বৃহস্পতিবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বিশেষ বেঞ্চে আরজি কর মামলার শুনানির কথা ছিল। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় জানা যায় যে তা হচ্ছে না। এদিন প্রধান বিচারপতি বসছেন না আর সেই কারণেই আরজি কর ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি হচ্ছে না বলে খবর। এই দিনটির জন্য অধির অপেক্ষায় ছিলেন আরজি কর হাসপাতালের নির্যাতিতা চিকিৎসকের বাবা ও মা। যারা তাঁদের মেয়ের নির্মম মৃত্যুর পর এ রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের নানা অসঙ্গতি আর অনিয়মে হয়রান হয়ে সুবিচারের আশা হারিয়েছিলেন। কারন গত ৮-৯ আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হলে মহিলা চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত নগ্ন দেহ উদ্ধারের পর একজন সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়া তখনো পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করে না। এদিকে এফআইআর থেকে শুরু করে পুলিশের তৎপরতার মধ্যে নানা ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়ে, প্রশ্নের মুখে পড়ে প্রশাসন। অন্যদিকে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের এজলাশে এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে আরজি কর ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন তোলে। নড়ে ওঠে রাজ্যের আম জনতা থেকে শুরু করে প্রশাসন। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় হাসপাতালে কর্মবিরতি পালন করা আন্দোলনকারী চিকিৎসকদেরও আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আদালতের উপর ভরসা করে কাজে ফিরে যান’। কিন্তু দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখতে পারেননি চিকিৎসক সমাজ, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কথা ভেবেই হয়তো চিকিৎসকরা আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি। সেদিন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি মামলাটি হাতে নিয়ে রাজ্য সরকারকে যেমন নানা প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল বৃহস্পতিবার ঠিক শুনানির দিন তাঁর হঠাৎ অসুস্থতা এবং মামলার শুনানি না হওয়ার খবরেও কিন্তু একাধিক প্রশ উঠেছে মহিলা চিকিৎসকের মা-বাবা থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যবাসীর মনে।
গোটা রাজ্য থেকে শুরু করে সমগ্র দেশে তোলপাড় ফেলে দেওয়া এই ঘটনার তদন্ত কোন পথে তা সিবিআইকে রিপোর্ট আকারে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চকে জানাতে হবে একই সঙ্গে রাজ্য সরকারের তরফে এই সংক্রান্ত ঘটনায় স্ট্যাটাস রিপোর্ট দিতে হবে- দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই নির্দেশকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে প্রধান বিচারপতি বৃহস্পতিবার আদালতে উপস্থিত থাকছেন না। তিনি নাকি অসুস্থ! তাহলে এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ কবে? এখনো পর্যন্ত তা বলা হয়নি। যেটা জানা যাচ্ছে তা হল প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় গত কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ, এবং বেঞ্চে বসছেন না। তার মানে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর বৃহস্পতিবার এজলাশে বসা নিয়ে একটা সংশয় ছিলই। কিন্তু এই খবর বুধবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টর তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে দেওয়া হয়। তার আগে আর কারও কাছেই সে খবর ছিলনা। এমনকি আরজি কর-কাণ্ডে মামলাকারীর পক্ষে লড়ছেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য তিনিও জানতেন না। বৃহস্পতিবার শুনানি থাকায় তিনি বুধবার সন্ধ্যাতেই দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়ে মাঝপথে জানতে পারেন।
বুধবার সন্ধ্যায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয়েছিল, প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ ৫ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) বসবে না। তবে একথা বলা চিল যে ওই বেঞ্চের বাকি দুই বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র আলাদা করে ১০ নম্বর কোর্টের কয়কটি মামলা শুনতে বেঞ্চে হাজির থাকবেন। কিন্তু তাঁরা কোন কোন মামলার জন্য বেঞ্চে বসবেন, সে বিষয়ে কিছুই স্পষ্ট করে জানানো ছিলনা। ফলে আরজি কর মামলার শুনানি নিয়ে যথেষ্ট রকম অনিশ্চয়তা আগে থেকেই তৈরি ছিল। প্রথম বিজ্ঞপ্তির বেশ কিছু সময় পরে সর্বোচ্চ আদালত থেকে দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় যেখানে ১০ নম্বর কোর্টের মামলার নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় দেখা যায়, আরজি করের মামলাটির কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চেও শুনানি হচ্ছে না। দীর্ঘ দিন ধরে আরজি করের বিচারের দাবিতে দিন গুনছিলেন সাধারণ মানুষ। এই শুনানির দিকেই তাকিয়ে ছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকেরা। এবং অবশ্যই নির্যাতিতার মা-বাব ও পরিবার কিন্তু শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় তাঁরা হতাশ। কবে আরজি কর মামলার শুনানি হবে?
শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে নাগরিক সমাজের মধ্যে। হওয়াটাই স্বাভাবিক, সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা পিছয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনকও বটে। সুপ্রিম কোর্টের এই মামলার শুনানির দিকে তাকিয়ে ছিল আপামর জনতা। বিশেষ করে বুধবার আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তাররা শুনানির আগে রাত জাগা কর্মসুচির ডাক দিয়েছিল। একই সঙ্গে রাত ৯ টার সময় বিশেষ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আরও এক রাত দখল করেন মহিলা পুরুষ। কিন্তু ঠিক তার আগেই সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর সংক্রান্ত মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। যে ধর্ষণ বা নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষকে। সমাজের প্রতিটি স্তরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ন্যায়বিচারের দাবিতে গনতান্ত্রিকভাবে আওয়াজ তুলছেন। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত আগ বাড়িয়ে এসে আরজি কর ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের মামলা নিজের হাতে তুলে নিয়েচিল তারাই আবার ছন্দপতন ঘটিয়ে দিলো। জুনিয়র চিকিৎসকরা এই আশঙ্কার কথা ভেবেই কী আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি? তবে তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। আর সেই জায়গা থেকেই প্রশ্ন উঠলো যে একজন সন্ত্রাসবাদীকে বাঁচাতে যদি মধ্য রাতে সুপ্রিম কোর্ট খুলে সওয়াল জবাব হয় তাহলে আরজি করের ধর্ষণ খুনের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার শুনানির দিনক্ষণ স্থির থাকা স্বত্বেও বিলম্ব কেন?
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ভোর ৩ টের সময় সুপ্রিম কোর্টের সিংহ দরজা খুলে একটি মামলার সওয়াল জবাব হয়েছিল। সেই মামলা ছিল সন্ত্রাসবাদী মুম্বাই বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড ইয়াকুব মেননকে নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের চার নম্বর এজলাসে সেই মামলার শুনানি করেন তৎকালীন বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি পি সি পন্থ ও বিচারপতি অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ। উল্লেখ্য, আগের দিন ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি স্থগিতের আর্জি খারিজ করে দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতি। তাই ওই সন্ত্রাসবাদীর ফাঁসি রোধ করতে ভোর রাতে সওয়াল জবাব করে নজির গড়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত ইয়াকুবের ফাঁসি আটকাতে পারেনি সর্বোচ্চ আদালত। নির্দিষ্ট দিন ভোর সাড়ে ৬টায় তার ফাঁসি হয় ইয়াকুব মেননের। যে মুম্বই বিস্ফোরণের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী। প্রশ্ন এক সন্ত্রাসবাদীকে বাঁচাতে যদি মধ্য রাতে আদালতের দরজা খুলে শুনানি হতে পারে তাহলে আরজি করের ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে দেওয়া? শেষ পর্যন্ত নষ্ট ব্যবস্থার পাকেচক্রে তিলোত্তমার বলিদান ব্যর্থ হয়ে যাবে নাতো?
যে আদালতের অন্য বেঞ্চেও আরজি করের মামলা রাখা হলনা। দ্বিতীয় তালিকাতেও আরজি কর মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়নি সে আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে? কিভাবে? কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি যদি অনুপস্থিত থাকেন তাহলে তিনি অন্য একটি বেঞ্চকে তাঁর এজলাসের মামলা স্থানান্তর করে যান। ওই মামলাগুলির শুনানি ওই বিশেষ বেঞ্চেই হয়। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রেও এমন হয়। কিন্তু আরজি করের মামলার ক্ষেত্রে এমনটা হল না, কেন হল না? সুপ্রিম কোর্টেও তারিখ পে তারিখের ঐতিহ্য বহাল আছে। বিচারের দাবি সার মাত্র কারণ, ঝুলে আছে বহু মামলা। দেশে আইনের শাসন বজায় রাখা এবং সংবিধান রক্ষা করার উদ্দেশে গঠন করা হয়েছিল যে সর্বোচ্চ আদালত সেখানে কতগুলি মামলা এখনো ঝুলে রয়েছে জানেন? কমপক্ষে সত্তর হাজারের বেশি। দেশে অপরাধের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি সুপ্রিম কোর্টে মামলার সংখ্যাও বাড়ছে লাফ দিয়ে। ২০২৪ সালের গোড়াতে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০,২২১। এই পেন্ডিং মামলাগুলির মধ্যে অধিকাংশই সিভিল এবং অপরাধমূলক মামলা। এছাড়া রয়েছে সাংবিধানিক, জনস্বার্থ মামলা, বিভিন্ন আবেদন। বছরের পর বছর ধরে মুলতুবি হয়ে পড়ে রয়েছে এই মামলাগুলি।