পঁচিশে বৈশাখ ১৪৩২ আরো একবার রবীন্দ্রনাথ স্মরণ গতানুগতিক পন্থায় ঠাকুর পূজার মতো নির্দিষ্ট কবিতা গান নৃত্যনাট্য প্রভৃতির মাধ্যমে। প্রথম নোবেল পুরস্কার জয়ী, বঙ্গীয় তথা সমগ্র ভারতের কৃষ্টির পথিকৃৎ পূজিত হন শিক্ষাঙ্গন থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মঞ্চে।কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ততই যেন বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা গ্রাস করছে এই ঠাকুর পূজার আয়োজন অনুষ্ঠানে।
আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর জীবনের অনেক কিছুই যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশোর কাল থেকেই ভ্রমণ পিপাসু ছিলেন। হয়ত তাঁর পিতৃদেবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন এই প্রেরণা। তবে ১৯৩০ সালে রাশিয়া ও আমেরিকা সফরের পর থেকেই শারীরিক সমস্যা তাঁর ভ্রমণ পিপাসার অন্তরায় হয়ে ওঠে।
এমনি সময় ইরানের সুলতান রহ্লাভি রেজা শাহ্ তাঁকে রাজ অতিথি হয়ে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানান।
একদিকে এই নতুন দেশ দেখবার প্রলোভন অন্যদিকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা কবিকে দ্বিধান্বিত করছিল। গরমে জাহাজ যাত্রা চিকিৎসকের অনুমতি পেলো না। অবশ্য এর অনেক আগেই ১৬ এপ্রিল ১৯২১ এ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে নিয়ে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ তাঁরই দেওয়া নাম “যন্ত্র পক্ষীরাজে” দু ঘন্টা সফর করেন লন্ডনের ক্রয়ডন এয়ারপোর্ট থেকে প্যারিস পর্যন্ত। কিন্ত কলকাতা থেকে ইরান যেতে থামতে হবে এলাহাবাদ, যোধপুর এবং করাচিতে।এর আগে সম্ভবত কোনো বিশিষ্টজন বাণিজ্যিক উড়ানে এত দূর যাত্রা করেননি। প্রধানত টিকিটের উচ্চ মূল্য এবং আকাশ যাত্রা সম্পর্কিত সন্দেহ প্রধান বাধা ছিল। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ এই ভাবে যেতে রাজি হয়েছেন জেনে এক বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হলো জনমনে। অচিরেই ইরানের ওই উড়ানে সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেলো।
বিমান সংস্থা কে এল এম তাঁদের এই বিশিষ্ট অতিথির জন্যে এক স্পেশাল টেস্ট রাইড আয়োজন করলেন এবং অবশ্যই তা ছিল বিনা মূল্যে।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ পাইলট ভ্যান ডিজ্জিক নেতৃত্বে বিমান দমদম থেকে আকাশে উড়ল বিকেল ৪টে নাগাদ ১২৫০০ ফুট উচ্চতায়, সময়কাল ২৫ মিনিট। মূলত কবির কোন অস্বস্তি হচ্ছে কি না দেখার জন্যই ছিল এই প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন। কবিগুরুর সঙ্গে ছিলেন নেদারল্যান্ডসের কাউন্সিল জেনারেল মিস্টার ভিরুলি, তাঁর স্ত্রী মিসেস ভিসার এবং কবির আপ্ত সহায়ক শ্রী অমিয় চক্রবর্তী মহাশয়।
এই প্রমোদ ভ্রমণের বিষয়, ছবি ও বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশিত হয় “দি স্টেটসম্যান” পত্রিকায় ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে, অর্থাৎ এই অভূতপূর্ব ঘটনার চার দিন পরে। কোনো বিদেশি বিমান সংস্থা এই ধরনের সম্মান আর কাউকে কখনো দেখিয়েছেন বলে জানা নেই।
শেষ পর্যন্ত ১১ এপ্রিল ১৯৩২ কলকাতার সর্বাধিক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ভোরের বেলায় খরদহ থেকে রওনা দিলেন দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছাবার জন্য। প্রসঙ্গত উনি আগের দিন রাত কাটিয়েছিলেন খড়দহতে, বিমান বন্দর কাছে হবে বলে।
বিমান বন্দরে কবির উত্তেজনা বহুগুণ বেড়ে গেল যখন উনি দেখলেন অনেক শুভানুধ্যায়ী বন্ধু এবং সাংবাদিক ওই ভোর বেলায় তাঁকে বিদায় জানাতে উপস্থিত। বিশিষ্টজনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সস্ত্রীক কালীদাস নাগ, সস্ত্রীক প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবীশ, সুরেন্দ্রনাথ কর প্রমুখ।
কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করার কৃতিত্ব অর্জন করলেন রবীন্দ্রনাথ।
লিবার্টি সংবাদপত্রকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি জানালেন যে সত্তর ঊর্ধ বয়সে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই আকাশপথে যাত্রা করছেন। কিন্তু তাঁকে যেতেই হবে কারণ ইরানের সুলতান তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশের প্রতিনিধি হিসাবে। সুদীপ বসু মহাশয়ের লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
অবশেষে ভোর পাঁচটায় প্রতিমাদেবী ও অমিয় চক্রবর্তী সহ, স্বর্ণাক্ষরে নীল বিমানের গায়ে কে এল এম খচিত ট্রিপল ইঞ্জিন ফকার এফ ১২, কবির ভাষায় যন্ত্র পক্ষীরাজ আকাশে ডানা মেলে উড়ে গেল।
এলাহাবাদ পৌঁছল সকল ১০টায়। বিমানে পাউরুটি, চীজ, চকলেট, সন্দেশ এবং পানীয় জল সরবরাহ করা হয়েছিল। এলাহাবাদ বিমান বন্দরে, বিমানে পেট্রোল ভরা হলো। এরপরের গন্তব্য ছিল রাজপুতানার যোধপুর। আর তারপর সিন্ধের করাচি। তৃতীয় দিনে ওঁরা পৌঁছালেন ইরানে।
ছ’সপ্তাহ পরে ফিরে এলেন কলকাতা। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথের এই অভিযান যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে এক অদৃশ্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।
সেই যুগে তাঁদের মাথা পিছু যাত্রী যাতায়াতের ভাড়া লেগেছিল ৩৩২ পাউন্ড।
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাবর্তনের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ও প্রতিমা দেবীর ছবি, এমনকি ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেটও ওই দিনই এক সবিস্তার সংবাদ মুদ্রিত হয়।
সূত্র: দি স্টেটসম্যান ও পারস্য যাত্রী।
বাহ একটি দারুণ নিবন্ধ পড়লাম, সমৃদ্ধ হলাম। দারুণ লিখেছেন স্যার। নীলাঞ্জন
Thakurbari r theke Khardah biman bondor kachhe? 🤔
খুবই মনোগ্রাহী এবং সময়োচিত প্রতিবেদন আজকের যুগের এই আড়ম্বর সর্বস্ব ঠাকুর পূজার পরিপ্রেক্ষিতে।
Sir khub bhalo hoyeche
1st bhebe chilam je kono news apni hoyto diyache kintu ata je apni likhechen ta jene amar khub bhalo laglo
কবিগুরু সম্মন্ধে এক অজানা তথ্য..সেই সময়ে তার বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব এই ঘটনা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়..
খুবই তথ্যবহুল ও মননশীল প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের এই অপ্রচলিত ভ্রমণকাহিনি ও বিমান যাত্রা নিয়ে আলোচনা পাঠককে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে কবিগুরুকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, ভ্রমণ ও প্রযুক্তির ইতিহাসেও তাঁর অবদান কতটা তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এমন স্মরণ সত্যিই সময়োপযোগী ও শিক্ষণীয়।
Thank you Sir for unfolding an unknown chapter of the great man. The writing is crisp and enjoyable.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী তথা ভারতবাসীর কাছে
এক আবেগ ।তিনি এক মহাসমুদ্র । তাঁকে জানার কোনো শেষ নেই একথা এই প্রতিবেদন পড়ে আবারও প্রমাণিত হলো। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখককে এই রকম একটি তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করবার জন্য। আশা রাখি ভবিষ্যতেও তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আরও নিত্য নতুন তথ্য দিয়ে আমাদের আলোকিত করবেন।
খুব সুন্দর ।
Thakur poribar somporke sob inner history porte amar khub bhalo lage.
Ei article tio porte khub bhalo laglo. Asha kori bhobishoteo ei dhoroner anek interesting anecdotes nie apnara likhben ar Kobiguru ke aro kacher kore, aro bhalo kore chenbar chance amra pabo.
Thank you.
খুব ভালো লাগল। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নানা জনে নানা গুরুগম্ভীর নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। এই লেখাটি তেমন নয়, বিশেষ এক ভ্রমণ কাহিনী। পড়তে ভালো লাগে।
লেখককে ধন্যবাদ।
খুব ভালো লাগল। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নানা জনে নানা গুরুগম্ভীর নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন। এই লেখাটি তেমন নয়, বিশেষ এক ভ্রমণ কাহিনী। পড়তে ভালো লাগে।
লেখককে ধন্যবাদ।
Aßadharan ekti informative lekha amra anekei onar bivinno samayer bidesh yatra samndhe porechi,kintu onar irane biman yatra bisesh kore kon plane chare kibava kon route iran pauchechilen sei jatrapoth samondhe abohito hoa gelo.kobir 70 bochor boiseo ei pranpachurje bhara jibondodh e sudhu kabir pakkhei samvab
খুব ভালো লাগল। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নানা মানুষ নানা জ্ঞানগর্ভ গুরুগম্ভীর লেখা লেখেন। এ লেখাটি তেমন নয়, বিশেষ এক ভ্রমণ কাহিনী। স্বচ্ছন্দ লেখা, পড়ে বেশ ভালো লাগল।
জানতে পেরে খুবই ভালো লাগলো
কত অজানারে জানাইলে । অভিবাদন ।
ভালো লাগল। কবিগুরু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম।
কবিগুরুর জীবনের এক অজানা দিকের ওপর আলোকপাত করে লেখক,পাঠকদের সামনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন।কবিগুরুর বিমানযাত্রা সম্পর্কে ধারণা ছিলো না,এবং সেই বিমানযাত্রার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে পেরে ভীষণ ভালো লাগলো।রবীন্দ্র অনুরাগীদের জন্যে এধরনের লেখা শুধুমাত্র তথ্য সম্বলিত এক লেখনীমাত্র নয়,রবীন্দ্রনাথের জীবনের খুঁটিনাটি তথ্য জানার জন্য এক নিমন্ত্রণও বটে….সমৃদ্ধ হলাম…ভবিষ্যতে আরো অনুরূপ লেখনীর আশায় রইলাম,অনুরোধ রইলো লেখকের কাছে,আরো এমন অজানা দিশার সন্ধান উনি পাঠকদের সামনে উন্মোচিত করবেন।
ইতি – নবনীতা পোদ্দার।।