বিশাল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য লেখকদের অসামান্য সৃষ্টি মানুষকে করেছে মুগ্ধ, দিয়েছে প্রেরণা ও আনন্দ। কিন্তু এইসব সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে কি কি করতেন বা কি সংস্কারে বিশ্বাস করতেন, যে এভাবে লেখা শুরু করলে তাঁদের লেখা মানে উত্তীর্ণ হবে। সেইরকমই কিছু মজার বাতিক নিয়ে এই লেখা। প্রত্যেক সৃষ্টিতে যেমন পরিশ্রম থাকে তেমনি কিছু কিছু সংস্কারও থাকে বিখ্যাত লেখকদের। তাঁদের সৃষ্টির মতোই এইসব ঘটনাও কম রঙবাহারি নয়।
মার্কিন লেখক ট্রুম্যান কাপোটের ছিল অদ্ভুত বাতিক। শুক্রবার কোনও মতেই তিনি লেখা শুরু বা শেষ করতেন না। মানতেন ‘ফ্রাইডে দ্য থারটিনথ’ এর গেরোকে। কোনও হোটেল বা ফোনের নম্বরে যদি তেরো সংখ্যাটি থাকত তাহলেই আর রক্ষা নেই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘর বদলাতেন এবং ফোন নাম্বার অগ্রাহ্য করতেন। এমনকি তাঁর অ্যাসট্রেতে সিগারেটের পোড়া টুকরো তিনি তিনটির বেশি রাখতেন না তেরোর গেরোর ভয়ে। তিনের বেশি হলেই পোড়া টুকরো চলে যেত নিজের কোটের পকেটে। ট্রুম্যানের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে এর অন্যথা হলে তাঁর লেখার উপর প্রভাব পড়বে। তবে কোটের পকেটে কটি সিগারেটের পোড়া টুকরো রাখছেন তার হিসাব রাখতেন কি না জানা যায় না।
অসাধারণ বুদ্ধিমতী আগাথা ক্রিস্টির সৃষ্ট চরিত্র মিস মার্পল আর এরকুল পোয়ারোর রহস্য ভেদ পড়েন নি এমন মানুষ কমই আছেন। কিন্তু এই দুটি চরিত্র সৃষ্ট হল কিভাবে? আগাথা ক্রিস্টি নিজের বাড়িতে তাঁর শখের বিশাল বাথরুমে একটা সুন্দর বাথটাব বসালেন। ভালো ডিজাইনার দিয়ে বাথটাবের চারপাশে তৈরি হল বেশ কিছু তাক, যেখানে সাজানো থাকবে তাঁর প্রিয় ফল আপেল। বাথটবে আরাম করে বসে আপেল খেতে খেতে দুর্দান্ত সব প্লট তাঁর মাথায় আসত। জটিল রহস্যের সমাধান করতেন এই বাথটাবে বসেই। তাঁর দেখানো পথে পরবর্তীতে সত্যিকারের অনেক রহস্যের ও অপরাধের উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ।
ভার্জিনিয়া উলফের পরবর্তী যুগের ইংরেজ শিল্প ইতিহাসবিদ এবং লেখক কোয়েন্টিন বেলের মতে আর্টিস্ট বোন ভ্যানেসার সঙ্গে প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকেই একটা বাতিক তৈরি হয় ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফের। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভ্যানেসা বেল ছবি আঁকতেন। ভার্জিনিয়া ভাবলেন তিনিও যদি দাঁড়িয়ে লেখেন তাহলে তাঁর এই উদ্যম মানুষের চোখে পড়বে। বসে লিখলে যেটা হচ্ছে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভার্জিনিয়া নিজের পছন্দমত বানিয়ে নিলেন অদ্ভুত একটি টেবিল যেটির উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট। তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন পাতলা প্লাইউডের বোর্ড এবং ট্রে। যেখানে থাকত প্রচুর কালি ও কলম। যাতে লিখতে লিখতে এইসব জিনিসের জন্য উঠতে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু পরের দিকে লেখিকা অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার বসে লেখা শুরু করেন।
