নিজের জীবনে বাতিক থাকে কমবেশি অনেকেরই। এই বাতিক গড়ে ওঠে পারিপার্শ্বিক নানা কারণে। শিশু বয়সেও বাতিক গড়ে ওঠে, যেমন পরীক্ষার সময়। একটা পরীক্ষা দিতে যাবার সময় হয়ত মা কপালে দইএর ফোঁটা দিলেন না, আর সেদিনই শিশুটির পরীক্ষা মনোমত হল না। আবার পরদিন দইএর ফোঁটা নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে সে টপাটপ সব উত্তর লিখে ফেলল। ব্যস এটাই হয়ে উঠল একরকম বাতিক। বাতিকটা সাধারণতঃ গড়ে ওঠে একই জিনিস বারংবার কারো জীবনে ঘটলে।
এই পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন যাদের মনে কোনো বাতিক (কুসংস্কার বলব না) নেই। কিছু না কিছু বাতিকে সকলেই একটু আধটু ভোগেন এবং ভোগান। মনে পড়ে যায় পরীক্ষার হলে আমার এক বান্ধবী প্রশ্নপত্র আর খাতা পাবার পর ঠিক গুনে গুনে সাতবার খাতাটা মাথায় ঠেকাত, তারপর লিখত। হাসির ব্যাপার নয়, সে কিন্তু ভালো রেজাল্ট করত। আবার কারো কারো থাকে তালার উপরে অসীম টান। বাড়ি বন্ধ করে কোথাও যাবার আগে তালা ধরে পাঁচ ছয় বার টানাটানি করে তাঁরা বাইরে বের হন। গুনতে কমবেশি হলে আবার ফিরে এসে টানাটানি করে তবে যাত্রা করেন। তবে সাধারণ মানুষের সাধারণ বাতিকের গল্প নয়, কিছু বিখ্যাত সাহিত্যিকের বিখ্যাত বাতিকের গল্প নিয়ে এসেছি আজ।
প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস ছিল তাঁর। অন্ধকার থাকতেই তিনি বসতেন ধ্যানে। এই আধো অন্ধকারই ধ্যানস্থ হবার প্রকৃষ্ট সময়। মনকে স্থির না করলে অমন লেখা আসবে কি করে? পূর্ব দিনের রাগ ক্ষোভ সব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে এই ধ্যান। তাঁর কথায়, “তোরা এই যে দেখিস তোদের রবি ঠাকুর, আমি কিন্তু তার থেকেও বড় করে দেখি আমার আমিকে। কথা বলি ভগবানের সঙ্গে। নিজেকে স্নান করাই।” সত্যিই তো, নিজের দেহের স্নান করালেই তো মুক্ত হওয়া যায় না। দরকার নিজের আত্মাকে স্নান করানো। সেটার জন্য প্রয়োজন আধো অন্ধকারে নিজের মুখোমুখি হওয়ার। সেটাই ধ্যান। ধ্যানের পর তিনি লিখতেন অনেকগুলি চিঠি। তারপর ছিল তাঁর চা পান ও প্রাতরাশ। এইবার শুরু হত তাঁর সাহিত্যপর্ব। চিঠি লেখার সময়েই তাঁর যে মানসিক ক্ষমতার অনুশীলন হত, তার পরেই তিনি বসতেন আসল লেখায়। কখনও এই নিয়মের বাইরে তিনি যাননি। আরও একটি কথা তাঁর সম্বন্ধে শোনা যায় যে তিনি এক বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। একঘেয়ে লাগত তাঁর। সৃষ্টির কাজ ব্যাহত হত।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাউন্ডুলে ইন্দ্রনাথ বা শ্রীকান্ত ভাবার কোনো কারণ দেখি না। লেখার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। কোন পাতায় কতটুকু লিখবেন, কি কি বিষয় নিয়ে লিখবেন, সবটুকু আগে লিখে নিতেন। ব্যবহার করতেন অত্যন্ত দামি কাগজ ও কলম। লেখা ছিল খুব ছোট ছোট হরফে কিন্তু মুক্তোর মত হস্তাক্ষরে। একবার কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি এতো দামি কাগজ কলম কেন ব্যবহার করেন?” লেখক উত্তর দিলেন, “মা সরস্বতী যে আমায় এত বড় প্রতিভা দান করেছেন, সেকি সস্তা কাগজে লিখে নষ্ট করার জন্য?” কথাসাহিত্যিক নাকি অল্প আফিমের নেশা ছাড়া লিখতে পারতেন না।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাকি স্নান করতে অপছন্দ করতেন। তবে এটাকে ঠিক বাতিক বলা যাবে কিনা সেটা পাঠক ঠিক করবেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আধ্যাত্মিক বোধের মানুষ। তাঁর লেখার জন্য নির্দিষ্ট ছিল ব্যাঘ্রচর্ম। বাঘছালের উপরে বসেই তিনি লিখেছেন। সামনে থাকত একটি ছোট কাঠের টুল, যাতে কাগজ পত্র রেখে তিনি লিখতেন। পরনে থাকত একখানি ধুতি।
বিদ্রোহী কবি নজরুল কোনও অনুষ্ঠানে গেলে ঝলমলে পোশাক পরতেন। কেউ তাঁকে এই পোশাক পরার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দিতেন – অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। বলতেন, “আমার সম্ভ্রান্ত হওয়ার দরকার নেই। আমার তো মানুষকে বিভ্রান্ত করবার কথা!” তিনি বেহিসাবি, বাউন্ডুলে, বৈরাগী মানুষ। নজরুল প্রচুর পান-জর্দা ও চা খেতেন। লিখতে বসার আগে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ চা আর একথালা পান নিয়ে বসতেন। পান শেষ হলে চা, আবার চা শেষ হলে পান। তিনি বলতেন, “লেখক যদি হতে চান/লাখ পেয়ালা চা খান!”
