bich dong প্যাগোডার তিনটি ধাপ আছে। মনে করা হয় প্রথমে এই প্যাগোডাটি পাহাড় চূড়ায় ছিল, সম্ভবত ১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে রাজা Le Du Tong আরও কয়েকজন ভিক্ষুর সম্মেলনে ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্যাগোডাকে তিন ধাপ বিশিষ্ট করা হয়। প্রাচীনতম গুহায় যেতে হলে ১২০টি ধাপের সিঁড়ি ভাঙতে হয়।
প্যাগোডা দর্শন শেষ হওয়ার পর ল্যাম বলল আবার নৌকোবিহার করতে হবে। বলতেই হবে এত নৌকোবিহার জীবনে কখনও করিনি, আর যেটুকু উদ্বৃত্ত জীবনকাল রয়েছে, আর যদি একটি বারও নৌকোবিহার না-ও করি কোনও আফসোস থাকবে না। যারা নৌকো চালায় তাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা অধিক বলে মনে হলো। নৌকোচালক মহিলা বেশ কিছুদূর নিয়ে আবার ফিরিয়ে এনে এক কচুবনের কাছে নৌকো লাগিয়ে দিল। দেখলাম সব নৌকোকে এভাবেই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এইবার মহিলাটি বেশ বড় সাইজের এক বোঁচকা খুলে হস্তশিল্প এর কিছু সম্ভার বের করে কিনবার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল। একটা ছবি কিনলাম। একেবারেই খেলো পণ্য। হাতব্যাগ ইত্যাদি সবগুলোর একই অবস্থা। একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে সাধারণ মানুষের চরিত্রে। ওরা যেমন সহজ সরল তেমনই রাগী। এখানে এসেছ তাহলে আমাদের সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল কিছু নিয়ে যাও, না নিলে গোল্লায় যাও। এমনই একটা ব্যাপার। হো চি মিন এর মার্কেটেও এই ব্যাপারটা দেখেছি। কেউ কেউ দরাদরি করে। কেউ কেউ বিলকুল নয়। একবার দু’বার কথা বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই নৌকোচালক মহিলা চাইছিল আরও কিছু কিনি হয়তো, ভ্রূ কুঁচকে গেল, যাই হোক নৌকো বিহারের পর কিছু ডলার ছাড়তে হলো।
এখন আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হ্যানয়ের বিশেষ ট্রেন দেখাতে। বাস থেকে একটা ন্যারো গেজ ট্রেন লাইন দেখেছিলাম। এইটি আসলে ট্যুরিস্ট দের জন্যে একটি বিশেষ ভিউ পয়েন্ট এবং একটা বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। একটা ন্যারো গেজ এর লাইনে এই ট্রেন চালু করেছিল ফরাসিরা ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে। এই ট্রেন লাইনের একেবারে গাঁ ঘেঁষে মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট। যখন ট্রেন আসে তখন তাড়াতাড়ি সব গুটিয়ে নেওয়া হয়। এই দৃশ্য আমি আগে এই ছোট্ট মোবাইলে বেশ কয়েকবার দেখেছি। অনেকেই হয়তো দেখে থাকবেন। এবার সামনে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ দেখলাম। বেশ একটা হৈ হৈ ব্যাপার। এবং এইটা একটি ভালো বাণিজ্যকেন্দ্রও বটে। হ্যানয়এর ট্রেন স্ট্রিট। যাবার আগেই গাইড বলল — ওখানে এক কাপ কফি খেতে হবে। নাহলে বসবার চেয়ার পাওয়া যাবে না, দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কফি খেতে তো খুবই ইচ্ছে, কিন্তু ওগো প্রিয় ল্যাম, তোমরা এই শীতে হাফকাপ ঈষদুষ্ণ কফি খেয়ে কি আরাম পাও বলো তো। কিন্তু এসবই স্বগতোক্তি। “আপ রুচি খানা”, সুতরাং। ট্রেন স্ট্রিটে রেললাইনের দুদিকে ছোট ছোট কাঠের চেয়ার টেবিল বসিয়ে ভিড়ে ভিড়াক্কার। কফি সফট ড্রিংকস এবং মদ দেদার বিক্রি হচ্ছে। গার্ল ফ্রেন্ড বয় ফ্রেন্ড সহযোগে এমনিতেই রাতের হ্যানয়ের চেহারা বিলকুল পালটে যায়। শুধু ট্যুরিস্ট নয়, ভিয়েতনামের ছেলেমেয়েরাও জীবন উপভোগ করে এভাবেই। প্রতিটি রেস্তোরাঁর সামনেই পথের পাশে পাশ্চাত্য কায়দায় চেয়ার টেবিল বের করে দেদার হৈ হুল্লোড় চলে। তবে ব্যাপারটা হো চি মিন সিটিতে কিছুটা কম দেখেছি। হো চি মিন সিটিতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও কিছুটা কম। লাখে লাখে বাইক চলে। ডে নাং এবং হ্যানয় থেকে হো চি মিন সিটি চরিত্রে যেন কিছুটা আলাদা।
যাই হোক প্রসঙ্গে আসি। হাফকাপ ঈষদুষ্ণ কফি এলো। অতঃপর হুলুস্থুল, ট্রেন আসছে। ঝটপট দোকানপাট গুটিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে, একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানো। উপায় নেই, জায়গা নেই, ২০১৯ এ নাকি এখানে এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেজন্যে কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল এই ট্রেন। আবার চালু করা হয়েছে স্থানীয় মানুষের দাবিতে। কারণ চা কফি মদ সফট ড্রিংক বিক্রিবাটা না হলে সবার পেটে হাত। সুতরাং আবার চালু হয়েছে ট্রেন। দিনে দুবার চলে। হ্যানয় টু হো চি মিন সিটি। ট্রেনের কুউউ শোনা যাচ্ছে। আরেকটু সরবো কি? উঁহু, একেই বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া! ট্রেন এলো। বেশ দেখতে সে। মোটেই ফরাসি সাম্রাজ্যের পুরনো ট্রেন নয়। বেশ নতুন, পরিচ্ছন্ন এবং পুরোটাই বাতানুকূল। ভেতরে যাত্রী আছে, তেমন বেশি নয়। সামনের কম্পার্টমেন্ট প্রায় খালিই। হ্যাঁ অবশ্যই ব্যতিক্রমী কিছু দেখলাম।
এরপর ট্রেন এলো, চলেও গেল। ছবি তোলা সম্ভব নয়। আগে তো বাবা প্রাণে বাঁচি। আমরা এখন চলেছি ডিনার সারতে। আগামীকাল সকালেই হে লং বে যাত্রা।
ব্রেকফাস্ট সেরেই যাত্রা। তাই একটু তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ব্যাগ গোছানো। আজ রাত কাটাব ক্রুজে।।
আগামীকাল রাতে কলকাতা ফেরার ফ্লাইট। আগামীকালটা মনে হচ্ছে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। সকালে ব্রেকফাস্ট এর পর একটা নৌকোবিহার আছে, ঐ গুহার ভেতর দিয়ে যাওয়া। তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাসের পেটে ঢুকিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি, মাঝে লাঞ্চ, তারপর ঘোরাঘুরি সেরে ডিনার সেরে মাঝরাতে উড়ান কলকাতার উদ্দেশ্যে। বেশ কঠিন হতে পারে। যা হোক সময় বলে আমার সাথে চলো। আর অতীত ভবিষ্যত ছেঁটে দাও। আর পরখ করে দেখা গেছে ব্যাপারটা সত্যিই সঠিক, আমি এইমুহূর্তে বেঁচে আছি তার চাইতে উপভোগ্য আর কিছু হতেই পারে না। তো চলো।
সুতরাং ব্রেকফাস্ট সেরে, ও হ্যাঁ এই সৌজন্যমূলক প্রাতরাশ সম্পর্কে কিছু তো বলতেই হবে। সর্বত্র তা অত্যন্ত উপাদেয় এবং স্বাস্থ্যকর ছিল।
হয়তো তার জন্যেই দিব্যি ভালোই ছিল সকলেই। সকালের খাবার ভালো হলে আর কীসের ভাবনা! কথায় বলে – প্রাতরাশ হোক রাজার মতো, মধ্যাহ্নভোজন যুবরাজের মতো, নৈশ আহার হোক ভিক্ষুকের মতো। যাকগে, ধান ভানতে শিবের গীত আপাতত তুলে রাখি।
চললাম হা লং বে। আপাতত নতুত্বের হাতছানিতে সবাই উদ্বেল।
হা লং বে হ্যানয় থেকে প্রায় ১৭৭ কিলোমিটার দূরত্বে। বাসে গান কবিতা চুটকি গল্পের আসর সেরে আমরা পৌঁছোলাম যখন তখন বেলা বারোটার কাছাকাছি হবে। ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছে আমাদের টিম এবং একটি অস্ট্রেলিয়ান টিম। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে ক্রুজ। বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হলো।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, অপেক্ষা বস্তুটা বিশেষ বিশেষ সময়, সময়কে ভারগ্রস্ত করে। নাহলে তো তরতর করে সময় গড়িয়ে যায়, বুঝতেই পারা যায় না। বিশেষ কিছু করার নেই। সামনে বিপুল স্বচ্ছ নীলাভ জলস্রোত। মাঝে মাঝে চুনাপাথর এর পাহাড়। এক অভূতপূর্ব প্রেক্ষিত, অনাস্বাদিত অনুভূতি। হা লং বে উত্তর ভিয়েতনামের কুয়াংনি প্রদেশে রয়েছে। হা লং একটি শহরের নামেই এর নাম হয়েছে হা লং বে। লোকজীবনের বিশ্বাস তাদের পবিত্র ড্রাগন স্বর্গ থেকে প্রথম এই উপসাগরেই অবতরণ করেছিল। একটু পরপরই চুনাপাথরের পাহাড়। মনে করা হয় এই পাহাড়গুলি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে কোটি কোটি বছর আগে। এখানে অনেকগুলো দ্বীপ রয়েছে, শোনা গেল ভাসমান গ্রামও নাকি রয়েছে, যেখানে প্রধানত জেলেরা বাস করে।
যাই হোক সময় কাটছে না। সবাই মিলে অস্ট্রেলিয়ার টিমের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে।
উপরের ছবিতে কালো টি শার্ট পরা ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করল কলকাতায় তার এক বন্ধু আছে, নাম বলল। জিজ্ঞেস করল তাকে কি আমরা চিনি? তাই নিয়ে কিছু সময় দিব্যি কেটে গেল। আমাদের টিমে কেউ কি তাকে চেনে? ধরা যাক তার নাম উজ্জ্বল উপাধ্যায় (নাম মোটেই মনে নেই এখন)। সে কি করে? সে কি কোনও স্বনামধন্য লোক? লোকটি বলল — হি ইজ আ ডক্টর। বেশ, তাকে নাহয় একবার খুঁজে দেখা যেতে পারে। আপাতত সময় খানিকটা কাটল। এরপর পাশের ফেরিতে দুটি চটপটে তরুণী ছোট ছোট নেটের জাল দিয়ে চটপট চিংড়ি মাছ ধরছে। দাঁড়িয়ে খানিকটা দেখলাম। ছোট ত্রিভুজাকৃতি যে হাত – জাল থাকে সেগুলো ফেলে দিয়ে মাছ ধরছে। যতবার ফেলছে ততবারই চিংড়ি মাছ উঠে আসছে। দারুণ দৃশ্য।
এখন দেখা গেল দুটো ফেরি আসছে। অতঃপর! একটাতে আমাদের টিম, আরেকটাতে অষ্ট্রেলিয়ার টিম। টা টা দিয়ে ভাসলাম। জোর খিদে পেয়েছে। অনেকটা দেরি হলো। ভেতর দিকে ভেসে চলেছি। স্বচ্ছ নীল জল, মাঝে মাঝে চুনাপাথরের পাহাড়। (ক্রমশ)