— হ্যালোওও! হ্যাঁ, আমি প্রশান্তদা বলছি। বলি, ব্যাপারটা কি তোদের? আমার মান সম্মান ডোবাবি নাকি? কি? কি বললি? আরও আধঘণ্টা?
শোন এদিকে জলখাবার দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই খোঁজ পরবে তোপসের বাটার ফ্রাই আর চিকেন পকোড়ার।
তোপসেগুলো না পৌঁছলে এরা আমার মুণ্ডু ফ্রাই করবে বুঝেছিস?
হ্যাঁ, এইসব চিৎকার চেঁচামেচির নায়ক প্রশান্ত ধাড়া। হাওড়া উলুবেড়িয়া অঞ্চলের এক নম্বর ইভেন্ট ম্যানেজার। উলুবেড়িয়ার সাহেবী বাগানবাড়িতে আজ কলকাতার একটা পিকনিক পার্টি এসেছে। এই পিকনিক পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে প্রশান্ত।
পিকনিক পার্টি এসে পৌঁছনোর আগেই প্রশান্তর টিম জলখাবার রেডি করে রেখেছিল। নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল, স্টাফড্ আলু কোর্মা, জয়নগরের মোয়া আর কমলালেবু। শুধু কড়াইশুঁটির কচুরীটা পার্টি এসে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই গরম গরম ভেজে দিয়েছে।
খোলা মাঠের একপাশে ছোট একটা মঞ্চ করে প্রশান্ত ওর দলের একটি মেয়েকে দায়িত্ব দিয়েছে নানারকম খেলা, ক্যুইজ এসবের মাধ্যমে সারাদিন সবাইকে মাতিয়ে রাখতে। খেলায় জয়ীদের জন্যে হাতে গরম উপহারও আছে।
ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটি নেই। প্রশান্ত জানে জলখাবারের পরপরই কেউ খেলায়, কেউবা এধার ওধার ঘুরতে, আবার কেউ কেউ একটু ঢুকুঢুকু পার্টি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর তখনই হাঁক পড়বে মৌতাতের ফ্রাই, পকোড়ার। তাই এত ব্যস্ততা প্রশান্তর।
এসব ঝামেলার মধ্যেই আজ স্থানীয় একটা কাগজের এক রিপোর্টার ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। প্রশান্ত নিজের ইভেন্ট ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই রিপোর্টারকে এখানে আসতে বলে দিয়েছে।
গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে রিপোর্টার এসে প্রশান্তকে খুঁজে বের করে।
রিপোর্টার : দাদা, আমিই আসব বলেছিলাম।
প্রশান্ত : ও।
রিপোর্টার : আপনার ওপর একটা আর্টিকেল লিখতে চাই।
প্রশান্ত : আরে ভাই, আজ সারাদিন আমার সাথে থাকুন, তাহলেই আপনার কাজ হয়ে যাবে।
রিপোর্টার : না মানে কিভাবে, কবে থেকে এই লাইনে এলেন, আর সাফল্যের রহস্যটা কি, এগুলো যদি বলেন।
এইসময়ে পিকনিক পার্টির এক দাদার চিৎকার,
প্রশান্ত, প্রশান্ত কোথায়? গুনে গুনে টাকা দিয়েছি, এখন খাবারে কম পড়লে চলবে কেন?
প্রশান্ত হেসে রিপোর্টারকে বলে, শুনছো ভাই কথাগুলো? এবার আমার সাথে ওদিকে চলো, বুঝতে পারবে সব।
প্রশান্ত হাসিমুখে এগিয়ে যায়। পার্টি তো ক্ষেপে আগুন।
— এ কী প্রশান্ত? আমাদের অনেকেই জয়নগরের মোয়া পায়নি। এরকমভাবে কম পড়ছে কেন খাবার? আমাদের ষাটজন আসার কথা ছিল আমরা আটান্ন জন এসেছি। তাতেও কম?
প্রশান্ত বলে, তাই নাকি? এমনটাতো হওয়ার কথা নয়। আমি নিজে আশি পিস্ মোয়া এনেছি। চলুন তো দেখি।
খাবার সার্ভ করছে প্রশান্তর লোকজন। ও তাদের জিজ্ঞাসা করে, “কি ব্যাপার? সবাই ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না কেন? মোয়া সবাই পায়নি কেন?”
ওদের একজন বলে, দাদা, আমরা ঠিক করে খাবার দেওয়ার পরেও কয়েকজন টপাটপ মোয়া তুলে নেয় নিজেদের পাতে। আমাদের বারণ কিছুতেই শুনছে না। আপনি ওদিকে দেখুন, কেউ কেউ মোয়া পায়নি আবার কারও কারও পাতে দুটো, তিনটে এমনকি চারটেও আছে। আমরা কি করি বলুন তো!
প্রশান্ত পার্টির দাদার দিকে তাকায়।
তিনি, “কাকে যে কি বলি!” বলতে বলতে সরে পড়েন।
প্রশান্ত মাঠের পাশে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে সঞ্চালিকার হাত থেকে মাইক নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে, “বন্ধুরা, আজ আনন্দের দিন। সবাই খুব ভালোভাবে উপভোগ করুন। আপনাদের সেবার জন্য আমরা রয়েছি। খাবার যার যতটা প্রয়োজন আমাদের থেকে চেয়ে নিন। কিন্তু আপনারা নিজেরা খাবারে হাত দিলে আমরাও হাত গুটিয়ে নেব। আশাকরি সবাই মেনে চলবেন। খেলাধুলায় অংশ নিন। দিন সবার ভালো কাটুক।”
এবারে রিপোর্টারের দিকে চেয়ে বলে, কি বুঝলে ভায়া?
রিপোর্টার হাসে।
তোপসে মাছ এসে গেছে। ফ্রাই, পকোড়ায় বাগানবাড়ির একটি ঘরে পানাসর জমে উঠেছে। দু-চারজন মহিলাও মাঝে মাঝেই ওদিকে যাচ্ছে আর বেশ রসেবশে হয়ে ফিরে আসছে। তাদের কাছ থেকে প্রশান্ত জেনে নিচ্ছে ফ্রাই, পকোড়া সব ঠিকঠাক ছিল কিনা।
বাচ্চারা খেলাধূলায় মেতে উঠেছে।
ওদিকে ডিজে বক্স বাজছে। কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে গানের তালে নাচছে।
এই যে ভায়া এবার রগড় দ্যাখো, প্রশান্ত রিপোর্টারের দিকে চেয়ে বলে।
কি রকম? জিজ্ঞাসু রিপোর্টার।
ওই যে দ্যাখো, পিকনিক দলের একজন মাঝবয়সী মহিলা অল্পবয়সী ছোকরাটির সাথে বেড়াতে চলেছে। বুঝলে কিছু?
“না দাদা, কিছুই তো বুঝলাম না।” রিপোর্টার বলে।
দাঁড়াও দশমিনিট পরে তোমাকে বোঝাচ্ছি।
এরইমধ্যে প্রশান্ত মঞ্চে গিয়ে সঞ্চালিকা মেয়েটিকে বলে এল, লক্ষ্য রেখো, প্রাইজ যেন মোটামুটিভাবে সকলে পায়।
চলো ভায়া এবার তোমাকে রগড় দেখাই, একথা বলে প্রশান্ত রিপোর্টারকে সঙ্গে নিয়ে বাগানবাড়ি ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে। ফুলের বাগান, সব্জির বাগান, বড় বড় শাল, জারুল, মেহগনি, নারকেলগাছের বাগান, পুকুর সবকিছু ঘুরিয়ে দেখায় রিপোর্টারকে। এবারে আসে বিল্ডিংয়ের পেছন দিকে। যেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে আগাছার জঙ্গল। দূর থেকে দেখে মাঝবয়সী মহিলার কাঁধে হাত রেখে ছোকরা দাঁড়িয়ে; আর মহিলার একটা হাত ছেলেটির কোমর জড়িয়ে রয়েছে।
প্রশান্ত চিৎকার করে ওঠে, ম্যাডাম ওদিকে যাবেন না। সাপখোপ আছে।
মহিলা আর ছোকরা সচকিত হয়ে ওঠে। ওদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশান্ত হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে। বলে, “ভাগ্যিস সি সি ক্যামেরাগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে আমি এদিকটায় এসেছিলাম, নইলে তো একটা বিপদ হয়ে যেতে পারত ম্যাডাম। চলুন আমরা ওদিকে যাই।”
হ্যাঁ, তাই চলুন, ছেলেটি বলে।
“আপনারা এগোন, আমি এদিকের কাজ সেরে আসছি” প্রশান্ত উত্তর দেয়।
ওরা চলে যায়।
আপনি গুরুদেব দাদা, হাসতে হাসতে রিপোর্টার বলে।
কি করব ভাই, প্রশান্ত হাসে, সবদিকে খেয়াল রাখতে হয় যাতে কোনও হাঙ্গামা না ঘটে। ওই যে সি সি ক্যামেরার কথা বললাম, ওটা ভাই ফুল ঢপ ছিল। এরা আর বেচালপনা করার সাহস পাবে না।
###
সাদা ভাত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল, বেগুনী, পনির কোপ্তা, ফ্রায়েড রাইস, মটন কারি, ফ্রুট চাটনি, নলেনগুড়ের রাজভোগে লাঞ্চ সারা হল। প্রশান্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ালো।
সবাই ভালো করে খাওয়াদাওয়া করলেও দু-চারজন মৌতাতের নেশায় বিভোর। তাদের সামাল দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে প্রশান্তর কাজ সারা হল।
আপনার দক্ষতা অভূতপূর্ব, রিপোর্টার বলে, আচ্ছা দাদা, এই পিকনিকের ভার আপনি কতদিন ধরে বহন করে চলেছেন?
এই পিকনিক পার্টি শুরু করেছি কোন্ ছেলেবেলায়, প্রশান্ত নস্টালজিক হয়ে পড়ে, জান ভাই, আমার বয়স তখন দশ কি এগারো হবে; তুতো ভাইবোনদের নিয়ে আমার প্রথম ঝালমুড়ি পিকনিক। জানো, আমি একাই সবকিছু জোগাড় করেছিলাম মা, কাকীমার রান্নাঘর থেকে। বিকেলবেলা খেলার মাঠের ধারে নারকেলগাছের নীচে খবরের কাগজ পেতে সে কি মুড়িমাখা! দারুণ। এখনো সে স্বাদ মুখে, মনে লেগে আছে। কিন্তু ভায়া কপাল খারাপ। ছোট বোনটা ঝালমুড়ির ঝাল হাতে চোখ রগড়ে ফেলে সে কি কান্না! তারপর বাড়িতে আমার যে কি হাল হল তা আর না বলাই ভালো।
আসলে কি জান, আমার মোটা মাথায় পড়াশোনা কোনদিনই ঢুকতো না। কিন্তু এইসব ব্যবস্থাপনার কাজ আমার ভারি ভালো লাগত। সেই থেকেই শুরু।
আর এখনকার পিকনিকে তো কেউ খাটতে চায় না। একটা দিন আয়েশ করে আনন্দে কাটাতে চায়। তাই তো আমার মতো মানুষের দরকার।
দাদা, সব পিকনিকের ধরণগুলো তো মোটামুটি একইরকমের হয় । রিপোর্টার বলে, আজকের এই পিকনিকের ধারাও গতানুগতিক। কিন্তু সবকিছুর পেছনে যার আবেগ, বুদ্ধিমত্তা, তীক্ষ্ণ নজর গোটা দিনটাকে আনন্দমুখর করে রাখে তাকে আজ সামনে থেকে দেখলাম। হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম।
আরে ভাই অতো ভালো ভালো কথা বলতে হবে না। এখন কেটে পড়ো দিকিনি, রিপোর্টারকে তাড়া লাগায় প্রশান্ত, এখন আমার পাততাড়ি গুটিয়ে আবার পরের পিকনিক থুড়ি ইভেন্টের জন্যে তৈরী হওয়ার পালা।