প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, প্রথামাফিক যে আলোচনা এ লেখায় তা পাবেন না হয়তো। বদলে আমি মগরেব বা মগার সঙ্গে হাত ধরে ঘুরতে পারি নলডুগরির গাঙনীর জলজ মায়ায়। তো, মগার আবার কপালে কপাল নয়, পায়েতে কপাল! সে এক আজগুবি মানুষ, ভোগোল — যার এদিক নেই, সেদিক নেই, আছে শুধু বেদিক! যার চোখেতে জবান। আর যে মানুষ কুড়িয়ে বেড়ায়। আমিও এক দিককানা মানুষ, মগার হাত ধরে মানুষ কুড়িয়ে বেড়ানোর হাউস। এখন মগা আবার হাটের না, সে কিছুটা বাটের, বাকিটা ঘাটের। এই ঘাটে-বাটেই তো মানুষের পারাপার, ছায়া বিলিয়ে। সেই ছায়ার মায়ায় মগা সেঁধোয়, আমিও। ডুবি, ভাসি।
আমার বিশ্বাস, বিশ্বায়িত আলোকে-উজল আধুনিক ভারতের যা ধারনা, তার আলোকবিভার পরিধির বাইরে, বা অন্যভাবে দেখলে সে বিজ্ঞাপিত বিভার অতল কালো গভীরে অপর ভারতবর্ষের আটন, যা শাশ্বত, আবহমানের— এক আলো-আঁধারির মায়া, যা ধারণ করে ভারতবর্ষের আত্মাকে— যা গ্রামীন, এক সদা জায়মান পুরাণের বহমান ধারা। আবহমানের সেই মায়ায় মগা আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল। যে মায়ায় ফুটে ওঠে বেঁচে থাকা। আমি সেই বাঁচার ধরণকে আঁজলায় ধরি এ মগরেবকাব্যে। এ কাব্যে সত্য হয় এ সময়, তার মাটি, গাঙনীর ছলাৎ বাক! যে বাকপ্রতিমায় বাংলার কথকতা আর পাঁচালির সুর বেজে ওঠে যেন! হ্যাঁ, লুৎফর বাংলার সেই বিরল গদ্যশিল্পী, যার বয়ানে বাংলার কথকতার নিজস্ব গড়ন। যে গড়নে একটা বাক্যের মধ্যে আরেকটা বাক্য অবলীলায় সেঁধিয়ে যায়, যেন বা সেঁধিয়ে যায় মাটির গভীরে, শিকড় চারানোর মতো। আর মাটির গভীর থেকে খুঁড়ে আনেন সেই প্রান্তিক, সভ্যতার বয়ানে যারা না-মানুষই, তাদের অতি লৌকিক যাপন। যে যাপনে কোনো গতিকে বাঁচাই সার। আর তাই মগার ঠাকুমা ফনেবুড়ি নামাজ-কালামের ধার ধারে না। তার কাছে টাকাই বড় ধর্ম। সে জানে টাকা যার নামাজ তার। যেখানে ভিখিরির ভিখিরি যে বাহাদুর, মরতে বসেছে যে, সে সটান বলে— বেহেস্ত কোনটা যে দোজখে ভয় পাব? আর এ পুরাণ মাটির গুণেই মুসলমান নারী বুলুনির মা কালির ভর হয়। আবার এই বাঁচার টানেই ভজকট খটাশপারা নিঘিন্নে রহমালী প্যান্ট পরে ভদ্র হয়, পকেটে মক্কামদিনার ছবি রাখে। মগার শুকরোচাচা মাথায় নামাজের টুপি দিয়ে ইমামের পিছন পিছন— পাড়ায় আজ চাঁদা, কাল বিচার সালিশ করে বেড়ায়। আবার বাবু হালদারের ঠাকুরদা ডুমুরখোলের লম্বা জলে মরেও তিন কাল জুড়ে ডিঙি বায়… সকাল নেই সন্ধে নেই… ডিঙি বেয়ে বেয়ে পাহারা দেয় গাঙনী আর ধান আর হালদারপাড়া। শম্ভু কাওরা, হারমোনি বাজিয়ে ভিক্ষা করে যে, সে ভিটেটুকুও হারিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে গাঁ ত্যাগকালে কাকে প্রণাম করে বেরিয়ে যাবে, না ফনেবুড়িকে। যাওয়ার আগে সে তার আঁতুড়ে নাড়ি যে গাবায় মাটি পেয়েছিল, সেই মাটিকেও ছুঁয়ে যায়। আবহমান ভারতের যে মাটি, তারই আলোক-মায়া এ। এ মায়াতেই ভগীর পেটের বস্তুটা নষ্ট হবার পর সে গাঙনী পারে দাঁড়ালে কত রাত তার গা ভার হত— মনে হত ছোট্ট একটা খোকা খিলখিল করে হাসতে হাসতে তার আশেপাশে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, ধরতে গেলে পালিয়ে যায় গাঙনীর অঠাঁই জলে। যেখানে চাঁদ হাঁসের মতো সাঁতার কাটে সারারাত আর কে যেন হাততালি দেয় ছোট্ট ছোট্ট হাতে… ইশারা দিয়ে মা মা বলে ডাকে! শ্মশানের অই ভাঙা হাঁড়ি, ভাঙা কলসির আড়ালে কোথা থেকে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেউ কাঁদছে… খিদের কান্না নয়, ঘুমের কান্নাও নয়… কেমন যেন আপন মনে বুক ফুলিয়ে গাল ফুলিয়ে কাঁদছে কেউ… অকারণ! আর পাঠক আমি এ কথকতায় থম মারি। আমার গা ভার হয়!
এ মায়াই তো ভিন্ন ভিন্ন নামে কখনো আবি খাতুন, মগার মা, যে মা’কে মগার কাছ থেকে সাজিশ করে কেড়ে নেওয়া হয়, কখনো বা ভগী, আলীমনবু, ছালেমাদাদি, ফুলমা, উজানিকাকি, বাসন্তীপিসি, আলেয়া, আনুর মা, আর সে আলোআঁধারি ফনেবুড়ি। এই ভিন্ন ভিন্ন মায়াই জড়ো হয়ে রূপ ধারণ করলে হয়ে ওঠে কহরকণ্ঠ পাখি। সে কহরকণ্ঠ পাখি থাকে কোথায়? না, ওই গাঁ ছাড়িয়ে যে বটতলা, তার পুবমাথায় যে ধু-ধু মাঠ— তারপর এক এতোল বেতোল দেশ— সেখানে আছে এক দুকূল হারানো নদী। তার এপারের জল বিষ, ওপারের জল মধুর মতো মিষ্টি! সেই নদীর ধারে রোজ সেই পাখি উড়ে এসে বসে আর মিষ্টিজল ঠোঁটে করে নিয়ে আবার উড়ে যায় যেখানে— সেখানে আছে আকুল-ব্যাকুল নামে দুই ভাই। আকুল সারাদিন রোদে পোড়ে, মাঠে গরু চরায় আর ব্যাকুল থাকে সোনার বিরিক্ষের ছায়ায়। তা, কহরকণ্ঠ পাখি যখন যায়, তখন আকুল থাকে মাঠে আর ব্যাকুল থাকে ছায়ায়। পাখি ব্যাকুলকেই সেই জল খাইয়ে একটুখানি রেখে আসে বটের পাতায়। আকুল রোজ সন্ধেবেলা সেই পাতা চেটে খায়, আর জোনাকি হয়ে আগানে বাগানে ঘুমিয়ে পড়ে। যেদিন কহরকণ্ঠ পাখির সঙ্গে আকুলের দেখা হবে, জল খাওয়াবে সেইদিন আকুল চাঁদের কপালে চাঁদ হতে পারবে আবার। সে পাখির দেখা পেলে আকুল মগারও যে পায়েতে কপাল না, কপালে কপাল হবে। তখন সে তার কাছ থেকে ছিঁড়ে নেওয়া তার মা’কে খুঁজে পাবে, পাবে তার হারিয়ে যাওয়া বাবাকে। উজানিকাকি তাকে বলেছে— বাবাকে পাওয়া যায় না, তার সঙ্গে নাকি দেখা হয়ে যায়! কিন্তু সে তো সেই আজব নদীর পথ চেনে না। ভগীদিও নদীর কথা জানে, পাখির কথা জানে, কিন্তু পথ চেনে না! পথের খোঁজে মগা তাই এদিক না, সেদিক না, বেদিকেই ঢলে।
সে দিক্বিদিকে ভেসে ওঠে পুন্দালির মতো মানুষ, যার বুকে-পিঠে অনেকখানি জায়গা। যে বলে হুজুররা হল আলেম, আল্লার দরকারি মানুষ। আর সে, মগা হল কাঁসর। কাঁসররা খোদার বান্দা— একটু মানুষ, বাকিটা ভাগাড়ে পড়া। ফলে কথারা গড়ন পায়।
—মরার জায়গা কী?
