দুর্গোৎসব যেমন হুতোমকেও ভাবিয়েছিল, সারা বিশ্বকে আজ ভাবাচ্ছে। ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা জুটে যাওয়ার পর বাঙালির তো গর্বে বুক চওড়া হয়ে গেছে। সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা আজ নামী দামি থিমের পুজো ঘিরে মেতে উঠলেও, প্রাচীনকাল থেকেই সাবেক বাড়ির প্রতি একটা অন্য আকর্ষণ কাজ করে বাঙালির মধ্যে। কলকাতার প্রায় প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহ্যবাহী সাবেক বাড়ির পুজো। তবে তাদের মধ্যে কুমোরটুলির মিত্র বাড়ির পুজো বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রাচীন এই পুজো কলকাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িত। অনেকেই জানেন না হয়তো, আজও মনে করা হয় মা দুর্গা মর্ত্যে এসে খেতে আসেন এই মিত্র বাড়িতে। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে গহনা পরে মাদুর্গা এখানে এসে পাত পাড়েন। আহার সমাপনান্তে শোভাবাজার রাজবাড়িতে গিয়ে নাচগান উপভোগ করেন! পশ্চিমবঙ্গের ব্যস্ততম শহর কলকাতায় অবস্থিত এই কুমোরটুলি অঞ্চল। কুমোরটুলির নাম শুনলে বাঙালির প্রথমেই মনে আসে মাটির তৈরি দেব-দেবীর বিগ্রহের কথা। কুমোরটুলির শিল্পীদের অসামান্য শিল্পকলা আজও মন টানে দেশ সহ বিদেশের উৎসব প্রিয় বাঙালিদের। কুমোরটুলিতেই অবস্থিত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মিত্র বাড়ি। এই পরিবারে দুর্গোৎসবের জাঁকজমক, আড়ম্বরের কথা একাধারে ইতিহাস ও কিংবদন্তী। এই বাড়ির আদি পুরুষ হলেন গোবিন্দরাম মিত্র। কলকাতায় ইংরেজরা যখন পাকাপাকি ভাবে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করেন, তখন ভারতীয় হিসেবে দ্বিতীয় ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন গোবিন্দরাম মিত্র। তাঁর পূর্বসূরী ছিলেন নন্দরাম সেন। জানা যায়, ঘোড়াগাড়ি চালানো প্রথম বাঙালি ব্যক্তিও ছিলেন তিনি। সেই সময়ই গোবিন্দরাম মিত্র কুমোরটুলিতে ৫০বিঘা জমির উপর নির্মাণ করেন এই মিত্রবাড়ি। এই বাড়িরই উত্তর পুরুষ হলেন অভয়চরণ মিত্র। গোবিন্দরামের আমলে মিত্র বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু হলেও অভয়চরণের আমলেই তার জৌলুস বৃদ্ধি পায়। মিত্র বাড়ির দুর্গা প্রতিমাকে নানারকম স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি, রূপোর তৈরি পাতে মুড়ে ফেলা হয। আজও মনে করা হয়, স্বয়ং দেবী দুর্গা মর্ত্যে এসে জোড়াসাঁকো দাঁ বাড়িতে গয়না পরার পর খেতে যান এই মিত্র বাড়িতে। তাই মায়ের ভোগের আয়োজনের জন্য বাড়ির সকল মহিলারা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান মিত্র বাড়ির হেঁশেলেই।
প্রাচীন সময় থেকেই মিত্র বাড়িতে দেবীকে ভোগে অন্নভোগ দেওয়া হতনা। তার বদলে নিবেদন করা হত তিরিশ থেকে পঞ্চাশ মণ চালের নৈবেদ্য। এছাড়াও নানারকম মিষ্টি, গজা, নিমকি, লুচি, রাধাবল্লভী ইত্যাদি নিবেদন করা হত মা দুর্গাকে। ঐতিহ্যময় এই রীতি আজও অব্যাহত রয়েছে মিত্রবাড়িতে। এছাড়াও মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ কুমারী পুজো। তবে এখানে পশুবলি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। মা দুর্গা বিগ্রহ বিসর্জনের জন্য মিত্র পরিবারের আদি পুরুষদের বানানো ঘাটটি বর্তমানে ‘বাগবাজার ঘাট’ নামে পরিচিত। যেখানে আজ সাড়ম্বরে বহু বনেদি বাড়ি ও বারোয়ারির প্রতিমাও নিরঞ্জিত হয়।
গোবিন্দরাম মিত্রর দুর্গাপুজো নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলে। তবে কেউ বলেন না যে তিনি মাদুর্গা ও তাঁর পুত্রকন্যাদের সঙ্গে মহাদেব ও রামচন্দ্রের পূজাও করতেন। এই তথ্য সহজে উদ্ধার হয়নি। শ্রীপান্থ তার ‘কলকাতা’ বইটিতে একটি বইয়ের নাম দেন, যেটি গোবিন্দরাম মিত্রের এক অজ্ঞাতনামা বংশধরের লেখা। নারায়ণ দত্ত নামক জনৈক লেখকের কলকাতাবিষয়ক বইয়ের পরিশিষ্টে গোবিন্দরাম মিত্রের এই সংক্ষিপ্ত জীবনীটি সন্নিবেশিত হয়েছে। ইংরেজিতে লেখা এই বইয়ে দুর্গার সঙ্গে রামচন্দ্রের মূর্তির একত্রে পুজোর বিবরণ আছে। আঠেরো শতকের প্রথমদিকে এই রামচন্দ্রীয় দুর্গাপূজার চল ছিল বাংলায়। মনে হয় বসন্তকালীন দুর্গার রামচন্দ্রকৃত অকালবোধনকে স্মরণে রাখার জন্যে গোবিন্দরামের শরৎকালীন দুর্গাপূজায় রামচন্দ্রের স্থান হত। এ বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণা দরকার। আজ যারা লেবুতলার দুর্গাপূজার রামমন্দির দেখতে কাতারে কাতারে ভিড় করছেন, তাঁদের জানা উচিত খোদ কলকাতার বুকেই দুর্গা ও রাম একত্রে পূজিত হয়েছেন তিনশো বছর আগেই।