আজ থেকে এক শত বছর আগে সেকালের নামকরা ফ্লিম ডিরেক্টর নরেশ মিত্র রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন তার একটা গল্পের চিত্রনাট্য করে দেবার জন্য যাতে তিনি সেটার সিনেমা করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ তার লেখা মানভঞ্জন গল্পটির চিত্রনাট্য করে দেন। ‘মানভঞ্জন’ (১৯২৩), রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে এটিই ছিল প্রথম চলচ্চিত্র।
খুব কম মানুষকে ভারতীয় সিনেমার ক্রমবিকাশে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় যোগ ও অবদান নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। সিনেম্যাটিক অভিযোজনে, বিশেষ করে চিত্রনাট্যে রবি ঠাকুরের লেখা চিরকালের কাছের।
অথচ তিনি সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন, সিনেমা যেহেতু একটি নতুন আর্ট ফর্ম, সে কারণেই নাকি তার সাহিত্যের ক্রীতদাস হয়ে থাকা উচিত নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ ও ‘জেনারেল লাইন’ দেখে উদ্বুদ্ধ হন ঠিকই, কিন্তু সিনেমার সমালোচনায় মুখর থেকেছেন নিজে। তাই তো পরবর্তীতে নির্বাক ছবিতে ইন্টার টাইটেলের বেশি ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। ভারতীয় সিনেমাতেও রবীন্দ্রকাব্যের ব্যবহার শুরু হয় নিবার্ক ছবির সময়েই। নরেশ মিত্র ও শিশির ভাদুড়ি বেশকিছু ছবি তৈরি করেছিলেন রবিঠাকুরের লেখা নির্ভর করে। এরপরে আসে নাভাল গান্ধীর ‘বলিদান’ (১৯২৭)। শিশির কুমার ভাদুড়ির পরিচালনায় ‘বিচারক’ (১৯২৯) এবং ‘বিসর্জন’ (১৯২৯) একই সময়ে তৈরি হয়।
এরপরে মধু বসু তৈরি করেন ‘গিরিবালা’ (১৯২৯)। পর পর দুটি ছবি তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উপর। কবিগুরু নিজে মধু বসুকে সাহায্য করেছিলেন চিত্রনাট্য তৈরিতে। রবিকাব্যের ব্যবহারে তৈরি হয় ‘মানভঞ্জন’ ও ‘দালিয়া’। এমনকী ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘তপতী’ তৈরি হওয়ার কথা হলে, তাতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তবে এ ছবি শেষ হয়নি। ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথের পরিচালিত একমাত্র ছবি তৈরি হয় ‘নটীর পূজা’। মঞ্চস্থ হওয়ার সময় শুট করা এই ছবি অনেকটা পরীক্ষামূলকই বটে। শান্তিনিকেতনে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দুটো স্টেশনারি ক্যামেরা সহযোগে মাত্র পাঁচদিনে শুট হয়েছিল ‘পূজারিণী’ কবিতার এই নাট্যরূপ।নরেশ মিত্রের পরিচালনায় নির্বাক ছবি ‘নৌকাডুবি’ (১৯৩৮) তৈরি হয় পরবর্তীতে।
তবে এ ছবিগুলির কোনওটিই আজ পাওয়া যাবে না। রক্ষা করা যায়নি কিছুই। পি কে নায়ার বলেছেন, ভারতীয় সিনেমার সেরা দশটি ছবি যা হারিয়ে গিয়েছে সেই তালিকায় রয়েছে ‘বলিদান’। ‘নটীর পূজা’-তো নিউ থিয়েটারর্সে আগুন লেগে রিল পুড়ে যায়, ২০১১ সালে তার কিছু অংশ উদ্ধার করে সংরক্ষণ করা গিয়েছে বটে। বাকি নির্বাক যুগের রবীন্দ্র ছবি রয়েছে কেবল খাতায়-কলমে।
তাই বলা চলে, কখনও তাঁর গান দিয়ে দৃশ্যপটে বদল এসেছে, কখনও আবার গোটা গল্পই তাঁর। কোথাও তিনি এসেছেন কবিতার মোড়কে, কোথাও আবার নাটকের সংলাপে। আজ তাই প্রাসঙ্গিকতা নয়, লকডাউনে বসে রবীন্দ্রভাবধারাস্নাত বাঙালি, সময়ের সঙ্গে কতটা নস্ট্যালজিয়ায় মেলে ধরলেন প্রিয় রবিকে সেটাই দেখার বিষয়।
বাঙালির মননে যিনি সার্ধশতবর্ষের বেশি পেরিয়ে গেলেও আজও একই তেজে দীপ্ত, তাঁকে আর যে ভাবেই হোক প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায় না। কারণ তিনি বহমান। আজও আমরা জাতে বাঙালি তালে রবি। সেই তালে তাই বছরের পর বছর ধরে সুর বেঁধে চলেছে একের পর এক সিনেমা। গল্প, স্ক্রিপ্ট, গান, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা ট্রানজিশন, ভরসা রবি ঠাকুরেই।
সময়ে বদল এসেছে, মানুষের চারিত্রিক আয়োজনে পরিবর্তন এসেছে, নির্বাক ছবির সময় থেকে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল হয়ে ঋতুপর্ণ-সৃজিত-শিবপ্রসাদে এসেও বড়পর্দায় কিন্তু আজও সেই নামটিই রয়ে গিয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, কাহিনী-গল্প-গান-নাটকে এখনও তিনিই অবলম্বন। অথচ খুব কম মানুষকে ভারতীয় সিনেমার ক্রমবিকাশে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় যোগ ও অবদান নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। সিনেম্যাটিক অভিযোজনে, বিশেষ করে চিত্রনাট্যে রবি ঠাকুরের লেখা চিরকালের কাছের।
এখন বলা যায়, কখনও তাঁর গান দিয়ে দৃশ্যপটে বদল এসেছে, কখনও আবার গোটা গল্পই তাঁর। কোথাও তিনি এসেছেন কবিতার মোড়কে, কোথাও আবার নাটকের সংলপে।
সবাক চলচ্চিত্রেও তার গল্প উপন্যাসে রবি ঠাকুর মহিমায় উজ্জ্বল ।
তাঁর সৃষ্টি করা গান, কবিতা, নাটক, গল্পে আজও মজে বাঙালি। এমনকি তাঁর লেখা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে একাধিক সিনেমা। দেখে নেব সেই সিনেমাগুলি।
কাবুলিওয়ালা (১৯৫৭)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পের ওপর ভিত্তি করে তপন সিনহা তৈরি করেন এই ছবি। কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস। কাবুলিওয়ালা ও মিনির সম্পর্কের রসায়ন খুব সুন্দরভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।
চারুলতা (১৯৬৪)
রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় এই ছবি বানান। অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাধবী মুখোপাধ্যায়। এক গৃহবধূর একাকিত্ব এবং সম্পর্কের জটিলতা নিয়েই এই ছবি।
ঘরে বাইরে (১৯৮৪)
রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় এই ছবি বানান। অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, জেনিফার কেন্ডাল। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী স্বাধীনতার অসাধারণ আখ্যান এই সিনেমা।
চোখের বালি (২০০৩)
রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষের এই সিনেমা দিয়েই ঐশ্বর্য রাইয়ের বাংলা সিনেমায় পদার্পণ। এই ছবিতে দেখতে পারবেন প্রেমের বিভিন্ন সংজ্ঞা। অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্যে। অভিনয় করেছেন ঐশ্বর্য সহ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, লিলি চক্রবর্তী ও টোটা রায়চৌধুরি।
চতুরঙ্গ (২০০৮)
রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায় এই ছবিটি বানান। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, কবীর সুমন, সুব্রত দত্ত, জয় সেনগুপ্ত প্রমুখ।
এলার চার অধ্যায় (২০১২)
রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের এই সিনেমা। গল্পের প্লট ১৯৪০ এর ব্রিটিশ ভারত। নিজের প্রেম ও দেশের প্রতি কর্তব্য – এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বে এলা জর্জরিত। অভিনয় করেছেন পাওলি দাম, বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, অরুনিমা ঘোষ, রুদ্রনীল ঘোষ।
নৌকাডুবি (২০১০)
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’-র গল্প নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ছবিটি বানান। এক নৌকাডুবিকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে এই ছবি। অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন, রিয়া সেন।
চিত্রাঙ্গদা (২০১২)
রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই ছবি তৈরি করেন। অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণ স্বয়ং, সাথে যীশু সেনগুপ্ত, দীপঙ্কর দে, অঞ্জন দত্ত, অনুসূয়া মজুমদার প্রমুখ। লিঙ্গ এবং যৌন সত্ত্বার অন্তর্দ্বন্দ্ব খুব নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।
তিন কন্যা (১৯৬১)
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সত্যজিৎ রায় এই সিনেমাটি তৈরি করেন। মূলত রবীন্দ্রনাথের তিনিটি ছোট গল্প নিয়ে তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই সিনেমা। গল্পগুলি হল পোস্টমাস্টার, মণিহারা এবং সমাপ্তি।
অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প গান কবিতা ও আজও সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। চিরকালের চিরকালের রবীন্দ্রনাথ বাঙালির হৃদয়ে
চিরজাগরুজ থাকবেন।প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার লেখা গান, কবিতা গল্প ও উপন্যাস বাঙালি সহ বিশ্ববাসীর হৃদয়ে নব নব ধারায় উদ্ভাসিত হবে।
মনোজিৎকুমার দাস, কথা সাহিত্যিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।