—কবর।
—বাঁচার জায়গা?
—ঘর?
—আর লুকনোর জায়গা?
—চোখ, মগা চোখ।
তাই, মগার বাবা, মগার মা সব লুকিয়েছে মগার চোখে। মগাও নিজেকে লুকোয় নিজের চোখে তার পথ-বেপথ সবটুকু নিয়ে। আর যখন পথ মরে যায়, তখনই তো মাটিতে পুরাণ জাগে, যে জাগরে তার মা’কে ধরে নিয়ে যায় মোটা দাগের জমির এক মানুষ। পুরে রাখে এক গহীন ঘরে, সেটা আসলে ঘর নয়— একটা ইঁদারা। দরজা নেই, জানলা নেই সেই ইঁদারায়— কেবল একটা সোড়ং আছে, সোড়ং বরাবর একটা পথ আছে, কিন্তু পথটা কোনোদিকে নয়, শুধু পাতালের দিকেই যায়। সেখানে হাসান আর হোসেন নামে দুটো ভাই। তারা সোনার চামচে ভাত খায় আর ফুলের খাটে ঘুমায়! মগার মা সেখানে রুপোর কাঠি, সোনার কাঠি হাতে বসে থাকে। কহরকণ্ঠ পাখি যেদিন আসবে, সেদিন রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে দেবে মায়ের পায়ে আর সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দেবে তার মাথায়। মা আবার পথ পাবে ফিরে আসার। মগা নৌকা নিয়ে দাঁড়াবে মরালী নদীর ঘাটে!
কিন্তু সে পথ তো ঘাটে ভেড়ে না। থৈ থৈ অন্ধকারে বার বার হারিয়ে যায়, যে অন্ধকারের গড়ন অন্নহীন খিদের। না, মগার, যার বাবা-মা থেকেও নেই, সে কাঁসর মগার ভাত জোটে না ঘরে সবদিন। তার আলীমনবু, ভগীদি, উজানিকাকি তার খিদে পাওয়া মুখে ভাত গুঁজে দেয় কোনও কোনও দিন। ভাত জোটে না তার সঙ্গী হাভাতে রতনেরও, যার আবার সর্ব শরীরজোড়া খিদে সর্বদা দাউ দাউ জ্বলে। নোনা, খেজুর, কুল… যা পায় তাই দিয়েই সে জ্বালা মেটায়। যখন কিছুই জোটে না তখন পেটপড়া পেটকে ঠাণ্ডা মাটিতে চেপে সে সেই আগুন নেভায়। আর এই নিয়তিতেই গাঙনীর চরে রাখা বাসি হবিস্যির ভাত-কলা একদিন তার সব জ্বালা নিমেষে নিভিয়ে দেয়। খিদের এই পাঁচালিতে আমি বিভূতিভূষণকে জাগর দেখি। পাঠক আমার অবচেতনে নির্মম এক তারসানাই ছড় টানে। ইছামতী যেন মুখ রাখে ভাঙনীর জলে!
আবার এও তো সত্য যে জীবন বহমান। যে বহমানতা আপন ছন্দে বাজে, যা দোতারা। একটি তারে আলাপের সুর, সে সুরে ভগী-পুন্দালী, উজানি-খোয়ারির শঙ্খলাগে। অন্য তারে রণঝঙ্কার, যা ক্ষমতার, দানবিক। দখলের রাজনীতির— সেই আদিম… জমির, নারীর। আর এই দখলের রাজনীতির কারণেই আলীমন হারিয়ে যায়, আবি খাতুনকে হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়। উজানি ভেসে যায়। সব হারানো যে মগা তাকেও তার ভুঁই থেকে উপড়ে দেওয়া হয়। গাঁ-গেরাম জুড়ে যেন কেমনধারা এক ঘুচে যাওয়ার হাওয়া ওঠে। যেদিকেই তাকাও, শুধুই যেন মুখচাপা বোলহারা এক দানব ছুটে বেড়াচ্ছে, আর তার কানায় কানায় পড়ে মানুষজন সব শুধু ধুলো হয়ে যাচ্ছে, মরে ভূত হয়ে যাচ্ছে। কারা যে মরে, কারা যে মারে— বিল খাল গাঙনী— কোথায় যে গন্ডগোল— যারা মরে তারা জানে, যারা মারে তারা জানে।
ফলত এই যে গাঙনী, কত বিশাল, ভাগাড়ে চরা কত বিশাল, নলডুগরি, মথুরগাছি, খেদাইতলা, চাকডোব, বাগডোব কত কত গ্রাম লেপ্টে আছে সেখানে, শুধু জায়গা নেই মগার—
যার মা-বাবা থেকেও নেই তার কি কোনো জায়গা থাকে? তবে তার মা গেলবার বলে গিয়েছিল, জায়গা আছে বাসন্তীপিসির কাছে, কারণ সেখানে বই আছে, কলম আছে… সে ছায়ায় জায়গা তৈরি হয়, তৈরি করে নেয় মগা। না, মগা পালিয়ে বাঁচে না ভিনদেশে বা হুজুর পীরের রওজায়। কারণ সে জানে কাঁসর হলে নুকিয়ে বাঁচতে হয় ওই ছায়ায়, না হলে সূর্য পুড়ে যায়, রাত অগাধ হয়, পথ ফুরিয়ে যায়!
আর তাই গাঁ উজাড় হলেও গাঙনীর ভাগাড়ে মগা নিজেকে খুঁজে পায় এদিক না, সেদিক না, জাদুকরি বেদিকেই। আলিমন, ভগী, ফুলমা, উজনিকাকি, ফনেবুড়ি, আলেয়া… যত যত কহরকণ্ঠ পাখিছায়া তার মিলিয়ে যেতে থাকে আলেয়ার মায়া যেন। এখন মগা তো জানে না কাকে বলে যাওয়া আর কাকে বলে ফিরে আসা! ভোগোল মগা, আজগুবি মগা দাঁড়িয়ে থাকে এক মহাকাব্যিক শূন্যতায়। যে শূন্যতায় কোনো একদিন তার হারিয়ে যাওয়া মা আবি খাতুন এক ভোরবেলায় নিশুতভাঙা পানিতে মগাকে স্নান করিয়ে দিলে ফুটে উঠবে রাঙা শুক্রবার তার স্বপ্নের কহরকণ্ঠ পাখির ডাকাডাকিতে। আর আমরা হিম ভেঙে জেগে উঠে শুনব সে সুর, যেখানে কার্তিকের ভোরের টহলের কীর্তন আর দিনের প্রথম আজান ধ্বনি একাকার!
জেনে ভালো লাগল যে এ গ্রন্থখানি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এবং জোরের সঙ্গে বলতে চাই, ‘মগা’ বাংলা সাহিত্যে প্রবলভাবে থেকে যাবে, চিরকাল।