বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে থেকে। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট যাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে ভূযিত করেছেন, সেই আহমদ রফিক এই উদ্যোগের প্রাণপুরুষ। কিভাবে রবীন্দ্রচর্চার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে তোলা যায়, তার প্রাথমিক আলোচনাসভায় আহমদ রফিকের সঙ্গে ছিলেন লেখক মঞ্জু সরকার, সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক শফী আহমদ, সাংবাদিক ফরহাদ মাহমুদ। এই আলোচনাসভায় ‘রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
ট্রাস্ট দলিল নিবন্ধিত হয় ১৯৮৯ সালের ১৬ মার্চ। এই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা হলেন : সভাপতি ; আহমদ রফিক, কোষাধ্যক্ষ : নুরুল ইসলাম, সদস্য : রইসউদ্দিন ভুঁইয়া, ওবায়দুল করিম, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রমকে বাস্তবায়িত করার জন্য গঠন করা হয় এক পরিচালনা পরিষদ, যার সভাপতি আবুল হোসেন। পরিচালনা পরিষদে বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টিত হয় বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে। এছাড়া গঠন করা হয় সেমিনার, প্রকাশনা, সংগীতানুষ্ঠান, গ্রন্থাগার বিষয়ে উপকমিটি। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের কার্যালয়ের ঠিকানা ছিল ৩৪ বিজয়নগর (পরে ১১৭ শান্তিনগর)।
এই সংগঠনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয় “আমাদের রবীন্দ্রচর্চার উদ্দেশ্য বলা বাহুল্য রবীন্দ্রপূজা নয়, নয় রবীন্দ্র রচনার মাধ্যমে শুধুমাত্র বিনোদন বা আনন্দলাভ।…
“রবীন্দ্র রচনা ও রবীন্দ্রচিন্তাধারার বিশেষ বিশেষ দিক সম্পর্কে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনাসভার আয়োজন এবং প্রয়োজনে পাঠচক্র পরিচালনা, রবীন্দ্ররচনা বিষয়ক গবেষণাকর্মে উৎসাহ ও সাহায্য দান, ক্ষেত্রবিশেষে গবেষণাকর্ম পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, রবীন্দ্র রচনাদির বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ …
“রবীন্দ্ররচনার নির্বাচিত অংশের সারাৎসার ছোট ছোট নিবন্ধাকারে প্রকাশ এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ…
“রবীন্দ্ররচনা ও রবীন্দ্রচিন্তাধারার উপর বক্তৃতামালার আয়োজন এবং রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্ররচনা সম্পর্কে নতুন উপাদান সংগ্রহের চেষ্টা …
“একটি রবীন্দ্রগ্রন্থাগার-পাঠাগার স্থাপন এবং রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা সম্পর্কে উদ্যোগ গ্রহণ…
“ঢাকায় একটি রবীন্দ্র ভবন নির্মাণের উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ। “
রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ‘রবীন্দ্র সাহিত্য শিক্ষাকোর্স’ চালু করেছিলেন। কোর্সের সময়সীমা ৬ মাস। ক্লাশ হত সপ্তাহে ২ দিন, ২ ঘন্টা করে। পাঠ্যসূচিতে ছিল : কবিতা বিভাগে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, অহল্যার প্রতি, বসুন্ধরা, সমুদ্রের প্রতি, নিরুদ্দেশযাত্রা, এবার ফিরাও মোরে, স্বর্গ হইতে বিদায়, ভারততীর্থ, বলাকা, ঝড়ের খেয়া, কর্তার ভূত, সবলা, বৃক্ষবন্দনা, প্রশ্ন, কোপাই, শিশুতীর্থ, পৃথিবী, ঐকতান, প্রথমদিনের সূর্য, তোমার সৃষ্টির পথ।। উপন্যাস–শেষের কবিতা। নাটক—ফাল্গুনী। ছোটগল্প—একরাত্রি, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, অতিথি, বলাই, দুরাশা, স্ত্রীর পত্র, পয়লা নম্বর, রবিবার, ল্যাবরেটরি।। পত্রসাহিত্য —ছিন্নপত্রের ২৭,৩৫, ৩৮, ৬৪,৭১,৮৮, ১১৯, ১২১, ১৫৩ সংখ্যক পত্র।। প্রবন্ধ–সাহিত্যের প্রাণ, মানব প্রকাশ, সৌন্দর্য ও সাহিত্য, বাস্তব, সাহিত্যধর্ম, তপোবন, সমগ্র, বিশ্ববোধ, মা মা হিংসী, সভ্যতার সংকট। শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত ছিলেন ড. সরদার আবদুস সাত্তার, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী, ড. মাসদুজ্জামান, জুবাইদা গুলশান আরা, হায়াৎ মামুদ, রফিকুল্লাহ খান, বিশ্বজিৎ ঘোষ, ভীষ্মদেব চৌধুরী।
রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র একটি ত্রৈমাসিক মুখপত্র প্রকাশ করেন, যার নাম ‘রবীন্দ্রচর্চা’। পরিকল্পনা ও সম্পাদনায় ছিলেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৯৬ সনের কার্তিক মাসে। এই পত্রিকায় দেশ-বিদেশের রবীন্দ্রচর্চার নানা তথ্য থাকত। আর্থিক সংকটের ফলে পরবর্তীকালে পত্রিকাটি ত্রৈমাসিক থেকে ষান্মাসিকে পরিবর্তিত হয়।
