শুক্রবার | ৯ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৩৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বাঙালী রবীন্দ্রনাথ : সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন আমাদের ঠাকুর : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি জীবনী : সুব্রত কুমার দাস চল্লিশের রাজনৈতিক বাংলার বিস্মৃত কথাকার সাবিত্রী রায় (প্রথম পর্ব) : সুব্রত কুমার দাস শুক্লাম্বর দিঘী, বিশ্বাস করে দিঘীর কাছে কিছু চাইলে পাওয়া যায় : মুন দাশ মোহিনী একাদশীর ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত নিজের আংশিক বর্ণান্ধতা নিয়ে কবিগুরুর স্বীকারোক্তি : অসিত দাস ঝকঝকে ও মজবুত দাঁতের জন্য ভিটামিন : ডাঃ পিয়ালী চ্যাটার্জী (ব্যানার্জী) সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা : লুৎফর রহমান রিটন সংস্কৃতি জগতের এক নক্ষত্রের নাম বসন্ত চৌধুরী : রিঙ্কি সামন্ত আংশিক বর্ণান্ধতাজনিত হীনম্মন্যতাই রবীন্দ্রনাথের স্কুল ছাড়ার কারণ : অসিত দাস পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী : তপন মল্লিক চৌধুরী সাত্যকি হালদার-এর ছোটগল্প ‘ডেলিভারি বয়’ নব নব রূপে এস প্রাণে : মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য ভারতের সংবিধান লেখার সেই ঝর্না কলমটা… : দিলীপ মজুমদার গীতা রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, ভারতাত্মার মর্মকথা : সন্দীপন বিশ্বাস সিন্ধুসভ্যতা ও সুমেরীয় সভ্যতায় কস্তুরীর ভূমিকা : অসিত দাস রবি ঠাকুর ও তাঁর জ্যোতিদাদা : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী তরল সোনা খ্যাত আগর-আতর অগুরু : রিঙ্কি সামন্ত নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সাদা-কালো রীল’ গঙ্গার জন্য লড়াই, স্বার্থান্বেষীদের ক্রোধের শিকার সাধুরা : দিলীপ মজুমদার সিন্ধুসভ্যতার প্রধান মহার্ঘ রপ্তানিদ্রব্য কস্তুরী : অসিত দাস রাখাইন পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক করিডোর : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন রামকৃষ্ণ মিশন মানে ধর্মকর্ম নয়, কর্মই যাঁদের ধর্ম তাঁরাই যোগ্য : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে সিংহবাহিনী মন্দির, নবগ্রাম (ঘাটাল) : কমল ব্যানার্জী পরিবেশ মেলা ২০২৫ : ড. দীপাঞ্জন দে মন্দির-রাজনীতি মন্দির-অর্থনীতি : দিলীপ মজুমদার স্বাধীনতা-সংগ্রামী মোহনকালী বিশ্বাস স্মারকগ্রন্থ : ড. দীপাঞ্জন দে অক্ষয়তৃতীয়া, নাকি দিদিতৃতীয়া : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী ও শান্তিনিকেতন : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় / ৫৯ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ৯ মে, ২০২৫

প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বেকার শান্তিনিকেতন; ডাকঘর তারঘর নেই, সবই বোলপুরে। খবরের কাগজ দুই একটা আসে ডাকযোগে—আজকালকার মতো দৈনিক কাগজ ঘরে ঘরে বিলি হতো না। বাইরের জগৎ সম্বন্ধে খবরাখবর কমই রাখতাম। তবুও শুনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় বাসিন্দাদের উপর সেখানকার শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ ও বুয়ররা নানাভাবে জুলুম করছে—তার প্রতিবাদ করছেন নাটালের এক গুজরাটি ব্যারিস্টার—নাম তাঁর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ৷

আমাদের থেকে রবীন্দ্রনাথ দুনিয়ার খবর বেশী রাখতেন—বিদেশী পত্রিকা তিনি যথেষ্ট পড়তেন। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদ তিনি রাখতেন। ব্যারিস্টার গান্ধী সেখানে যে সত্যাগ্রহ বা প্যাসিভ রেজিসটেন্স বলে আন্দোলন উত্থাপন করেছেন তার কথা নিশ্চয়ই জেনেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কবি, ঋষির দৃষ্টিতে অনুভব করেছিলেন যে ভারতের ভাবী সংগ্রামের নেতৃত্ব করবেন এক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী; তাই ১৯০৯ সালে প্রায়শ্চিত্ত নামে যে নাটকটি লিখলেন তাতে ধনঞ্জয় বৈরাগীর এক অদ্ভুত চরিত্র সৃষ্টি করলেন—এই চরিত্র হলো যেন ভাবী গান্ধীজীর প্রতীক।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি অবিচারের কথা আমরা শুনি ও পরে জানলাম, ভারতীয়দের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য মহারাষ্ট্রীয় রাজনীতিক, ভারত সরকারের বিধান সভার সদস্য গোপালকৃষ্ণ গোখলে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ইংলণ্ড-আমেরিকা সফর করে এলেন; নোবেল পুরস্কার পেলেন (১৯১৩, নভেম্বর)। ভারতে ও ভারতের বাইরেও রবীন্দ্রনাথকে ও তাঁর বিদ্যালয়কে জানবার জন্য ঔৎসুক্য দেখা দিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিলাতে রেভারেও সি. এফ. এন্ড্রুজ নামে দিল্লী সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের পাদরী অধ্যাপকের পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথকে দেখে, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে, পত্র ব্যবহার করে এন্ড্রুজ বুঝলেন যে ভবিষ্যতে তাঁর জীবন বাঁধা পড়লো এই মহামানবের কাজের সঙ্গে।

এন্ড্রুজ তাঁর আত্মজীবনী “What I owe to Christ” গ্রন্থে লিখছেন “১৯১২ সালের একটি চমৎকার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। হ্যামষ্টেড হীথের কাছে রদেনস্টাইন তাঁর গৃহে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তখন লণ্ডনে।…..সেদিন কবিকে আমি প্রথম দেখলাম, তাঁর কাব্যসুধা পান করলাম, ভারতের অন্তর গভীরে যে মহান বিশ্বসংস্কৃতি নিহিত, সেই সংস্কৃতির সূক্ষ্ম নিবিড় মাধুর্য্যের পরিচয় আমি আমার স্তব্ধ অন্তরের মধ্যে অনুভব করলাম—গীতাঞ্জলির কাব্যমাধুরীর সহিত সেই আমার প্রথম পরিচয়।

“সেইদিন রাত্রে শয্যা গ্রহণের আগে একটি বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চয় করলাম। কবি যদি অনুমতি দেন, তাহলে তাঁর শান্তিনিকেতন আশ্রমে স্থান নেব। দিল্লীর বিদেশী মিশনে বসে এই ভারতবর্ষকে কিছুতেই আমি চিনতে পারব না। শান্তিনিকেতনের পটভূমিকায় এই বিচিত্র মহাদেশ নিবিড়ভাবে আমার কাছে ধরা দেবে……একটা কথা শুনে আমার আনন্দের শেষ হইল না যে উইলিয়ম পিয়ার্সনও এই একই বাসনা কবির কাছে নিবেদন করেছেন এবং কবি তাতে সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু আমার পক্ষে অবিলম্বে এমনি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার উপায় ছিল না। তখনো আমি মিশনের কর্ত্তব্য থেকে মুক্ত হইনি। কিন্তু মনে আশা রইল। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্কটময় দিনগুলির বেদনা এই আশার আনন্দে লাঘব হলো।” (“ঋণাঞ্জলি” অনুবাদ নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। পৃঃ ১০৮-১০৯)

এন্ড্রুজ দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন বলে দিল্লী থেকে এলেন; উইলিয়ম পিয়ার্সন দিল্লীতে রঘুবীর সিংহের গৃহশিক্ষক ছিলেন- তিনিও এলেন শান্তিনিকেতনে।

কলিকাতা নাগরিকদের পক্ষ থেকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সম্বর্ধনা হবার (২৩ নভেম্বর ১৯১৩) পর কবি কলিকাতায় যান; কিন্তু ফিরে আসলেন—এণ্ড্ৰজরা দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন গান্ধীজীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন দেখবার জন্য। শান্তিনিকেতন মন্দিরে উপাসনা করলেন রবীন্দ্রনাথ এই দুই বিদেশী ভারত দরদীর কল্যাণের জন্য। ছাত্রদের সভায় পিয়ার্সন বাংলায় বললেন “আমি এবং আমার বন্ধুর (এন্ড্রুজের পক্ষ হইতে একটি মাত্র কথা তোমাদিগকে বলিতেছি যে এই শান্তিনিকেতন আশ্রম হইতে যে শান্তি আমরা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেছি, তাহা দক্ষিণ আফ্রিকার কার্যে আমাদিগকে সাহায্য করিবে।” নির্যাতিত প্রবাসী ভারতীয়দের দুঃখে দুইটি ইংরেজের হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ এন্ড্রুজকে লিখলেন, — “You know, our best love was with you, while you were fighting our cause in Africa”. এই হলো গান্ধীজীর কর্মে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সংযোগ—যদিও তা অপ্রত্যক্ষ।

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯১০ সালে গঠিত হয়েছে; ব্রিটিশ বুয়র সকলেই জোট পাকিয়েছিল—ভারতীয়দিগকে দেশ থেকে দূর করবার জন্য; প্রায় ৭০/৮০ বৎসর ধরে ভারতীয়রা পুরুষানুক্রমে বাস করে দক্ষিণ আফ্রিকার যথেষ্ঠ উন্নতি করেছে; এখন দেশটা বাসের যোগ্য হয়েছে, ভারতীয়রা এখন ফালতু। তাই নানা রকমের আইন করে, তাদের অপমান করে, উত্ত্যক্ত করে, দেশ থেকে তাড়াবার ষড়যন্ত্র করছে। গান্ধীজীর প্রতিবাদ সত্যাগ্রহ রূপ নিয়েছিল।

যাই হোক জেনারেল স্মাটস নূতন গবর্মেন্টের অন্যতম মন্ত্রী হয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে একটা মিটমাট করলেন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন বন্ধ হলো।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত দুই দেশই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত; তাই তিনি ইংলণ্ডে চললেন কলোনিয়াল সেক্রেটারী বা উপনিবেশ সচিবের সঙ্গে মোলাকাৎ করে একটা বোঝাপড়া করবেন ও তারপর ভারতে ফিরবেন। কিন্তু মুস্কিল হলো তাঁর ফিনিক্স বিদ্যালয় নিয়ে— সেটাও তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয়। ব্যবস্থা করলেন এন্ড্রুজ। তিনি ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁর ব্যবস্থায় ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ শান্তিনিকেতনে আশ্রয় পেলো।

রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীকে লিখলেন, — “That you could think of my school as the right and the likely place where your Phoenix boys could take shelter when they are in India, has given me real pleasure and that pleasure has greatly enhanced when I saw those dear boys in that place I write this letter to thank you for allowing your boys to become our boys as well and thus form a living link in the Sadhana in both of our lives.”

রবীন্দ্রনাথের গান্ধীকে এই প্রথম পত্র (১৯১৫); আর শেষ পত্র লেখেন ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। এই ২৫ বৎসর উভয়ের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করে চলেছিলেন এন্ড্রুজ।

১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে এন্ড্রুজের মৃত্যু হলো। গান্ধীজী কলকাতায় এন্ড্রুজকে নার্সিং হোমে শেষ দেখা দেখে গেলেন। রবীন্দ্রনাথেরও সঙ্গে সেই শেষ সাক্ষাৎ করে গেলেন।

এন্ড্রুজ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, “মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় (১৯১৩)….. গান্ধীজীর সংস্পর্শে এসে আমি ভয়কে জয় করতে শিখেছি। অগ্নি স্ফুলিঙ্গের স্পর্শে এসে আমি ভয়কে জয় করতে শিখেছি। যা কিছু নিষুপ্ত শুভবোধ তাঁর চরিত্রস্পর্শে তেমনি জাগ্রত হয়েছে, উজ্জীবিত হয়েছে আমার প্রেরণা।”

ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসেছে শান্তিনিকেতনে। তাঁদের সঙ্গে আছেন মগনলাল, রাজঙ্গম, কোটাল প্রভৃতি। দত্তাত্রেয় বা কাকা কালেলকর এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এই ছাত্র-শিক্ষকরা আশ্রমের সামনে একটা নূতন আদর্শ ধরলো।

গান্ধীজী ইংলণ্ড থেকে ভারতে এসে জানতে পারলেন যে তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্ররা, তাঁর পুত্র দেবদাস প্রভৃতি সকলেই শান্তিনিকেতনে আছে। গান্ধীজী কস্তুরাবাঈকে সঙ্গে করে বোলপুর এলেন (ফেব্রুয়ারী ১৯১৫)। রবীন্দ্রনাথ তখন আশ্রমে ছিলেন না তথাচ গান্ধীজী বলেছেন— “The teachers and students overwhelmed me with affection, the reception was a beautiful combination of simplicity, art and love!”

সত্যই গান্ধীজী আসছেন বলে আশ্রমবাসীরা দিনরাত্রি খেটে নূতন রাস্তা নির্মাণ করেছিল।

কিন্তু এ যাত্রায় গান্ধীজীর পক্ষে আশ্রমে দীর্ঘকাল থাকা সম্ভব হলো না। টেলিগ্রাম পেলেন ১৯ ফেব্রুয়ারী পুনায় গোখলের মৃত্যু হয়েছে। গান্ধীজী গোখলেকে গুরুর ন্যায় শ্রদ্ধা করতেন। তিন বৎসর পূর্বে গোখলে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ ও ভারতীয়দের নিগ্রহ দেখতে গিয়েছিলেন। গান্ধীজী বিলাত হইতে ফিরবার পথে বোম্বাইতে নেমে পুনায় গিয়েছিলেন পীড়িত গোখলেকে দেখবার জন্য। এখন, তাঁর মৃত্যুর সংবাদ টেলিগ্রামে পেয়ে খুবই ব্যথিত চিত্তে গান্ধীজী আশ্রম থেকে পুনা গেলেন।

৬ই মার্চ গান্ধীজী শান্তিনিকেতনে এলেন; তখন রবীন্দ্রনাথ আছেন শ্রীনিকেতন কুঠিবাড়িতে, ফাল্গুনী নাটক লিখছেন, সমস্ত মনটা গানের সুরে ডুবে আছে।

গান্ধীজী আশ্রম পরিদর্শন করে খুসী হতে পারলেন না। তিনি কঠোর জীবন যাপনে অভ্যস্ত, তাঁর ফিনিক্স বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাও সেই কঠোরতায় অভ্যস্ত। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন —

“আমার স্বভাব অনুযায়ী আমি বিদ্যার্থী ও শিক্ষকদিগের সহিত মিলিয়া গিয়াছিলাম। আমি তাঁহাদের সহিত আত্মনির্ভরতা সম্বন্ধে আলোচনা করিতে আরম্ভ করিলাম। বেতনভোগী পাচকের পরিবর্ত্তে যদি বিদ্যার্থী ও শিক্ষকরা নিজেরাই রান্না করেন তবে ভাল হয়। উহাতে পাকশালার স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিষয় শিক্ষকদের হাতে আসে, বিদ্যার্থীরা স্বাবলম্বী হয় এবং নিজে হাতে পাক করিবার ব্যবহারিক শিক্ষাও লাভ করে। এই সকল কথা আমি শিক্ষকদিগকে জানাইলাম। দুই একজন শিক্ষক মাথা নাড়িলেন। কাহারও কাহারও এই পরীক্ষা ভাল মনে হইল। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানাইলে তিনি বলিলেন, শিক্ষকেরা যদি অনুকূল হন, তবে এ পরীক্ষা তাঁহার নিজের খুব ভাল লাগিবে। তিনি বিদ্যার্থীদিগকে বলিলেন, “ইহাতেই স্বরাজের চাবি রহিয়াছে।”

তখন আশ্রমের পাকশালায় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর পংক্তি পৃথক ভোজন করতো। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে এ বিষয়ে কথা ওঠে; গান্ধীজী এই পংক্তিভেদের বিরোধী। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথও জাতিভেদ বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু বললেন, তিনি কোনোদিন ছাত্র ও শিক্ষকদের ধর্মমত বিষয়ে জুলুম করেননি; কবির মতে জোর করলে আপাতদৃষ্টিতে তারা নিয়ম পালন করবে, কিন্তু তা স্থায়ী ফলপ্রদ হবে না। গান্ধীজীর মতে এটা নিষ্ক্রিয়তার লক্ষণ; তাই কিছুকাল পরে তিনি সাবরমতীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ‘জাতপাত’ মেনে চলেননি; তার জন্য তিনি তাঁর নিকটের অনেক লোককে দুঃখ দিয়েছিলেন। গান্ধীজী দুঃখ পেতে বা দুঃখ দিতে দ্বিধা করতেন না। তাঁর সংগ্রামে কত সহস্র নরনারী দুঃখকে বরণ করে নিয়েছিল। তিনি নিজের দেহকে দুঃখ দিয়েছেন অনশনের দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং দুঃখ পেতেন, কিন্তু তার জন্য অন্যকে দুঃখ দিতে পারতেন না। কর্মী ও কবির মধ্যে এইখানে মস্ত একটা ভেদ।

রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন পেয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা আশ্রমের যাবতীয় কাজে লেগে গেলেন (১০ মার্চ, ১৯১৫)। এই উৎসাহ মাস দেড়েক ছিল। গ্রীষ্মের ছুটীর সঙ্গে এর অবসান হয়। এখনো প্রতি বৎসর এইদিন গান্ধী দিবস বলে আশ্রমে উদ্যাপিত হয়। ভৃত্য, পাচক, মেথর, মালি সবাই ছুটি পায়—আশ্রমবাসীরা সব কাজ করেন। আশ্রমে স্বাবলম্বননীতি প্রবর্তনের পরদিন (১১ মার্চ, ১৯১৫) গান্ধীজী রেঙ্গুন চলে গেলেন; তারপর দিন কুড়ি পরে ফিরে গিয়ে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে গেলেন। ফিনিক্স বিদ্যার্থীদের সঙ্গে আশ্রমের যোগ ছিল মাস চার। তাদের সেখানে থাকা ব্যর্থ হয়নি—অনেক বিষয়ের প্রতি আশ্রমবাসীদের দৃষ্টি গেল।

দুই বৎসর পরে (১৯১৭) কলিকাতায় ‘বিচিত্রা’ হলে ডাকঘর অভিনয়ে গান্ধীজী অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন; কবির সঙ্গে বিশেষ আলোচনার অবসর ও প্রয়োজন তখন হয়নি।

১৯২০-২১ সালে রবীন্দ্রনাথ য়ুরোমেরিকা সফরে আছেন — গান্ধীজী প্রবর্তিত অসহযোগ আন্দোলন এলো রৌলট বিলের প্রতিবাদে ও খিলাফত আন্দোলনের সমর্থনে।

রবীন্দ্রনাথ জাতীয় আন্দোলনের সাথে সাম্প্রদায়িক খিলাফত আন্দোলনকে জুড়ে দেবার বিরোধী ছিলেন; এন্ড্রুজও। রবীন্দ্রনাথ যে পত্রধারা সে সময়ে লেখেন, তা মডার্ন রিভিউ মাসিকে প্রকাশিত হয়—তা এক হিসাবে গান্ধীজীর অসহযোগনীতির অসমর্থন।

কবি যখন পশ্চিমে সফরে আছেন। সেই সময় গান্ধীজী বাংলা দেশে আসেন। শান্তিনিকেতনে বিশ্রামের জন্য তিনি এলেন। এন্ড্রুজের ব্যবস্থায় এসব হলো। খিলাফত আন্দোলনের অন্যতম নেতা সৌকত আলি এলেন গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করতে। প্রসঙ্গত বলে রাখি বহু বৎসর পরে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে যখন গান্ধীজীর বিরোধ বেধেছে, তখন এই শান্তিনিকেতনে কবির কাছে আসেন সুভাষ ও জহরলাল। কবি দেশে ফেরবার পর (৬ সেপ্টেম্বর ১৯২১) কলিকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গান্ধীজী আসেন কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে; সেখানে এন্ড্রুজ ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তার বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে তাঁদের মতের মধ্যে মিলনের বাধা ছিল। গান্ধীজী দেশের আশু মুক্তির জন্য ব্যগ্র, রবীন্দ্রনাথ মানুষের মুক্তির জন্য ব্যাকুল। একজন ভাবছেন স্বাধীনতা পেলেই সব পাওয়া যাবে, অপরজন মনে করছেন মানুষের মন জাগলে সত্যকার স্বাধীনতা মিলবে—রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির ক্ষেত্রে। এন্ড্রুজ এই দুই মহাপুরুষ সম্বন্ধে যে বিশ্লেষণ করেছিলেন, তা ‘Mahatma Gandhi’s Ideas’ গ্রন্থের পাঠকদের নিকট সুপরিচিত জ্ঞানে উদ্ধৃত হলো না।

অসহযোগ আন্দোলন নিরুপদ্রব অহিংস থাকলো না; অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেল। গবর্ণমেণ্ট গান্ধীজীকে এসবের জন্য দায়ী ঠিক করে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন।

এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম ভারত সফরে বের হয়েছেন বিশ্বভারতীর জন্য। আহমদাবাদে এসেছেন। সেখান থেকে সাবরমতী আশ্রমে গেলেন। দুই বৎসর পূর্বে (১৯২০ সালে) গান্ধীজী যখন তাঁর আশ্রমে ছিলেন, তখন কবি সেখানে গিয়া একরাত্রি বাস করে আসেন। সেবার গান্ধীজীর আমন্ত্রণে গুজরাট সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে আসেন।

১৯২৫ সাল। কনগ্রেস স্বরাজ্যদলের হাতে পড়েছে। গান্ধীজী চরকা-খদ্দর আন্দোলন করছেন। রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ আমেরিকা সফর থেকে ফিরেছেন। গান্ধীজী কলকাতায় এসেছেন, ভাবলেন রবীন্দ্রনাথকে চরকা-খদ্দর আন্দোলনের মধ্যে টানতে পারবেন। তাই এলেন শান্তিনিকেতনে (২৯ মে, ১৯২৫)। দুই দিন আলোচনা হলো। বলা বাহুল্য কেউ কাউকে নিজের মতে আনতে পারলেন না। গান্ধীজীর সঙ্গে এসেছিলেন মহাদেব দেশাই, পিয়ারীলাল, সস্ত্রীক সতীশচন্দ্ৰ দাশগুপ্ত প্রভৃতি।

১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ পাশ্চাত্য সফর করে ফিরে আসেন। লণ্ডনে তখন গোল টেবিল বৈঠক প্রথম দফায় বসেছে; গান্ধীজী তাতে যোগদান করেন নি। রবীন্দ্রনাথ তখন লিখেছিলেন যে গান্ধীজী লণ্ডনে উপস্থিত হলে ভালো করতেন—কোনো আশা না করে যাওয়াই উচিত ছিল।

তারপর দ্বিতীয় বৈঠকে গান্ধীজী গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত একা ভারতের প্রতিনিধি হয়ে। সেই সময়ে গান্ধীজীর জন্মদিন প্রথম উদ্যাপিত হলো (২রা অক্টোবর, ১৯৩১)। কবি বলেন “কেবলমাত্র রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধির মূল্য আরোপ করে তাঁকে আমরা উপলব্ধি করিব। প্রচণ্ড এই শক্তি, সমস্ত দেশের বুক জোড়া জড়ত্বের জগদ্দল পাথরকে আজ নাড়িয়ে দিয়েছে। ….দেশ ভয়ে আচ্ছন্ন, সংকোচে অভিভূত ছিল। ….আমাদের আত্মকৃত পরাভব থেকে মুক্তি দিলেন মহাত্মাজী। এখন শাসনকর্তারা উদ্যত হয়েছেন আমাদের সঙ্গে রফা নিষ্পত্তি করতে। কেননা তাদের পরশাসনতন্ত্রের গভীরতর ভিত্তি টলছে, যে ভিত্তি আমাদের বীর্যহীনতায়। আমরা অনায়াসে আজ জগৎসমাজে আমাদের স্থান দাবি করছি।”

দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক থেকে ফেরবার আটদিনের মধ্যে লর্ড উইলিংডন গান্ধীজীকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন; তখন রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দেন, সেটি এখনো স্মরণীয়।

তারপর এলো ম্যাকডোনল্ডের নয়া সংবিধানের খসড়া; ইতিপূর্বে মুসলমানদের তো পৃথক সত্তা সাব্যস্ত হয়ে আছে, এবার হিন্দুসমাজের মধ্যে অন্ত্যজদের ও বর্ণহিন্দুদের পৃথক করে দেবার চেষ্টা হয়েছে। গান্ধীজী পুনা যেরবেদা জেলে আটক। তিনি ঘোষণা করলেন যদি এই আইন পাশ হয় তবে তিনি অনশনে প্রাণত্যাগ করবেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে। তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন; পত্র, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারলেন না; দেশের কনগ্রেসী সমস্ত নেতাই তখন কারাগারে। রবীন্দ্রনাথ পুনায় চলে গেলেন। পুনা প্যাক্ট হলো। গান্ধীজী অনশন ত্যাগ করলেন—রবীন্দ্রনাথ গান করলেন—

“জীবন যখন শুখায়ে যায় করুণাধারায় এসো।”

পুনা প্যাক্ট হওয়ায় বাঙালিরা গান্ধীজীর উপর খুব বিরক্ত হয়। তিনি যখন কলকাতায় আসছেন, তখন তারা তাঁকে বর্জন করবে বলে শাসায়। রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীকে শান্ত হবার জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করে বললেন, “আমি তাকে অভিনন্দন করছি।”

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর চিরদারিদ্র্য মোচন করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ১৯৩৬ সালের গোড়ার দিকে উত্তর ভারতে সফরে বের হয়েছেন। শরীর জীর্ণ—তবুও বের হতে হচ্ছে অর্থের জন্য। বিশ্বভারতীর দায় তাঁর একারই। বহু নগর ঘুরে দিল্লীতে উপস্থিত হলেন। গান্ধীজী তখন সেখানে। সেদিন সন্ধ্যায় গান্ধীজী ও কস্তুরাবাঈ কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন; বললেন, কবির যা বয়স ও স্বাস্থ্য, তাতে তাঁর পক্ষে এভাবে ঘুরে বেড়ানো উচিত নয়। তাঁরা শুনলেন বিশ্বভারতীর ঘাটতির কথা। তার পর দিন বিড়লাদের কাছ থেকে ষাট হাজার টাকার একখানি চেক নিয়ে কবির হাতে এনে দিলেন।

কবির শরীর দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে; তাই গান্ধীজী ও কস্তুরাবাঈ কবিকে দেখতে এলেন শান্তিনিকেতনে (১৯৪০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী)। গান্ধীজীর সহিত কবির কয়েক বার দেখা হলো কিন্তু তাঁদের আলোচনা “Too sacred and personal in character for recapitulation.”

গান্ধীজী ফিরে গিয়ে বলেন “The visit to Santiniketan was pilgrimage to me.”

কিছুকাল পূর্বে এক জাপানী বাংলা দেশে আসেন; গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন “কি দেখেছ বাংলা দেশের?” তিনি বলেন যে হামিলটন সাহেবের গোসালা দেখেছেন। গান্ধীজী তাঁকে বলেন “Gosala is Gosala. But Santiniketan is India.”

গান্ধীজী শান্তিনিকেতন ছাড়ার পূর্বে কবি তাঁর হাতে একখানি পত্র দিয়েছিলেন। সেই পত্রে কবি লেখেন যে তাঁর অবর্তমানে তাঁর বিশ্বভারতীর ভার তিনি গান্ধীজীর হাতে দিয়ে যাচ্ছেন। কবি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতে বৃটিশ শক্তির অবসান হবেই এবং একদিন কনগ্রেস ভারতের শাসনভার গ্রহণ করবে। তাই গান্ধীজীকে বিশ্বভারতী সম্বন্ধে তাঁর শেষ অনুরোধ জানিয়ে দেন।

কবির মৃত্যুর (১৯৪১, ৭ই আগস্ট) ছয় বৎসর পরে ভারত স্বাধীন হলো। তারপর ভারত সংবিধান তৈরী হয়ে যখন পুরোপুরিভাবে সর্ববিধ কাজ কর্ম করবার আইন প্রণয়নের অধিকার লাভ হলো; রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন, তার অল্পকালের মধ্যে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্য্যাদা লাভ করলো (১৯৫১)।

ভারত সরকার যখন এ ভার নিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজী কেহই আর ইহধামে নেই ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন