বসন্ত মানে সুর ফিরে পাওয়া কোকিল কন্ঠ, বসন্ত মানেই দোল। আবিরে ভেসে যাওয়া রঙের খেলা, বাঙালির ইতিহাসে যা শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যে লীলায় শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান বিষ্ণু আর শ্রীচৈতন্য কেউই পৃথক নন।
চৈতন্যদেব জন্মেছিলেন দোল পূর্ণিমায় এবং বাংলাদেশে দোলযাত্রার সূচনা করেছিলেন তিনি। বঙ্গের পর কলিঙ্গ, তারপর বৃন্দাবনেও মহাপ্রভুর সরাসরি যোগদানে এই দোল উৎসব রূপ-বৈচিত্র্যে আরও গভীরতা পেয়েছে।
আজ থেকে প্রায় ৫১৫ বছর আগে প্রেম পুরুষোত্তম শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবন ধাম যাত্রা করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার দুই পার্ষদ। ৫০০ বছর আগে সেই যাত্রা পথ ছিল দুর্গম, বিপদসঙ্কুল। সেই দুর্গম যাত্রা পথে সর্বত্রই মহাপ্রভু তার অলৌকিক লীলা প্রদর্শন করেছিলেন। বনের হিংস্রবাঘ তার ‘হরিনাম’ শুনে প্রভুর চরণে লুটিয়ে পড়েছিল। মত্তহাতি বশ মেনে ছিল মহাপ্রভুর। পথের দস্যুরা ডাকাতি করতে এসে মহাপ্রভুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। আর যাত্রাপথে কাশীধাম মাতিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমরসে। আজকের প্রচ্ছদে রয়েছে বৃন্দাবন যাত্রাপথে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের অলৌকিক লীলা কাহিনী।
প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ে অরাজকতা-অনাচার অত্যাচার নৈরাজ্য ঘিরে ফেলেছিল গোটা সমাজকে। সমাজের এই ঘোর দুর্দিনে শ্রীচৈতন্যদেব তার বিশ্বধ্বনিত শঙ্খনিনাদ করে প্রেম ধর্মের শান্ত শীতল ছায়ায় দুঃখিত তাপিত নরনারীকে আশ্রয় দিয়ে ধন্য করেছিলেন। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিন্তাধারার এক নব উন্মোচন ঘটিয়ে, হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার আন্দোলনে নেমেছিলেন শ্রী চৈতন্যদেব। করেছেন কাজি দমন। তার সেই আন্দোলনের মূলে ছিল ধর্ম অবশ্যই সেই ধর্ম মানবমুখী। এই ধর্ম গনধর্ম।তিনি ছিলেন বঙ্গের প্রথম জননেতা।
ভারত সংহিতার প্রয়োজনেই তিনি কূর্মক্ষেত্র থেকে কন্যাকুমারী, মহারাষ্ট্র থেকে মথুরা বৃন্দাবন, গৌড় থেকে গুজরাট, বারানসি থেকে প্রয়াগ সর্বত্র প্রেমের শতধারায় মানুষকে অভিষিক্ত করেছিলেন। পথে প্রান্তরে দিক দিগন্তে নির্যাতিত মানুষকে আলিঙ্গন দান করে বিলিয়ে দিয়েছিলেন অনন্য স্মরণ হরিনাম। এমনকি বন্যপশুপাখি তরুলতাও তার অপার করুণা লাভে কৃতার্থ হয়েছিল।
শ্রী চৈতন্যদেবের অবদানে বৈশিষ্ট্য সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল তার অতীন্দ্রিয় দর্শনের দ্বারা রাধাকৃষ্ণের দিব্যমাধুরীর সঙ্গে জড়িত নিত্যলীলাভূমি বৃন্দাবনের বহু লুপ্ত স্থান উদ্ধার করে লীলা ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করা। নবদ্বীপচন্দ্রের এই বৃন্দাবন যাত্রার সুদীর্ঘপথে দেখা গিয়েছে নানান রোমাঞ্চকর ও পরম আশ্চর্য সব ঘটনা।
জননী ও জাহ্নবীকে দর্শন করে গোরাচাঁদ গৌড় থেকে নীলাচলে ফিরে এলেন।তিনি এসেছেন শুনেই নীলাচলবাসী ছুটে এলেন তার কাছে। কিছুদিন পুরীতে থাকার পর বর্ষা কাটতে তিনি বৃন্দাবন যাবেন বলে ঠিক করলেন। প্রভুর মুখে বৃন্দাবন, যমুনা আর কৃষ্ণ ছাড়া তখন আর অন্য কথাই ছিলনা। সর্বদাই তিনি মলিনবদন,বাষ্পপূর্ণ নেত্রে বৃন্দাবন ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকতেন।
তাঁর অনুরাগীরা বিনীতভাবে বৃন্দাবনের না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন, তাঁকে আটকে রাখার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করেন। রাজা প্রতাপরুদ্র (পুরীর রাজা) এবং অন্যান্য ভক্তরা বর্ষাকাল এবং আসন্ন রথযাত্রা উৎসবের কারণ উল্লেখ করে মহাপ্রভুকে সেখান থেকে যেতে নিষেধ করেন। শ্রীচৈতন্যদেব বর্ষাকাল এবং রথযাত্রার পরে বৃন্দাবন যাত্রার জন্য মনস্থির করলেন।
তীর্থযাত্রায় বেশী লোক সঙ্গে থাকলে ভগবত চিন্তার একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়, তাই মহাপ্রভু বৃন্দাবনে একাকী যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু রায় রামানন্দ, স্বরূপ দামোদর, সার্বভৌমাদি ভক্তগণ প্রভুকে অন্তত একজনকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলেন। অবশেষে বলভদ্র ভট্টাচার্য নামে এক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ বাংলা থেকে নীলাচল এসেছিলেন তীর্থ করতে প্রভুর সঙ্গে, তাঁকেই সঙ্গে নেবেন বলে ঠিক হলো। সঙ্গে দেয়া হলো আরো একজনকে।
কটককে ডান দিকে রেখে বামে ঝাড়খণ্ডের বনপথ ধরে বৃন্দাবনে রওনা হলেন।প্রভু চলেছে উচ্চৈঃস্বরে নিরন্তন কৃষ্ণ নাম করতে করতে। ঝাড়খণ্ডের গভীর বনাঞ্চল এখনকার আটঘড়া, ঢেঙ্কানল, কেওনঝড়, ছোটনাগপুর প্রভৃতি। সেই সময় এই পথগুলি ছিল লোকালয়বিহীন, হিংস্রবণজন্তু পূর্ণ, অত্যন্ত শ্বাপদসঙ্কুল।
এমন পরিবেশে গৌড়সুন্দর কৃষ্ণ প্রেমে উন্মত্ত হয়ে উর্দ্ধ বাহু হয়ে ছুটে চলেছেন বৃন্দাবনে। তার পরিধানে কৌপিন ও বহির্বাস। তাঁর নয়ন দিয়ে অজস্র ধারাবিগলিত আর মধুর স্বরে উচ্চকণ্ঠে গাইছেন —
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হে ।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হে।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ রক্ষ মাম।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ পাহি মাম।।
রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষমাম।
কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহী মাম।।
নিবিড় অরণ্যে পালে পালে বাঘ, হাতি, শুকর, গন্ডার প্রভৃতি বন্য ও হিংস্র পশুকে বিচরণ করতে দেখে বলভদ্রের মানে দারুণ ভয়ের সঞ্চার হল। কিন্তু অকুতোভয় গৌরাঙ্গের সেদিকে কোন দৃষ্টি নেই। আশ্চর্যর বিষয় সমস্ত বন্যপশুরা পথ ছেড়ে দিচ্ছেন প্রভুকে যাওয়ার জন্য। একবার প্রভুর চরণ লাগলো শুয়ে থাকা এক বাঘের গায়ে। প্রভু বলে উঠলেন ‘কহ কৃষ্ণ’। বাঘ উঠে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলে নাচতে লাগলো।
একদিন প্রভু নদীতে স্নান করছেন, হঠাৎই সেখানে একদল মত্ত হাতি জল পান করতে এলো। প্রভু ‘কৃষ্ণ কহ’ বলে হাতির দলের উপর জল ছিটিয়ে দিলেন। সেই জলবিন্দু যে যে হাতির জায়গায় গিয়ে পড়ল, তারাও কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে প্রেমে নাচতে লাগলো। হরিণের দলও প্রভুর কন্ঠে মধুর হরিনাম শুনে পিছু পিছু চলতে লাগলো। হরিণ এবং বাঘ যারা একে অপরের প্রাকৃতিক শত্রু, তারাও কৃষ্ণ নামে অভিভূত হয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করে এবং চুম্বন করলো। বলভদ্র অবাক হয়ে দেখলেন।
