জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো, রাজরাজাদের দুর্গাপুজো নিয়ে অনেক মিথ বাংলার সংস্কৃতির অলিতে গলিতে ঘোরাঘুরি করছে। গবেষণালব্ধভাবে কিছু হয়তো বাস্তব, বাকি সব মিথ। এই মিথ নিয়ে কারুর মাথাব্যাথা নেই। বছরের একটা সময় সকলেই ব্যস্ত থাকেএই মিথ নিয়ে। ছুটে বেড়ায় অনেকে তার সত্য মিথ্যের খোঁজে। কারুর কাছে দুর্গা ঘরের মেয়ে কারুর কাছে দুর্গা কৈলাস ঘরনী। দুর্গা আছে সেই দুর্গাতেই।
মহিষাদলের রাজবাড়ির দুর্গাপুজো
দেবীপক্ষের ভোর থেকে এখানে শুরু হয় পুজো। প্রতিমার পাশে বসানো হয় ঘট। বিশ্বাস, সেই ঘটেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় দেবীর। প্রায় ২৫০ বছর আগে রানি জানকীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই পুজো। ইতিহাস বলে তারও প্রায় পঞ্চম প্রজন্ম আগে উত্তর ভারত থেকে ব্যবসার কাজে পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে এসেছিলেন রায়চৌধুরী পরিবার। ষষ্ঠ প্রজন্মে পুত্রসন্তান না থাকায় কন্যাকেই পুত্রের মতো করে লালন পালন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল অস্ত্রশিক্ষারও। সেই কন্যাই পরে পরিচিতি লাভ করেন ‘রানি জানকী’ নামে। ইতিহাস আরও বলে, তাঁর হাতেই পরিবারের রমরমা বৃদ্ধি পায়।
রূপনারায়ণ, দামোদর ও হুগলি নদীর সংগমস্থলে মহিষাদল অবস্থিত। এক সময় এই জায়গাটি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। নদীপথ ছাড়াও সড়ক ও রেলপথে বাণিজ্য হতো। বাণিজ্যের হাত ধরেই বসতি গড়ে ওঠে। শুরু হয় নানা রকম পুজো-আরাধনা ও উৎসব। সেই ট্র্যাডিশন মেনে আজও দুর্গা আরাধনা চলে মহিষাদল রাজবাড়িতে। এই রাজবাড়ির বিশেষত্ব হলো নীল পদ্ম দিয়ে আজও এখানে পুজো হয়। যদিও আড়ম্বর অনেক কমে গেছে। আগে রাজবাড়ির কামানের আওয়াজে শুরু হতো সন্ধিপুজো। এখন শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ। প্রতিপদ থেকে মন মন চালের ভোগ অর্পণ করা হতো দেবীকে। এখন তার পরিমাণ নেমে এসেছে কেজিতে। আগে ষষ্ঠীতে ছ’মন চালের ভোগ রান্না হতো। এখন হয় ছ’কেজি চালের ভোগ। তবে তাতেও আনন্দে ভাটা পড়ে না। আষাঢ় মাসে রথা টানা ছাড়াও প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে মহিষাদলের রাজবাড়ি থেকে রথ বের হয়।
ইচ্ছেপূরণের দুর্গাপুজো, হরগৌরির আরাধনা
বর্ধমানের দামোদর সংলগ্ন সদর ঘাট একসময় পরিচিত ছিল বাণিজ্য নগরী হিসেবে। প্রায় ১৫০ বছর আগে বাঁকুড়ার কোতুলপুর থেকে ব্যবসা করতে বর্ধমানে চলে আসেন দাশ পরিবার। বর্ধমানের খাজা আনোয়ার বেড় এলাকায় তৈরি হয় বিশাল জমিদার বাড়ি। জমিদার ব্রজেন্দ্রলাল দাশ সন্তান লাভের আশায় এখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন ১৫০ বছর আগে। পুত্র সন্তান জন্মালে তাঁর নাম রাখা হয় দুর্গাচরণ। এখানকার দুর্গা ঘরোয়া কন্যা, মহিষাসুরমর্দিনী নন। এখনও ট্র্যাডিশন মেনে দাশ পরিবারে হর-গৌরীর আরাধনা করা হয়। স্বামী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে দুর্গা বৎসরান্তে বাপের বাড়ি আসেন। এখানে অসুর থাকে না। পঞ্চমী থেকে পুজো শুরু হয়। দুর্গা আরাধনার কারণ যদিও ইচ্ছাপূরণ, তবে ইচ্ছাপুরণের আগে থেকে পুজো শুরু হয়েছিল, না ইচ্ছাপূরণ হবার পর পুজো শুরু করা হয়েছে সেই বিষয়ে ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু ১৫০ বছরেরও আগে থেকে যে জাঁকজমক করে পুজো হতো সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখনও গেলে দেখা যাবে ১৫ ফুট উুঁচু কাঠের দরজা পেরিয়ে দুর্গা দালান। দালান জোড়া কারুকার্য। যদিও তার অনেকটাই আজ ক্ষয়ে গেছে। চারপাশে খিলান, লম্বা বারান্দা। মহিলাদের জন্য দোতলায় আলাদা ব্যবস্থা। গোপন পথ ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় দোতলার বারান্দায়।
অতীতে ওখানেই ছিল বাড়ির ‘অন্দরমহল’। আগে ঠাকুর দালানে যাত্রার আসর বসতো। দোতলায় খড়খড়ির আড়ালে গল্পে মগ্ন থাকতেন বাড়ির মহিলা মহল। তিনটি আলাদা ভোগ মহলে ভোগ রান্না হতো। মিষ্টি তৈরি করতে ভিয়েন বসতো। দুর্গা দালানে ছিল বিশাল ঝাড় লণ্ঠন। এখন আড়ম্বর কমলেও ষোড়শপচারে হয় দুর্গা আরাধনা। এখানের পুজোয় বলি হয় না। ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি হয় প্রতিমার। পুজো ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা মিথ। সন্ধি পুজোর সময় নাকি দুর্গার পাশে দেখা মেলে একটি বিশাল মথের। পুজোর পর আর দেখা যায় না তাকে। পুজোর সময় আকাশে পাক খায় শঙ্খচিল। এই সবই পারিবারিক বিশ্বাস। আজ সবই ইতিহাস। কয়েক বছর আগে চুরি হয়ে গেছে ঝাড়লণ্ঠন। ভেঙে পড়েছে দুর্গা দালানের একাংশ। জাঁকজমকে টান পড়েছে। তবুও পুজোর কদিন পরিবারের সদস্য-বন্ধু-পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়ে যেন জীবন ফিরে পায় বর্ধমানে দাশ বাড়ি।
শেরশাহের পুজো
৩৬৫ বছর পার করা এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে শেরশাহের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শেরশাহ যখন দিল্লির সুলতান তখন থেকেই সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল পুজোর। বর্ধমানের কোলসরা গ্রামের জামালপুরে এই পুজো শুরু করেছিলেন দিগম্বর ঘোষাল। কাহিনিটি এইরকম — শেরশাহের নির্দেশে আজকের জি.টি রোড সংস্কারের কাজে নামলেন বিশ্বস্ত কর্মচারী দিগম্বর ঘোষাল। সংস্কারের কাজ শুরু করার পর জামালপুরের কাছে দেখতে পেলেন সিদ্ধেশ্বরী দেবীর কুঁড়ে। জানালেন দিল্লির সুলতানকে। মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য এক কথায় তাম্রপত্রে ৫০০ বিঘা জমি দান করলেন সুলতান শের শাহ। ১৬৫৫ সালে সেই জমিতেই বর্ধমানের কোলসরা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলো মন্দির। তখন থেকেই শুরু হলো ঘোষলবাড়ির দুর্গাপুজো।
এখন সেই জমি আর নেই। সেই আড়ম্বররও আজ অতীত। কিন্তু অলৌকিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল ঘোষালবাড়িতে। ঘোষাল পরিবারের দাবি, দিগম্বর ঘোষালের উত্তরসূরি রামচন্দ্র ঘোষাল নাকি একদিন কলাবাগানে দেখা পেলেন দেবী দুর্গার। তারপর থেকে দুর্গার উপাচারে কলা, থোড়, মোচার ভোগ দেবার প্রথা শুরু হয়েছিল। সেই প্রথা আজও বিদ্যমান। ৩৬৫ বছরের বেশি পুরনো রীতি-রেওয়াজ এখনও বহাল আছে বর্ধমানের ঘোষালবাড়িতে। জন্মাষ্টমীতে বিশেষ পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় দেবীর আবাহন। বোধন হয় মহালয়ার প্রতিপদে। মহালয়ার দিন তর্পণ করে বাড়ির পুরুষেরা গঙ্গা থেকে জল আনেন। সেই জলে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পুজোর প্রতিদিনের ভোগ রান্না হয় কলাবাগানে। পুজোর ক’দিন ইতিহাস এবং বর্তমান পাশাপাশি বিরাজ করে জামালপুরের ঘোষাল বাড়িতে। অতীতের গল্প, স্মৃতিচারণা আর তার সঙ্গে বর্তমানের হুল্লোড় একাকার হয়ে যায় এখানে। পুজো উপলক্ষে আসে আত্মীয়-বন্ধুরা। বনেদিয়ানায় ভরপুর হয়ে ওঠে জামালপুরের ঘোষালবাড়ি। ৩৬৫ বছর আগের হিন্দু-মুসলমানের মেলবন্ধনের সাক্ষী হয়ে আজও হয়ে চলেছে সেই দিনের শের শাহের দুর্গাপুজো।
খুব ভালো হয়েছে, লেখাগুলো পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম, অভিনন্দন