শিবরাত্রির দিনে ত্র্যম্বকেশ্বর দর্শনের সৌভাগ্য হয় নি আমার। তবে ফাল্গুনের প্রথম সোমবার ত্র্যম্বকেশ্বর দর্শনের অধিকার লাভ করেছিলাম। শেষ রাতের অন্ধকারে কালো পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। পথের ধারে এক আধটা দোকান খোলা, কয়েকটি বড় হোটেল, দূরে পাহাড় আরও অন্ধকারে জমাট বাঁধা আলাপ নিয়ে অপেক্ষায়। একসময় পথের শেষ হয়। রাত্রি শেষের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র তখন যেন সকলকে পথ দেখাবার জন্য উদগ্রীব। আর সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের নীচে ভক্তদের বহু আকাঙ্ক্ষিত শিবমন্দির। জ্যোতির্লিঙ্গ ত্র্যম্বকেশ্বর। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।
ফাল্গুনে নাসিকে বেশ কাঁপানো ঠান্ডা থাকে। ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরটি মহারাষ্ট্রের নাসিক শহর থেকে আঠাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কাকভোরে স্নান সেরে মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। এবার মন্দিরের বাইরে জুতো খুলে শুরু খালি পায়ে পরিক্রমা। ঠান্ডা পাথরে পা রাখতেই দাঁতে দাঁত লেগে অনন্য এক তালবাদ্যের উৎপত্তি হচ্ছে। তাতে বেশ অহংকারী হবারই কথা, কারণ সবটুকুই আমার নিজস্ব সৃষ্টি। কিন্তু যত মন্দিরের অন্দরে প্রবেশ করতে লাগলাম তালের অহং কমার দিকে যেতে লাগল। একটার পর একটা রেলিং ঘেরা পথ পেরোবার আগ্রহে শীত হেরে দূরে সরল। দর্শন হল জ্যোতির্লিঙ্গ ত্র্যম্বকেশ্বরের। হৃদয় পূর্ণ হল কানায় কানায়।
মন্দিরের পিছনের দ্বারে এক যোগীর দর্শন মিলল। যাঁর বয়স কত বোঝা যায় না। অথচ এই শীতে গায়ে একখন্ড বস্ত্রের আচ্ছাদন। মুখে লেগে আছে এক অপার্থিব হাসি। যে হাসি দেখলে সূর্য লজ্জা পায়। যোগীকে দেখে মনে হবে এ পৃথিবীতে কোনও দিন কোনও দুঃখ শোক ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।
নাসিকের ব্রহ্মগিরি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ত্র্যম্বকেশ্বর শিবমন্দির। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর — হিন্দুধর্মের তিনটি স্তম্ভ। এনাদের শক্তিতেই চলছে এই জগৎ। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালন করেন এবং ধ্বংস করে দিতে আসেন শিব। এই তিন কর্তা একসাথে আছেন পবিত্র গোদাবরীর তীরে। ত্র্যম্বকেশ্বর শিবলিঙ্গ একমাত্র লিঙ্গ, যিনি মাটির নীচে অবস্থান করছেন। একমাত্র এই মন্দিরে একটি বিশেষ পূজা সম্পন্ন হলে সেই সমস্ত মানুষের আত্মা শান্তি পায় যাদের দুর্ঘটনা বা সাপের কামড়ে অকাল মৃত্যু হয়েছে। বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী সেই বিশেষ পূজাটি হল নারায়ণ নাগবলী পূজা।
গোদাবরী নদীকে তার তাৎপর্য অনুযায়ী দক্ষিণের গঙ্গা বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী গোদাবরীর একটি ঐশ্বরিক উৎপত্তি রয়েছে। এই কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন ঋষি গৌতম। ঋষি গৌতম ও তাঁর স্ত্রী অহল্যা ব্রহ্মগিরি পর্বতের পাদদেশে একটি নির্জন আশ্রমে বাস করতেন। একবার এই অঞ্চলে হল নিদারুণ খরা। স্থানীয় মানুষ ও পশুপাখি খাদ্য ও জলের অভাবে হাহাকার করতে লাগল। ঋষি তখন জলের জন্য বরুণ দেবের আরাধনা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট বরুণ দেব তাঁকে এমন একটি জলাশয় দান করলেন যেটির জল কখনও শেষ হত না। গৌতম ঋষি এই জল সকলের কল্যাণে লাগালেন। মানুষ ঋষি গৌতমের নামে ধন্য ধন্য করল। তখন অন্যান্য ঋষিদের হল হিংসা। তাঁরা গণেশের আরাধনা করতে লাগলেন।
গণপতি দর্শন দিয়ে তাঁদের অনেক বোঝালেন। হিংসা থেকে সরে আসতে বললেন। কিন্তু না। তাঁরা অনড়। তখন গণেশ এক দুর্বল গোবৎসের রূপ ধারণ করে ঋষি গৌতমের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। ঋষি তাকে দেখামাত্র কিছু ঘাস খেতে দিলেন। গোবৎসটি সেটি মুখে দিতেই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিল। অমনি অন্যান্য ঋষিরা ঋষি গৌতম এবং তাঁর স্ত্রী অহল্যাকে গোহত্যার অপরাধে পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে আশ্রম থেকে বহিষ্কার করলেন। এই ঘটনায় ঋষি গৌতম অত্যন্ত দুঃখ পেলেন ও নির্জন স্থানে মহাদেবের আরাধনায় মগ্ন হলেন।
তপস্যায় তুষ্ট মহাদেব তাঁর সামনে প্রকট হয়ে সমস্ত ঋষিদের ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে দিলেন। গোহত্যার পাপ গঙ্গা বা সমতুল্য নদীতে অবগাহনে দূর হয় সেটাও জানিয়ে দিলেন। এবার ঋষি গৌতম মা গঙ্গাকে গোটা প্রাণীকুলের উদ্ধারের জন্য মর্ত্যে আনার প্রার্থনা শিবের কাছে জানালেন। কিন্তু মা গঙ্গা প্রকট হলেও ঐ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে পারলেন না। তবে তার একটি স্রোতকে ঐ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে নির্দেশ দিলেন। এই স্রোতটিই গোদাবরী নামে খ্যাত হল। ঋষি গৌতম গোদাবরীতে স্নান করে গোহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হলেন।
আরও একটি কাহিনী রয়েছে যেখানে ত্রিবিক্রম (বামন অবতার) রূপে ভগবান বিষ্ণুর পা থেকে এই গোদাবরীর সৃষ্টি। বিষ্ণু বা শিব যেই হন না কেন গোদাবরী ঐশ্বরিক আশীর্বাদ ও ত্র্যম্বকেশ্বরের সঙ্গে যুক্ত রইলেন ওতপ্রোতভাবে। ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে যদি দেখা হয় তবে গঙ্গা ওইখানে কখনোই যেতে পারেন না, সুতরাং গঙ্গার মতো কোনো পবিত্র নদীর দরকারে এই ধরণের কাহিনীর অবশ্যই প্রয়োজন। বহতা জলধারা মানেই পবিত্র। সেই জলধারাকে পবিত্র রাখার কাজ মানুষের।
দিনের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় ত্র্যম্বকেশ্বরের পূজার্চনা। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই স্থানে পাপ থেকে মুক্তি পেতে আসেন। ত্র্যম্বকেশ্বর মাটির নীচে অবস্থান করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহের একদম মাঝখানে গর্ত রয়েছে। এই গর্তের মধ্যে তিনটি ছোট ছোট শিবলিঙ্গ রয়েছে। এই তিন লিঙ্গ হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর। ত্র্যম্বক অর্থাৎ ত্রিদেব। এই শিবলিঙ্গের পূজা করা হলে শুধু শিব নয়, একইসঙ্গে তিন দেবতার পূজা সম্পন্ন হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই শিব দর্শনে মানুষ তার জীবন মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পায় এবং মোক্ষলাভ করে।
ত্র্যম্বকেশ্বরে মা গঙ্গা যখন গোদাবরী রূপে প্রকট হয়েছিলেন তখন তাঁর বেগ এত ভীষণ ছিল যে কেউ তাঁর কাছে যেতে পারতেন না। তাই ঋষি গৌতম মা গঙ্গার বেগ কমাতে গঙ্গার দুইধারে কুশগাছ লাগিয়েছিলেন। এই স্থানটি ‘কুশাবর্ত কুন্ড’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই ‘কুশাবর্ত কুন্ড’ জলাশয় দক্ষিণ গঙ্গা অর্থাৎ গোদাবরী নদীর প্রতীক। এখানে স্নান করলে মানুষের সব পাপ ধুয়ে যায়।
এত পবিত্র মন্দিরটি কিন্তু যবনদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। বারবার এই মন্দিরের উপর আঘাত এসেছে। এটিকে নষ্ট করে দেবার চেষ্টা হয়েছে। ১৬৯০ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সেনা এই মন্দির আক্রমণ করে এবং নষ্ট করে দেয়। এই স্থানে তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করে। এই আক্রমণ মন্দিরের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
এই অন্ধকারে আলো এনেছিলেন পেশোয়া বালাজী বাজিরাও (১৭২০-১৭৬১)। তিনি এই মন্দির পুনরায় নির্মাণ করেন। প্রথম বালাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বালাজী বাজিরাও মারাঠা রাজ্যের পেশোয়া হন। তিনিই ওখান থেকে মসজিদ ভেঙে আবার মন্দির নির্মাণ করেন। এভাবেই ত্র্যম্বকেশ্বর একবার ফের নিজের প্রতিষ্ঠা ফিরে পায়।
বর্তমানে এই মন্দির এমন একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও শিব ভক্তির জন্য এখানে আসেন। কালো পাথরের অপূর্ব কারুকার্য সমেত মন্দিরটি শিব ভক্তদের কাছে পরম তীর্থস্থান। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেই একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ অনুভবে আসে।
শিব পুরাণ অনুসারে একবার ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের দিক নিয়ে তর্ক করছিলেন। তাঁদের পরীক্ষা করার জন্য শিব জ্যোতির্লিঙ্গ নামে একটি বিশাল অন্তহীন আলোর স্তম্ভ হিসাবে তিন জগতকে বিদ্ধ করেছিলেন। বিষ্ণু এবং ব্রহ্মা উভয়দিকে আলোর শেষ খুঁজে বের করার জন্য যথাক্রমে নীচে এবং উপরে যাত্রা করেছিলেন। ব্রহ্মা এখানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন যে তিনি আলোর শেষ খুঁজে পেয়েছেন। বিষ্ণু পরাজয় স্বীকার করে নিলেন।
শিব তখন আলোর দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসাবে আবির্ভূত হয়ে ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিলেন যে অনন্তকাল পর্যন্ত বিষ্ণুর পূজা করা হবে কিন্তু সেখানে ব্রহ্মার কোনো স্থান থাকবে না। জ্যোতির্লিঙ্গ হল অখন্ড বাস্তবতা যার মধ্যে শিব আংশিক ভাবে আবির্ভূত হন। মূলত ৬৪টি জ্যোতির্লিঙ্গ ছিল বলে বিশ্বাস করা হত। তার মধ্যে ১২ টিকে অত্যন্ত শুভ ও পবিত্র বলে মানা হয়।
একজন ব্যক্তি আধ্যাত্মিক সাফল্যের উচ্চস্তরে পৌঁছলে তিনি জ্যোতির্লিঙ্গগুলিকে আগুনের স্তম্ভ হিসাবে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেখতে পান। জ্যোতির্লিঙ্গ হল শিবের অসীম প্রকৃতির প্রতীক। সর্বোচ্চ স্তরে শিবকে নিরাকার, সীমাহীন, অতীন্দ্রিয় পরম ব্রহ্ম এবং আদি আত্মা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল এর তিনটি মুখ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে ধারণ করে। জলের অত্যধিক ব্যবহারে ক্রমশ লিঙ্গটি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ধরা হয় এটি মানব সমাজের ক্ষয়ের প্রতীক। অবশ্য যে মানব সমাজ শুরুর আদি থেকে শুধু পাপ বিনষ্টের জন্য বহতা নদী খোঁজে, পাপ না করার কথা ভাবে না কখনও, সেই সমাজের অবক্ষয় অবশ্যম্ভাবী।