চৈতন্যদেবের সুমধুর কন্ঠ ধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে ময়ূরেরা পেখম মেলে নাচতে লাগল। বনের নানা জাতির পাখিরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কলরব করতে করতে সঙ্গে যেতে লাগলো। ঝাড়খণ্ডের পথেই মোহনিয়া গৌড়সুন্দর স্থাবর জঙ্গম সকলকেই কৃষ্ণ নামে একবারে উন্মত্ত করে তুললেন।
প্রভুর চলার পথে বন দেখে বৃন্দাবন মনে করে ভ্রম করেন, পাহাড় দেখে মনে করেন এই বুঝি গিরিগোবর্ধন, যেখানে নদী দেখেন সেটি ভাবেন কালিন্দী, যেখানে সেখানে নাচেন গায়েন প্রেমাবেশে গড়াগড়ি খান। পথে ভট্টাচার্য শাক ফলমূল যা পান, যত্ন করে প্রভুর সেবার্থে ঝুলিতে সংগ্রহ করেন।
যেসব গ্রামে সাত পাঁচ জন ব্রাহ্মণ থাকে তারা প্রভুকে নিমন্ত্রণ করেন, কেউবা দুগ্ধ ঘৃত প্রভুকে প্রদান করেন। আর যে গ্রামে ব্রাহ্মণ থাকে না সেখানে শূদ্রভক্তগণ সেবা দ্রব্য দিয়ে যান ভট্টাচার্যকে। ভট্টাচার্য পাক করে শালগ্রাম শিলারূপী নারায়ণকে ভোগ দিয়ে মহাপ্রভুকে সেবা করান। প্রভু কিন্তু এইসব বনদ্রব্যাদিতে বেশ সন্তুষ্ট। এমনকি কঠোর পদযাত্রায় প্রভুর কোন কষ্টানুভাব নেই।
ঝাড়খণ্ডের দিক দিগন্তহীন বিশাল নির্জন বনের স্থানে স্থানে কোল-ভিল দস্যুদের অবাধ বিচরণ ছিল। যারা নরহত্যা অপহরণ লুণ্ঠনে পারদর্শী। এই নরভুক জাতির মুখোমুখি হলেন আনন্দলীলাময় বিগ্রহ শ্রীচৈতন্য। স্বাভাবিকভাবেই বলভদ্র বেশ কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। এইসব নরহন্তারকরা নবারুন বহির্বাসধারী সুমনোহর তনু ও প্রফুল্ল বদনকমল দর্শনমাত্র তাদের দেহ-মন-প্রাণ মধুরতম পুরুষকে সমর্পণ করল। চৈতন্য গোঁসাই জপমালাধৃত হস্তে ঊর্ধ্ববাহ হয়ে মধুর স্বরে উচ্চকণ্ঠে কীর্তন আরম্ভ করলেন। হিংস্র বন্য অধিবাসীরা দলে দলে এসে মহাপ্রভুর কণ্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগলো।
মহাপ্রভুর পাদপদ্ম স্পর্শ করে, তার প্রেম ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে, এই পুরুষোত্তমের করুণায় সেই ভয়াল ও দুর্ধর্ষ অর্ধসভ্য বনবাসিরা সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসেছিল। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপায় মানবধর্মের এক নতুন উন্মেষ দেখা দিল।
এইভাবে মহাপ্রভু ভীল অধ্যুষিত শ্বাপদ সঙ্কুল বনপথ অতিক্রম করে ছোটনাগপুর বিহার প্রদেশ দিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলেন মোক্ষক্ষেত্র কাশীধামে। বৈষ্ণব, শাক্ত ও শৈবের মিলনক্ষেত্র হিন্দুদের সুপ্রাচীন এই মহাতীর্থে পৌঁছে শ্রীগৌরাঙ্গ মহানন্দে স্নান করতে গেলেন মণিকর্ণিকা ঘাটে।
শৈবতীর্থ হিসেবে বারানসি শৈবক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হলেও, শক্তি দেবীর অধিষ্টান ক্ষেত্র হিসেবেও এটি বিশেষভাবে চিহ্নিত। ৫১ পীঠের একটি পীঠ বারানসি। দেবীর মণিময় কুন্ডল এখানে পড়েছিল বলে এই ঘাটটির নাম মণিকর্ণিকা ঘাট।
সেখানে দেখা হল হঠাৎ করে পূর্ববঙ্গীয় তপন মিশ্রের সঙ্গে। বিস্মিত উল্লাসিত হলেন তপন মিশ্র মহাপ্রভুকে পেয়ে। প্রভু তাকে বুকে টেনে আলিঙ্গন করলেন। প্রভু বিশ্বেশ্বর মহাদেব ও বিন্দুমাধবকে দর্শন করে সুখ পেলেন। এরপর সর্বদর্শনান্তে তপন মিশ্র প্রভুকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। [ক্রমশ]