটি, তারপর ডে নাং, তারপর হ্যানয়।
বাস রওনা দিল বাঁশবাগানের দিকে( bamboo village)। “বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই”… না, চাঁদ দেখা হবে না। কারণ সেটা সকালবেলা। এদিকে কিম বলতে শুরু করেছে। এই ফাঁকে একবার স্বীকার করেই ফেলি ভিয়েতনাম ভ্রমণের যেসব দৃশ্য, মানুষ এবং ছোটখাটো ছবি যা মনের ভেতর ঠাঁই করে নিয়েছে সেসব জায়গাতেই আলোকপাত করব। তাই মনে হতে পারে এটা কি ভ্রমণকাহিনি? না কি গল্প? তবে মূল থেকে নিশ্চয়ই সরবে না আমার কলম। তাই আগেভাগেই এই লেখা যাঁরা পড়বেন তাঁদের কাছে এবং অবশ্যই মাননীয় সম্পাদক মহাশয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মূল কথায় আসি। কিম বলছে ভিয়েতনাম নিয়ে। ভিয়েতনামের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ নিয়ে। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়ে কিম্বা প্রথম যৌবনে একটা শ্লোগান কানে আসতো — “আমার নাম, তোমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।” সেটা সত্তরের দশক। একটা উত্তাল আবহাওয়া চারপাশে। ১৯৭৫ সালে কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম স্বাধীনতা অর্জন করে। যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সাথে। এরপর কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম সংযুক্ত হয় এবং বৃহত্তর ভিয়েতনাম দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিয়েতনামের ইতিহাস অনেকেই জানেন। এর আগে ভিয়েতনাম ফরাসিদের দখলে ছিল। সুতরাং ফরাসিদের প্রভাব তাদের স্থাপত্যে রয়ে গেছে। তাদের লিপিও রোমান alfabet এ লেখা।
ভিয়েতনামের গাইডরা অভিজ্ঞতায় ভরপুর, পর্যটকদের কী করে মনোরঞ্জন করা এবং দেশের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া যায় তাতে তারা সিদ্ধহস্ত। কিম মেয়েটি খুব মিষ্টি। ওর কথা বলার ভঙ্গিমা ও সৌজন্যবোধ চমৎকার। এবার সে বলল — গান শুনবেন? সবাই খুশি। ঠিক ঠিক এবার গান হোক। সে এবার জানতে চাইছে — কি ভাষায় গান শুনতে চাই আমরা? ইংরেজি না কি ভিয়েতনামী ভাষায়? সবাই চাইছে ভিয়েতনামী ভাষায় হোক। প্রথমেই প্রেমের গান। ভাষা যদিও কিছুই বোধগম্য নয়, তবে সুরের মূর্ছনা একটা অন্তহীন ব্যাপার তা দিয়েই হৃদয়ের যোগসূত্র হয়েই যায়। যদিও কিম তার গানের অর্থ বুঝিয়ে বলেছে, তবে মনে হলো সেটারও তেমন কিছু দরকার ছিল না।
ওইসব বাঁশবাগান দেখার উৎসাহ আমার মোটেই ছিল না। বাঁশগাছ দেখেছি বিস্তর। আসামের কাছাড় জেলায় জন্ম আমার আর ওখানেই বেড়ে ওঠা। ওখানে শহরতলিতে, গ্রামেগঞ্জে এদিক ওদিক তাকালেই বাঁশগাছ চোখে পড়ে। ছোটবেলায় তো বিশ্বাস করতাম বাঁশবাগানে ভূত আছে, তাছাড়া বৃষ্টির দিনে বাঁশবাগানের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ে মাটির রাস্তা বিচ্ছিরি রকমের পিছল, বাঁশগাছ ভিজে কেমন যেন গন্ধ ছাড়ে। সে যাই হোক এইপ্রথম চোখে পড়ল ভিয়েতনামী টুপি, আমাদের চা বাগানের শ্রমিকদের প্রায় এরকমই বাঁশের টুপি (ওরা বলত ছপি) ব্যবহার করতো।এরা কী বলে কে জানে। ছবিতে দেখা ভিয়েতনামের বাঁশের গোল টুপি দেখে উৎসাহিত তখন। শুনেছি এই ব্যাম্বু হ্যাট তাদের জাতিগত ঐতিহ্য বহন করে। দেখলাম এক বৃদ্ধা খালের জলে ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরছে। মাথায় অমনি টুপি। রাস্তার আগাছা সাফ করছে কিছু লোক। মাথায় ঐ টুপি।