ফরাসি ঔপন্যাসিক সিদোনিয়ে গ্যাব্রিয়েল কোলেটের ছিল সবথেকে উদ্ভট বাতিক। কোলেটের ছিল সুসি নামে একটি বুলডগ। কোলেট প্রতিদিন এই সুসির গায়ের লোম থেকে পোকা বাছতেন এক মনে। কোলেটের মন এই পোকা বাছার মধ্যেই নিবিষ্ট হলে তিনি উঠে লিখতে বসতেন। এটিই সম্ভবত ছিল তাঁর একাগ্র হবার ধ্যান।
আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েস লিখতেন উপুড় হয়ে শুয়ে। গায়ে থাকত সাদা কোট আর লিখতেন নীল পেন্সিলে। অবশ্য তাঁর চোখের অসুখের জন্য তিনি এই অভ্যাস করেছিলেন এটাও হতে পারে। গায়ের সাদা কোটের রঙ রাতে আলোর প্রতিফলন ঘটাত। তাঁর শেষ বই ‘Finnegan’s Wake’ এর বেশির ভাগ অংশ তিনি লিখেছেন কার্ডবোর্ডের উপর ক্রেয়নের টুকরো দিয়ে। তিনি দুই সংখ্যাটিকে খুব প্রাধান্য দিতেন। কারণ তাঁর জন্মসাল ১৮৮২। বই প্রকাশ করতেন শেষে দুই আছে এরকম সালে।
রহস্য রোমাঞ্চ লেখক এডগার অ্যালেন পো লিখেছেন বিখ্যাত সব রহস্য গল্প। তাঁর লেখার ধরণ ছিল অদ্ভুত। লেখার পাতার মার্জিনের ধারে বা ছোট ছোট কাগজে অথবা বইয়ের পাতায় চারিদিকে লিখে রাখতেন। তারপর মোম দিয়ে জোড়া হত সেগুলো। দেখতে লাগত যেন গোটানো প্রাচীন পুঁথি। সেটাই ছিল তাঁর পান্ডুলিপি। প্রকাশকরাও জানতেন বলে কোনো লাভ নেই, কারণ পরের বারও ঠিক এরকম পান্ডুলিপিই আসবে। এছাড়াও এডগারের একটি প্রিয় পোষা বেড়াল ছিল। নাম ক্যাটরিনা। এই ক্যাটরিনা মালিকের কাঁধে চড়ে আদরে ঘড় ঘড় আওয়াজ করত আর পো লিখতেন আনন্দে। যদি বেড়াল চুপ করে থাকত, তাতে এডগার মনে করতেন যে লেখাটা বেড়ালের পছন্দ হয় নি। তৎক্ষণাৎ তিনি সেই লেখা বাতিল করতেন।
জার্মান কবি, নাট্যকার, ঐতিহাসিক, দার্শনিক ফ্রাইডরিখ শিলার ছিলেন সবথেকে সৃষ্টিছাড়া বাতিকগ্রস্ত। তাঁর এই উদ্ভট বাতিকের কথা প্রথম জানতে পারেন তাঁর বিশেষ বন্ধু বিশ্ববিখ্যাত জার্মান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক জোহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে। একদিন তিনি গেছেন শিলার বাড়ি। গ্যেটে বসলেন বন্ধুর লেখার টেবিলে। ভাবলেন কিছু লিখবেন। কিন্তু একটা উৎকট গন্ধ তাঁকে লিখতে দিল না। এই অদ্ভুত দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখলেন টেবিলের ডানদিকের ড্রয়ার এর উৎসস্থল। ড্রয়ার খুলে দেখেন সেখানে রয়েছে একগাদা পচা আপেল। গন্ধে গ্যেটের প্রাণ যায় আর কি। তাড়াতাড়ি জানলা খুলে নিঃশ্বাস নিয়ে সুস্থ হলেন। তারপর গেলেন শিলার স্ত্রীর কাছে। শিলার স্ত্রী শার্লট জানান যে তাঁর স্বামী এই পচা আপেলের গন্ধ ছাড়া লিখতে পারেন না। এটাই শিলাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়াও দিনের বেলা শিলা জানলায় মোটা ভারি পর্দা ঝুলিয়ে ঘর অন্ধকার রাখতেন। দিনকে রাত বানিয়ে লিখতেন তিনি। আবার রাতে ক্লান্ত লাগলে পা ডোবাতেন হিম ঠান্ডা জলে।
চার্লস ডিকেন্স ও আর্থার মিলার বিভিন্ন সময়ের হলেও ওঁদের নেশা ছিল এক। তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন ইউরোপের নানা প্রান্তে। সেখানে অচেনা সব জায়গায় হারিয়ে গিয়ে হত তাঁদের নতুন সৃষ্টির উন্মেষ। ডিকেন্স বেশ কতগুলি বাতিকে ভুগতেন। তিনি কোনোদিন কাউকে ছুরি উপহার দিতেন না। ধারালো অস্ত্র উপহার নিতেন না। সবসময় উত্তর দিকে মুখ করে লিখতেন। সেজন্য তাঁর কাছে কম্পাস থাকত। রুমাল উপহার পেতে বা দিতে পছন্দ করতেন না।
মার্কিন কবি, দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো আজও বিখ্যাত তাঁর ‘কেপ কড’, ‘ওযালডেন’, ‘ওয়াকিং’ ইত্যাদি গ্রন্থের জন্য। তাঁর পছন্দ ছিল জঙ্গল। তিনি নাকি গল্প লেখার জন্য ঘন জঙ্গলের মধ্যে লগ কেবিন নির্মাণ করে বছর খানেক, বছর দুয়েক কাটাতেন।
আবার ‘লোলিটা’র স্রষ্টা রাশিয়ান সাহিত্যিক ভ্লাদিমির নবোকভের অভ্যাস ছিল গাড়ির ভিতরে বসে লেখার। কোনও একটা নিরিবিলি পরিবেশে গাড়ি রেখে তার ভিতরে তিনি লিখে যেতেন। গাড়ির ইঞ্জিন চালু আর বন্ধ করার মধ্যে তিনি পেতেন ছন্দ। আর এতেই আসত তাঁর কবিতার লাইন ও উপন্যাসের প্লট। তিনি আবার লিখতেন ছোট ছোট ইনডেক্স কার্ডে। কার্ডগুলো সাজানো থাকত ছোট ছোট বাক্সে। এতে যেকোনো সময় লেখা পাল্টাতে তাঁর সুবিধা হত।
সবচেয়ে অদ্ভুত আর চিত্তাকর্ষক ঘটনা ছিল ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোর। ১৮৩৯ সাল। হুগো তখন সবে একটু নাম করেছেন। প্রকাশকের মন জুগিয়ে চলতে হয়। একটি পান্ডুলিপি জমা দেওয়ার কথা, কিন্তু তিনি লেখা জমা দিতে পারছেন না। এদিকে সময় বেঁধে দিয়েছেন প্রকাশক। শর্ত অনুযায়ী ভিক্টরকে প্রতি সপ্তাহে জরিমানা দিতে হচ্ছে এক হাজার ফ্রাঙ্ক। কিন্তু পছন্দমত লেখা আসছে না। হুগো এই সময় অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তাঁর পরিচারককে বললেন তাঁর সব জামা কাপড় সরিয়ে তালা চাবি দিয়ে রাখতে। জামা না পরে কোথাও বেরোতে পারবেন না। শুধু লেখার কাজে মন দিতে পারবেন। একটা শাল গোটা গায়ে জড়িয়ে তিনি লিখতে বসতেন। খুব শীত করলে কম্বল জড়িয়ে বসতেন। তাঁর এই কৃচ্ছ্রসাধন ব্যর্থ হয় নি। উপন্যাস জমা দিলেন। সেই উপন্যাসের নাম হল সর্বকালের অন্যতম সেরা ‘দ্য হানচব্যাক অব নটরডম’।
স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, কবি ও নাট্যকার পাবলো পিকাসো নাকি কোনোদিন কোনও পুরোনো জিনিস কাউকে দিতেন না। তিনি মনে করতেন যে এতে তাঁর অস্তিত্বের কিছু অংশ চলে যাবে। এর ফলস্বরূপ তাঁর বাড়িতে পুরোনো জিনিসের পাহাড় জমেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলো নিলাম করা হয়।
অ্যান্থনি ট্রেল্লোপ ছিলেন ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ ঔপন্যাসিক। তাঁর অদ্ভুত বাতিক হল তিনি ২৫০ শব্দ লেখার পর আর লিখতেন না। হাতে ঘড়ি নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন। তারপর রেস্ট হয়ে গেলে আবার লিখতেন।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক জ্যাক লন্ডনের আসল নাম জন গ্রিফিথ। দ্য কল অব দ্য ওয়াইল্ড, দ্য সী উলফ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি প্রতিদিন হাজার শব্দের বেশি লিখতেন না। বলতেন, “এরপর যেটা লিখব, সেটা মনের মতো হবে না।”
আমিও জ্যাক লন্ডনের সঙ্গে একমত। হাজার শব্দের বেশি বর্তমান সময়ে কেউ পড়বেন না। কারণ মনোযোগের অভাব। তাই আমিও আর লেখা দীর্ঘ করব না। এরপর যেটা লিখব, সেটা মনোমত হবে না।