সুন্দর হাতের লেখা ছিল রাজশেখর বসুরও। লেখায় কোনো কাটাকুটি হলে তিনি সেই জায়গায় কাগজ পেষ্ট করে দিতেন।
লেখক দিব্যেন্দু পালিত আবার পরিষ্কার লেখার ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। লিখতে গিয়ে কোথাও কাটাকুটি হলে আবার প্রথম থেকে লেখা শুরু করতেন।
সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার অদ্ভুত বাতিক ছিল। শরদিন্দুর নেশা ছিল জ্যোতিষশাস্ত্র। তিনি এই বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে তিনি তাঁর উপন্যাসের প্রত্যেক চরিত্রদের ঠিকুজি কোষ্ঠী তৈরি করে তবে উপন্যাস লেখাতে হাত দিতেন। সেই কোষ্ঠীর ফল প্রতিফলিত হত তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিতে। লেখক ঐতিহাসিক প্রতুল চন্দ্র গুপ্তকে নাকি বলেছিলেন, “ছক অনুযায়ী ব্যোমকেশের গাড়ি হবে না।” তবু শেষের দিকে তিনি ব্যোমকেশের গাড়ি কেনার ব্যাপার নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। দুঃখের বিষয় এই যে লেখকের মৃত্যুতে গল্পটি অসমাপ্ত থেকে যায়। ছক অনুযায়ী সত্যবতীর ভাগ্যেও নাকি গাড়ি ছিল না। তাই স্রষ্টাই চলে গেলেন। কাহিনীর নাম ‘বিশুপাল বধ’।
শিবরাম চক্রবর্তী আবার ঘর অগোছালো রাখতেন। ঝাঁট বা ধুলো ঝাড়া তো নৈব নৈব চ। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকত লেখার কাগজপত্র। তিনি বলতেন এরকম ধুলোর মধ্যে বসে না লিখলে নাকি তাঁর লেখাই আসবে না।
বুদ্ধদেব গুহ এবং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কলমপ্রীতির কথা বিশেষভাবে জানা যায়। বুদ্ধদেব গুহ লিখতে বসতেন হরেকরকম কলম নিয়ে এবং সেগুলি সবই ফাউন্টেন পেন। যেদিন যে রংয়ের কালি দিয়ে লেখার ইচ্ছে হত সেই রঙের কালি দিয়ে তিনি লিখতেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবার সন্ধ্যাবেলা কিছু লিখতেন না। কদাচিৎ খুব প্রয়োজন ছাড়া তিনি সন্ধেবেলা কখনও লিখতে বসেন নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অদ্ভুত মনঃসংযোগ ছিল, অনেক লোকের মাঝে বসেও, অজস্র কথা হাসি ঠাট্টার মধ্যেও তিনি অফিসে বসে উপন্যাসের পর্ব শেষ করেছেন।
সুনীল মানেই কাছাকাছি শক্তি আছেনই। শক্তির সুরা আসক্তি সর্বজনবিদিত। সন্ধ্যায় নিয়ম মেনে পান তাঁকে করতেই হত। সকালে উঠে মাথা পরিষ্কার হলে তবে তিনি বড়জোর দশ লাইন লিখে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। মনও ক্লান্ত। ফলে আবার শয্যাগ্রহণ। তারপর কিছুটা শক্তি পেলে স্নান খাওয়া সেরে অফিসযাত্রা করতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখতে বসার আগে বাড়ির ছাদে অসংখ্য উড়ে আসা পাখিদের সেওভাজা খাওয়ান। খাওয়া হলে পাখিরা চলে গেলে লেখক নিশ্চিন্ত মনে লিখতে বসেন।
কবি জীবনানন্দ দাশ লেখার আগে চুপ করে জানলার ধারে বসে থাকতেন। বাড়ির সামনের সবুজ দেখে তারপর লিখতে বসতেন।
নিখিল সরকার আবার খাটের উপরে বুকে বালিশ দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে লিখতেন। তবে এটিকে বাতিক না বলে অভ্যাস বলাটাই সঙ্গত।
যেমন সত্যজিৎ রায় ছিলেন প্রচন্ড নিয়মনিষ্ঠ। কারোর সঙ্গে কথা বলতে বলতেও নিখুঁতভাবে ছবি আঁকতেন, লিখতেন। শুনতেন অপরের কথা, উত্তর দিতেন। কিন্তু হাত এবং মস্তিষ্ক নিজের কাজ করে যেত। কোনও ছবি করার আগে সেই ছবির সেট, পোশাক, মুকুট, আলোয়ান সবকিছু নিখুঁত ভাবে এঁকে রাখতেন।