বাঁশবাগান দেখে ভুল ভাঙল। একই গাছ বিভিন্ন জায়গায় মানে মাটির ধর্ম অনুযায়ী নিজেকে কিঞ্চিত অধিক পরিবর্তন করে মানুষের মতই। মানুষ যেমন তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমতা বজায় সত্ত্বেও গায়ের রঙে, চেহারায়, দৈর্ঘ্যে এবং ভাষায় বিভিন্নতা বজায় রাখে গাছপালার ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। বাঁশবাগানে অন্ধকার তেমন কিছু নেই। দৈর্ঘ্যে খানিকটা খাটো। পাতাগুলো হালকা, বেশ সুন্দর। বাঁশের হস্তশিল্পের ছোট ছোট দোকান। দোকানি সবাই মহিলা। কিম আমাদের কাছ থেকে একটা কথা ভালো শিখেছে — “চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো”। আমাদেরও একটা সৌজন্যমূলক কথা শিখিয়েছিল। যেমন আমরা দেখা হলেই বলি — কেমন আছেন? ভালো তো? মনে হয় সেরকমই কিছু একটা হবে। কিন্তু এখন আর মনে নেই। ভিয়েতনামী ভাষায় “টোন” ব্যাপারটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিম বলেছিল — ওদের যা যা ফল উৎপাদিত হয় তার মধ্যে আছে আম, তরমুজ, ড্রাগনফ্রুট, নারকেল, কলা, কাঁঠাল আরও কিছু নাম না জানা ফল। এখন ধরা যাক “আম” বলতে আম বোঝায়, আবার যদি বলি আ..আ..ম তখন বোঝা যাবে কলা, আবার কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে যদি বলি আ..আম তখন বোঝা গেল ড্রাগনফ্রুট। এটা একটা দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ তাদের শব্দভান্ডার কম, টোনের বা কন্ঠস্বরের ওঠানামা দিয়ে অনেক কিছু বোঝায়। কিম আমাকে ওটা প্র্যাক্টিস করাবার চেষ্টা করেছে। সেই মুহূর্তে কিছুটা পেরেছি বটে।
এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো কেনাকাটার জন্যে বাঁশের হস্তশিল্পের প্রদর্শনীশালায়।
সামনে থেকে দেখতে ছোট মনে হলেও ওটার ভেতর অনেকটাই বড়।
কিম বলল — ওখানে খানিকটা বিশ্রাম পাবেন, একটু চা পান করবেন, কেনাকাটা করবেন, অবশ্যই সেটা আপনাদের ইচ্ছের ওপর।
প্রথমে আমাদের ছোট্ট ছোট্ট গ্লাসে চা দেওয়া হলো। তবে ঠান্ডা চা। স্বাদে গন্ধে একেবারেই আলাদা। তারপর একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সারি সারি চেয়ার সাজানো। বসতে বলা হলো। এক ভিয়েতনামী সুন্দরী এবারে বাঁশের তৈরি নানা ধরনের পণ্যদ্রব্যের ওপর ডেমো দিল। দেখাল বাঁশ থেকে তৈরি তুলো। তুলো থেকে সুতো তৈরি করে কতসব পণ্যদ্রব্য যে তারা তৈরি করেছে তা অবাক হবার মতই। এখানে কেনাকাটা হয় না। অত:পর কেনাকাটার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের প্রদর্শনীশালায়।
এখন আমাদের কারেন্সি সংক্রান্ত কিছু সমস্যা দেখা দিল। ভিয়েতনামের কারেন্সিকে বলে ডং। আমাদের ১ টাকা = ২৯৯.২৬ ডং। এক ডলার = ২৫, ৩৮৫ ডং। সুতরাং সামান্য একটা তোয়ালে কিনতে গিয়ে হাজার লাখের ওপরে দাম শুনে আমরা আঁতকে আঁতকে উঠছি। অতঃপর সেই ব্যাপারটায় পরিষ্কার না হয়ে কিছু কেনা সম্ভব হলো না।
এবার চললাম নারকেল ফ্যাক্টরিতে, নারকেলের দুধ থেকে ক্যান্ডি তৈরি হচ্ছে। টেস্ট করে দেখলাম খুব সুস্বাদু। তিন চারটে তরুণ তরুণী হাতে গ্লাভস মুখে মাস্ক লাগিয়ে তৈরি করছে চকোলেট নারকেল ও তার দুধ দিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কি বিক্রি করবে? ওরা নিরুত্তর। সম্ভবত ভাষা বুঝল না।
এরপর নৌকো করে যাওয়া হলো একটি আইল্যান্ডে লাঞ্চের জন্যে।
বেশ ভালো ভারতীয় খাবার। সেফদের মুখে এই প্রথম হিন্দি শুনলাম। এরা সব ভারতীয়। কাশ্মীরী একজন, একজন রাজস্থানি, একজন গুজরাতি।
এরপর মেকং ডেল্টাতে নৌকো বিহার। মেকং ডেল্টা পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপগুলির মধ্যে একটি। কিম দেখাল ঐদিকে কাম্বোডিয়া। কোনও এক দিগন্তের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল সে অর্থাৎ মেকং নদীর একটা অংশ কাম্বোডিয়াতে (খুব সম্ভব বৃহত্তর অংশ) আর একটা অংশ ভিয়েতনামের সাইগনকে ঘিরে রয়েছে।
নৌকাবিহার শেষ হলো যখন তখন পড়ন্ত বিকেল।নারকেলবীথির মধ্য দিয়ে সরু খাঁড়ির ভেতর দিয়ে নৌকো এলো।
কিম শোনাল এখন চা পান মধু পান এবং কিছু মনোরঞ্জক অনুষ্ঠান রয়েছে। খুব ক্লান্ত সবাই। তাছাড়া নৌকো থেকে ভূমিতে পা রাখার জায়গাটি বেশ বিপজ্জনক। যাই হোক ওখানে পা রেখেই ভালো লাগল। কারণ এক প্রশস্ত জায়গায় খুব সুন্দর বসার ব্যবস্থা। যেন এক বড়সড় রেঁস্তোরা। যদিও সেটি রেঁস্তোরা নয় সম্ভবত, কারণ ওখানে কিছু ট্যুরিস্ট ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। বসে বেশ ভালো লাগছিল। পাশে তরতর করে বয়ে যাচ্ছে মেকং নদী। ঝলমলে ট্যুরিস্টরা ছবি তুলে চলেছে, এই সময়ে কিম ডাকল উঠে আসার জন্যে। সামনের হলঘরে আমাদের দিব্যি আপ্যায়ন করে বসানো হলো। তারপর চায়ের আস্বাদন মধুর আস্বাদন ইত্যাদি। সামনে কিছু পণ্য রাখা হলো খরিদারি করার জন্যে। অত:পর এই হলঘর ছেড়ে নিয়ে যাওয়া হলো সামনের বাঁশের তৈরি বাহারি এক হলঘরে। গান চলছে, এক প্রবীণ গাইছেন। সাথে টকটকে লাল পোশাকে নেচে চলেছে একদল তরুণী। পশ্চিমী পর্যটকদের বড় একটি দল বসে আছে। আমাদেরকে বসানো হলো অপর পাশে। এখানে বলে রাখি ওদের চা কফি আমাদের মতো নয়। গরম কফি কোথাও মেলে না। হালকা গরম আর রোস্টেড কফি। আমরা গরম চা কফি হোটেলের রুমেই পান করেছি নিজেদের মত করে।
চা কফি পান করার নিদারুণ ইচ্ছে তখন। এলো ফল। অত:পর ইচ্ছে দমন। তবে খুব সুস্বাদু তরমুজ, পেয়ারা, ড্রাগন ফ্রুট। ওতেই ক্লান্তি অনেকটা অপনোদন হলো। এরপর সেই প্রবীণ ভদ্রলোক আমাদের দিকে চলে এসে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে গান ধরলেন। লাল পোশাকের মেয়েরা এসে নাচতে শুরু করল।
তারপর যা হয়, টিপস্।
হ্যাঁ, এই ঋতুতে পর্যটকরা ঘুরতে আসে। বেশির ভাগই পশ্চিমাগত। মনে হলো যত পর্যটক আসে তার মধ্যে শতকরা নব্বইভাগ সাগরপারের মানুষ। কারও কারও সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে। এরা ছিল জার্মানির ও অস্ট্রেলিয়ার।
এরপর আবার শপিং সেন্টার। ফুটপাতে কোনও দোকান নেই। যেটা আছে তা ভিউ পয়েন্টগুলোতে।
আমাদের একটা শপিং সেন্টারে নামিয়ে দেওয়া হল।অত:পর কেনাকাটা। ডলার, রুপি, টাকা এবং আরও আরও দেশের কারেন্সির সাথে ডং এর বিনিময়। পরস্পর শুনে গিয়েছিলাম ওখানে জিনিসপত্রের দাম বেশ কম। তবে সর্বত্রই পর্যটন ক্ষেত্রে একটু দাম বাড়িয়ে রাখা হয়। নিজের দেশেই দেখতে পাই। সুতরাং পর্যটনের ঋতুতে দেশটি আর্থিকভাবে আরও সমৃদ্ধ ও সবল হয়ে থাকে কিম্বা হচ্ছে তা বলতে বাধা নেই।
রাতে ডিনার সেরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। আগামীকাল আরও প্রোগ্রাম রয়েছে এবং রাতে ডে নাং শহরে যাবার ফ্লাইট।
ঘুমে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তেও পড়তেও ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম। আগামীকাল ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ট্যুরিস্ট বাসের পেটের ভেতর সবার লাগেজ থাকবে, দিনশেষে সেগুলো বিমানবন্দরের দোরগোড়ায় রেখে দিয়ে বাস টা টা দেবে। সুতরাং এতো ঘোরাঘুরির পরও সব গোছগাছ সেরে রাত দুটোয় বিছানায় গেলাম।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর চেক আউট। লাউঞ্জে ভিড়। বত্রিশ জনের ব্যাগপত্র চাবি জমা দেওয়া হ্যানাত্যানার পর গাড়ি এলো। এদিকে কিম বলছে — চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো। কখনও “তাড়াতাড়ি” “তাড়িতাড়া” হয়ে যাচ্ছে। তাতে কি! হৃদয় যখন কথা বলে তখন পৃথিবীর তাবৎ ভাষাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো প্রথমে মিউজিয়ামে। বিখ্যাত হো চি মিন মিউজিয়াম। ভেতরে ঢুকে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে পড়লাম। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে দেখে ভাবছি এটাই সত্য মানুষ জীবনের? এটাই বাস্তবতা? মানবতা মনুষ্যত্ব এগুলো বুঝি শুধুই কাগজেপত্রে? শুধুই শিল্পে সাহিত্যে? সভা সমিতিতে? ছোটবেলায় ইতিহাসে শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়েই তো পড়েছি। আবার প্রাচীন মহাকাব্যগুলিতে যুদ্ধ বিগ্রহই প্রধান। কী ভয়াবহ এই মানবজীবন। আবার কিম যখন বলে — “তাড়িতাড়া চলো” তখন মনে হয় কী সুন্দর এই জীবন। কিন্তু ভয়াবহতা আসে হঠাৎই। মানুষের দাঁত নখ তখন বেরিয়ে পড়ে। মিউজিয়ামে ছবি তোলার অনুমোদন রয়েছে। তাই কিছু ছবি তুলে নিলাম।
আমাদের পরের গন্তব্য ইন্ডিপেন্ডেন্স প্যালেস, শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ এবং অপেরা হাউস। ওসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসা হলো। রাতে ডে নাং সিটির ফ্লাইট। সময় হাতে কম। কিমের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওর আন্তরিক চমৎকার ব্যবহার ভুলতে পারব না হয়তো কখনই। (ক্রমশ)