কণিকা এক সময় বলেছিলেন, ‘ততদিনে রবীন্দ্রনাথে সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন কত সহজ। আজ জানি, তখনই তিনি অন্যদের কাছে কত ‘মহান’, কত ‘বিরাট’, কত ‘বিশাল’, কিন্তু তখন তিনি আমার অতি আপনজন। আমার আবদার করার, আমার নালিশ জানাবার, আমার অভিমান করবার, আমার সমাধান খুঁজে দেবার মানুষ তিনি।’
১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তার ‘অণিমা’ নামটি পরিবর্তন করে ‘কণিকা’ রাখেন। অবশ্য ডাকনাম হিসাবে তিনি ব্যবহার করতেন ‘মোহর’। পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এই ‘মোহর’ নামটি বিস্তারিত করে বলেছিলেন ‘আকবরী মোহর’। ১৯৩৫ সালেই শিশুশিল্পী হিসাবে প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন কণিকা। শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে একটি অনুষ্ঠানে বালক-বালিকাদের দলে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সেই প্রথম ও শেষ মঞ্চাবতরণ; কারণ সেই অনুষ্ঠানটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ মঞ্চাভিনয়। ২৪ জুলাই ১৯৪০ বোলপুর টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ওগো তুমি পঞ্চদশী গানটি গেয়েছিলেন। গানটি তিনি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছেই শেখেন। এই অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারিত হয়। এটিই কণিকার প্রথম বেতার অনুষ্ঠান। এরপর ১৯৩৭ সালে প্রথম কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে আয়োজিত বর্ষামঙ্গল উৎসবে কণিকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গানটি গেয়েছিলেন। কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরূপে সেটিই ছিল তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। এই সময়ে অনেকগুলি গান রবীন্দ্রনাথ তাকে স্বয়ং শিখিয়েছিলেন। কণিকা অভিনয় করেছিলেন তাসের দেশ নাটকের দহলানী, ডাকঘর নাটকের সুধা, বিসর্জন নাটকের অপর্ণা ও বশীকরণ নাটকের নিরুপমা চরিত্রে।
১৯২৪ সালে ১২ই অক্টোবর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মায়ের নাম মা অনিলা দেবী। পাঁচ বোন এবং তিন ভাইয়ের ভিতরে তিনি ছিলেন বড়। অন্য তিন বোনের নাম ছিল— সুরেখা, সুহিতা, ঝর্না ও বীথিকা। ভাইদের নাম শান্তময়, সুমন ও পান্নালাল।
কণিকার বাবা ছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারের কর্মী ও মা অনিলা দেবী ছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজননী। তাঁর শৈশবের শুরুতে বিষ্ণুপুরের মামাবাড়ির যৌথ পরিবারে ছিলেন। পরে খুব অল্পবয়সে পিতার কর্মস্থল শান্তিনিকেতনে চলে আসেন এবং ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পৈতৃক নাম ছিল অণিমা মুখোপাধ্যায়। পারাবারিক ডাক নাম ছিল মোহর। রবীন্দ্রনাথ এই নাম পরিবর্তন করে নাম দেন কণিকা। এই নামে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অবশ্য তাঁর কাছের লোকেরা তাঁকে ডাকতেন মোহর নামে। বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহের পর নাম হয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সহজাত প্রতিভায় তিনি শৈশবে গান শিখেছলেন শুনে শুনে। শান্তিনিকেতনে আসার পর, গান শেখেন। এই সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রায়ই নতুন গান শিখতে যেতেন। একারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত নতুন গান শেখানোর জন্য ডাকতেনও।
১৯৩৫ সালে শিশুশিল্পী হিসাবে শান্তিনিকেতনের শারদোৎসবে প্রথম মঞ্চে গান করেন।
১৯৪০ সালে ২৪শে জুলাই বোলপুর টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গান করেন ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’। উল্লেখ্য এই অনুষ্ঠানটি বেতারে সম্প্রচারিত হয়। এই বিচারে ছায়া সিনেমা হলে আয়োজিত বর্ষামঙ্গল উৎসবে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। এই বৎসরে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি তাঁর গাওয়া দুটি গানের রেকর্ড করে। রেকর্ড নম্বর ছিল H 584। এই গান দুটির গীতিকার ছিলেন নীহারবিন্দু সেন। সুরকার ছিলেন হরিপদ চট্টোপাধ্যায়। এই গান দুটির শিরোনাম ছিল—
ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার/গান নিয়ে মোর খেলা
উল্লেখ্য তাঁর এই গানের রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮ ফেব্রুয়ারিতে। এই বছরের আগষ্ট মাসে ‘ফুলপরী’ কলকাতার গীতিনাট্যের রেকর্ডে তিনি কণ্ঠ দেন। রেকর্ড নম্বর ছিল H 638। এই সময় শিল্পী হিসেবে তাঁর নাম ছিল ‘কুমারী কণিকা’। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর আনন্দধারা গ্রন্থ থেকে জানা যায় — আধুনিক গান গাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেয়েছিলেন। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর ছিল H 648। এই গান দুটি হলো —
ডাকব না, ডাকব না, মনে কী দ্বিধা রেখে গেল
১৯৩৯-এ হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্বিতীয় রেকর্ড। রেকর্ড নম্বর ছিল H 1021। এই রেকর্ডটিতে তিনি দুটি গানে কণ্ঠ দেন। গান দুটি ছিল— ওই মালতি লতা দোলে, ঘরেতে ভ্রমর এলো
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশ মতো ‘সমুখে শান্তিপারাবার গানটি দলগতভাবে পরিবেশন করা হয়। এই দলে কণিকা ছিলেন।
১৯৪২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর শেষ রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর H 1021। এই রেকর্ডটিতে তিনি দুটি গানে কণ্ঠ দেন। গান দুটি ছিল — ওগো তুমি পঞ্চদশী, এসো শ্যামলসুন্দর
১৯৪২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত একক এবং সহশিল্পীদের সাথে তাঁর রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল ২৮টি। এই রেকর্ডগুলোর পৃথক কোনো শিরোনাম ছিল না।
১৯৪২ (১৬ বৈশাখ) বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
১৯৪৩-এ ৪০ টাকা বেতনে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৬২-এ প্রথম ‘জেমস ফ্রম টেগোর’ শিরোনামে রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ড নম্বর EALP 1267। এরপর ১৯৮৯ পর্যন্ত তাঁর ৫৯টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮০ এ এইচএমভি তাঁর গানের ক্যাসেট প্রকাশ করে। এই কোম্পানি থেকে তাঁর প্রায় ৪০টি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর গাওয়া অনেকগুলো গানগুলো সিডি প্রকাশিত হয়।
একক এবং দ্বৈতকণ্ঠের রেকর্ডের পাশাপাশি তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন ‘শ্যামা’, ‘মায়ারখেলা’, ‘তাসের দেশ’, চিত্রাঙ্গদা, ‘কালমৃগয়া’ নৃত্যানাট্য ও গীতিনাট্যে। গীতি-আলেখ্য হিসেবে প্রকাশিত শাপমোচনেও তাঁর গান রয়েছে। এছাড়া তিনি গেয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, অতুলপ্রসাদের গান, নজরুলসঙ্গীত।
১৯৫০-এ তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন। এই চলচ্চিত্রগুলো হলো তথাপি (১৯৫০), নিমন্ত্রণ (১৯৭২) এবং বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা (১৯৭২), আহবান ।
তিনি নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারগুলো হল।
১৯৭৮ : গোল্ডেন ডিস্ক ই এম আই গ্রুপ থেকে।
১৯৭৯ : সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার পান।
১৯৮৬ : পদ্মশ্রী পদক।
১৯৯৩ : ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ ছবিতে গাওয়া ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটির জন্য তিনি বিএফজে-এর শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কার পান।
১৯৯৬ : এশিয়ান পেন্টস শিরোমণি পুরস্কার।
১৯৯৭ : বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৯৮: পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র তাঁকে সম্মান জানান।
১৯৯৯ : আলাউদ্দিন পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়া মৃত্যুর পরে কলকাতার বিখ্যাত সিটিজেন্স পার্কটিকে তাঁর নামে উৎসর্গিত করা হয়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল লাগোয়া এই সুরম্য বিশাল উদ্যানটির বর্তমান নাম মোহরকুঞ্জ।
তার রচিত গ্রন্থাবলি
রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে স্বামী বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রচিত গ্রন্থ :রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভূমিকা [এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত), রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানা দিক (মিত্রালয় প্রকাশিত)]
রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাব্য ও সুর [শঙ্খ প্রকাশনী ও বর্তমানে করুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত]।
আত্মকথা: আনন্দধারা [আজকাল পত্রিকার প্রকাশন বিভাগ থেকে প্রকাশিত।
২০০০-এর ৫ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠের গায়কীরীতি রপ্ত করা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে আজও বরণীয় স্মরণীয়া।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা