একজন পরিপূর্ণ শিল্পী বলতে যা বোঝায় সেই প্রতিভাদৃপ্ত গায়ক, সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত বাবু নিজেই ছিলেন একটি সাঙ্গীতিক যুগ। তিনি যেমন স্রষ্টা তেমনি বহু প্রতিভাধর সংগীত শিল্পীর আবিষ্কার কর্তাও। তার নীতিবোধ ও সততা ছিলো অননুকরণীয়। অসাধারণ জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার জীবন ছিল খুব সাধারণ। হেমন্তবাবু নিজের জীবন নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা আজও অনেকের কাছে প্রেরণাদায়ক হতে পারে। তিনি নিজেই বলতেন, ‘কোনদিন ভাবেনি যে বেরিয়ে বিরাট শিল্পী হব। চারিদিকে গান গেয়ে বেড়াবো। আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী, ভাগ্যবিধাতাই আমাকে গানের জগতে নিয়ে এসেছেন।
তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিয়ে যখন একটু আধটু গাইছি তখনও আমার মনে হয়নি গানকে পুরোপুরি ক্যারিয়ার হিসেবে নেব। তাই শর্টহ্যান্ড আর টাইপ শিখতে গেলাম, তাতে চাকরি একটা জুটি নেয়া যাবে বৈকি। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। একে ভাগ্য ছাড়া আর কি বলব!’
জীবন সমস্যার সূত্র, নিরহংকার, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার পাশাপাশি বাংলা আর হিন্দি সংগীত জগতের উজ্জ্বল ঘটনার নানান কথা হেমন্ত বাবু শুনিয়েছেন পাঠকদের। প্রসঙ্গত লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে হেমন্ত বাবু অনেক অজানার ঘটনার প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের লেখা ।
পিছিয়ে যাই আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে। কলকাতা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এক বিরাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেসকার-সহ কলকাতা ও মুম্বাইয়ের তাবড় তাবড় সংগীত রথী মহারথী। সঙ্গে বাংলার হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয় নায়ক নায়িকারা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বাস্থ্য উপস্থিত ছিলেন যুবভারতীতে। মূল মঞ্চের সামনে ভিআইপি এনক্লোজারে সোফায় বসে ছিলেন লতা। একটু তফাতেই বসে ছিলেন জ্যোতিবাবু।
মঞ্চে উঠলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান পরিবেশনার পথ ধরলেন ‘রানার’। হেমন্ত বাবুর তালে তালে মাটিতে পা ঠুকছেন আর মাথা দোলাচ্ছেন লতা। গানটি যে রীতিমতো উপভোগ করছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গান শেষ হওয়ার পর ইন্ডিয়ান নাইটেঙ্গেল উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তার শ্রদ্ধা মানুষটিকে অভিনন্দন জানালেন। লতার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন জ্যোতিবাবু।
হেমন্তবাবুর পর লতা গাইবেন। হেমন্তবাবু মঞ্চ থেকে নেমে আসার আগেই লতা মঞ্চে উঠে এলেন। তখন দর্শক শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালি। হেমন্তবাবু লতাকে দেখিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এবার আমার ছোট বোন লতা গাইবে’।
হেমন্তবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে লতা আবেগমথিত গলায় বললেন, ‘দাদা আশীর্বাদ কিজিয়ে, ম্যায় ঠিক সে গা সাকু।’ এরকম দাদা বোনের এক মধুর সম্পর্ক ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকরের মধ্যে।
লতা মঙ্গেশকরের জীবনে অভিভাবকের মতো ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলা-হিন্দি ফিল্মের গান, আধুনিক গান এমনকি রবীন্দ্র সংগীত, কত গান গেয়েছেন একসঙ্গে। রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেশকরকে উৎসাহিত করেন। ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা’, ‘মধু গন্ধে ভরা’, ‘তুমি রবে নীরবে’ গাওয়া ডুয়েট গান আজ দর্শকদের মধ্যে ভীষণ পপুলার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘শেষ পরিচয়’ নামে বাংলা ছবিতে প্রথম গান গেয়েছিলেন লতা। হিন্দি ছবির সেরা দশটা গানের মধ্যে হেমন্ত মুখার্জী সুরে ‘বিশ সাল বাদ’-এর ‘কাঁহি দ্বীপ জ্বলে কাঁহি দিল’ অন্যতম।
কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধার। কলকাতা থেকে মুম্বাই গেলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেসকারের জন্য নিয়ে যেতেন তাঁতের শাড়ি। দু-দিকে বেণী ঝুলিয়ে সেই শাড়ি পরে একদম বাঙালি মেয়েদের মতো লাগতো লতাকে। বড় শ্রদ্ধা করতেন লতা মঙ্গেশকর হেমন্তবাবুকে।একাধিক বাংলা ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকের গান গাইয়েছেন হেমন্তবাবু।
কলকাতা ফেরার ট্রেনের টিকিট কেটে চুপিচুপি মুম্বাই থেকে পালিয়ে আসছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে প্রায় ধরেবেঁধে আটকান প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। ‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিওর তখন সর্বেসর্বা শশধর মুখোপাধ্যায়। পরিচালক হেমেন গুপ্তকে দিয়ে আনন্দমঠ ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে মুম্বাইতে নিয়ে গেছিলেন তিনিই। তখন ‘ফিল্মিস্তান’-এর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক অতি খারাপ হলেও কম বলা হয় তবু তাকে দিয়ে ছবির জন্যে বন্দেমাতারাম গাইয়ে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
২১ বার ‘টেক’ এরপর মিলেছিল সবুজ সংকেত। যতক্ষণ না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পছন্দ হচ্ছে, ততবার লতা মঙ্গেশকর গানটি গেয়েছিলেন। এত কিছু ঘটনার পর গানটি মুক্তি পেল ১৯৫২ সালে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত, হেমেন গুপ্তের পরিচালনায় হিন্দি আনন্দমঠ ছবিতে সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আনন্দমঠ ছবিটি তখন হিট করেনি কিন্তু বন্দেমাতারাম গানের ওই অভিনব সুর ভারতবাসীর দেশপ্রেমের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে গেল অচিরেই।
মল্লার রাগে গানটি, কাওয়ালী তালে বাঁধা। পুরুষ এবং নারী কন্ঠে বন্দেমাতারাম গানটি গাওয়া হয়েছিল। লতামঙ্গেসকার যখন গাইছিলেন বিশেষ করে শেষ স্তবকে ‘মা’ ডাকের নেপথ্যে পুরুষ প্রান্তে হামিং দিয়েছিলেন হেমন্ত। দেশ সেবক সন্তান দলের যুদ্ধযাত্রার দৃশ্যের নাটকীয় আবেদন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরে বন্দেমাতরম হয়ে উঠলো মার্চিং টিউন। ২০০২ সালের বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস সমীক্ষাও অনুযায়ী পৃথিবীর জনপ্রিয় ৭ হাজার গানের মধ্যে প্রথম দশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল আনন্দমঠ ছায়াছবির এই বন্দেমাতারম গানটি।
আনন্দমঠ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজে গিয়েছিলেন ‘জয় জগদীশ হরে’ গীতা দত্তের সঙ্গে ডুয়েট। গান হিট হলো কিন্তু ছবি? সুপার ফ্লপ। তারপরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে আসতে চান কলকাতায়। ভিটি স্টেশন থেকে লুকিয়ে ফোন করে সে খবর শশধর মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছে দেন হেমন্ত পত্নী বেলা দেবী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেবার ফেরা হয়নি এরপরই তো ‘নাগিন’। সে ছবির গানের রেকর্ড কুড়ি বছর বাদে ভেঙেছিল ‘ববি’। এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কি না এক সময় রেকর্ড কোম্পানি দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। জলসায় গান গাওয়ার আশ্বাস পেয়েও ঠায় ৪ ঘন্টা বসে থেকে শুনেছেন, ‘আপনার গানকে শুনবে? দেখছেন না পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন, ওর গান শুনে বাড়ি চলে যান’।
ভেবে ছিলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন, গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল তখন। অথচ পুরো ষাটের দশক জুড়ে শ্রাবণের পুঞ্জ মেঘের দিকে তাকিয়ে মহাকরণের কোন কনিষ্ঠ কেরানি যা ভেবেছেন, তাও তো হেমন্ত কন্ঠই। ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’।
গোটা ভারতে এখনো বিয়ের ব্যান্ড পার্টিতে ,আপনি চান বা নাই চান বাজবেই হেমন্ত সুরারোপিত ‘নাগিন মেরা মান দোলেরে’। আর হ্যারিসন রোড পাড়ায় ঠাকুর বিসর্জনে হোক বা শিবরাত্রিতে মেহবুবা ব্যান্ডে শোনা যাবে, ‘নিঝুমও সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা …
আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে গায়ক বা সুরকার ভাবলে কম বলা হয়। তিনি সময়ের একটি অবিনশ্বর দাগ, এমন এক সাংস্কৃতিক উপস্থিতি যিনি যুগের মুদ্রাভঙ্গকে বিপুল প্রতিভায় ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত করেন। বলুনতো ‘রানার’ থেকে জনপ্রিয় বাংলা গান আর কটা আছে? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ব্যতিত এই গান গাওয়া সম্ভব ছিল! হেমন্ত না থাকলে শ্যামা শাপমোচন বাল্মিক প্রতিভা চিত্রাঙ্গদা আর চন্ডালিকা, উওর বাংলার পাহাড় থেকে নদীয়ার সমতল ঘুরে সুন্দরবনের সজনেখালি পর্যন্ত বাহু বিস্তার করতে পারতো না। আমরা বাঙালি বলেই জানি ভেড়ির নোনা জলও হেমন্ত পান করলে মিষ্টি হয়ে যেত। তাইতো সলিল চৌধুরী বলতেন, ঈশ্বর গান গাইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠেই গাইতেন। ব্যারিটোন ভয়েসের এই মহান গায়ককে তার ১০৬ বছর জন্ম শতবার্ষিকীতে জানাই আকুন্ঠ শ্রদ্ধা।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও তথ্যঋণ : কিংবদন্তি সংগীত সাধকের অন্তরঙ্গ জীবন কথা: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়– সুমন গুপ্ত; হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রচনা সংগ্রহ- শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়।