সনাতন ধর্মের প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণের চারটি প্রধানতম চরিত্র হচ্ছে- রাম, রাবণ, সীতা ও লক্ষ্মণ। পাঠকবৃন্দদের মধ্যে হয়তো অনেকেই জানেন বিবাহের পর রাম তাঁর ভার্যা সীতা ও কণিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণ কে সঙ্গে নিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গমন করেন সেখানে তাঁরা চিত্রকূট নামক পর্বতের পাদদেশে বসবাস করছিলেন। বছর দশেক এদিক সেদিক ঘুরেফিরে তাঁরা আশ্রয় নিলেন গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী নামক একটি অরণ্যে। এই অরণ্যধামটি সীতার বিশেষ পছন্দ হওয়াতে আপাতত সেখানেই থিতু হলেন তাঁরা। সেখানে তাঁদের দিন ভালই কাটছিল বলাচলে কিন্তু হঠাৎ একদিন রাবণের ভগিনী শূর্পণখা সেই বনে বেড়াতে এসে সাক্ষাৎ পেলেন রাম ও লক্ষ্মণের। সুন্দরী রমণীর ছদ্মবেশে রাম ও লক্ষ্মণকে প্রলুব্ধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন শূর্পণখা। ক্রোধে অন্ধ হয়ে শূর্পণখা সীতাকে ভক্ষণ করতে গেলে লক্ষ্মণের খড়গাঘাতে নাক কাটা গেল শূর্পণখার। শূর্পণখার অপর দুই রাক্ষস ভ্রাতা খর ও দুষন এই সংবাদ পেয়ে সসৈন্যে রাম ও লক্ষ্মণকে আক্রমণ করলেন। সৈন্য সামন্ত সমেত খর ও দুষন উভয়কেই বধ করলেন রাম। রাবণ এই সংবাদ পেয়ে ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ কল্পে সীতাকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করলেন। এই কাজে রাবণকে সাহায্য করলেন মারীচ নামে এক মায়াবী রাক্ষস। মারীচ স্বর্ণমৃগ ছদ্মবেশ ধারন করে সীতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। হরিণটির রূপে মোহিত হয়ে সীতা রাম কে বললেন- আমার সোনার হরিণ চাই। সীতার মন রক্ষার্থে হরিণটির পিছন পিছন ছুঁটলেন রাম। খানিকবাদে সীতা শুনতে পেলেন, রাম আর্তচিৎকার করছেন। আসলে মায়াবী মারীচ রামের কণ্ঠ নকল করে আর্তনাদ করেছিল। ভীত হয়ে সীতা লক্ষ্মণকে রামের সন্ধানে যেতে অনুরোধ করলেন। রাম যে অপরাজেয় সে কথা সীতাকে বারংবার মনে করিয়ে দিলেন লক্ষ্মণ। কিন্তু সীতা সে কথায় কর্ণপাত না করে লক্ষ্মণকে বাধ্য করলেন রামকে অনুসরণ করতে। অবশেষে কুটিরের চারিদিকে একটি গণ্ডী কেটে সীতাকে সেই গণ্ডীর বাইরে যেতে নিষেধ করে লক্ষ্মণ গেলেন রামের সন্ধানে। রাবণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি ঋষির ছদ্মবেশে এসে সীতার নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। রাবণের ছলনা বুঝতে না পেরে সীতা গণ্ডীর বাইরে এসে তাকে ভিক্ষা দিতে গেলে দুষ্ট রাবণ বলপূর্বক সীতাকে অপহরণ করে নিজ পুস্পক বিমান রথে তুলে পালিয়ে গেলেন লংকায়।
রাবণ ছিলেন অসীম শক্তির অধিকারী। তিনি দেবতাদেরও ছাড়তেন না। তিনি তাদেরও আহ্বান করতেন সম্মুখ সমরে। প্রথম জীবনে রাবণ শিবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে পরবর্তীতে শিবের ভক্ত হয়েছিলেন। রাবণের প্রকৃত নাম দশানন/দশগ্রীব। রাবণ নামটিও দেবতা শিবের-ই দেওয়া। কিন্তু সীতাকে কেন স্পর্শ করেননি রাবণ? সংগীত রচনায় নিপুন রাবণ ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। সার্বক্ষণিক শিবের সান্নিধ্য পাওয়ার লক্ষ্যে রাবণ যখন কৈলাশ পর্বতকে লংকায় প্রতিস্থাপনের জন্যে দুই হস্তে কৈলাশ পর্বত তুলে নেন তখন শিব তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি কৈলাশে স্পর্শ করলে রাবণের দুই হাত কৈলাশ পর্বতের নিচে চাপা পরে যায়। রাবণ তখন প্রচন্ড জোরে চিৎকার করতে থাকেন। অতি উচ্চ মাত্রায় রোদন করার জন্যই তার নাম হয়ে যায় রাবণ। শিবকে শান্ত করার নিমিত্তে তিনি একটি সংগীত রচনা করেন, যা পরে “শিব তাণ্ডব স্তোত্র” নামে পরিচিতি লাভ করে। শিবের ক্রোধ শান্ত হয় এবং তিনি তার চন্দ্রোহাশ নামক খড়গটি রাবণকে উপহার দেন।
রামায়ণ যারা পড়েছেন তারা বেশ ভালো করেই জানেন রাবণ একজন কামুক ও ধর্ষক হিসেবে বিশেষ খ্যাত হয়ে আছেন মহাকাব্যের পাতায় পাতায়। একদিন পুষ্পক বিমানে ভ্রমণকালে বেদবতী নামে পরমাসুন্দরী এক নারীকে বিষ্ণুর উপাসনায় রত দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন রাবণ। ওই নারীর চুলের মুঠি ধরে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করার সময় অগ্নিতে সমর্পণ করে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করেন বেদবতী। এক বছরেরও অধিক কাল সীতা রাবণের কুক্ষিগত থাকলেও সীতাকে রাবণ কেন ধর্ষণ করেননি? এর উত্তর রামায়ণে না পাওয়া গেলেও সনাতন ধর্মের আরেকটি মহাকাব্য মহাভারত থেকে জানা যায়, দিগি¦জয় কালেই স্বর্গে পৌঁছে রাবণ রম্ভা নামক এক অপ্সরাকে দেখে মুগ্ধ হন। বাসনা চরিতার্থে তিনি জোর করে ধর্ষণ করেন রম্ভাকে। রম্ভা ছিলেন রাবণের সৎ ভাই কুবেরের পুত্র নলকুবেরের স্ত্রী। সেই হিসেবে রম্ভা রাবণের পুত্রবধূসমা। সে কথা রাবণকে স্মরণ করিয়ে দেন রম্ভা। ঠিক সেসময় নলকুবেরও উপস্থিত হন সেখানে এবং রাবণকে অভিশাপ দেন। নলকুবের রাবণকে বলেন, যদি সে আবার অন্য কোন মেয়েকে ধর্ষণ করে তাহলে তার মাথা বিস্ফোরিত হবে। জানা যায়, সেই অভিশাপের ভয়েই সীতাকে স্পর্শ করেননি রাবণ৷
প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই শুধু ধর্ষণ আর ধর্ষণ। সিলেটে গৃহবধূকে তার স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ, আশুলিয়ায় গৃহবধূকে গণধর্ষণ। দু’একদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম সিঁধকেটে ঘরথেকে শিশুকণ্যাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ। বর্তমান পরিস্থিতি যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময়কেও অতিক্রম করে গেছে।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হল। নির্যাতন চলাকালীন সেই নারী আকাশ পাতাল বিদীর্ণ করে চিৎকার করে বলছিলেন- “আব্বাগো তোর আল্লাহর দোহাই লাগে ছাড়ি দে!” অন্যদিকে বিশ-পঁচিশ বছরের পাষাণ্ড সেই হায়েনাগুলো তখন হাসছিল আর বলছিল— উল্টা, উল্টা, উল্টা! কারণ বিবস্ত্র সেই নারী নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ওপর হয়ে শুয়ে আর্তনাৎ করে তাদের উদ্দেশ্যে মিনতি করেছিলেন— ‘এরে আব্বা গো তোগো আল্লাহর দোহাই রে।’ মর্তের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দশানন/দশগ্রীব রাবণ যিনি দু’হাতে হিমালয়ের কৈলাশ পর্বত তুলে ফেলেছিলেন। সর্বাধিক শক্তিশালী দেবতা শিবকেও তুচ্ছজ্ঞান করতেন যে ব্যক্তিটি সেই ব্যক্তিটিও রম্ভা ও নলকুবেরের অভিশাপের ভয়ে সীতাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে সাহস করেননি, অথচ নোয়াখালীর নরপিচাশ ধর্ষকদের প্রতি সেই নারীর আল্লাহর দোহাই কিংবা সেসব ধর্ষকদের পিতৃতুল্য আসনে বসিয়েও তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি।
একপর্যায়ে ওই গৃহবধূকে পিটিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে তার ভিডিও ধারণ করে। বিবস্ত্র নারীর গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে একজন। তার যৌনাঙ্গে টর্চলাইট ও লাঠি ঢুকিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করে সেই পশুগুলো।
মানুষ নামের কলঙ্ক ওই পাঁচজন শুধু গৃহবধূকে বিবস্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়নি, ৩২ দিন ধরে ওই পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখে। একবার ভাবুন তো, তারা যদি ভিডিওটি ফাঁস না করত তাহলে ৩২ দিন কেন, ৩২ মাসেও প্রশাসন কিচ্ছু করতো না মানুষরূপী সেসব পাষাণ্ডদের।
বর্তমানে জনরোষে, আন্দোলন ও চাপের মুখে বর্তমান সরকার হয়তো ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেছে বটে কিন্তু আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রাশ্চাত্য ও প্রাতীচ্যে ধর্ষণের শাস্তি ছিল চরম ও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত। যেমন প্রাচীন গ্রীসের কথাই ধরা যাক, যদিও গ্রীক কিংবদন্তিতে দেবদেবীদের মধ্যে ধর্ষণের ছড়াছড়ি। গ্রীক মিথলজির সবচেয়ে প্রধান দেবতা জিউস ধর্ষণ করছেন দেবী ইউরোপা, জেনেমেড কিংবা লেডা কে। অন্যদিকে গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে থ্যাবনের রাজা লাইয়াস (layas) দ্বারা ক্রিসিপ্পাস কে ধর্ষণের বিষয়টি, গ্রীক কিংবদন্তিতে ‘লাইয়াসের কুকর্ম’ নামে বিশেষ ভাবে খ্যাত। আমার ধারণা বাংলা ‘লুচ্চা’ শব্দটির উদ্ভব ইংরেজি ‘লাইয়াস’ শব্দ থেকেই।
সে যা হোক আমরা দেখি যে প্রাচীন গ্রীসে চারটি পাপের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। সেগুলো হচ্ছে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহ, অগ্নিসংযোগ ও চতুর্থটি হচ্ছে ধর্ষণ। এতেই বোঝা যায় সে সময় ধর্ষণ কতটা ঘৃণিত ও দৃষ্টিনিন্দিত ছিল। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইউরোপে দেখা যায় যিনি ধর্ষণের শিকার সে ইচ্ছে করলে সেই ধর্ষণকারীকে নিজ হাতে হত্যা করতে পারতেন। অন্যদিকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংলেণ্ডে ধর্ষণের শাস্তি ছিল ভয়াবহ। সে সময় ধর্ষণের শিকার নিপীড়িত নারীটি নিজের হাতে ধর্ষণকারীর অন্ডকোষ কিংবা চোখ উপড়ে নিতে পারতেন। গ্রীসের মতো রোমান সাম্রাজ্যেও ধর্ষণের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সম্রাট অগাষ্টাস সিজার ধর্ষণ আইনের কিছু পরিবর্তন আনলেন। যদি কোন কুমারী মেয়েকে (অক্ষত যোনী) ধর্ষণ করা হতো তাহলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড কিন্তু ধর্ষিতা যদি বিধবা বা বিবাহিতা হতেন তাহলে শাস্তির পরিমাণ ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা নমনিয় হতো। এখানে উল্লেখ্য যে, সেই প্রাচীন গ্রিস কিংবা রোমান সাম্রাজ্যে আইন এতো উন্নত ছিল যে বারাঙ্গনা কিংবা বারবানিতাদের ধর্ষণ করলেও ধর্ষককে শাস্তি পেতে হতো। প্রাচীন ভারতে ধর্ষণের শাস্তি ছিল পুরুষাঙ্গ ছেদ। আমরা সাধারণত যাকে খোজা করা হিসেবে বুঝে থাকি। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের মতো ভারতেও দেখি গণিকাদের অপমান কিংবা ধর্ষণের শাস্তির বিধান ছিল। কিন্তু সে শাস্তি হতো অর্থদণ্ডে।
রাজা চন্দ্রগুপ্তের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০-২৯৮) অর্থমন্ত্রি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় গণিকা অর্থাৎ বেশ্যাকে প্রকাশ্যে অপমান করার দণ্ড ছিল চব্বিশ পন। পন হচ্ছে সে আমলের মুদ্রা। অন্যদিকে গণিকাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করার দণ্ড ছিল পঞ্চাশ পন এবং বহুজনে মিলে পরপর ওইভাবে ধর্ষণ করলে তাদের প্রত্যেকে চব্বিশ পন দণ্ড দিতে হত।
খ্রিষ্টধর্ম আবির্ভূত হওয়ার পরবর্তী সময়গুলোতে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তির ধরণ বেশকিছুটা পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে সম্রাট কন্সট্যান্টাইন (২৭২-৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি ধর্ষণের জন্য ছেলে মেয়ে উভয়কেই দায়ী করতেন এবং ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে দু’জনকেই আগুনে পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল। কন্সট্যান্টাইনের যুক্তি ছিল ধর্ষণে মেয়ের যদি সম্মতি-ই না থাকবে তবে তো সে নিশ্চই চিৎকার চেচামেচি করবে। খুবই দুর্বল যুক্তি সন্দেহ নেই কিন্তু ধর্ষিতা নারীর চিৎকার চেচামেচির কোন স্বাক্ষী প্রমাণ না থাকলে ধর্ষিতা সেই নারীকে বেশ দুর্ভোগ-ই পোহাতে হত বলাচলে। কিন্তু পরবর্তী কালে সম্রাট জাষ্টিনিয়ান (৫২৭-৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) এই বিধানে পূণরায় পরিবর্তন আনেন। তিনি ধর্ষণের জন্য শুধু পুরুষকেই শাস্তির আওতায় আনেন। আমার মনে হয় এমন একটি যুগান্তকারী আইনের পিছনে তার বিজ্ঞ ও প্রাক্ত স্ত্রী থেওডোরার হাত ছিল। কারণ আমরা জানি তাঁর স্ত্রী থেওডোরা সম্রাট জাষ্টিনিয়ানকে অনেক ভালো ভালো আইন প্রণয়নে তাঁকে উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন।
এখন ধর্ষণের সম্ভাব্য কারণ ও প্রতিকার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। আমার দৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণের মুল কারণ মূলত তিনটি। এক. আইনের শাসনের অভাব, দুই. মূল্যবোধের অভাব, তিন. মনোবৈকল্য। একটি রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন না থাকে তাহলে সেখানে কিছুতেই ধর্ষণ ঠেকানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয় হচ্ছে মূল্যবোধের অভাব। ধর্ষণের আসল সমস্যা নারীর পোষাকে নয় বরং এর শেকড় সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের ভেতর প্রথিত। যেমন আমাদের সমাজে অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় নারীরা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের স্বীকার হচ্ছেন। একটি শিশু যখন চোখের সামনে দেখে তার মা নিগৃহ হচ্ছেন তার পিতা দ্বারা কিংবা তার বোন অবহেলিত হচ্ছেন কারণ সে একজন নারী। এসব নানাবিধ লিঙ্গ বৈষ্যমের কারণে একজন পুরুষের মনোজগতে ধারণা জন্মায় যে নারীরা সমাজে পুরুষের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। অতএব তাদের নিগৃহ নির্যাতন করা দোষের কিছু নয়। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেও সমাজে ধর্ষণের আধিক্য আজকের মতো এতোটা ভয়াবহ ছিল না। কারণ সে সময় আমাদের সমাজে পাঠ্যাভ্যাসের প্রচলন ছিল। কমবেশি সবাই বই পড়তেন। মানুষের ভেতর কিছুটা হলেও মূল্যবোধ কাজ করতো। বিভিন্ন জেলার মফস্বল শহরগুলোতে পর্যন্ত নানাবিধ সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব প্রভৃতি ছিল। যেখানে নানা রকম সাংস্কৃতিক চর্চা কিংবা খেলাধুলা হতো। পৃথিবীতে সবচেয়ে কম ধর্ষণ সংঘটিত হয় ফিনল্যাণ্ড, সুইডেন, সিঙ্গাপুর, জাপান প্রভৃতি দেশগুলোতে। মজার বিষয় হচ্ছে বই পড়ার হার সুচকে এই দেশগুলি-ই পৃথিবীতে শীর্ষে অবস্থান করছে। অতএব পাঠ্যাভ্যাস যে মূল্যবোধ তৈরিতে ভুমিকা রাখছে এটা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। অন্যদিকে আইনের শাসনের কঠোরতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ধর্ষণের হার অনেক কম। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে আইনের শাসন বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছুটা উন্নত হলেও মূল্যবোধের অভাবে সেখানে প্রতিবছর অসংখ্য ধর্ষণ সংঘটিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা কেভিন স্পেসি, ডাষ্টটিন হফম্যান কিংবা জর্জবুশ সিনিয়র, ডোনাল ট্রাম্প, বিল ক্লিনটনের মতো সুদর্শন ও প্রতিষ্ঠিত সেলিব্রেটিদের বিরুদ্ধে যখন যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তখন প্রশ্ন জাগে এর পেছনে কি তাদের মনোবৈকল্য দায়ী নয়? কারণ তাদের কি নারী সঙ্গীর অভাব? আমার মতে তাঁদের মনোজগতে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে মনোচিকিৎসাটাই সর্বাগ্রে জরুরী। আইনের শাসন ও মূল্যবোধ এই দুটি বস্তুর সমন্বয় ঘটলে একটি দেশে যে কি অসাধারণ দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমি তখন ব্রীটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে অধ্যায়ণ করছিলাম। নববর্ষের একরাতে খাজা মাসুদ নামে এক বাংলাদেশী বড় ভাইয়ের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন শেষে মধ্যরাতের দিকে স্টুডেন্ট ডর্মে ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল একটি রেস্তোরাঁর পাশের এককোণে। সেখানে দেখলাম একটি অর্ধনগ্ন মেয়ে অতিরিক্ত সুরাসক্ত হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। খাজা ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- দেখ কি অসভ্য দেশ! আমি বললাম— ভাই একটু উল্টা করে চিন্তা করেন। দ্রাক্ষারসে আসক্ত ও অর্ধনগ্ন হয়ে পড়ে থাকাটা মোটেও কাজের কথা নয়। কিন্তু দেখেন কি সভ্যদেশ। এই মেয়েটি সম্ভবত সারারাত পড়ে থাকবে এভাবে। অথচ ভুলেও কেউ তার শরীর স্পর্শ করবে না। কিন্তু বাংলাদেশ হলে কি হতো একবার চিন্তা করেন তো। আমি বললাম একটি দেশ কতটা সভ্য সেটা নির্ভর করে সে দেশে নারীরা কতটুকু সুরক্ষিত। যা হোক আমার মনে হয় বর্তমান সরকারের উচিত ধর্ষণরোধে যা কিছু করণীয় সেগুলো করা। কারণ এই ধর্ষণের কারণে অতীত ইতিহাসে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সেসব ঘটনার দু’একটি শুনিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো।
সেটা খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ সালের ঘটনা, গ্রিক ইতিহাসবেত্তা ডায়োডরাস সিকুলাস ও প্লুতার্ক লিখিত ইতিহাস থেকে জানাযায় মেসেডোনিয়ার রাজা সেসময় আলেকজেন্ডারের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপ। আলেকজেন্ডার কিন্তু মোটেও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। দ্বিতীয় ফিলিপের বহু পত্নী ও উপপত্নী ছিল। সেসব ঘরেও বেশকিছু সন্তানাদি ছিল ফিলিপের। তাদের মধ্য থেকেই একজনকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেছিলেন ফিলিপ। একই সঙ্গে রাজা ফিলিপ ছিলেন সমকামিও। পাওসানিয়াস নামে ফিলিপের একজন দেহরক্ষী ছিল। পাওসানিয়াসের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল ফিলিপের। তো হয়েছে কি একদিন ফিলিপের শশুর এটালাস কর্তৃক এক ভোজ সভায় নিমন্ত্রণ করা হয় পাওসানিয়াসকে। তো সেই ভোজসভা চলাকালীন এটালাসের এক ভৃত্য ধর্ষণ করে পাওসানিয়াসকে। পাওসানিয়াস ধর্ষণের বিচার দাবি করে তার প্রেমিক ও রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে। কিন্তু পাওসানিয়াসকে ফিলিপ বললেন- তুমি যেহেতু ধর্ষিত হয়েছো সেহেতু তোমাকে আমি পদোন্নতি দিচ্ছি কিন্তু এর বিচার আমি করতে পারবো না। পাওসানিয়াস বললেন— আমি আমার সম্ভ্রম হারিয়েছি এর উপযুক্ত বিচার আমি চাই। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ধর্ষণের বিচার না করাতে পাওসানিয়াস ক্রোধান্ধ হয়ে হত্যা করলেন রাজা ফিলিপকে আর এই সুযোগেই আলেকজেন্ডার সিংহাসনে বসে সমস্ত দুনিয়া জয় করার সুযোগ লাভ করলেন।
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিস্কার করেন তখন মিশেল ডি কুনেও নামে কলম্বাসের এক বন্ধু রেড ইন্ডিয়ান এক মেয়েকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করার জন্য ব্যাপক বিদ্রোহের মুখে পাততারি গুটিয়ে সেসময়ের মতো কলম্বাসকে ফিরে আসতে হয় স্পেনে। তবে এতো ডামাডোলের মধ্যেও কলম্বাস সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রায় সহস্রাধিক দাস।
তবে একটি যৌন নির্যাতন আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের ভাগ্য একেবারেই পাল্টে দিয়েছিল। আমেরিকার ১৬তম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন একসময় মাঝিমাল্লার কাজ করতেন। তো সেই কাজের সূত্রেই একবার তিনি এসেছিলেন নিউ অরলিয়ন্সে। সঙ্গে ছিল তার মামাতো ভাই জন ও সৎ ভাই জোহান্স্টন। সেখানে একদিন দাস বাজারে একটি ষোড়শ বর্ষীয়া বর্ণশংকর যুবতী মেয়েকে নির্যাতিত হতে দেখে দারুন ভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। মঞ্চে শৃঙ্খলিত সেই মেয়েটিকে ক্রেতাগণের মধ্যে কেউ কেউ মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করছিল। যেমনটি করা হয় পশু হাটে পশু ক্রয় বিক্রয় করার সময়। কেউ হাত বুলোচ্ছিল মেয়েটির উরুতে, কেউ আবার বক্ষে, কেউ কেউ আবার …। এ যেন এক নারকীয় দৃশ্য! কুরুচিপূর্ণ এসব দৃশ্য দেখে আব্রাহাম লিংকন ভীষণ কষ্ট পেলেন।
আব্রাহাম প্রচণ্ড ক্রোধে জনের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বলেছিলেন— জন, আমি যদি জীবনে একবার, শুধুমাত্র একটি বার সুযোগ পাই তবে এই দাস প্রথা যে করে হোক নির্মূল করে ছাড়ব আর এর জন্যে আমাকে যতই মূল্য দিতে হোক না কেন, তুই দেখে নিস।
Thanks. I read it third time.