সমরেশ বসু যেমন একটা ফুলস্কেপ কাগজ পুরো ব্যবহার করতেন। কোথাও জায়গা ছাড়তেন না। হস্তাক্ষর সুন্দর ছিল কিন্তু খুব ছোট ছোট। এভাবে লেখার কারণ হিসেবে বলতেন একসময় কাগজের অভাব ছিল সেজন্য এমন অভ্যাস। তাই এগুলো ঠিক বাতিক বলা যাবে না। বাইরে তাঁর স্ত্রী টালির বাড়ির একফালি খোলা বারান্দায় তোলা উনুনে রাঁধতেন। লেখক কিছুটা লিখেই উঠে গিয়ে স্ত্রীকে শুনিয়ে আবার লিখতেন।
‘তাবান’ তখল্লুস ছদ্মনাম নিয়ে কবিতা লিখতেন মীর আব্দুল হায়ে। কিছু লেখার আগে পাতার উপর লিখতেন ‘৭৮৬’, যার অর্থ ‘আল্লার নামে’। দিল্লীবাসী এই কবির শখ ছিল পার্কার আর শেফার্স কলম। আর চাইতেন ভালো পেন্সিল। এই কলম আর পেন্সিল ছাড়া মানুষটির আর কিছু চাহিদা ছিল না। অবিবাহিত এই কবির সবচেয়ে ভালো লেখা আসত মানসিক হতাশা আর উত্তেজনা থেকে। সারা ভারত তাঁকে চেনে অন্য এক নামে। তিনি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হিন্দি ছবির বিখ্যাত গীতিকার সাহির লুধিয়ানভি।
উর্দু গল্পের লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর লেখাও শুরু হত ‘৭৮৬’ দিয়ে। পরিবারে তাঁর শান্তি ছিল না। তাঁর অধিকাংশ লেখাই এসেছে মানসিক অস্থিরতা, চিন্তা, অত্যধিক নেশার পর। শেষ জীবনে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে। সেখানে বসেই লেখেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা ‘তোবা টেকসিং’।
উর্দু ঔপন্যাসিক ইসমত চুঘতাই লিখতেন মেঝেতে মাদুর পেতে। লম্বা বালিশে হেলান দিয়ে বাঁহাতে একাই তাস খেলতেন আর ডান হাতে লিখতেন। পুরোনো তাসের গন্ধ ছাড়া লিখতে পারতেন না।
আবার বাংলায় ফিরি। সাহিত্যক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিশেষ নেশা ছিল বিভিন্ন দেশের মানচিত্র ও ভূগোল বিষয়ক বই পড়া। তিনি বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডলের নাম ও সেগুলো কখন কোনদিকে ওঠে তা খুব ভালোভাবে খবর রাখতেন। তাই আফ্রিকায় না গিয়েও তিনি চাঁদের পাহাড় লিখতে পেরেছিলেন।
সবশেষে আসি সাগরে। সাগর অর্থাৎ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি স্নান করতে অতিরিক্ত ভালোবাসতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বিপরীত। কাউকে অন্দরমহলে ঢোকানোর পূর্বে স্নান করিয়ে নাকি ঢোকাতেন। বানানের ব্যাপারে একেবারে নিখুঁত ছিলেন। একটা কাহিনী আছে – একবার একজন সাহায্যপ্রার্থী এসেছেন। এসে বললেন, “আমার খুব দুরাবস্থা। কিছু সাহায্য করুন।” বিদ্যাসাগর বললেন,
“সাহায্য করব, কিন্তু আকার বদলে আসুন।” দুতিনবার ঘোরাঘুরির পর সাহায্যপ্রার্থী অনেক কষ্টে বুঝলেন যে ‘দুরাবস্থা’ নয়, তাঁর আসলে ‘দুরবস্থা’। তাই আকার বদলে আসতে বলেছেন বিদ্যার সাগর। মুশকিল হচ্ছে আমাদের কেউ ‘আকার’ বদলে আসার জন্য বলার নেই, তাই আমাদের ‘দুরাবস্থা’ রয়েই গেছে।
খুব ভালো লাগলো।
Onek Oanusandhan kore Gunijon Der Lekhar shurute Banibandana koto rokamer hote pare ♥️ tar eak Ruchi- Alekshqa ….Sahaj bhave pore jaoyer moto aar majhe – majhe Kautuker swayd..