ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে শুভেন্দু-পুত্র শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে বলছেন, “ছোটবেলায় পান খেতে খুব ভালবাসতাম। রাংতা দেওয়া পান। হেঁটে স্কুলে যেতাম, ট্রাম ভাড়া বেঁচে যেত। সেই টাকা দিয়ে মিষ্টি পান কিনে খেতে খেতে স্কুল থেকে ফিরতাম। তখনই একদিন দেখা হয়ে যায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সাবিত্রী বলছেন, ‘আমি রাসবিহারীতে যেখান দিয়ে হেঁটে স্কুল থেকে ফিরতাম, সেখানে রোজ আড্ডা মারতেন কিছু শিল্পী। সেখানেই একদিন ভানুদা আমায় ডেকে বলেন, ‘আমরা একটা নাটক করছি, সেখানে এমন একটি মেয়ে দরকার যে বাঙাল ভাষা জানে। শুনলাম তুমি ঢাকার মেয়ে।’ আমি তখন বলেছিলাম, বাবার সঙ্গে কথা বলতে। পরেরদিন ভানুদা এসে হাজির হয়েছিলেন আমার বাবার কাছে। সব শুনে বাবা বলেছিলেন, ও কলকাতার রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। যেতে দিতে পারি যদি আপনি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যান আবার দিয়ে যান। তাতেই রাজি হয়ে যান ভানুদা।’
এখানেই শেষ নয় গল্প.. সাবিত্রী বলে চললেন, ‘প্রথম যেদিন সেই নাটকের রিহার্সালে গেলাম, সেদিন আমার ছিল খালি পা। ভানুদা অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে আমি বলেছিলাম, আমার একটাই জুতো। স্কুলের কেডস। সেটা নোংরা হলে স্কুলে বকাবকি করে… ফলে খালি পা। রিহার্সালে যাওয়ার আগে ভানুদা প্রথমে আমায় জুতোর দোকানে নিয়ে গিয়ে একটা জুতো কিনে দিয়েছিলেন। তারপরে বলেছিলেন, ‘কলকাতার রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা যায় না।’ সেই জুতো আমি বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলাম আর সামলে রেখেছিলাম। ভানুদার বলা সেই কথা এখনও আমার কানে লেগে রয়েছে।” নাটকটা নাম ছিল ‘নতুন ইহুদি’।
এই প্রসঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আত্মকথা’য় লিখেছেন —
৪৮ সাল নাগাদ ‘উত্তর সারথী’ নামে একটা নাটকের দল প্রতিষ্ঠা করি বলীন সোম, নেপাল নাগ, সলিল সেনকে নিয়ে। এরপর কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী গাঙ্গুলী, সাবিত্রী, গৌতম মুখার্জী, ধ্রুব চ্যাটার্জী, মনোজ ভট্টাচার্য, বিনু বর্ধন, রসরাজ চক্রবর্তী প্রভৃতি যোগ দেয়। দুই বছর ধরে এই নাটকের মহড়া চলে বলীন সোমের বাড়িতে। আরও পরে সুশীল মজুমদার শ্যাম লাহাও যোগ দেন। ১৯৫১ সালের ২১ জুন কালিকা সিনেমায় প্রথম অভিনীত হয় নাটকটি। এরপর মঞ্চস্থ হয় নিউ আম্পায়ার হলে। এই নাটকে আমার চরিত্রের নাম ছিল দুইখ্যা। এক জায়গায় আমার সংলাপ ছিল, ‘সোইইন্যা, তরা মানুষ চিনস নাই, ভালোমাইনসি কইরা এই দুনিয়ায় বাইচ্যা থাকন যাইব না। ভালো মানুষ পাইয়া হগলে তগো ঠকাইব। আমি খারাপ হইয়া গেসি দেইখ্যা তরা আমারে গালমন্দ করস। একখান আমার কথা মনে রাখিস, দ্যাশে আইজ যত ব্যাটা রাজা গজা হইয়া বইসে, হগলব্যাটাই চোর আর বাটপার, হগল ব্যাটাই খারাপ।’
প্রত্যেকটি শোয়ে এই ডায়লগের পর তুমুল প্রশংসা পেয়েছি। ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, নির্মল দে, অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুধীর মুখার্জি প্রভৃতি তখনকার দিনের বহু রথী-মহারথীরা এই নাটকটি দেখেন ও পছন্দ করেন। ‘নবান্ন’ র পরে নব্য ধারার নাটক হিসেবে ‘নতুন ইহুদী’র খুবই নামডাক হয়। এই নাটক হওয়ার পরই আমাদের সমস্ত শিল্পী এমনভাবে সিনেমায় চান্স পেতে লাগল যে আমরা নাটকটা বেশিদিন চালাতে পারলাম না। বিশেষ করে আমার আর সাবিত্রীর প্রচুর সুযোগ এল। এই ‘নতুন ইহুদী’ সিনেমাও হয়েছিল নেপাল নাগের প্রযোজনায়। সলিল সেনের এটিই প্রথম পরিচালনা, কিন্তু ছবিটি বিশেষ চলেনি। সাবিত্রীকে আবিষ্কার করেছিলাম এই অমৃতায়ন থেকেই। ও তখন কালীঘাটের ভিক্টোরিয়া ইস্কুলে পড়ত। বাঙাল ভাষায় কট কট করে ঝগড়া করতে করতে বন্ধুদের সঙ্গে যেত। আমাদের নাটকে ওই বয়সের একটা বাঙাল রিফিউজি মেয়ে দরকার ছিল। আমি একদিন স্কুলে যাবার রাস্তায় ওকে ধরলাম, ‘এই, তুমি নাটকে অভিনয় করবে?’
ও চোখ পাকিয়ে কট কট করে তাকিয়ে বলল, ‘আমায় জিগ্যেস করছেন কেন? আমার বাবার কাছে যান।’ সেই থেকে আমি ওর নাম দিয়েছি ‘কটকটি’।
যাই হোক, আমি একদিন ওর বাড়ি গিয়ে হাজির। সেখানে গিয়ে দেখলাম ওর বাবা আমার সম্পর্কে মামা। অনুরোধ করতে গেছিলাম, মামাকে দেখে সেটা দাবি হয়ে গেল। প্রথম দিন ওকে নিয়ে বলীন সোমের চেতলার বাড়িতে রিহার্সালে গেলাম। ওর প্রথম দিনের অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ, তখনই বুঝেছিলাম ওর হবে।
দুই
১৯৪০-এর অক্টোবর মাস, তখনও রাজনীতির সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ আছে। এই সময় একজন ব্রিটিশ পুলিশের ইনফরমারকে মারের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি। আমার নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়ে গেল Town entermination-এর। আমি ধরা পড়লে আমার বুড়ো বাবা-মা’র কী হবে, এই ভেবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে পালানো মনস্থ করলাম। আমার বাল্যবন্ধু গোপাল মিঞা ও তার পরিবার ১৪ তারিখে কলকাতায় আসছিল গাড়ি করে। তাদের গাড়ির পিছনের সিটের পাদানিতে শুয়ে কলকাতা রওনা দিলাম। তখন আমার ২৯ ইঞ্চি বুকের ছাতি এবং ভীষণই রোগা হওয়াতে বিশেষ অসুবিধা হল না।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১, কলকাতায় পৌঁছে চারু অ্যাভিনিউতে দিদির (প্রকৃতিদেবী) বাড়িতে উঠলাম। আমার মা দিদিকে টেলিগ্রাম করে আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি আমার ভগ্নিপতি বাদলবাবু আমায় ক্লাইভ স্ট্রিটে আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোল অফিসে নিয়ে গেলেন চাকরির জন্য। লিন্ডসে স্ট্রিটের নকুল দাশের টেইলারিং-এর দোকান থেকে সুট বানানো হল, ইন্টারভিউ-এর জন্য। আমি চিরকালই ধুতি এবং বাংলা শার্ট পরে অভ্যস্ত। এই ইন্টারভিউ ছাড়া আরেকবার সুট পরেছিলাম, সেটা ১৯৭৬-এ আমেরিকা যাবার সময়। সেই দিনই ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম। আমি যে খুব একটা চাকরি পাওয়ার যোগ্য তা নয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অনেকেই চাকরি পাচ্ছিল, আমিও পেয়ে গেলাম। দিদির বাড়িতেই থাকতে লাগলাম।
আমার স্ত্রী নীলিমা টালিগঞ্জ কবরখানার পাশে দিগম্বরীতলার মেয়ে, ওর সঙ্গে বিয়েটা হঠাৎ-ই হয়ে যায়। ও গান শিখতে আসত আমাদের বাঙালপাড়ায় মধুদা (সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়)-র কাছে, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে। পাড়ার ছেলে হওয়ার সুবাদে মধুদার বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। সিদ্ধেশ্বর ও রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে তখন অনেকে গান শিখতে আসত। একবার শ্রীরামপুর কোর্টে এক জলসায় মধুদা আমায় নিয়ে যায়, সঙ্গে গাড়িতে নীলিমাও ছিল। আমার তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা, একটা বিয়ের দরকার ছিল; মধুদাই উদ্যোগী হয়ে আমার মা আর ওর বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে।
১৯৪৬ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি বিয়ের দিন স্থির হল। কিন্তু নীলিমার বাবা পরেশ মুখার্জী বেঁকে বসলেন। কারণ মাত্র বছর তিনেক আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তদুপরি সেইসময় কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আমরাও জোরাজুরি করছি ওই দিনই বিয়ে দেবার জন্য। কারণ ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের প্রথম সিনেমার শুটিং। একবার নীলিমার চরম রক্ষণশীল বাবা যদি জানতে পারতেন যে তাঁর হবু জামাই সিনেমায় অ্যাকটিং করার মতো চরম পাপকাজে লিপ্ত তাহলে কিছুতেই বিয়ে দিতেন না।
তখন আমি বললাম, ‘মার্চ মাসে আমাকে দিল্লি ট্রান্সফার করে দেবে সুতরাং তার আগে বিয়ে করতেই হবে।’
নীলিমার বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, কিন্তু এই ঝামেলার বাজারে আমার কিছু কেনাকাটার সময় নাই।’ আমরা তাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
বিয়ের তিন দিন বাদে শ্বশুরঘর থেকে মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি। দ্বিরাগমনে। স্ত্রীকে বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে জামাই গেছে কাজে। এদিকে বিকলে পেরিয়ে সন্ধে গড়িয়ে রাত গভীর। তাতেও জামাইয়ের দেখা নেই। সময়টা ১৯৪৬। ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের রাত। রাস্তাঘাট শুনশান। বাড়ির সবাই খেয়েদেয়ে একে একে শুয়ে পড়েছে।…
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়র স্ত্রী নীলিমা দেবী এক নিঃশ্বাসে বলে চলেছেন, “আমার বাপের বাড়ি ছিল একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশের বাড়ি। ‘রাধা ফিল্ম’ কাছেই। যেখানে প্রথমদিকে দূরদর্শনের অফিস ছিল। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-ও তাই। যেটা এখন নবীনা সিনেমা। উনি তখন আয়রন অ্যান্ড স্টিল-এ চাকরি করেন। অফিস থেকে ফিরে আমায় পৌঁছে দিয়ে বললেন, ‘রাধা-য় কাজ আছে। আসছি।’ তারপর তো ওই কাণ্ড! রাধায় পৌঁছে বাবা ওঁকে তো দেখলেন, ছেঁড়া চিটচিটে একটা ত্রিপল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার ফাঁকফোকর দিয়ে যতটুকু শরীর দেখা যায়, তাতে ভরতি ঝুল, কালি, ময়লা! শুনলেন শুটিং চলছে, তখনও অনেক কাজ বাকি। এই শুনে বাড়ি ফিরে গুম মেরে বসে রইলেন। আমি আর কত জাগি! খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত দুটো, কী আড়াইটের সময় কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে উঠে দেখি, আমার মা তাঁর জামাইকে তোয়াজ করে খাওয়াচ্ছেন। সেই প্রথম ওঁর ছবি করতে যাওয়া।”
ছবির নাম ‘জাগরণ’। বিভূতি চক্রবর্তীর নির্দেশনা। ডেকেছিলেন উনিই। যেতেই বলেছিলেন, “দুর্ভিক্ষের সময়কার এক হাড়গিলে চিমসে মার্কা চেহারার লোক। তারই চরিত্রে অভিনয়। করো যদি বলো।”
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় রাজি হয়েছিলেন। সেই শুরু।
তিন
“আমি অনেকবার নীলিমাকে নিয়েও সত্যেনদার ২২, ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িতে গেছি। সে সত্যেনদার জন্মদিনেই হোক কি এমনি দিনেই হোক। এরকম একদিন নীলিমাকে নিয়ে গিয়ে দেখি সত্যেনদা বেহালা বাজাচ্ছেন। আমরা চুপ করে পাশে গিয়ে বসলাম। খানিকক্ষণ পরে আমাদের দিকে চোখ পড়লে সত্যেনদা বাজনা বন্ধ করে বললেন, ‘তোরা কতক্ষণ এসেছিস?’
নীলিমা বলে, ‘এই তো দু-মিনিট, বাজনা বন্ধ করলেন কেন সত্যেনদা, বাজান।’
সত্যেনদা বলেন, ‘না, অনেকক্ষণ বাজিয়েছি, তুই এবার একটা গান শোনা তো নীলিমা।’ বলে নিজের স্ত্রী, উষা বউদিকে ডাকলেন— ‘কই গো শুনবে এসো, কত বড় গাইয়ে এসেছে।’— এই বলে নীলিমাকে বললেন, ‘একটা কেত্তন গান শোনা।’
নীলিমার গান যখন শেষ হল তখন দেখি সত্যেনদা চুপ করে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছেন। আমি বললাম, ‘কি সত্যেনদা, কিছু বলবেন?’
সত্যেনদা বলেন, ‘না, ভাবছি।’
আমি বলি, ‘কী ভাবছেন?’
সত্যেনদা বলেন, ‘না, ভাবছি তোকে বিয়ে করে নীলিমা লাভবান হয়েছে না নীলিমাকে বিয়ে করে তুই বেশি লাভবান হয়েছিস?’
আমার মনে হয় আমিই ওঁর একমাত্র ছাত্র, যে ওঁকে ‘সত্যেনদা’ বলে ডাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। সম্ভবত সত্যেনদার জীবনের শেষ দশ-পনেরো বছরের জন্মদিনগুলোর প্রায় সবক’টাতেই আমি উপস্থিত ছিলাম।”
বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর জন্মদিন নিয়ে অনেক গল্প আছে তাঁ একটা গল্প এখানে বলি —
সম্ভবত সত্তরের দশক। কলেজ স্ট্রীটের প্রেসিডেন্সির পাঁচিলে পুরনো বই-এর দোকান। কিছু জরুরী বই কিনতে গেছেন কিংবদন্তী নায়ক উত্তমকুমারের ছোটভাই অভিনেতা তরুণকুমার। বইকেনা শেষ হলে পায়ে পায়ে পুটিরামের কচুরি ছোলার ডাল। পুটিরামে এসে দেখেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড় প্রমান মিষ্টি কিনতে ব্যাস্ত।
চোখাচুখি হতেই সেই অনাবিল হাসি। ঢাকাই তোপ ধেয়ে আসে —
আরে বুড়া! যাস কই…?
বই কিনতে এসেছিলাম এখন কচুরি খাব।
বই কিনছস! তা বেশ বেশ… কচুরি খাইয়া ল তারপর আমার লগে চ।
তরুণকুমার দেখেন ঘোর বিপদ। কিন্তু উপায় নেই! ‘সিনিয়র’ আর্টিস্ট এবং অগ্রজ বলে কথা। একবার আমতা আমতা করে বলতে গেলেন — আসলে একটু কাজ ছিল যে…।
ওইসব পরে হইবো গিয়া। আমার লগে আয়। মিষ্টির হাঁড়িটা ল। আজ আমার মাস্টারমোসাই’র জন্মদিন। চল তর লগে আলাপ করামু গিয়া। দেখবি, খুব ভাল মানুষ।
এরপর আর কোন কথা চলেনা।
ভানু চলেন আগে আগে, পিছনে বিশালকায় মিষ্টির হাঁড়ি হাতে তরুণকুমার। কলেজ স্ট্রিট, হেদো ছাড়িয়ে বিবেকানন্দ স্ট্রীটের কাছে শীর্ণকায় গলি। তার মধ্যে ততোধিক ক্লিস্ট একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধে নেমেছে শীতের কলকাতায়। চারিদিক বেশ অন্ধকার। ঘরণী এক চিলতে তুলসীতলায় বাতি দিচ্ছেন। শাঁখ বাজছে কোথাও। তরুণবাবু ঠিক ঠাহর করতে পারছেনা যে কোথায় এলেন! একি অদ্ভুত রহস্য!
এমন সময় বাড়ির বাইরে থেকেই আকাশবাতাস কাঁপিয়ে আবার ‘ঢাকাই’ গর্জন — মাস্টারমোসাই… আইসা পড়ছি। মাতৃসমা সেই মহিলা হেসে বললেন, “ভেতরে যাও বাবা..উনি বসে আছেন।” ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করে তরুণকুমারকে সঙ্গে নিয়ে সামনের ঘরে সটান ঢুকে পড়লেন ভানু।
খুবই অনাড়ম্বর, আটপৌরে ঘর। একটি খাট, তক্তপোষ, টেবিল, চেয়ার, জলের কুজো, মশারি, এস্রাজ, এবং সব ছাপিয়ে ঘরভর্তি উপচে পড়া বই-এর সাম্রাজ্য।
সাদা চাদর জড়ানো এক অভিজাত প্রৌঢ় বসে। অন্ধকারে মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলেননা তরুণকুমার। তখনো অগ্রজের নির্দেশে মিষ্টির হাঁড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। গৃহিণী আলো নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই যেন মাটি দুলে উঠলো! তরুণকুমার দেখেন তার সামনে বসে আছেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। এই তবে তার ভানুদার ‘মাস্টারমোসাই’!
ততক্ষণে গুরু-শিষ্য সংবাদ শুরু হয়ে গেছে!
আচার্য ধীর কন্ঠে তার গৃহিণীকে বললেন — “দেখেছো উষা (উষাবতী বসু) কেউ মনে রাখেনি… অথচ সাম্য কিন্তু কোনদিন ভোলেনা।”
দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন ভানু। গুরুমা’কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “মাসীমা, মালপো খামু…আছে নাকি দুইখান?”
তরুনকুমারের বিস্ময়ের শেষ নেই তার চোখমুখ দেখলেই তা বোঝা যায়।
খুব কম লোকেই জানেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম সাম্যময় ব্যানার্জি এবং তিনি সত্যেন বসুর পদার্থ বিজ্ঞানের প্রিয় ছাত্রদের অন্যতম।
চার
সমরেশ বসুর ছেলে উদিত বসু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে স্মৃতি চারনা করেছেন —
ভানুজ্যেঠুকে আমি প্রথম দেখি আমাদের ১২ নম্বর সার্কাস রেঞ্জের বাড়িতে। দিলীপকাকা (অভিনেতা, পরিচালক — দিলীপ রায়) নিয়ে এসেছিলেন — বাবার ‘কোথায় পাবো তারে’ উপন্যাস ছবি করবার প্রস্তাব নিয়ে, অভিনেতৃ সংঘের ব্যানারে।
বাড়িতে ঢুকেই, স্বভাবসিদ্ধ আচরণে, বাবার লেখার ঘরে না ঢুকে, মা-র রান্না ঘরে গিয়ে সোজা অর্ডার — “টুনি, কয়েক কাপ চা, ওই লেখকটার ঘরে পাঠা দেখি! খুব জরুরী আলোচনা আছে!”
আমি তো হতবাক! বাবার লেখার ঘরের, বারান্দার জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আমার তো পা আটকে গেছে!
এবার — আলোচন…
তার মধ্যে, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি দেখে, দিলীপকাকা ভেতরে ডাকলেন…আলাপ করিয়ে দিলেন…প্রণাম করলাম সবাইকেই। ভানু জ্যেঠু মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। কিন্তু মন তখন বাবার ‘কোথায় পাবো তারে’ নিয়ে আলোচনা করতেই ব্যস্ত!
এই সময়, চায়ের ট্রে হাতে, আমার জননীর প্রবেশ… সঙ্গে চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে, মাছ ভাজা। দিলিপকাকা উচ্ছ্বসিত মাছ ভাজা দেখে! ভানুজ্যেঠু কিন্তু গম্ভীর…
“তোরে কইলাম সা খাওয়াইতে, মাস ভাসা কে আনতে কইলো?”…ধমক!
এতো serious ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে, কে দেখেছে ভাই?…
“টুনি — শোন, তুই একডা কাম কর! আমারে, সমরেশের একডা ভালো বই গিফট্ কর দ্যাখি!!! মাস ভাসা খাওয়াইতে লাগবো না!”
মা, বইয়ের কাব্বার্ড খুলে, হাতের সামনে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ পেয়ে, সেটাই বার করে ভানু জেঠুর হাতে দিলেন।
ভানুজ্যেঠু, পত্রপাঠ বাবার টেবিলে বইটা রেখে, অর্ডার করলেন — “লেখো, আমারে গিফট্ করসো!”
বাবা, ভলো মানুষের মতন সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলেন।
আরো অনেক আলোচনার পরে, ওনারা সবাই চলে গেলেন।
আমি কিন্তু কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেদিননা দেখে, হতাশই হয়েছিলাম।
কয়েকদিন পরে, আবার সদলবদলে ভানুজেঠুর আগমন…এবং যথারীতি, বাবার কাছে যাবার আগে, মা কে রান্না ঘরে গিয়ে অর্ডার…কিন্তু, এবার একটু অন্য রকম!!!
“টুনি, সা টা লইয়্যা, তুই আয় দ্যেখি! দরকার আসে…”
বাবার ঘরে তখন দিলীপকাকারা গভীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন…
ভানুদা কি যে করেন!…সব প্ল্যান চেঞ্জ!
বাবা, হাসি মুখে চুপ!
ভানুজ্যেঠু ঘরে ঢুকেই — “সমরেশ, প্ল্যান চেঞ্জ! ‘কোথায় পাবো তারে’ নয়… অভিনেতৃ সংঘ ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ করবে। দিলীপ ডিরেকশন দিবো। কালকূটের সরিত্রটা কারে দেওয়া যায়, ভাবতাসি। হইয়া যাইবো। তুমি বাসা, পারমিশনটার লগে, একটা অটোগ্রাফ দাও তো ভাই!”
বাবা পত্রপাঠ সই দিলেন…মা, চায়ের ট্রে হাতে প্রবেশ করলেন।
ভানুজ্যেঠু — “টুনি, তরে thank you কমু না, মন থ্যাইক্যা ভালোবাসা জানাইলাম। আমারে সমরেশের ঠিক বইটা দিসস!”
বাকিটা ইতিহাস…
সবাই কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন…আমি দেখেছিলাম একজন serious অভিনেতা এবং সংগঠক মানুষকে।
পাঁচ
কোনও রকম ঢাকঢাক গুড়গুড়ে বিশ্বাসী ছিলেন না ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। স্পষ্টবাদী ছিলেন। অপ্রিয় সত্যি কথা বলার মতো সাহস ছিল তাঁর। রাগ প্রকাশ করতেন সঙ্গত কারণে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পূর্বসূরির প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা, সমসাময়িকের প্রতি এমন দ্বিধাহীন, ঈর্ষাশূন্য স্বীকৃতি ক’জন শিল্পীর মধ্যে দেখতে পাই!’’ অভিনয়কে তাৎক্ষণিক বিনোদনের বস্তুমাত্র বলে মনে করেননি তিনি। মনে করেননি কখনও শিল্পীরা কেবল বিনোদনের সামগ্রী। সুচিত্রা-উত্তম জুটি যখন দাপটের সঙ্গে টলিউড শাসন করে চলেছে, ঠিক সেই সময়েই ভানু-জহর জুটির কিংবা ছবিতে কমেডিয়ানদের দাপটও কিন্তু কম ছিল না। ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবিতে সুচিত্রা সেন তখন দৈনিক ১৫০০ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একই ছবিতে কাজ করেছেন দৈনিক ১০০০ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে। জহর রায় শুরু করেছিলেন দৈনিক ৭৫ টাকা পারিশ্রমিকে। লড়াই করে ভানুদা তাঁর পারিশ্রমিক পরে যখন ১৫০০ টাকায় নিয়ে এলেন, তখন তিনি পাচ্ছেন দৈনিক ২০০০ টাকা। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্মে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন দৈনিক ২৫০ টাকায়। এসব নিয়ে বহু পরিচালক বা প্রযোজকের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন। বলতেন, ‘‘নায়ক-নায়িকাই শিল্পী। ওরাই কেবল চরিত্র সৃষ্টি করে। পার্শ্ব চরিত্রে যারা কাজ করে, তারা সব গরু-গাধা। তাদের অবদান কোন অংশে কম?’’
ছয়
সে একটা দিন ছিল। যখন হাতিবাগানের থিয়েটার পাড়া গমগম করত। সেরকমই একটা সময়ে রঙ্গনায় চলছে সুপারহিট নাটক ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নির্দেশনা ও মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিটি শো-ই হাউসফুল। লোক ভেঙে পড়ছে নাটকটি দেখতে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধব সহ-অভিনেতারাও আসছেন দেখতে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা অভ্যেস ছিল পরিচিত কেউ নাটক দেখতে এসেছেন জানতে পারলে কায়দা করে তাঁর নামটা নাটকের কোনও একটা সংলাপে ঢুকিয়ে দিতেন। অন্য দর্শকরা বুঝতে না পারলেও যাঁর নাম নেওয়া হচ্ছে তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারতেন। ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত সহ অনেকেরই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা একদিন বাংলা ছবির আর এক দিকপাল অভিনেতা চিন্ময় রায় গিয়েছেন নাটকটা দেখতে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানেন সে কথা। নাটকে একটা জায়গায় বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়ার দৃশ্যে ভানু হঠাৎ বলে বসলেন ‘আমারে খেপাইয়েন না বুঝছেন আমারে খেপাইয়েন না। আমার হাতে চিনু গুন্ডা আছে। আমার লগে লাগলে চিনুরে আইন্যা এমন দিমু না…।’ বলাই বাহুল্য এই সংলাপ নাটকের স্ক্রিপ্টে ছিল না। চিন্ময় রায়কে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘চিনু’ ‘চিনুদা’ এভাবেই সম্বোধন করা হতো। তিনি দর্শকাসনে আছেন জেনেই তাঁর নামটা জুড়ে দিয়েছিলেন ভানু। অন্য যাঁদের ক্ষেত্রে এ জিনিস হয়েছে তাঁরা সবাই বিষয়টা উপভোগ করেছেন আসনে বসে বসেই। কিন্তু চিন্ময় রায়ও তো ডাকসাইটে অভিনেতা। মঞ্চ থেকেই তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। এরকম ইম্প্রোভাইজেশন তিনি বহু দেখেছেন। এমন সুযোগ তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তিনি নন। ভানু ডায়লগ শেষ করা মাত্র চিন্ময় আসন ছেড়ে মঞ্চের সামনের সিঁড়িতে উঠে এসে বললেন ‘কী হল গুরু কোনও ঝামেলা হয়েছে নাকি!’ এবার চিনুকে সামাল দিতে ভানু বলে উঠলেন ‘এখনও হয় নাই হলে তরে ডাকুম অনে, অহন তুই যা তরে লাগব না।’ একেই বলে সেয়ানে সেয়ানে। এই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ওই শোয়ে দর্শকাসনে হাজির ছিলেন অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য।
সাত
পারিবারিক অ্যালবামের একটি ছবি— হলুদ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে চেনা গেল দর্শকাসনে বসে আছেন অধ্যাপক সত্যেন বসু, ড: শহীদুল্লাহ, ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার, কবি মোহিতলাল মজুমদার, কবি জসীমুদ্দিন। এ দৃশ্য ঢাকার। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অভিনয় দেখছেন এমনই সব বিশিষ্ট ব্যক্তি। নিজে বলতেনও, ‘‘আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে।’’
এই হওয়া কেমন, কী বা তার প্রস্তুতি, তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরই ছোট একটি লেখা থেকে— ‘‘রসরাজ রাজশেখর বসু একবার আমাদের বলেছিলেন, জগতের সমস্ত সত্যকথাই হাসির কথা। তবে, সেটা কী ভাবে এবং কোথায় বলতে হবে জানা দরকার।…. হোয়েন দ্য ইমাজিনেশন অব আ পারসন ইজ বিটন উইদাউট কনসার্নিং হিজ অর হার মাইণ্ড, লাফটার ইজ ইনএভিটেবল। দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে, একটি পাঁচ বছরের ছেলে রাস্তায় আছাড় খেলে কেউ হাসে কি? হাসে না। কারণ, ইমাজিনেশন ইজ নট বিটন। ধরেই নেওয়া হয়, বাচ্চা ছেলে তো আছাড় খাবেই। কিন্তু, একজন বয়স্ক লোক রাস্তায় আছাড় খেলে সবাই হাসে।
এই সংজ্ঞার ওপর সিচুয়েশন তৈরি হলে হাসির মার নেই। তবে, কথায় থ্রো কিন্তু ভীষণ ইমপর্ট্যান্ট। একটা কথা একজন বললেন, লোকে খুব হাসল। দেখা গেল, আর একজন যখন বললেন শুধু একটু মুচকি হাসি হল অথবা হাসিই হল না।
পরিশেষে বলি, আমাদের দেশে কিছু বিদগ্ধ (সংখ্যায় অতি নগণ্য) ব্যক্তি আছে, যারা ছেঁড়া কাঁথা, ভাঙা চৌকি, অভাবের সংসার দেখলে (নাটক বা সিনেমায়) বাস্তব বলেন। আর ঝাড়লণ্ঠন সমেত জমিদার বাড়ি দেখলে বলেন অবাস্তব। এরাই আবার ইংরেজি স্ল্যাপস্টিক কমেডি দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। একই সঙ্গে দেশি কমেডিয়ানদের অভিনয়ে স্ল্যাপস্টিকের ছোঁয়া থাকলে বলেন ভাঁড়ামি হচ্ছে।
মাসিমা মালপোয়া খামু। এই কথা বা সংলাপে সাতাশ বছর ধরে মানুষ হাসছেন। আমি কিন্তু হাসিনি। বরং ভোজনে দক্ষিণা পেয়েছি। এবং এখনও পাচ্ছি। দক্ষিণা পাচ্ছি বলাটা আমার বার্থ রাইট।’’
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ। ৬২ বছর বয়সে।
পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত