মঙ্গলবার | ১০ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:২৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত সিন্ধুসভ্যতার ভাষা মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবির নামে : অসিত দাস বিস্মৃতপ্রায় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষায় সিন্ধুসভ্যতার মেলুহার ভাষার প্রভাব : অসিত দাস বঙ্গতনয়াদের সাইক্লিস্ট হওয়ার ইতিহাস : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘ঝড়ের পরে’ ভালো থাকার পাসওয়ার্ড (শেষ পর্ব) : বিদিশা বসু গাছে গাছে সিঁদুর ফলে : দিলীপ মজুমদার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড : বিদিশা বসু সলিমুল্লাহ খানের — ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় : ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা : মিল্টন বিশ্বাস নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ধরনীর ধুলি হোক চন্দন : শৌনক দত্ত

শৌনক দত্ত / ৩৪ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ৯ জুন, ২০২৫

ভারতীয় সঙ্গীতের ন্যারেটিভে ওয়েস্টার্ন হারমনি, কয়্যার অর্কেস্ট্রা এমন ভাবে জুড়লেন, বিদেশি হয়েও সেটা হয়ে উঠল দেশীয় গানের ও দেশজ কানের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুকূল। পাশ্চাত্য সঙ্গীতকে তিনি ভারতীয় আত্মায় শামিল করলেন। কী কথায়, কী সুরের আঙ্গিকে যন্ত্র-আয়োজনে প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙে বাংলা গানকে নবদিগন্তের সন্ধান দিলেন। পুরনোকে অস্বীকার করে নয়, ঐতিহ্য মেনেই। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা গানে সার্থক কম্পোজার হিসেবে যার কথা সর্বাগ্রে মনে আসে তিনি সলিল চৌধুরী (১৯২৫-১৯৯৫)। বিচিত্রগামী প্রতিভা — প্রদীপ্ত জীবন পথিক৷ কেবল কিংবদন্তি সুরকার, গীতিকার, কবিই নন — সাহিত্য, নাটক প্রভৃতি সমস্ত পরিশীলিত রুচিবোধসম্পন্ন সংস্কৃতির প্রতীক৷ মানবতার পক্ষে অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ-যুক্ত, সত্য-সম্পৃক্ত জীবনবোধের বেদ-উদগাতা৷ বৈপ্লবিক সাংস্কৃতিক চেতনার জীবন্ত মশাল, কলা-তপস্যার সু-ধীমান ঋত্বিক৷ একদিকে ছন্দের জাদুকরী সৃষ্টি করে যৌবনকে দিয়েছেন প্রাণবন্ত রূপ, প্রগতিশীল চেতনার আবেগ—অন্যদিকে, বাণীকে দিয়েছেন পারিজাতের সৌন্দর্য, শাশ্বত মানবিকতার আশ্রয়, নক্ষত্রের প্রভা৷ তাঁর বাণী জীবনগীতার অপরাজেয় শ্লোক৷ তাঁর সুর কেবল সুর নয়, জুঁই-বেলি-গোলাপের সুরভিত নির্যাস— মানব মনের সামমন্ত্র৷

সলিল চৌধুরীর জন্ম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলের গাজীপুর গ্রামে। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের ডাক্তারি করতেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের আবহে মানুষ। বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী পেশায় চিকিৎসক হলেও গানবাজনার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তবে সলিল সবচেয়ে লাভবান হন দাদা নিখিল চৌধুরীর সঙ্গীতময় সান্নিধ্যে এসে। মূলত এই দাদার মাধ্যমেই তাঁর গানের জগতে শৈশব-সম্পৃক্তি। বিশিষ্ট শিল্প-সংস্কৃতি আলোচক স্বপন সোমের কথায় তার সাক্ষ্য মেলে — ‘‘ছেলেবেলা থেকেই সলিল গানের পরিমণ্ডলে মানুষ। বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী গান বাজনার অকৃত্রিম অনুরাগী ছিলেন। পরে দাদা নিখিল চৌধুরীর সংগীতময় সান্নিধ্যে এসে সলিল খুবই উপকৃত হন। দাদার ‘মিলন অর্কেস্ট্রা’ নামে একটা অর্কেস্ট্রার দল ছিল। বিভিন্ন ধরনের গান, অর্কেস্ট্রা শুনতে শুনতে সলিলের কান তৈরি হতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বাঁশি। দারুণ বাঁশি বাজাতে পারতেন । বাঁশির প্রতি ছিল একটা আন্তরিক টান। তাই বুঝি বহু গানের প্রিল্যুড-ইন্টারল্যুডে বাঁশির ব্যবহার ছিল অনিবার্য। শুধু বাঁশি নয়, বিভিন্ন যন্ত্রবাদনে সলিলের দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।’’ (‘যুগন্ধর স্রষ্টা সলিল চৌধুরী’ — স্বপন সোম)

সলিল চৌধুরীর পিতা একবার হাতিকুলি চা বাগানে রীতিমতো বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটিয়ে কুলিদের পুরুষ ও নারী চরিত্রে পুরুষ ও নারী দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন৷ নিজেই নাট্য পরিচালক, নিজেরই সংগীত৷ সেই সময়েই চাঁদ সওদাগরের ওপর একটা নাটকে সলিল চৌধুরীর বাবা সলিল চৌধুরীকে প্রস্তাব দিলেন অর্ধেক গানে সুর করার জন্যে৷ শেষে সলিল চৌধুরীর পঙ্কজ মল্লিক ঢঙের সুর শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্ত সংগীতের কাজটাই করতে বললেন সলিল চৌধুরীকে এবং বাবার সহযোগী হয়ে সেই তাঁর প্রথম সংগীত পরিচালনার কাজে প্রবেশ৷ বঙ্গবাসী কলেজে পড়াকালীন তাঁর অন্য এক প্রবণতা তথা আকর্ষণের অভিমুখ পরিলক্ষিত হয়। এই সময়েই তাঁর সঙ্গীত জ্ঞানের পরিপক্কতা লাভের পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা ও অনুরাগও গড়ে ওঠে। উচ্চ মেধা ও মনন সম্পন্ন তরুণ সলিল চৌধুরী ১৯৪৪ সালে যখন স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন তখনই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-তে যোগ দেন। এই সময় থেকেই গণনাট্য সংঘের প্রয়োজনে তিনি গণসংগীত লিখতে শুরু করেন এবং সেগুলিতে সুর সংযোজনা করতে থাকেন। আইপিটিএ-র সাংস্কৃতিক দলটি দেশের বিভিন্ন শহর শহরতলি, গ্রাম, গ্রামান্তরে ভ্রমণ করতে থাকে। সেই সূত্রে সলিল চৌধুরীর লেখা এই গণসংগীতগুলিও কাছে দূরে বিভিন্ন শ্রেণির বহু মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তাদের অবারিত সান্নিধ্য গীতিকার, সুরকার, শিল্পী এবং ব্যক্তি সলিল চৌধুরীর প্রত্যক্ষ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়ক হয়। একজন সৃজকের কাছে এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মূল্য অপরিসীম। কারণ এটিই তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও সৃজন-সম্ভারকে বাস্তবতার ভিত্তি দান করে।

রেকর্ডে তাঁর যে-গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় তা হল গণসঙ্গীত নন্দিত নন্দিত দেশ আমার ও নবারুণ রাগে। তবে চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়ল যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করলেন কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা। সংগীত জগতের যে যুগটা চিহ্নিত স্বর্ণযুগ বলে তার উদ্বোধনী সংগীতটি হচ্ছে ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা’ — এই সংগীত দিয়ে গণসংগীতের চালচিত্রে বাণিজ্যিক সংগীতে নব ধারার প্রবাহ সৃষ্টি৷ সলিল চৌধুরীর সংগীত সৃষ্টিকে তিনটি সময়ে ভাগ করা যায় (১) প্রাক-মার্কসিস্ট সময়-যখন তাঁর সুরে রবীন্দ্রনাথের গানের ছাপ৷ (২) মার্কসিস্ট হয়ে গণ-আন্দোলনে যুক্ত জীবন৷ সংগীতে দ্বন্দবাদের পর্দার চলন বলন৷ গণ-সংগীত সৃষ্টি৷ (৩) আন্দোলন বিচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক জীবন, — যেখানে প্রেম সংগীতেও আত্ম দ্বন্দের স্বর ব্যবহার৷ ধান ও জমি দখলের লড়াই, মিছিল, ধর্মঘট, বন্দীদের অনশন, যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের উদ্দীপ্ত উর্বর ভূমিতে সংগীত ফসল সৃষ্টি করার এক সুদক্ষ সংগীতস্রষ্টা ছিলেন সলিল চৌধুরী৷ এই বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিচিত্র পটভূমিকায় সলিল চৌধুরির জীবনের ছবি আঁকা৷ যে সব অনবদ্য গান এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে জনমানসে পৌঁছেছে সেগুলি, বিচারপতি তোমার বিচার, ঢেউ উঠছে কারা টুটছে, তেভাগা আন্দোলনের গান হেই সামালো, শপথ কবিতা, শান্তির গান আমাদের নানান মতে, স্বাধীনতার গান মানব না এ বন্ধনে৷ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব আঙ্গিকে সৃষ্টি ‘ও মোদের দেশবাসীরে’ — আরও আরও অজস্র সংগীত৷ জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরিদের গানের ঢেউ সেদিন আছড়ে পড়েছিল স্বর্ণযুগীয় নতুন নতুন সুরকার, গীতিকার, এমনকি গায়কদের মধ্যে৷ সুরকার সলিল চৌধুরির সমগ্র জীবন এক বিপ্লবের প্রতীক৷ পুঁজিবাদী শক্তির কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে পৃথিবীর ধনবাদীরা মহা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে তিনটি অমোঘ অস্ত্র, — প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা ও ভদ্রতার মুখোশ পরা উগ্র জাতীয়তাবাদ৷ এর দ্বারা মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করার খুব সহজ উপায় পাওয়া গেছে৷ আজও পৃথিবীর মুষ্টিমেয় ওপরতলার মানুষের অন্ধ প্রাদেশিকতা, অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধ জাতীয়তাবাদের উগ্রতার শিকার সাধারণ মানুষ৷ এই বিভেদ সৃষ্টি করবার বিরুদ্ধে মানব সংহতির জন্য ওই গণসংগীতের ইতিহাসে আজও সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি গণসংগীতের ধারার বাইরে এসে কেউ কিছু সৃষ্টি করেছে বলে আমার জানা নেই৷ হরতালের গান গাইতে গিয়ে যেমন ছন্দকে ধর্মঘটের বাক্সে বন্ধ করে গড়ে তোলেনি, — ছন্দকে দিয়েছেন মেশিনের মর্মধ্বনির— ধ্বনি ও গতি, তেমনি বিভিন্ন লোকসংগীতকে মাঠ থেকে তুলে এনে বুদ্ধিজীবীর আসর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন৷ যেমন ‘মানব না এ বন্ধনে’৷ পাল্কি চলের ‘সামাল হেঁকে থেকে ঐ যে গাঁয়ের ঐ সীমানা’ পর্যন্ত সুর একটা মারাঠি লোকসংগীতের সুরে রচিত৷ লোকশিল্প ও আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে একটা অনাবিল মেলবন্ধন সৃষ্টির প্রয়াস শুধু নয়, এক অভিনব সিদ্ধি৷ যেমন রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা পাই লোকসংগীতের সুর নিয়ে তিনি যখন গান বেঁধেছেন তখন তা পূর্ণভাবে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠেছে৷ ‘জাগো মোহন প্যারে’ একটি বিখ্যাত খেয়াল গান৷ তার কায়দায় রবীন্দ্রনাথ গান বাঁধলেন, ‘মন জাগো মঙ্গললোকে৷’ তাকেই আবার সম্মেলক সুরের অপূর্ব ব্যাপ্তির মধ্যে সলিল চৌধুরী করলেন প্রয়োগ ‘জাগো মোহন প্রিতম’ গানে৷ ছোট ছোট ক্ষেত্রে আঙ্গিকের প্রয়োগ এমন সুন্দর যা সামনাসামনি বসে উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হয়, না হলে বোঝানো যায় না৷ তাঁর গানের মাধুর্য, চমৎকারিত্ব, প্রয়োগ কৌশল, যন্ত্রানুষঙ্গ, সামগ্রিক পরিবেশনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনুভব তাঁর গানে এতটাই পরিপুষ্ট যে তাকে ব্যাখ্যার দ্বারা তার অপূর্বতাকে গড়ে তোলার কথা ভাবা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়৷ তাঁর সৃষ্টি ও জনমানস বোধ কেবল পরিপূরক নয় একাত্ম৷ সলিল চৌধুরির গান কেবল গান নয়, মানবতার জীবনবেদ এবং আঙ্গিকে যুগ-পথিকৃৎ৷ তাঁর সুর-সংযোজনার কৌশল নিয়ে এবং সংগীতের বিষয়বস্তুর মধ্যে জীবন-দর্শনের বিস্তার নিয়ে প্রচুর আলোচনা করা যায়৷ প্রতিভার সাক্ষাৎ মেলা যতটা সহজ যুগস্রষ্টার সন্ধান পাওয়া ততটা সহজ নয়৷ সংগীত জগতে আমরা বহু প্রতিভার প্রকাশ দেখেছি কিন্তু যুগস্রষ্টা মাঝে মাঝে৷ এঁরা এক একটি বিশেষ ধারার প্রবর্তক৷ যেমন এস ডি বর্মন একজন ক্ষণজন্মা অসাধারণ সুরকার কিন্তু তাঁর স্রোতে বয়ে আসা কোনও প্রতিভাধর সুরকার আমরা পাইনি, — যদিও তিনি নিজে তাঁর স্বকীয়তায় একেবারে মৌলিক৷ কিন্তু আর ডি বর্মন এমন একটি আঙ্গিকের প্রবর্তক যার প্রভাব আজও বর্তমান সুরকারদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে৷ সলিল চৌধুরি এমনই এক সুর-সূর্য, যাঁর প্রদীপ্তিতে সমস্ত বাংলা গানের একটা মোড় ঘুরে গেছে৷ সলিল চৌধুরীর গানে প্রিলিউড আর ইন্টারলিউডের খেলা ছাড়াও আর একটা বৈশিষ্ট্য আছে — ওঁর সুরে মাঝেমাঝেই উঁকি দিত স্বর আর সুরের আশ্চর্য আলোআঁধারির খেলা। যেমন ‘রানার’ গানটিতে অবলিগেটো। গানের সুরে মধ্যেই যেন তার অবলিগেটো তৈরি হয়ে আছে — তা-ই রানারের সমস্ত বিপন্নতা লক্ষ করে আলো জ্বেলে রাখে। যদিও এ পাশ্চাত্য সঙ্গীত থেকেই শেখা, কিন্তু ঠিক কতটা নিলে তা ভারতীয় প্রাণকে আলোড়িত করতে পারে, তা তিনি জানতেন। এবং তার ফলেই তাঁর এই সব গান কখনও নগরের রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকে না, সে দিব্যি গিয়ে বসে প্রান্তিক মানুষের কানে-মনে। যেমন, ‘পথে এ বার নামো সাথী’র ইন্টারলিউডে সেই হারমনিক কোরাস! হারমনি নিয়েই আর একটি গান ‘সুরের এই ঝর ঝর ঝরনা’।

কবিতাপ্রেমী যে কারো একটা কথা মনে হতেই পারে সলিল চৌধুরী যদি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে কবিতা না লিখতেন তবে হয়ত সফল সঙ্গীতকার হয়ে উঠতেন না, কবিতা নিয়ে বিলাস তিনি পছন্দ করতেন না। তাই বলেছেন, “আমার সময় নেই/ আজগুবি গল্প ফেঁদে/ সিম্বলিক কবিত্ব সাধার/ অতএব ব্রাদার/ আমাকে মার্জনা কোরো।” নির্মল আবেগ ও সহজ শব্দবন্ধ তাঁর কবিতা বা গান লেখার মূল শক্তি। তাই তাঁকে স্বভাবকবি বলা যায়। কবিতায় সলিল কখনও বলেছেন একগুচ্ছ চাবির কথা যেগুলো সততার, সত্যের, যুক্তির, নিষ্ঠার যা এ যুগে অচল জেনেও যত্ন করে রেখেছেন তার কাছে, কখনও সেই চাবি দিয়ে তালা খুলবে এই আশায় সেগুলি তুলে দিতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে। কখনও শুনেছেন অজানা কারোর ডাক যিনি মাঝ রাতে চিৎকার করে ঘুমন্ত পাড়াকে জাগিয়ে কিছু বলতে চান। আসলে এই রাত মানুষের অজ্ঞানতা, শঠতার রাত, সেখানে ওই অজানা মানুষটার মতো চিৎকার করে সলিল জাগাতে চান মানুষের ঘুমন্ত সত্ত্বাকে। তবে অনেকেই বলেন, আকাশছোঁয়া সাঙ্গীতিক আধিপত্যের মনসবদার সলিল চৌধুরীর কাছে হার মেনেছেন রাজনৈতিক নাট্যকার ও যুগযন্ত্রণার আলেখ্য রচয়িতা সলিল চৌধুরী। তবে তাঁর কবিতা, গান, সুরের ভুবন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাহস ও শক্তি জোগাবে, অন্যায়ের প্রতিবাদে উৎসাহিত করবে। এ কথাটা ঠিক যে কবি এবং গল্পকার সলিল চৌধুরী অত্যন্ত অনালোকিত এবং অনালোচিত। বিশিষ্ট শিল্প-সংস্কৃতি আলোচক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের বয়ানে তার সাক্ষ্য মেলে — ‘‘সলিল চৌধুরীর গান নিয়ে জন্মেছিলেন ঠিক কথা। কিন্তু তার মুম্বাইয়ে যাবার পাসপোর্ট এসেছিল গল্প লিখে। যাঁকে পৃথিবী মনে রাখে তাঁর সুরের জন্য, কিন্তু তিনি জীবনের গোড়ায় এবং শেষে দেখিয়েছেন লিখিত বাণীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ‘গাঁয়ের বধূ’ গান হবার আগে কিন্তু কবিতা হয়ে জন্মেছিল।’ (শঙ্করলাল ভট্টাচার্য — ‘কলের গান মনের গান’) নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লেখক সলিল চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন — ‘একটি নিজস্ব ক্ষোভ আমার আছে৷ ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় ‘ড্রেসিং টেবিল’ নামে দাঙ্গা-বিরোধী ও মানবতাবাদী সেই অসাধারণ গল্পটির লেখক সলিল চৌধুরীকে বাংলা কথা-সাহিত্য হারিয়েছে৷’ গানের সলিল চৌধুরী ছিলেন নাটকেরও। অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবেও তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ছাত্র ফেডারেশন স্কোয়াডের সঙ্গে অসমে গিয়ে তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা নাটক ‘জাপানকে রুখতে হবে’ এবং পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তিত ‘মণিপুর’ নাটকেও অভিনয় করেন। শিক্ষক আন্দোলনের ওপর তাঁর নিজের লেখা প্রথম নাটক ‘সংকেত’। ‘তার’ আরও দুটি নাটক ‘জনান্তিক’ ও লেডি গ্রেগরির ‘দা রাইজিং অফ দা মুন’ অবলম্বনে ‘অরুণোদয়ের পথে’। তাঁর একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নাটক ‘আপনি কে? আপনি কী করছেন? আপনি কী করতে চান?’ থিয়েটার ইউনিট রঙ্গনায় নাটকটি মঞ্চস্থ করে। চলচ্চিত্রেও তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। তাঁর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো বিঘা জমিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলের মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র এবং বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তাঁর ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’ যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। সলিল চৌধুরীর ছোটগল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তাঁর কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে, যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়।

আসামের প্রত্যন্ত চা বাগানের সমাজ জীবন, ২৪ পরগণার কৃষক আন্দোলন, মামাবাড়ির অঞ্চলের ধাঙড়দের ধর্মঘটের অভিজ্ঞতা, রেল শ্রমিকদের আন্দোলন — এসব বাদ দিয়ে সলিল চৌধুরীকে চেনা যাবে না। সমগ্র সলিল চৌধুরীর দিকে যদি নজর দিই, তাহলে কিছু অসামান্য ব্যাপার নজরে আসবে। আমরা দেখব যে সলিল চৌধুরীর জীবনের দুটো পর্বের সমস্ত সৃষ্টিই এক অভিন্ন আদর্শের ধারায় প্রবাহিত। যাঁর আদর্শ, মানবতাবোধ, সংগীত, শিল্প, কর্মকাণ্ড, জীবনের সার্বিক প্রকাশ পরম সাধনায় বোধিসত্ত্ব, মানবতা যেখানে পরিণত হয়েছে ধূসর মরুভূমিতে সলিল চৌধুরী সেখানেই তাঁর সৃষ্টির ধারা দিয়ে জাগ্রত করতে চেয়েছেন বিবেক। কখনও সেই ধারা প্রাণ পেয়েছে কথায়, কবিতায় আবার কখনও বা সুরে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ৷

মধ্যরাত, ০৭ জুন, ২০২৫


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন