‘শিশুশিক্ষা’ তৃতীয় ভাগ, যেটা ‘ঋজুপাঠ’ নামে পরিচিত, এই বই সম্পর্কে মুখবন্ধে বলা হচ্ছে —
“শিশুশিক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে বর্ণপরিচয়ের উপায় ব্যবস্থাপিত হইয়াছে। এক্ষণে তৃতীয় ভাগে অতি ঋজু ভাষায় নীতিগর্ভ নানা বিষয়ক প্রস্তাব সকল সঙ্কলিত হইল।”
ঈশপের ‘ফেবলস্’-এ যে নীতিকথা (Moral) ব্যবহৃত হত এই বইয়ের প্রত্যেকটি লেখার উপরে একটি করে নীতিবাক্য সংযোজিত হয়েছে। যেমন —
১) “সুশীল শিশুকে সকলে ভালবাসে।”
২) “দূরন্ত বালককে কেহ দেখিতে পারে না।”
৩) “কুকুর বড় প্রভুভক্ত।”
৪) “ধার্ম্মিক লোক পৃথিবীর অলঙ্কার।”
৫) “পিপীলিকা ও মধুমক্ষিকার আপলস্য নাই।”
৬) “ভেক শীতকালে কেবল নিদ্রা যায়।”
৭) “পরের দ্রব্যে লোভ করিও না।”
৮) “অন্ধজনে দয়া কর।”
৯) “নির্দ্দয় লোক পশুর সমান।”
১০) “চুরি করা বড় দোষ।”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়‘
এবার দু-চার কথায় ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ বই দুটির আলোচনায় আসা যাক। দুটি বই ১৮৫৫ তে প্রকাশিত হয়। পুরোহিত যেমন মাটির প্রতিমায় চক্ষুদান করেন, তেমনি বঙ্গ প্রতিমায় চক্ষুদান করেছিল বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘আদিকবি’ বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন — “কেবল মনে পড়ে, জল পড়ে পাতা নড়ে তখন ‘কর’ ‘খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। আমার জীবনের এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা।” ‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রথম ভাগে ১২টি স্বরবর্ণ ও ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকা দেওয়া হয়েছে। মদনমোহন তর্কালঙ্কার ষোলটি স্বরবর্ণের ব্যবহার করেছিলেন। বিদ্যাসাগর সেখান থেকে চারটি স্বরধ্বনি বাদ দিলেন। আর ৩৪টি ব্যঞ্জন এর জায়গায় বিদ্যাসাগর আনলেন ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ। ছবিতে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগ এর স্বর ও ব্যঞ্জনের তালিকাটি দেখানো হল —
‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রথম ভাগের মুখপত্রে বিদ্যাসাগর বলেছেন —”বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ প্রচারিত হইল। বহুকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল।কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋ কার এবং দীর্ঘ লি কারের প্রয়োগ নাই। এই নিমিত্ত ওই দুটি বর্ণ পরিত্যাক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত এই দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণ স্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদ মধ্যে অথবা পদান্তে থাকিলে ড়, ঢ়, য় হয়। সুতরাং উহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ইত্রই পরস্পর ভেদ আছে তখন তাহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই শ্রেয়ঃকল্প এই নিমিত্ত উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ক এবং ষ মিলিয়া ক্ষ হয়। সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ। এজন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।”
এই বই দুটির প্রথমটিতে বর্ণের সঙ্গে যেমন শিশু শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি বর্ণের সঙ্গে স্বরচিহ্ন জুড়ে এক একটি ধ্বনিকে চিনতে শেখানো হয়েছে। তারপর ধ্বনিগুলিকে জুড়ে ছোট ছোট শব্দও শেখানো হয়েছে। একটু উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক। যেমন-‘জ’ একটি ব্যঞ্জনধ্বনি বা বর্ণ। আর ‘জ’-এর সঙ্গে যখন ‘আ’ এই স্বরধ্বনি বা বর্ণটি যোগ হল তখন তার চেহারা বদলে গিয়ে হল —
জ+আ=’জা’। এই ‘জা’ হল একটি ধ্বনিগত একক বা ইউনিট (Unit)।তেমনি ম+আ = মা। এই জা এবং মা জুড়ে নতুন একটি শব্দ তৈরি হল — জা+মা=জামা।
প্রথম কারবিহীন শব্দ, তারপর দশটি কার সহযোগে নতুন নতুন শব্দ ক্রম অনুযায়ী শেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে ‘আ’-কার, তারপর ‘ই’-কার এভাবে। এরপর ছোট ছোট বাক্য যা শিশুর আয়ত্তের মধ্যে তাই শেখানো হয়েছে। যেমন —
‘বড় গাছ’, ‘ছোট পাতা’, ‘লাল ফুল’, ‘ভাল জল’, ‘ঘন দুধ’ ইত্যাদি। ধীরে ধীরে অনুচ্ছেদ স্তরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের এটা স্পষ্ট। শেষের দিকে বেশ কিছু অনুচ্ছেদ দিয়েছেন তার মধ্যে থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ এখানে উল্লেখ করছি।
১) “আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি। কাপড় পরিয়া পড়িতে বসি। ভাল করিয়া না পড়িলে পড়া বলিতে পারিব না। পড়া বলিতে না পারিলে গুরু মহাশয় রাগ করিবেন। নূতন পড়া দিবেন না।”
আর দুটি অনুচ্ছেদ বই থেকে তুলে দিচ্ছি —
প্রথম ভাগের শেষে এক থেকে নয় ও শুন্য সংখ্যার কথায় ও সংখ্যায় লিখে শিশুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর সরাসরি আসি দ্বিতীয় ভাগের কথায়।দ্বিতীয় ভাগের শুরুতেই মুখবন্ধ অংশ বিদ্যাসাগর বলেছেন — “বালকদিগের সংযুক্ত বর্ণ পরিচয় এই পুস্তকের উদ্দেশ্য।সংযুক্ত বর্ণের উদাহরণ স্থলে যে সকল শব্দ আছে শিক্ষক মহাশয়রা বালকদিগকে উহাদের বর্ণবিভাগমাত্র শিখাইবেন অর্থ শিখাইবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইবেন না। বর্ণ বিভাগের সঙ্গে অর্থ শিখাইতে গেলে গুরু শিষ্য উভয় পক্ষেরই অত্যন্ত কষ্ট হইবেক এবং শিক্ষা বিষয়েও আনুষঙ্গিক অনেক দোষ ঘটিবেক।ক্রমাগত শব্দের উচ্চারণ ও বর্ণ বিভাগ শিক্ষা করিতে গেলে অতিশয় নীরস বোধ হইবে ও বিরক্তি জন্মিবে এজন্য মধ্যে মধ্যে এক একটি পাঠ দেওয়া গিয়াছে।”
প্রথমেই য ফলার ব্যবহার শেখানো হয়েছে। তারপর র-ফলা, ল-ফলা, ব-ফলা, ণ ও ন-ফলা, ম-ফলা, রেফ্ এবং অন্যান্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনের উল্লেখ, তাদের দিয়ে শব্দ তৈরি এবং একঘেয়েমি কাটানোর জন্য ছোট ছোট পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরকম যুক্ত বর্ণ সমন্বিত পাঠ এখানে দেখানো হল —
রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’-এর কথা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’-এর নাম শুনলেই আট থেকে আশি সকলের মধ্যেই এক নস্টালজিয়া কাজ করে, বিশেষত যারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন তাকে ঘিরেই এক অদ্ভুত উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মত। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠ’ এর চারটি ভাগ। তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগই বিশ্বভারতী কর্তৃক অনুমোদনের ভিত্তিতে স্কুল পাঠ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগের বেশিরভাগ রচনায় রবীন্দ্রনাথের লেখা নয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-মে নাগাদ (১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে) শান্তিনিকেতন থেকে ‘সহজ পাঠ’-এর প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ একত্রে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তৃতীয় ভাগ ও চতুর্থভাগ প্রকাশিত হয়েছিল। এর অলংকরণ করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যক্ষ শ্রী নন্দলাল বসু মহাশয়।
‘সহজপাঠ’ মূলত বাংলা ভাষা শিক্ষার শিশুপাঠ্য বই।প্রথম ভাগে আছে বাংলা বর্ণমালার প্রাথমিক ধারণা, তাদের গঠন বা কাঠামো, প্রত্যেকটা বর্ণের উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা, শব্দ ও শব্দ গঠন, ছোট ছোট বাক্যের মাধ্যমে নির্মিত কাহিনীর গ্রাফিক্স। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে যুক্তবর্ণের ব্যবহার,তার দ্বারা নির্মিত শব্দ ও বাক্যে ব্যবহার করে ছোট ছোট অনুচ্ছেদ ও গল্প অর্থাৎ বর্ণস্তর > শব্দ স্তর > বাক্য স্তর > অনুচ্ছেদ স্তর > গল্প স্তর এই ক্রমটিকে রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছিলেন।অত্যন্ত সুচারুভাবে রবীন্দ্রনাথ শিশুর কল্পনার জগতকে প্রসারিত করেছেন বইগুলির প্রত্যেকটি পাতায়। আমি মূলত ‘সহজপাঠ’ প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ নিয়েই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব এই প্রবন্ধের পাতায়।
সে যুগে এত জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বইগুলি থাকতে রবীন্দ্রনাথ আবারও নতুন করে কেন শিশু পাঠ্য বই লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন? প্রশ্নটা এখানেই। কি এমন বাড়তি বৈশিষ্ট্য রয়েছে বইটির মধ্যে, যাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিশুরা একে অনুসরণ করে! এই সকল কারণই আমরা খুঁজব ‘রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ ও অন্যান্য’ শীর্ষক প্রবন্ধটির পাতায়।
‘সহজ পাঠ’ কথাটির নাম শুনলেই আপাতভাবে মনে হয় পাঠগুলি খুবই সহজ-সরল। তাই হয়তো এই নামকরণ। শিশুদের মধ্যে এই বোধটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে-যে বই এত সহজ তাকে পড়তে দোষ কোথায়? কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এটুকু অন্তত বোঝা যায় ‘সহজ পাঠ’ আদৌ কতটা সহজ? আপাত ‘সহজ’ নামটি এর নামকরণের সঙ্গে দেগে দেওয়া হলেও সেটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। সাধারণভাবে দেখতে গেলে ‘সহজ পাঠ’ শিশুদের ভাষা শিক্ষার বই। তবে এ ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি তাদের সাহিত্যবোধ, কল্পনা প্রবণতা, নান্দনিকতাবোধ ইত্যাদি দিকগুলির দিকেও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ছিল। শান্তিনিকেতনের শিশুদের জন্য রবীন্দ্রনাথ এমন একটা বই তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যাতে শিশুরা নিজে থেকেই কিছু শেখে অর্থাৎ আধুনিককালে যেটাকে বলে ‘Self Learning’ (সেলফ লার্নিং) অর্থাৎ আত্মশিখণ এ অনেকটা তারই পূর্ব প্রস্তুতি। তাই ডক্টর কমল কান্তি দাস মন্তব্য করেছিলেন — “সহজ পাঠকে সহজ না বলে সহজাত বললেও অত্যুক্তি হবে না।” (ক্রমশ)