ইংরেজ ও ওলন্দাজ জাহাজে খালাসি তথা Stevedore-এর কাজ করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবঙ্গে প্রথম আসা পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী ও তাঁর কাকা শুকদেব কুশারী। তখন সবে জোব চার্নক কলকাতায় পা রেখেছেন। সপ্তদশ শতকের শেষ লগ্ন তখন। সেইসব জাহাজের খালাসিদের কাছ থেকে জাহাজের গান বা Sea Shanty শেখেন পঞ্চানন কুশারী। সারিগানও জানা ছিল তাঁর। যেহেতু নদীপথে নৌকা বাইতে গিয়ে মাঝিমাল্লারা এই গান গায়, পঞ্চানন এগুলো ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তাঁরা কাকা-ভাইপো এইসব গানের সঙ্গে সাবেক কীর্তনের মিশেল দিয়ে জেলে-মালো-কৈবর্ত-অধ্যুষিত গোবিন্দপুরে কবিগানের নতুন একটি স্টাইল তৈরি করলেন। তাঁদের গান শুনে মোহিত হয়ে সরল সাদাসিধে গ্রামবাসীরা তাঁদের ঠাকুর বলে ডাকতে লাগল। সেই থেকে তাঁদের পদবি হয়ে গেল ঠাকুর।
হরু ঠাকুর ছিলেন পঞ্চাননের পরবর্তীকালের আর এক নামী কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭৩৮-এ। তিনি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভাকবি ছিলেন। অরুণ নাগ সম্পাদিত ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইয়ে কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নীলু ঠাকুর নিয়ে সম্পাদনা বিভাগে অনেক তথ্য আছে। হরু ঠাকুরের আসল পদবি ‘দীর্ঘাঙ্গী’। ব্রাহ্মণ কবিয়াল হওয়ায় তাঁর পদবি পাল্টে ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। নীলু ঠাকুরের আসল নাম নীলমণি চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ হওয়ায় তাঁরও পদবি পাল্টে গিয়ে নীল ঠাকুর হয়ে যায়। এরকমভাবে কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর, সৃষ্টিধর ঠাকুর (ছিরু ঠাকুর), রমাপতি ঠাকুর, নবাই ঠাকুর, রামকানাই ঠাকুর, মনোরঞ্জন ঠাকুর, নিমচাঁদ ঠাকুরের নাম আমরা পাই। এঁদের মধ্যে ছিরু ঠাকুর শুধু বদ্যিবামুন ছিলেন (পূর্বপদবি জানা নেই), বাকি সকলে নিখাদ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ কবিয়ালদের পদবি বদলে পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে যেত। উপরোক্ত সকল ঠাকুর পদবিধারী ব্রাহ্মণ কবিয়াল ছিলেন চক্রবর্তী পূর্বপদবির অধিকারী। কেবলমাত্র রমাপতি ঠাকুরের পূর্বাশ্রমের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
পঞ্চানন কুশারী আসলে ছিলেন খালাসি-কবিয়াল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারীর পদবি বদলে গিয়ে না হয় ঠাকুর হয়ে গেল, সেই ঠাকুর আবার কাদের কেরামতিতে Tagore হল, সেটাই রহস্য। সব স্বীকৃত বইয়ে বলা হয়েছে, Tagore হল ঠাকুরের Anglicised ফর্ম। অর্থাৎ ইংরেজরাই এটা করেছিল। কিন্তু যে প্রশ্নটা ভাবায়, তা হল বাংলা ‘ক’ লিখতে গিয়ে ইংরেজরা K, C, Ch, এমনকি Q না লিখে G লিখতে গেল কেন? কলকাতার আদি বাসিন্দা বসাকপরিবার। বসাককে ইংরেজরা লিখেছে Bysak বা Bysack, Bysag লেখেনি। তেমনি রাজা নবকৃষ্ণকে Nabkissen লিখেছে, Nabgissen লেখেনি। তাহলে ঠাকুর-কে Takur বা Thacore বা Tachore না লিখে Tagore লিখতে ইংরেজরা যাবে কোন দুঃখে? এইখানেই একটা প্রশ্ন জাগে, অন্য কোনও ইউরোপীয় জাতি এটা করেছে কিনা।
চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ শহরে গিয়ে দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষমূর্তির নীচে নাম লেখা আছে,’Rabindranath Thakur’। জায়গাটির নামও ভারি সুন্দর, Thakurova। কলকাতার নামকরণের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে দেখেছি, পণ্ডিত রাধাকান্ত দেব একটি থিয়োরি দিয়েছিলেন। ওলন্দাজরা হবু-কলকাতার পাশ দিয়ে জাহাজে করে যাওয়ার সময় সেখানে মড়ার খুলির স্তূপ দেখতে পেয়েছিল সাড়ে তিনশ বছর আগে। বাইবেলে এই রকম খুলিপূর্ণ জায়গাকে গোলগাটা (GOLGATA) বলা হয়েছে। সে দৃশ্য দেখে ওলন্দাজরা তাদের উচ্চারণে চেঁচিয়ে ওঠে “KOLKATA”। যেহেতু তারা G-কে K উচ্চারণ করে। রাধাকান্ত দেবের এই তত্ত্বেই আমরা প্রথম জানতে পারি ডাচদের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্যের কথা। পরে ডাচ ফুটবলার রুড গুলিট, ডাচ চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘ- এর নামের ক্ষেত্রেও G এর প্রায়-K উচ্চারণ লক্ষ্য করলাম। ওলন্দাজী বা ডাচ উচ্চারণে রুড কুলিত ও ফ্যান কখ -এর মতো লাগে। ১৬৬০ এ আঁকা ডাচ পর্যটক ভ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রে কাঁকিনাড়া-র বানান লেখা হয়েছে Canginere। সমস্ত বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে ডাচরাই ঠাকুরের রোমান লিপ্যন্তর Tagore করে। ইংরেজরাও পরে সেটা মেনে নেয়। পঞ্চানন কুশারী ও তাঁর কাকা শুকদেব কুশারী গোবিন্দপুরে বসবাসকালে ডাচ ও ইংরেজ জাহাজে পণ্যসরবরাহকারী বা স্টিভডোর ছিলেন। অবসরের নেশা ছিল কবিগান গাওয়া। সেইসূত্রেও তাঁর সঙ্গে ডাচদের মেলামেশা ছিল। ডাচরাই তাঁকে ঠাকুর থেকে Tagore বানিয়ে দেয়।
ঠাকুর কেন Tagore অনেক দিন ধরেই এই প্রশ্নটা করে যাচ্ছি। বিদ্বজ্জনদের দুচারজনকে সামনাসামনি জিজ্ঞাসাও করেছি। সদুত্তর পাইনি। প্রত্যেকেরই বাঁধা গৎ যে ওটা অ্যাংলিশাইজ্ড ফর্ম। অর্থাৎ ইংরেজদের উচ্চারণেই এই বিকৃতি ঘটেছে। বাস্তবে তা নয়। ইংরেজরা ঠাকুরকে নিজেরা লিখলে লিখত Thakore/Tacore। প্রসন্ন ঠাকুরের নাম ইংরেজদের লেখা বইয়েই আছে Thacore। আসলে এটা ডাচ বা ওলন্দাজদের কীর্তি। Golf খেলা ওদের উচ্চারণে কল্ফ, যেহেতু ওরা G এর উচ্চারণ K করে। তেমনভাবে “ঠাকুর” বোঝাতে ওরা রোমান হরফে লিখত ‘Tagoure’ বা ‘Tagore’। অর্থাৎ ওলন্দাজ বা ডাচরাই ‘ঠাকুর’কে Tagoure বা Tagore বানিয়েছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গেও ওলন্দাজ বিজনেস-টাইকুনদের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ডাচেদের বানানটাই ইংরেজরা শিরোধার্য করেছে। প্রসঙ্গত দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিলেতের কেনসাল গ্রিন সমাধিফলকে Tagoure লেখা আছে।
গত বছর ইউরোপভ্রমণে গিয়ে নেদারল্যান্ডসে ছিলাম তিনদিন। ওখানকার লোকেরা যে G কে Ch বা K-এর মতো উচ্চারণ করে, তা লক্ষ্য করলাম। তবে ডাচভাষা জানলে আরও গভীরভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করা যেত। একটি বিরাট বাগানে গল্ফ খেলা চলছিল। গল্ফ কিনা জিজ্ঞেস করায় স্মিতহাস্যে এক ডাচ ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন ‘কল্ফ’। Keukenhof নামে এক জায়গায় ওদেশে টিউলিপের বাগান দেখেছি। এটার উচ্চারণও কিন্তু ক-এর মতই। G-এর উচ্চারণ ‘Guttural’, কণ্ঠধ্বনিবিশেষ। ক আর হ-য়ের মাঝামাঝি। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।