ঢাকার রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ও কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মধ্যে একটা সেতু তৈরি হয় এবং ঠিক হয় দুই প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে কলকাতা ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন। ১৯৯৩ সালের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল কলকাতায় এ রকম সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজরুল ইসলাম, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী, শাহিদা রহমান ও আহমদ রফিক। ১৯৯৪ সালের ৮ ও ৯ এপ্রিল ঢাকার জাতীয় যাদুঘর শিশু মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন। কলকাতায় এ সম্মেলন হয় ১৯৯৫, ১৯৯৭ ও ঢাকায় সম্মেলন হয় ১৯৯৬, ১৯৯৮ সালে।
ঢাকার রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। ঢাকায় জার্মান কালচারাল সেন্টারে, গ্যায়টে ইন্সটিটিুটে, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে, এ রকম সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।
রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেটি হল পতিসর উদ্ধার প্রচেষ্টা। রবীন্দ্রনাথের রচনায় শাহজাদপুর, শিলাইদহের মতো কালিগ্রাম পরগণার পতিসর এসেছে বারবার। অথচ পতিসরের রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য কুঠিবাড়িটি পড়েছিল অবহেলিত হয়ে। ১৯৯০ সাল থেকে আহমদ রফিক তাঁর নানা লেখায় (‘অবহেলিত পতিসর’, ‘ডেটলাইন পতিসর’, ‘রবীন্দ্রনাথের পতিসর’ ইত্যাদি) সে বিষয় সম্পর্কে মানুষ ও সরকারকে অবহিত করতে থাকেন। তাঁর দাবি ছিল : পুরাতত্ত্ব বিভাগকে এই কুঠিবাড়ি অধিগ্রহণ করতে হবে, যোগাযোগ ব্যস্থার উন্নতি ঘটিয়ে একে পর্যটনকেন্দ্র করে তুলতে হয়ে। সরকার তাঁদের দাবি মেনে নেন। কুঠিবাড়ি ও সংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করেন পুরাতত্ত্ব বিভাগ। কুঠিবাড়িতে পরিত্যক্ত কাগজের স্তূপে রবীন্দ্রনাথের’এস্টেট’ পরিচালনা সংক্রান্ত কোন কাগজ-পত্রের সন্ধান করতে গিয়ে কি অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, সে সম্পর্কে আহমদ রফিক লিখেছেন, “কিছুই মেলে নি। বরং যা জানা যায় তা ভয়াবহ। পাকিস্তান আমলে জমিদারি ব্যবস্থা উঠে যাবার পরে কুঠিবাড়ি সরকারের অধীনে আসে। এর পর কোন এক সময়ে ‘এস্টেটে’র সব কাগজপতের সদগতি হয় বাজে কাগজ হিসেবে, কিছু দোকানে, কিছু আগুনের মুখে। তহশিল অফিসের কর্মচারীদের পরামর্শে খোঁজ নেওয়া হয় নাটোর রেভেনিউ অফিসে ; আবার তাদের নির্দেশে রাজশাহির এ.ডি.সি রেভেনিউ অফিসে। তাদের কথা : যা কিছু কাগজ-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ সবই থাকার কথা পতিসর কুঠিবাড়িতে।”
কুষ্টিয়ার ‘টেগোর অ্যান্ড কোং’ বাড়িটির হাতবদল হয়েছিল। বর্তমান মালিক আড়াই লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাড়িটি দিতে চান। কিন্তু রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের এত টাকা ছিল না। পরবর্তীকালে কুষ্টিয়া পুরসভা এই বাড়ি কিনেছিলেন। পতিসর, শিলাইদহ, শাহজাদপুরকে নিয়ে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ‘রবিতীর্থ’ নামে একটি চমৎকার তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন।
রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের অনুপ্রেরণায় পতিসরে গঠিত হয়েছে ‘ রবীন্দ্রচেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ’। এই সংগঠনের নির্বাহী সম্পাদক গবেষক মতিউর রহমানের চেষ্টায় সংগৃহীত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠি, কালিগ্রাম কৃষি ব্যাঙ্কের একটি হিসাবের খাতা, সাবেক এস্টেট ম্যানেজার বীরেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীর কাছে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর লেখা চিঠি, রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র।
লেখক সিনিয়ার ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক
বাংলাদেশ রবীন্দ্র-চর্চাকেন্দ্র কত ভালো ভালো কাজ করেছে।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েরও একটি রবীন্দ্র-চর্চাকেন্দ্র রয়েছে। তারা ঠিক কী কাজ করে, কেউ জানতে পারে না! আশ্চর্য!
অথচ রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কত কাজ এখনো করা যায়…যা কোনো সরকারি সাহায্যপুষ্ট সংস্থার পক্ষেই সম্ভব। একক প্রচেষ্টায় সেসব কাজ অসম্ভব!
ঠিক । একদম ঠিক ।