ভগবান শ্রীরামের পরম ভক্ত গোস্বামী তুলসীদাস শ্রাবণ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের অমবস্যার সাত দিন পর কবি ও সাধক গোস্বামী তুলসীদাসের জন্মজয়ন্তী হিসেবে পালিত হয়।
গোস্বামী তুলসীদাস উত্তর প্রদেশের চিত্রকূট জেলার রাজপুর গ্রামে ১৫৫৪ সালের ৩০শে জুলাই শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তম দিনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আত্মারাম দুবে ও মাতা হুলসী। তাঁরা ছিলেন কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ।
জনশ্রুতি আছে যে তুলসীদাস বারো মাস গর্ভে থাকার পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মের সময় তার মুখে বত্রিশটি দাঁত ছিল, তার স্বাস্থ্য এবং চেহারা পাঁচ বছরের ছেলের মত ছিল। জন্মের সময় কাঁদেননি পর্যন্ত। কথিত আছে, তার মুখ থেকে প্রথম নামটি বেরিয়েছিল ‘রাম’। এ কারণে এই শিশুর নামও রামবোলা হয়ে গেছে।
জন্মের দ্বিতীয় দিনেই তার মা হুলসী মারা যান এবং রামবোলাকে ৫ বছর ধরে তার পিতার বাড়ির দাসী চুনিয়া নামে একজন নারী লালনপালন করেন। এর পরে চুনিয়াও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় এবং তারপর রামবোলা একাকী অনাথ এর মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
রামবোলার এমন অবস্থা দেখে রামানন্দের শিষ্য নরহরি দাস তাকে সঙ্গে করে অযোধ্যায় নিয়ে আসেন। অযোধ্যাতেই তাঁকে নরহরি দাস রাম মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। রামবোলার নাম পরিবর্তন করে তুলসীদাস রাখা হয়। তিনি রামানন্দের গুরুপরম্পরায় রামানন্দী সম্প্রদায়-ভুক্ত ছিলেন। তিনি এখানেই শিক্ষাগ্রহণ বিদ্যা অধ্যয়ন শুরু করেন। নরহরি দাস তাঁকে রামায়ণ বর্ণনা করে শুনিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তুলসীদাস বারাণসীতে গিয়ে নরহরি দাসের বন্ধু গুরু শেশা সনাতনের কাছ থেকে পনেরো বছর বয়সে চারটি বেদ শিক্ষা শুরু করেন। ছয়টি বেদাঙ্গ ও সংস্কৃত ব্যাকরণেরও অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি। তারপর তুলসীদাস নিজ ভূমিতে এসে রামের মাহাত্ম্য প্রচার করেন।
তুলসীদাসের শিক্ষা দীক্ষা তাকে একজন দক্ষ গল্পকারে পরিণত করেছিল। একদিন, যমুনার ওপারের দীনবন্ধু পাঠক সেখানে রামকথা শোনার জন্য আসেন, তিনি তুলসীদাসের রামকথা বলার শৈলীর এমন ভক্ত হয়ে ওঠেন যে তিনি তার ১২ বছর বয়সী কন্যা রত্নাবলীকে তুলসীদাসের সাথে বিবাহ দিবার সিদ্ধান্ত নেন।
দীনবন্ধু পাঠক তুলসীদাসের গুরুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন, গুরু এই বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তুলসীদাস বিয়ে করেন কৌশাম্বী জেলার অন্তর্গত মহেওয়া গ্রামের ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ দীনবন্ধু পাঠকের কন্যা রত্নাবলীকে। তাঁদের তারক নামে এক পুত্রসন্তান ছিল। যদিও পুত্রসন্তানটি জন্মের পরেই মারা যায়।
তুলসীদাস ও রত্নাবলীর বিয়ে হয় ১৫৭৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে। রত্নাবলী ছিল খুব সুন্দর, তার সৌন্দর্য ছিল মোহনীয়। তুলসীদাস তাঁর রূপবতী এবং গুণবতী পত্নীর উপর অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তুলসীদাসের বিবাহিত জীবন খুব সুন্দর ছিল, তিনি রত্নাবলীকে খুব ভালোবাসতেন, এতই মোহ যে তিনি একদিনের জন্যও স্ত্রীর বিচ্ছেদ সইতে পারতেন না।
একদিন তুলসীদাস যখন হনুমান মন্দিরে গিয়েছিলেন তখন রত্নাবলীর ভাই এসে রত্নাবলীকে তাঁর পিত্রালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি এসে স্ত্রীকে না দেখে এবং তাঁর স্ত্রী নিজের পিতার কাছে চলে গেছে জানতে পেরে সেই রাতেই স্ত্রীর প্রেমে মগ্ন তুলসীদাস বিচ্ছেদ ও যন্ত্রণার কারণে বিচলিত হয়ে রত্নাবলীর গ্রামে ছুটলেন।
বাইরে প্রবল বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তুলসীদাস সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি, প্রবল বৃষ্টি ও অন্ধকার রাতে তুলসীদাস স্ত্রীর জন্য ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছিলেন। তিনি একটি ভাসমান লাশের সাহায্যে যমুনা নদী পার হয়ে রত্নাবলী গ্রামে পৌঁছান। বাড়ির কাছে পৌঁছে বাড়ির পাশের একটি গাছে একটি সাপ ঝুলছিল, সেখানে একটি দড়িও দেখতে পান। তার সাহায্যে তিনি সরাসরি রত্নাবলীর ঘরে প্রবেশ করলেন।
এটা দেখে তার স্ত্রী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং লোকলজ্জার জন্য চিৎকার করে তাকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তুলসীদাস নড়লেন না। তিনি রত্নাবলীকে তার সাথে যেতে অনুরোধ করতে থাকেন।
এতে রত্নাবলী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পূর্ণ চিত্তে তুলসীদাসকে তীব্র ভৎর্সনা করে বলেন —
লাজ ন লাগত আপকো, দৌরে আএহু নাথ।
ধিক ধিক ঐসে প্রেম কো, কহা কহুঔ মোই নাথ।
অস্থি চরমময় দেহ মম, তামে জাইসী প্রীতি।
তাইসী জো শ্রীরাম মহু, হোতি ন তৌ ভরভীতি॥
সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এলে, তোমার লজ্জা লাগল না ? হাড়-চামড়ার এই দেহ আমার, তাতে তোমার যেমন প্রেম, যদি তা রামচন্দ্রে হ’ত, তাহলে ভবভয় দূর হয়ে যেত।
একথা তুলসীদাসের হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধল। তিনি একটি কথা না বলে সেখান থেকে সোজা কাশী চলে এলেন। শুরু হল তাঁর বৈরাগ্যের জীবন।
অরথ ন ধরম ন কাম রুচি গতি ন চাহুই নিরবান।
জনম জনম রতি রাম পদ য়েহ বরদানু ন আন॥
আমি অর্থ চাই না, ধর্ম চাই না, কাম চাই না — আমি মুক্তিও চাই না। জন্ম-জন্মান্তরে যেন রামচরণে আমার মতি থাকে। এই বরদানই আমি চাই, অন্য কিছু নয়।
পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, তুলসীদাস গঙ্গা নদীতে স্নান করার পরে, প্রচুর জল ভরে একটি গাছের নীচে রেখে দিতেন, যার উপর একটি আত্মা বাস করত। একদিন আত্মা তুলসীদাসকে খুব খুশি হয়ে কিছু চাওয়া চাইতে বললেন। তুলসীদাস ভগবানের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং আত্মা তাকে হনুমানজির আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
তুলসীদাস আত্মার কথামতো হনুমান জিকে খুঁজে পেলেন এবং তাঁকে ভগবান শ্রী রামের ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। এতে হনুমানজি তুলসীদাসকে চিত্রকূটের ঘাটে যেতে নির্দেশ দেন।
তুলসীদাস চিত্রকূটের ঘাটে তাঁর প্রভুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, এখানে তিনি প্রভুর পথ অবধি ঘাটের পাড়ে চন্দন মাখতেন। একদিন ভগবান শ্রী রাম তাঁর চন্দন নিয়ে হাজির হন এবং তুলসীদাসকে তাঁর দর্শন দেন। একটি শিশুর বেশে ভগবান শ্রী রাম তুলসীদাসের কাছ থেকে চন্দনের তিলক পড়তে চেয়েছিলেন। শিশুটিকে দেখে তুলসীদাস এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর কপালে চন্দনের তিলক পড়িয়ে দিয়েছিলেন।
চিত্রকূটের ঘাটে ভাইদের ভিড়।
তুলসীদাস ঘষে চন্দন, তিলক দেয় রঘুবীর॥
এভাবেই হনুমানজীর ইশারায় তুলসীদাস ভগবান শ্রী রামের দর্শন লাভ করেছিলেন। তুলসীদাস চিত্রকূট ত্যাগ করে বারাণসীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় মাঘ মেলায় কলা গাছের নীচে মুনি যাজ্ঞবল্ক্য ও ভরদ্বাজের দর্শন পেয়েছিলেন।
তুলসীদাস বারাণসীর ঘাটে বসেই ‘রামচরিতমানস’ কাব্যটি রচনা শুরু করেছিলেন। আটদিন ধরে প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় কাব্যের যে শ্লোকগুলি তিনি রচনা করেছিলেন, একদিন রাতে হঠাৎই সেগুলি হারিয়ে যায়।
বারাণসীর বিশ্বনাথ মন্দিরে শিব তুলসীদাসকে স্বপ্নে সংস্কৃতের পরিবর্তে স্থানীয় ভাষায় শ্লোকটি রচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁকে আশীর্বাদ দিয়ে শিব বলেছিলেন যে অযোধ্যায় গিয়ে তিনি যেন তাঁর এই কাব্য রচনা করেন।
সেই নির্দেশমত অযোধ্যাতে রামনবমীর দিনে ‘রামচরিতমানস’ কাব্য লেখা শুরু করেছিলেন তিনি। সমগ্র কাব্যটি তিনি রচনা শেষ করেছিলেন দু-বছর সাত মাস ছাব্বিশ দিনে। এরপর তুলসীদাস বারাণসীতে এসে বিশ্বনাথ মন্দিরে শিব এবং পার্বতীর সামনে সেই কাব্য পাঠ করেছিলেন।
গোস্বামী তুলসীদাস মোট ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তবে তাঁর রচিত রামচরিতমানস সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছে। এই গ্রন্থটি হল সংস্কৃত রামায়ণ মহাকাব্যের অবধি ভাষায় অনুবাদ। এটি নয়টি খণ্ডে বিভক্ত যার মধ্যে বালকাণ্ডটি আয়তনে সবচেয়ে বড়।
রামচরিতমানস তুলসীদাসের এক অমর কীর্তি যাকে তুলসীদাসী রামায়ণ বলা হয়। রামচরিতমানস রচনা করে তিনি আগম, নিগম, পুরাণ, উপনিষদ প্রভৃতি সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সারমর্মকে পূর্ণ করেন এবং বৈদিক হিন্দু নীতিগুলিকে চিরকালের জন্য অমর করে তোলেন।
হনুমান চালিসা তুলসীদাস রচিত রামচরিতমানসের একটি অংশ বিশেষ। শ্রীহনুমানের স্তুতি হিসেবে তিনি হনুমান চালিসা রচনা করেন। হনুমান চালিসা পাঠ করলে সমস্ত সঙ্কট দূর হয়ে যায় বলা হয়। হনুমান চালিসা মূলত রচিত হয় অবধি ভাষায়। হনুমান চালিসা রচনা হয়েছিল ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে সম্ভবত ১৫৮২ সালে।
ভারতে তখন মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল। ততদিনে তুলসীদাস এক সিদ্ধ পুরুষ হয়ে উঠেছেন। একবার তিনি এক গাছের নীচে বসে ধ্যান করছিলেন। এক মহিলা এসে তাকে প্রণাম করেন। তুলসীদাস তাকে সুখী হবার আশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ পেয়ে মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি মহিলাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করাতে মহিলা বলেন এই মাত্র তার স্বামী মারা গেছেন। তুলসীদাস বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে রাম নাম নেবার পরামর্শ দেন। মহিলা বাড়ি গিয়ে রাম নাম শুরু করেন সঙ্গে উপস্থিত সকলেই রাম নাম করতে থাকেন। কিছুক্ষন পরেই মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে ওঠেন। এই রকম তিনি এর আগেও এক দৃষ্টি হীন ব্যক্তিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন। তার কীর্তি দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এই খবর সম্রাট আকবরের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। আকবর বীরবল ও টোডরমলকে পাঠায় খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। তারা খবর নিয়ে এসে সম্রাটকে বলেন যে ঘটনা সত্য। আকবর তুলসীদাসকে রাজ সভায় ডেকে পাঠান এবং কিছু চমৎকার দেখাতে বলেন। তুলসীদাস সেটা করতে অস্বীকার করে বলেন আমি কোন চমৎকারী বাবা নই যে চমৎকার দেখাব। চমৎকার দেখানেওয়ালাতো স্বয়ং শ্রীরাম। আমি নই।
এই কথা শুনে সম্রাট আকবর প্রচণ্ড ক্রোধিত হয়ে তুলসীদাসকে আটক করবার নির্দেশ দেন এবং সেপাইরা তাঁকে ফতেপুর সিক্রিতে আটক করে রাখেন। তুলসীদাস বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে শ্রী হনুমান চালিসার রচনা শুরু করেন। হনুমান চালিসার রচনা যখন প্রায় শেষ তখন ফতেপুরসিক্রি সমেত গোটা রাজধানীতে কয়েক লক্ষ বানর হামলা করেন। বানরের অত্যাচারে সম্রাট সহ রাজধানীর সকল নাগরিক অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিচক্ষন সম্রাট আকবরের নিজের ভুল বুঝতে সময় লাগে নি। তিনি দ্রুত তুলসীদাসকে কয়েদ থেকে মুক্ত করেন এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তুলসীদাস মুক্ত হতেই বানরের উপদ্রব বন্ধ হয়ে যায়। সম্রাট আকবর আমৃত্যু তুলসীদাসের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক রেখেছিলেন।
তুলসীদাসের অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল ‘হনুমান বাহুক’, ‘জানকী মঙ্গল’, ‘বিনয় পত্রিকা’, ‘কৃষ্ণ গীতাবলী’, ‘তুলসী সাতসাই’, ‘রামলীলা নাহছু’, ‘দোহাবলী’, ‘বারভাই রামায়ণ’, ‘বৈরাগ্য সন্দিপনি’ ইত্যাদি। তুলসীদাস তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলির মাধ্যমে কিছু বিশেষ কাহিনি উল্লেখ করেছেন যেগুলি ব্রজ ও অবধি ভাষায় রচিত। ‘দোহাবলী’ গ্রন্থের প্রায় পঁচাশিটি দোঁহা তিনি রামচরিতমানসে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ‘কৃষ্ণ গীতাবলী’ বইতে তুলসীদাস শৈশবে কৃষ্ণের রামলীলা বর্ণনা করেছেন। পার্বতী ও শিবের বিবাহ বর্ণনা করেছেন তুলসীদাস ‘পার্বতী মঙ্গল’ বইতে, একইভাবে তাঁর লেখা ‘জানকী মঙ্গল’-এ সীতা ও রামের বিবাহের কাহিনি সংকলিত আছে। ‘রামলালা নাহছু’ বইটি শিশু রামের বাল্যলীলার বর্ণনায় সমৃদ্ধ। ‘হনুমান বাহুক’ গ্রন্থে তিনি ভয়াবহ রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
তুলসীদাস হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান বদ্রিকা, দ্বারকা, পুরী, রামেশ্বরম এবং হিমালয় ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর হিমালয় ভ্রমণের একটি কাহিনি বর্ণিত আছে ‘রামচরিতমানস’-এ। জানা যায় বর্তমান তিব্বতের মানস সরোবর হ্রদ পরিদর্শন করে তিনি সেখানে কাকভূশন্ডির দেখা পেয়েছিলেন। সেই কাকটির বর্ণনাও রামচরিতমানসে আছে এবং তাঁর লেখা রামচরিতমানসের কাহিনির চার কথাকারের মধ্যে এই কাকভূশণ্ডি ছিল অন্যতম।
একবার বৃন্দাবনের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি একটি মন্দিরে পৌঁছেছিলেন। মন্দিরে মূর্তি খুব সুন্দর লাগছিল। মন্দিরের পাণ্ডা তুলসীদাসকে বেশ কয়েকবার মূর্তির সামনে মাথা নত করতে বলে। তবে গোস্বামী তুলসীদাস প্রতিমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু, কিভাবে সে কৃষ্ণের সামনে মাথা নত করবে? তার দেবতা ছিলেন শ্রী রাম।
সে তার আবেগী মন খুলে তার সামনে রেখে বলল —
নাথ হয়ে গেলেও আজ সেই চিত্র কোথায়।
ধনুক বাঁধলে তুলসীর মাথা নতুন হয়॥
কিংবদন্তি বলে যে তুলসীদাসের এই কথায় কৃষ্ণের মূর্তি বাঁশি ছেড়ে ধনুক হাতে নিয়েছিলেন।
শোনা যায় বারাণসী মন্দিরের ব্রাহ্মণেরা তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ কাব্যটি বিভিন্ন উপায়ে চুরি করতে চেয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তাঁরা দুজন চোরকে তুলসীদাসের কুঁড়েঘরে পাঠান। কিন্তু সেখানে দুজন শ্যামবর্ণ ও গৌরবর্ণের পুরুষ পাহারা দিচ্ছিলেন সেই সময়। তাঁদের দেখে দুই চোরের মনে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটে, তাঁরা রামের ভক্ত হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণেরা কোনও উপায় প্রয়োগ করতে না পেরে মধুসূদন সরস্বতীজীকে কাব্যটি দেখতে বলেন। তিনি তুলসীদাসের কাব্যটি পড়ে যারপরনাই আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।
১৬২৩ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাণসীর গঙ্গানদীর তীরে অসি ঘাটে গোস্বামী তুলসীদাস দেহত্যাগ করেন। দেহত্যাগের আগে তিনি রামের নাম জপ করছিলেন।
তুলসীদাস তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় বারাণসী ও অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। বারাণসীর গঙ্গা নদীর ঘাট ‘তুলসীঘাট’ নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল। তিনি বারাণসীতে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, যেখানে এই মন্দিরটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানেই তিনি হনুমানের দর্শন লাভ করেছিলেন।
রামলীলা নামে রামায়ণ-ভিত্তিক লোকনাট্যের প্রচলনও তুলসীদাসই করেছিলেন। তুলসীদাসকে হিন্দি, ভারতীয় ও বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হয়। তুলসীদাস ও তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রভাব ভারতের শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সমাজে সুদূরপ্রসারী। সেই কারণে তাঁকে স্মরণ করতে তাঁর জন্ম তিথি উপলক্ষে এই জয়ন্তী উৎসব পালন করা হয়।
তুলসীদাস জয়ন্তী উপলক্ষে হনুমান মন্দির ও রাম মন্দিরে রামচরিতমানস-এর অনুচ্ছেদ পাঠ করা হয়। সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে সেই পাঠ শ্রবণ করেন।
তুলসীদাস সেই ব্যাক্তি ছিলেন যিনি একটি মানব হয়েও ভগবান শ্রীরামকে উপলব্ধি করেছিলেন।
সকল জগৎকে সীতা ও রামের স্বরূপ (‘সীতারামময়’) মনে করে আমি করজোড়ে প্রণাম করি।