আমার বয়স যখন বারো, তখন দৈবাৎ একদিন শুনে ফেললাম জম্মু ও কাশ্মীরের সুফি গান, যার সঙ্গে সেদিন সঙ্গতে ছিল সন্তুর নামে একটা যন্ত্র। যন্ত্রটার প্রতি সেদিন যে বড় একটা টান অনুভব করেছিলাম তা নয়, কিংবা তার দ্বারা যে বিরাট কিছু মুগ্ধ হয়েছিলাম, তাও নয়। শোনা হতেই মন থেকে সেটিকে ঝেড়েও ফেলেছিলাম, থোড়াই বুঝেছিলাম আমার জীবনে শেষ অবধি কী কাণ্ডটাই না ঘটাবে এ বস্তু। আমি দিব্যি আগের মতোই গান গেয়ে, তবলা বাজিয়ে চালিয়ে গেলাম।
বাবা যখন জম্মু রেডিওর বড় কর্তা, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বক্সি গুলাম মহম্মদ— পরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত মানুষটি ছিলেন আবার একই সঙ্গে সঙ্গীত এবং আমার বাবার প্রতি অনুরক্ত— বাবাকে স্বল্পকালের জন্য বদলি করে দিলেন রেডিও শ্রীনগরে। তাঁকে সেখানে পাঠানোর উদ্দেশ্য, যাতে শ্রীনগরের সঙ্গীতজ্ঞরা তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিখতে পারেন। আর, সেই তখন, কাশ্মীরে, বাবা প্রথম শুনলেন সন্তুর যন্ত্রটি এবং এক্কেবারে তার বশ হয়ে গেলেন। আর, যেটা আমার জানা ছিল না সে সময়, বাবা চুপিসাড়ে একটা যন্ত্র কিনে ফেলে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছিলেন; উদ্দেশ্য, খতিয়ে দেখা তাতে মার্গসঙ্গীত বাজানো যায় কি না। তারপর হঠাৎ একদিন সব্বাইকে তাজ্জব করে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরলেন রেশমে জড়ানো একটা কিম্ভুত আকারের বাক্স নিয়ে। আর, সেটা তুলে দিলেন আমার হাতে। আমার বয়স তখন চোদ্দ।
আমি সন্তর্পণে টুক টুক করে সেটা খুলে দেখি একটা সন্তুর! সত্যি সত্যি আমি চমকে উঠেছি তখন। আর, আরও চমকালাম, যখন বাবা বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘‘এখন থেকে এটাই তোমার যন্ত্র।’’
অকপটে স্বীকার করছি আজ, সেদিন আমি মোটেই আহ্লাদে আটখানা হইনি। বরঞ্চ, বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, অচেনা, নবীন এই উৎপাতটির জন্য আমার আগেকার সব মেহনত, কসরতকে শিকেয় তুলে দিতে হবে। কিন্তু, বাবা নাছোড়বান্দা। তিনি সন্তুরের মধ্যে বিরাট সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন, এবং পূর্ণ আন্তরিকতা এবং গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘‘আমার কথাটা খেয়াল রাখিস খোকা। একটা সময় আসবে, যখন শিবকুমার শর্মা বলতে সন্তুর বোঝাবে, আর সন্তুর বলতে শিবকুমার শর্মা। বিলকুল গোড়া থেকে কিছু শুরু করার সাহস রাখ, দেখবি লোকে তোকে পথপ্রদর্শক বলে মানবে একদিন।’’
বাবার বিশ্বাসের ওই জোর দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম। এর আগে নানা যন্ত্র নিয়ে নাড়াঘাঁটা, কাজ করার অভিজ্ঞতা তো ছিলই, ফলে বেশ শিগগির শিগগির সন্তুরের টেকনিকগুলো রপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু, যন্ত্রের ধ্বনিটা যেন তেমন মনে ধরে না! তখন অবধি তো সেটিকে বাজানো হয়েছে শুধু সুফি গানের সঙ্গতে। তবু, প্রাণমন ঢেলে রেওয়াজ চালিয়ে গেলাম। নতুন যন্ত্রটা তখন একটা চ্যালেঞ্জের মতো। বাবা যে-স্বপ্নটা দেখেছেন, সেই উচ্চতায় কি সন্তুরকে নিয়ে তুলতে পারব? তখন, বলতে নেই, দু’ধরনের দায়িত্ব আমার ওপর — এক, সন্তুরটাকে দখলে আনা, আর দুই, জম্মু ও কাশ্মীরে একজন সেরা তবলাবাদক হিসেবে নিজের জায়গা কায়েম করা।
তবলায় সঙ্গত করছি তখন রবিশঙ্করের সঙ্গে, রাধিকামোহন মৈত্রের সঙ্গে, সিদ্ধেশ্বরী দেবী, বেগম আখতারের সঙ্গে, যাঁরা প্রায়ই তবলায় আমায় পেতে চাইছেন, আর আমারও খ্যাতি বিস্তার হচ্ছে উত্তরোত্তর। সে বড় কঠিন পরিস্থিতি! সন্তুরের রেওয়াজ জারি রাখতে শেষে তবলার ডাক উপেক্ষা করা শুরু করলাম। আর, তা না করে তো উপায়ও নেই কোনও। বাবার সিদ্ধান্তকে তো হেলাফেলা করতে পারি না। আর, তেমন কিছু করার কথা আমি স্বপ্নেও আনিনি। কিছু কিছু ব্যাপারে তিনি ছিলেন অটল শৃঙ্খলাপরায়ণ, আমার জো ছিল না ট্যাঁ ফুঁ করার। তা ছাড়া তিনি ছিলেন আমার গুরুদেব, আর শিশুকাল থেকে শিখেছিলাম যে, গুরুর পায়ে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনই শিষ্যের ধর্ম।
মা আমার অবস্থাটা বুঝতে পারতেন, এবং সেজন্য কিছুটা সহানুভূতিও ছিল তাঁর। কিন্তু, দুজনেই আমরা তটস্থ থাকতাম বাবার ব্যাপারে। কারণ, ভদ্রলোকের রাগ চড়তে সময় নিত না। ফলে, একটাই সান্ত্বনা তখন আমাদের — যা-ই করুন তিনি, ভালর জন্যেই তো করেন। আর, সেই তিনি যদি ভেবে থাকেন যে, সন্তুরেই আমার সাফল্যের চাবিকাঠি, তা হলে তা-ই হোক।
আস্তে আস্তে সন্তুরের ধ্বনিসংগঠন নিয়ে মেতে গেলাম। সেটার থেকে ঠিক ঠিক টোনগুলো বার করার চেষ্টা চালালাম। আর, ওই ভাবেই ক্রমশ আমার আনুগত্য আর সব কিছু থেকে সরে এসে জড়ো হল সন্তুরের প্রতি — ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন বাবা। অতঃপর, বয়স যখন সতেরো আমার, আমি জম্মু বেতারে তবলাও বাজাচ্ছি, সন্তুরও বাজাচ্ছি। যন্ত্রটির ওপর দখল জমতে এও টের পাচ্ছি তখন যে, এতে ছন্দ এবং সুর খুব নিটোল ভারসাম্যে নিহিত আছে। সন্তুর হল ডাণ্ডি দিয়ে ঠুকে ছন্দে ছন্দে বাজানো এক সুরযন্ত্র।
এরপর সুদীর্ঘ সময় ধরে সন্তুর নিয়ে যে কাজটা আমি করেছি, তা হল এক ধরনের পরিশীলন কর্ম। আমি ভারতীয় রাগসঙ্গীতের দাবি মেটানোর জন্য একটু একটু করে গড়ে নিয়েছি যন্ত্রটিকে। তার স্বন, সুর, স্বর, বর্ণ, স্বরভঙ্গি, অর্থাৎ, এক কথায়, টোনাল কোয়ালিটির ঋদ্ধি ও বিস্তার ঘটিয়েছি।
সন্তুরের জন্ম কাশ্মীরে, কিন্তু, আমি জম্মুতে ভূমিষ্ঠ একজন ডোগরা, আর আমার স্টাইলে এই দুই রাজ্যেরই সঙ্গীতধারা এসে মিশেছে। আমার বাজানো পাহাড়ি রাগ কিন্তু কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গীতে প্রভাবিত নয়, এতে অবদান ডোগরা লোকসঙ্গীতের, যা আমি গ্রামবাসীদের মুখে শুনে শুনে বড় হয়েছি। শুনেছি পেশাদার পল্লীগায়েনদের কণ্ঠে, এবং অবশ্যই আমার মায়ের গলায়।
আমাকে প্রায়ই কাশ্মীরি বলে ভুল করা হয়। সেটা হয়তো আমি রাজ্যটির ভাষা চোস্ত বলি ও সন্তুর বাজাই বলে। যন্ত্রটা তো কাশ্মীরের ঐতিহ্যের অঙ্গ, তাই না! শৈশবের সমস্ত গ্রীষ্মগুলো আমার কাশ্মীরে কেটেছে, ফলে, রাজ্যটাকে জানা হয়েছে হাতের তালুর মতো। আর, এখন হায়, বেড়াতেও যেতে পারি না, যতটা প্রাণ চায়। এই মর্মবেদনার কি কোনও পরিমাপ হয়?
কাশ্মীরি বন্ধুদের থেকে জায়গাটার সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সাহিত্য সম্পর্কে কত কিছুই না জানা হল, মায় কাশ্মীরের আমিষ রান্নার সূক্ষ্ম পদাবলী। বিশেষত, সেই বিশ্রুত ওয়াজওয়ান।
আমার বাবা-মা গোঁড়া ডোগরি ব্রাহ্মণ এবং নিরামিষাশী হয়েও কিন্তু আমাকে আমিষ খেতে বারণ করেননি। ফলে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় ছিল না। আর, সেই ধারাতেই আমার পড়াশোনাও ছিল রীতিমত উদারপন্থী: আমি ভারতীয় দর্শন ও বেদান্ত পাঠ করেছি, আবার অতি অবলীলায় আজও উর্দু পড়ে যেতে পারি।
সন্তুরের উৎপত্তি নিয়ে নানা ধারণা আছে। পারসিকদের দাবি হল যে, যন্ত্রটি তাদের দেশে জন্মে ক্রমে পূর্বের দিকে যাত্রা করে কাশ্মীরে পৌঁছয়। যদিও এটা প্রমাণ করা মুশকিল, তবু ধারণা করা যায় যে, ব্যবসায়ীদের বস্তায় করে সন্তুর ভারতে আসে। কিছু ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রী অবশ্য প্রাচীন সংস্কৃত রচনাদিতে অনুরূপ এক শততন্ত্রী সঙ্গীতযন্ত্রের উল্লেখ পেয়েছেন, যে যন্ত্রের নামও শততন্ত্রী বীণা।
কাশ্মীরে সন্তুরের ভূমিকা খুবই সীমিত। পারসিক সন্তুর যেখানে স্বাধীনভাবে বাজানো হত আর পাঁচটা যন্ত্রের মতো, সেখানে কাশ্মীরি সন্তুরের কাজই ছিল গানের সঙ্গে সঙ্গত করা — বিশেষত কাশ্মীরি সুফিয়ানা মৌসিকির সঙ্গে। এই সুফিয়ানা মৌসিকি — জানিয়ে রাখা দরকার — কিন্তু লোকসঙ্গীত নয়। এতে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সপ্তক ব্যবহার করা হয় — অর্থাৎ, সাত স্বরের পরম্পরা, যার ভিত্তিতে যাবতীয় সুর নির্মাণ — এবং পারসিক মার্গীয় নামাবলি, যে জন্য ভারতীয় শব্দ ‘রাগ’-এর বদলে এখানে ব্যবহার করা হয় পারসিক শব্দ লবজ্ বা ‘মকাম’।
সন্তুরের এক নিকট আত্মীয় হল জার্মান যন্ত্র হ্যাকব্রেট, যা অর্কেষ্ট্রাতে বাজানো হয়। চিন দেশের যন্ত্র ইয়ং-কিন আলাদা করেই বাজে। সিম্বালম যন্ত্রটি বাজে হাঙ্গেরীয় জিপসি লোক সুরের সঙ্গে। তাঁরও নানা বিচিত্র রূপ ধরা দেয় আধুনিক ইরান ও ইরাকে, কাজাখস্তান, তিব্বত, ভিয়েতনাম, গ্রিস, সুইটজারল্যাণ্ড, ইতালি ও আয়ারল্যাণ্ডে।
ভারতীয় পটভূমিতে তন্ত্রী যন্ত্রগুলির সূত্রপাৎ শনাক্ত করা যায় বিনীত ধনুর্বাণে। ধনুকের জ্যা আকর্ষণ করে তীরকে নিক্ষেপ করলে অস্ত্রটি একটি ধ্বনি সঞ্চার করে। এর থেকেই প্রাচীন ভারতীয় বীণার উদ্ভব এবং তার নামকরণ পিনাকী বীণা। এই যন্ত্রটি পৃথিবীর তাবৎ অঞ্চলের প্রাচীন সাঙ্গীতিক মূর্তিকল্পনার অঙ্গ: তাঁর lyre হাতে অর্ফেয়ুস, বীণা হাতে সরস্বতী। বীণা ক্রমে হয়ে উঠল রুদ্র বীণা, বাণ বীণা, কাত্যায়নী বীণা এবং শততন্ত্রী বীণা; শেষোক্ত বীণা থেকে অবশেষে জন্ম নিল সন্তু।
সন্তুর লোহার ছোট্ট ছোট্ট ষ্ট্রাইকার বা ডাণ্ডি দিয়ে বাজানো হয়, এক এক হাতে এক একটা ডাণ্ডি। এই বাজনায় বাদকের আঙুল তন্ত্রী স্পর্শ করে না। ফলে সন্তুরের কোনও মীড় নেই; স্বরগুলি কাটা কাটা এবং আলাপ অসম্পূর্ণ। আমি এই ভাবে কাশ্মীরি সন্তুর বাজিয়েছি বেশ কয়েক বছর, যখন শুধু সাত স্বরের রাগই বাজাতাম। যেমন আমি বেহাগ কখনও বাজাতে পারতাম না, কারণ সেখানে শুদ্ধ এবং তীব্র — দুই মাধ্যমেরই প্রয়োগ। এই কারণেই মুম্বইয়ে ১৯৫৫ সালে আমার প্রথম অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র; এবং সমালোচকরা সত্বর চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমার যন্ত্রের সংকীর্ণতা। তাঁরা ঠিকই ধরেছিলেন, আর সেটা আমার জানাই ছিল। আমি নির্জনে তখন দগ্ধ হচ্ছি হতাশায়, হা-হুতাশ করছি, তা হলে বাবা যা আমাকে গেয়ে গেয়ে শিখিয়ে গেলেন, তা যন্ত্রের অক্ষমতার জন্যে আমার বাজনায় অধরাই থেকে যাবে!
বাবার হাত থেকে যে কাশ্মীরি সন্তুর উপহার পেয়েছিলাম, তা কাশ্মীরি সঙ্গীতের জন্যই পরিকল্পিত ছিল, তাতে রাগবাদনের অনেক সমস্যা। একটি রাগ হল আপন ব্যাকরণে প্রতিষ্ঠিত একটি সুর। রাগে অন্তত পাঁচটি স্বর থাকতে হবে আরোহণে ও অবরোহণে। এভাবে আমরা পাই সা রে গা মা পা ধা নি সা এবং সা নি ধা পা মা গা রে সা। রাগ কোনও বিশেষ স্বরাবলি থেকে তার পরিচয় অর্জন করে না, তার পরিচয় সৃষ্টি হয় স্বরাবলি যে-পরম্পরা ও বিন্যাসে আবির্ভূত হয়, তাতে এবং যে-যে স্বরে বিশেষ অভিঘাত প্রয়োগ করা হয়, তাতে। যে জন্য অবিকল একই স্বরাবলি ব্যবহার করেও দুটি রাগ শুনতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে পূর্ণ চেহারা ও মহিমায় বাজাতে আমাদের প্রয়োজন সাত সাতটি স্বরবিশিষ্ট তিন তিনটি সপ্তক : মন্দ্র, মধ্য এবং তার সপ্তক।
যেহেতু কাশ্মীরি সন্তুরে প্রতি সপ্তকে সাতের বেশি স্বরে সুর মেলানো যায় না, আমার বাবা সেই সব রাগ দিয়ে আমাকে শেখানো শুরু করেন, যেখানে সাত স্বরের বেশি প্রয়োজন হয় না। যেমন, ইমন, ভূপালি, মালকোষ। আজকেও একশো জন ছাত্রের মধ্যে নিরানব্বই জনই সন্তুর শেখা শুরু করে ইমন দিয়ে। প্রথানুযায়ী একজন ছাত্র শুরুতে একটি প্রধান রাগের ওপর মনোনিবেশ করে দীর্ঘকাল ধরে — কখনও কখনও দু’বছর অবধি — এবং ইমন রাগে তন্ত্রকারীর সম্ভাবনা প্রায় অসীম: গৎ বাদন, বিলম্বিত কি মধ্যলয় বাদন, দ্রুত ঝালা এবং আলাপ। (কিছু রাগ শুধু আলাপের পক্ষেই শ্রেয়, কিছু রাগ আবার যথার্থ বিচ্ছুরিত হয় দ্রুত লয়ে)। বাবা যখন আমাকে সন্তুরে সরগম্ করা শেখালেন, তখন আমি বিভিন্ন ছন্দ ও লয়ে দেড় বছর ধরে শুধু সরগমের অজস্র ভেরিয়েশন বাজিয়ে গেলাম অকাতরে। শেষে আমার রাগশিক্ষা শুরু হল।
আমার কাছে সঙ্গীতের সেরা অধ্যায়টি হল তার অন্তর্যাত্রা পর্ব। সন্তুর বাজানো আজ আর শুধু বিনোদন নয় আমার কাছে, এর মাধ্যমে আমি নিজের ভিতরে পৌঁছই। এই হল সঙ্গীতের অধ্যাত্ম। টেকনিক তো নিছক মাধ্যম— সার হল টেকনিকের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ায় যখন টের পাই যে আমার বাজনায় তাঁদের মন ও শরীরের কিছু কিছু ব্যথা মরেছে, আমি বুঝি যে, আমি কিছু করে উঠতে পারলাম। অনেক শ্রোতাই জানান যে, আমার সঙ্গীত তাঁদের ধ্যানে মগ্ন করে।
আমি সুখী যে, সন্তুর তার সীমাগুলি অতিক্রম করে উঠতে পেরেছে, কিন্তু এও জানি যে, একজন সঙ্গীতজ্ঞ কখনওই, কোনও দিনই পূর্ণ ও নিখুঁত হন না। তিনি সারাক্ষণই বিবর্তিত হচ্ছেন। আজ যখন আমার পুরনো সব রেকর্ডিং শুনি (এক কালে মহৎ বাদন হিসেবে প্রশংসিত) কী রকম যেন ছেলেখেলা মনে হয়। দশ বছর আগের বাজনা আর এখনকার বাজনা পাশাপাশি ফেললেও পার্থক্য খুঁজে পাই। আর, এও জানি যে, ওই রচনা পাঁচ বছর পরে বাজালে তা আজকের থেকে অনেক ভিন্ন হয়ে উঠবে।
আজ যেভাবে সন্তুর বাজছে, সেই শৈলীর পথিকৃৎ আমি। এ কাজ অন্য কেউও করতে পারতেন, আর এও সম্ভব যে, আমার পথ ধরে আমার শিষ্যদের কেউই হয়তো আমার কাজের সীমানা অতিক্রম করে যাবে।
শিল্পের তো কোনও সীমা নেই, কোনও পূর্ণ যতি নেই।