মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি অভিহিত হয়েছে জয়া একাদশী বা ভীষ্ম একাদশী নামে। শ্রীগরুড়পুরাণে এই একাদশী তিথিকে ‘ভৈমী’ একাদশী নামে অভিহিত করা হয়েছে।
যে একাদশী দেবী তার পদাশ্রিত একনিষ্ঠ সাধক বা ভক্তকে সাধন পথের বাধা অতিক্রম করার শক্তি দিয়ে অন্তিমে বৈকুন্ঠলোকে পৌঁছে দেন, তিনি হলেন শ্রীশ্রী জয়া একাদশী দেবী।
হিন্দুধর্মে জয়া একাদশীর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনে জগতের রক্ষাকর্তা, সর্বপাপবিনাশীনি ভগবান বিষ্ণুর পুজো করা হয়। কথিত আছে যে, এই দিনে শুভ মুহুর্তে পুজো করলে জীবনের সমস্ত পাপ ও দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই ব্রতের ফলে মানুষ কখনও প্রেতত্ব প্রাপ্তি হয় না । এবার জয়া একাদশী কবে, পারণের সঠিক তারিখ এবং পুজোর শুভ সময় জেনে নিন।
হিন্দু বৈদিক পঞ্জিকা অনুসারে, মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি ৭ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ৯টা ২৬ মিনিটে শুরু হবে এবং ৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাত ৮ টা ১৫ মিনিটে তিথি শেষ হবে। উদয় তিথি অনুসারে, এবার জয়া একাদশীর উপবাস ৮ ফেব্রুয়ারি পালন করা হবে।
পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, একাদশীর পারণ পরের দিন অর্থাৎ দ্বাদশী তিথিতে পালন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে, ৯ ফেব্রুয়ারি,
রবিবার জয়া একাদশী উপবাস এর পারণ পালন করা হবে। পারণের শুভ সময় সকাল ৭টা ০৪ মিনিট থেকে ৯টা ১৭ মিনিট পর্যন্ত হবে। এই সময়ের মধ্যে উপবাস ভাঙা যেতে পারে।
ব্রতকথা :
পদ্মপুরাণ অনুসারে, পুরাণের কালে কোন এক সময় পঞ্চাশ কোটি গন্ধর্বদের নেতা এবং দেবতাদের বীর রাজা ইন্দ্র তাঁর পারিজাত বৃক্ষে ভরা নন্দনবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি বিশাল উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।সেখানে সকল দেবতা, সিদ্ধগন ও ঋষিদের মনোরঞ্জন করার জন্য গন্ধর্ব পুরুষ ও গন্ধর্ব কন্যারা নৃত্য করছিলেন।
এই উৎসবে, গন্ধর্বরা সুরেলা সুর গাইছিলেন। তাদের মধ্যে প্রধান শিল্পী ছিলেন চিত্রসেন, পুষ্পদন্ত এবং তার পুত্র। চিত্রসেনের স্ত্রীর নাম ছিল মালিনী এবং তার গর্ভে পুষ্পবন্তী নামে পরিচিত এক কন্যার জন্ম হয়। গন্ধর্ব পুষ্পদন্তের মাল্যবান নামে এক পুত্র ছিল। মাল্যবান পুষ্পবন্তীর সৌন্দর্যে গভীরভাবে মোহিত হয়েছিলেন। তারা দুজনেই ভগবান ইন্দ্রের সন্তুষ্টির জন্য রাজসভায় নৃত্য করতে এসেছিলেন।
স্বর্গীয় অপ্সরাদের সাথে গান গাইতে গাইতে এবং নৃত্য করতে করতে, তাঁদের পারস্পরিক আকর্ষণ আরও গভীর হয় এবং তারা একে অপরের প্রতি মোহিত হয়ে পড়ে। তাদের মন বিভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ফলে গানের ক্রম বিপর্যয় ঘটল। তাদের এইরখম তাল- মান ভঙ্গভাব দেখে তারা যে পরস্পর কামাসক্ত হয়েছে, দেবরাজ ইন্দ্র তা বুঝতে পারলেন।
তখন ক্রোধবশে তিনি তাদের অভিশাপ দিলেন — ‘রে মূঢ়! তোমরা আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছ। তোমাদের ধিক! এখনই তেমারা পিশাচযোনী লাভ করে মর্ত্যলোকে নিজ দুষ্কর্মের ফল ভোগ কর।’
ইন্দ্রের অভিশাপ পাওয়ার পর, তারা উভয়েই অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করে। এরা দুজনেই ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তারা হিমালয় পর্বতমালায় চলে যায় এবং পাহাড়ের গুহায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। পিশাচত্ব প্রাপ্ত হওয়ায়, হিমশীতল পরিবেশের শারীরিক অস্বস্তিতে যন্ত্রণা ভোগ করে। হিমালয়ের প্রচন্ড শীতে কাতর হয়ে নিজেদের পূর্বপরিচয় বিষ্মৃত হল।
একদিন, তাদের যন্ত্রণার মাঝে, পুরুষ রাক্ষস তার রাক্ষসী স্ত্রীকে বলল, “আমরা এমন কোন পাপ করেছি যার ফলে আমাদের এই দুর্দশাগ্রস্ত পিশাচ অস্তিত্বে প্রাপ্ত হয়েছে? এই যন্ত্রণা নরকীয় এবং অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং এই পিশাচ যোনি অনেক কষ্ট নিয়ে আসে। অতএব, আমাদের আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হতে হবে এবং পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।”
এইভাবে খুবই দুঃখ কষ্টের মধ্যে তাদের দিনগুলো কাটছিল। মাল্যবান ও পুষ্পবন্তীর পূর্ব কোন পুন্যবশত সেই সময় মাঘী শুক্লপক্ষীয় ‘জয়া’ একাদশী তিথি উপস্থিত হল, যাকে সকল তিথির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। সেই দিন, তারা সকল ধরণের খাদ্য ত্যাগ করেছিল, এমনকি জলও বর্জন করেছিল। তারা কোনও জীবের ক্ষতি করা থেকে বিরত ছিল, এমনকি গাছের ফলও না। ক্রমাগত দুঃখে জর্জরিত হয়ে তারা একটি অশ্বত্থ বৃক্ষতলে বসেছিল।
সূর্যাস্তের সাথে সাথে, প্রাণঘাতী সত্ত্বার নিঃশ্বাসে ভরা সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি ঘনিয়ে এল। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুম এড়িয়ে উভয়ে সারারাত শ্রী হরির ভজন করতে থাকে। পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে দ্বাদিশী তিথি উপস্থিত হল। ভগবান বিষ্ণু প্রসন্ন হয়ে তাদের আশীর্বাদ দিলেন। এই ব্রতের প্রভাব এবং ভগবান বিষ্ণুর ঐশ্বরিক শক্তির কারণে, তাদের পিশাচ অবস্থা দূর হয়ে গেল।
পুষ্পিত বাগানে, পুষ্পবন্তী এবং মাল্যবান তাদের পূর্বের রূপে ফিরে এলেন। তাদের হৃদয়ে, সেই পুরনো স্নেহই ফুটে উঠছিল। তাদের দেহে ইতিমধ্যেই শোভা পাওয়া অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে, তারা একটি স্বর্গীয় রথে বসে, মোহময় রূপ ধারণ করে স্বর্গরাজ্যের দিকে উড্ডয়ন করলেন।
সেখানে, দেবরাজ ইন্দ্রের সামনে, তারা অত্যন্ত আনন্দের সাথে উপস্থিত হলেন এবং শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন।
তাদের এই দিব্য রূপে দেখে ইন্দ্র অত্যন্ত অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে বলো, কোন পুণ্যের প্রভাবে তোমরা দুজনেই তোমাদের আসুরিক অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছ? তোমরা আমার অভিশাপের অধীনে ছিলে, আর এখন, কোন দেবতা তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন?”
মাল্যবান বললেন, “প্রভু! ভগবান বাসুদেবের কৃপায় এবং জয়া নামক একাদশী ব্রত পালনের ফলে আমাদের আসুরিক যন্ত্রণা দূর হয়েছে।”
তাদের কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র বললেন হে মাল্যবান তোমরা এখন থেকে আবার অমৃত পান করো। একাদশী ব্রতে যাঁরা আসক্ত এবং কৃষ্ণভক্তি পারায়ন তাঁরা আমাদেরও পূজ্য বলে জানবে। এই দেবলোকে তুমি পুষ্পবন্তির সাথে সুখে বাস কর।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই ব্রত সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, “হে রাজা!একাদশী উপবাস পালন করা উচিত। জয়া উপবাস ব্রহ্মহত্যার (ব্রাহ্মণ হত্যা) পাপও ধৌত করে। যে ব্যক্তি জয়া উপবাস পালন করে সে সকল প্রকার দান করেছে এবং সমগ্র যজ্ঞ সম্পন্ন করেছে। এই উপবাসের মহিমা পাঠ এবং শ্রবণ করলে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল লাভ হয়।”
পালন : একাদশীর দিন সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পরিষ্কার হলুদ পোশাক পরিধান করে ঈশ্বরের আরাধনা করতে হবে। একটু উঁচু জায়গায় লাল কাপড় পেতে ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর ছবি রেখে তার সামনে ধুপ, প্রদীপ জ্বালিয়ে, নৈবেদ্য অর্পণ করে মন্ত্র জপ ও পুজো করতে হবে। ভগবান বিষ্ণু কে হলুদ ফুল চন্দন অর্পণ করার পাশাপাশি ঘরে বানানো মিষ্টি, ফল, জল অর্পণ করতে হবে।এরপর বিষ্ণুসহস্র নাম জপ করে আরতি। পরের দিন সূর্যোদয়ের আগে স্নান এবং ধ্যান করে ভঙ্গ করতে হবে উপবাস।
জয়া একাদশীতে খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ কিছু নিয়ম রয়েছে, যা পালন করা অত্যন্ত জরুরি। এই একাদশী ব্রতর সুফল পেতে হলে এই নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক। এই তিথিতে লাল আলু, দুধ, দই, ফল খেতে পারেন। নারায়ণকে পঞ্চামৃতর ভোগ নিবেদন করুন। তার পর সেটি প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করুন। জয়া একাদশী ব্রতর সময় বাইরের মিষ্টি ও খাওয়ার-দাওয়ার খাবেন না।
শাস্ত্র মতে জয়া একাদশীতে ভাত খাওয়া নিষিদ্ধ।নুনও খাবেন না। এ ছাড়াও পেঁয়াজ, রসুন, মুসুর ডাল খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
জয়া একাদশীর তাৎপর্য : জয়া একাদশীর উপবাস ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। বিশ্বাস করা হয় যে, এই উপবাস পালন করলে একজন ব্যক্তির জীবন থেকে রোগ দূর হয় এবং তিনি সুস্বাস্থ্য লাভ করেন।
এছাড়াও এই উপবাসের মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি পাপ থেকে মুক্তি পান এবং বৈকুণ্ঠ ধাম অর্জন করেন। এছাড়াও, জয়া একাদশীর নাম থেকেই বোঝা যায় যে এই উপবাস একজন ব্যক্তিকে তার সমস্ত কাজে বিজয়ী করে তোলে।
চমৎকার একটা লেখা পড়লাম।