দ্বারকানাথ ঠাকুরের পালকপিতা রামলোচন ঠাকুর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একটি উইল বা ইচ্ছাপত্রে দ্বারকানাথকে নিজের সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
দ্বারকানাথের রক্তসম্পর্কিত (বায়োলজিক্যাল) পিতা রামমণির কাছে সমস্ত কাগজপত্র গচ্ছিত রাখার কথা বলা আছে উইলে। তার মানে রামলোচনের সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামমণির সম্পর্ক ভালোই ছিল বরাবর। রতন রাড় নামক এক ব্যক্তির কথা তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে। রাড় পদবি এখন আর দেখা যায় না। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ এই পদবির অর্থ শূদ্র, অন্ত্যজ বা ইতর দুর্বৃত্ত। এর সঙ্গে রাঁড়-কে যেন কেউ গুলিয়ে না ফেলেন। ডোম ইদরু সাহেবের বাড়ির কথাও আছে। সম্ভবত ইনি পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কসাইটোলা-চুনাগলিতে ইদরুস, পিদরুস, গমিসডিস ইত্যাদি মেটে ফিরিঙ্গির উল্লেখ আছে।
উইলটির উল্লেখ করা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জানা দরকার, দ্বারকানাথ পিতৃদত্ত কোনও ব্রথেলের কারবার করে বা অতিরঞ্জনকথিত ‘ফ্লেশট্রেড’ করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাননি।
উইল —
“আপন জ্ঞানপূর্ব্বক ও সেই উইল করিতেছি আমার পৈতৃক দৌলত নাই।
শ্রীশ্রী ঠাকুর ও জায়গা ও বাটী ও এলবাস পোষাক তাঁরা পিতল কাঁসার ও রূপা সোণার বাসনদিগর সেওয়ায় গহনা পৈত্রিক যা কিছু আছে ইহার তিন অংশের এক অংশ আমি পাইব দুই অংশ ভায়ারা পাইবেন পৈত্রিক ও আমার দত্ত সোনা রূপার গহনার অংশ হইবেক না, জাহির থাকে যে চিহ্ণিত আছে সে তাহারই থাকিবে।
আর সংসারের খরচ ও ধর্মতলার বাটীদিগর বানাতে মবলগহায় আমার নিজ ঢাকা বিং খাতা রোকড় ভায়াদিগের স্থানে আমার পাওনা আছে এবং অন্য অন্য লোকের স্থানেও যে পাওনা আছে আমার দেনা নাই এই সকল পাওনা ও পৈত্রিক হিস্যা ও আমার স্বোপার্জ্জিত দৌলত, সোনা রূপার বাসন ও এলবাস পোষাক ও জেলা যশোহরের মোতালক পরগণে বিরাহিমপুর জমিদারী ও সহর কলিকাতার মধ্যের খরিদা জায়গা ওগায়রহ সেওয়ায় রতন রাড়ের দরুন বাটী আমার সোপার্জ্জিত ও পৈত্রিক হিস্যা যাহা কিছু, সব তোমাকে দিলাম রতন রাড়ের দরুন বাটী খরিদ করিয়া তৎকালীন তোমার মাতাকে দিয়াছি এবং সন ১২১৩ সালে তোমার মাতার অর্থে আমি তুষ্ট হইয়া সিক্কা ১০,০০০ দশ হাজার টাকা দিয়াছি এ টাকা এবং রতন রাড়ের দরূণ বাটী ইহার সহিত তোমার এলাকা নাই ইহার দান বিতরণ এক্তার তোমার মাতার।
এখনও তুমি নাবালক একারণ এই জমিদারি ওগায়রহ জে কিছু বিষয় তোমাকে দিলাম ইহার কর্ম্মকার্য যাবৎ আমি বর্ত্তমান থাকিব তাবৎ আমিই করিব আমার অবর্তমানে যাবৎ তুমি বয়সপ্রাপ্ত না হও তাবৎ পরগণাদিগর এ সকল বিষয়ের কর্ম্মকার্য্য ও সহী দস্তখত ও বন্দবস্ত ও হুকুম হাকাম সকলি তোমার মাতা করিবেন তুমি প্রাপ্ত বয়স হইলে জমিদারিদিগর আপন নামে হজর লেখাইয়া এবং আপন এক্তারে আনিয়া জমিদারির ও সংসারের কর্ম্মকার্য ও জমিদারির বন্দবস্ত ও খরচপত্র ওগায়রহ মাতার অনুমতি পরামর্শে তুমি করিবা এবং জাবত তোমার মাতা বর্ত্তমান থাকিবেন ভাবত পরগণার মুনাফা ওগায়রাহ যাহা কিছু, আমদানির তহবিল তোমার মাতার নিকট যেমন আমি রাখিতাম তুমিও সেই মতো রাখিবা।
আমি ও তোমার মাতা যাবৎ বর্ত্তমান ও বর্ত্তমানা থাকিবেন ও থাকিব তাবত আমারদিগর পণ্য ক্রিয়া আদি যে কিছু, খরচপত্র এই দৌলাত হইতে পাইব।
আমার সোপার্জিত জায়গার কবালা ও বরনামা ওগায়রহ আমার স্থানে ছিল!
নিস্তীমতো তোমাকে দিলাম পৈত্রিক জায়গা ও বাটীদিগরের কবালা ও পাট্টা ওগায়রহ কাগজ রামমণি বাবুর স্থানে আছে জায়গা হিস্যা চিহ্ণিত মতো বুঝিয়া লইবা এতদর্থে উইলপত্র লিখিয়া দিলাম।”
সম্পত্তি তালিকা-
“জায় জায়গা সোপার্জ্জিত জমিদারি পরগণে বিরাহিম — পুর মোতালকে, জেলা জসোহর — ১
সহর কলিকাতার মধ্যে ডোম পিদুরু সাহেবের দরুন জায়গা — ১
বামদেব বাইতির দঃ জায়গা — ১
কৃষ্ণচন্দ্র রায় কবিরাজের দঃ জায়গা — ১
তিলক বসাকের দঃ জায়গা — ১
শঙ্কর মুখোপাধ্যায় দঃ বাটী — ১
রামকিশোর মিস্ত্রীর দঃ জায়গা — ১
রামনিধি সাহার দঃ বাটী — ১
রতনরাড়ের দঃবাটী- এবাটী তোমারমাতাকে দিয়াছি — ১
পৈত্রিক — নিজবাটী- ১, ধর্ম্মতলার বাটী — ১
বড়বাজারের বটতলার বাটী — ১
জানবাজারের হাড়িটোলার জায়গা — ১
ডোমটোলার জায়গা — ১, মাহুতের দঃ জায়গা — ১
কলিঙ্গা ব্রহ্মচারীর দঃ জায়গা — ১
পরগণে মাগুরা মৌজে ফতেপুর ব্রহ্মত্তর জমি — ১
মৌজে কপিলেশ্বর ব্রহ্মত্তর জমি — ১”
(বানান অপরিবর্তিত)
বিদ্যাসাগরের উইলের মতই রামলোচন ঠাকুরের এই উইলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কারণ দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিষয়-আশয় হঠাৎ করে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা নয় বা নির্ধনের আকস্মিক ধনপ্রাপ্তি নয়। তাঁর পালকপিতা রামলোচন ঠাকুর ছিলেন কলকাতার অন্যতম রহিস ব্যক্তি। তিনি তাঁর দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরের জন্যে বিশাল সম্পত্তি রেখে যান। এই ভিতের উপরই দ্বারকানাথ নিজের ব্যবসাবুদ্ধির সাহায্যে সুউচ্চ ইমারত গড়ে তোলেন। সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে তিনি বিত্তবান হয়েছিলেন। কোনও পতিতাপল্লির উপায় থেকে নয়।
[আমার টীকা — এলবাস > পোশাক-পরিচ্ছদ, কাপড়-চোপড় (আরবি ইলবাস থেকে)
সেওয়ায় > ভিন্ন, ব্যতীত (ফারসি সিবা থেকে হিন্দি সিবায়্ হয়ে)
জাহির > ব্যক্ত, সুবিদিত, প্রচারিত (আরবি জাহির থেকে)
মবলগাহায় > মোট, থোক, নগদ (আরবি মবলগ থেকে)
রোকড় > নগদ টাকায় দেনা পরিশোধ। ( ফারসি রোখ থেকে, বাংলায় রোক-শোধ)
খরিদা — ক্রীত (ফারসি খরিদ থেকে)
ওগায়রহ > ইত্যাদি, অন্যান্য (ফারসি ওয়াগয়রহ্ থেকে)
এক্তার — বৈধ ক্ষমতা, আইনগত অধিকার(আরবি ইখতিয়ার থেকে)
হজর > উপস্থিতি, হাজিরা (আরবি হজ – রৎ থেকে)
হিস্যা > অংশ, ভাগ, প্রাপ্য, (আরবি হিসসাহ্ থেকে)
কবালা > অঙ্গীকারপত্র (আরবি ক্ববুল — জাত শব্দ)
বরনামা — ফারসি বরনামজ থেকে। এক খণ্ড কাগজ যাতে বিক্রীত জিনিসের বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকে। বিল বা ইনভয়েস বা চোতা কাগজ।
নিস্তীমতো > আনন্দসহকারে বা সানন্দে (আরবি নিশাত্ থেকে, নিশাত মানে আনন্দ)।
যে যে অভিধানের সাহায্য নিলাম —
১. বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান — মোহাম্মদ হারুন রশিদ
২. বঙ্গীয় শব্দকোষ — হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা ভাষার অভিধান — জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
৪. আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান — ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান]