সোমবার | ১৬ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১লা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এ আমার এ তোমার পাপ : দিলীপ মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকট — ত্রান সহায়তা ও কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে : তপন মল্লিক চৌধুরী বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সময় হোক বা পরিস্থিতি, প্রণাম সব শিক্ষককেই : প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকটের সাত বছর — বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন রবিবাবুর নোবেল রহস্য : সাইফুর রহমান জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (দ্বিতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব স্যার এই পুরস্কার আপনারই প্রাপ্য — নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম : রিঙ্কি সামন্ত
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

রবিবাবুর নোবেল রহস্য : সাইফুর রহমান

সাইফুর রহমান / ৬৭ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরষ্কারটি পেতেন না যদি তাঁর রচিত হারিয়ে যাওয়া গীতাঞ্জলী কাব্যটির ইংরেজী অনুবাদ, যেটির নাম তিনি দিয়েছিলেন “সঙ অফারিংস” খুঁজে না পেতেন। হ্যাঁ, সত্যি বলছি তাঁর অনুদিত গীতাঞ্জলীটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব ষ্টেশনে। আমার এই লেখাটিতে আপনাদের আমি সেই গল্পই শুনাব। এই গল্প বলতে হলে আগে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

৮ই মে ১৯১২, বাংলা ২৫শে বৈশাখ, কবি গুরুর বাহান্নতম জন্মদিন। কবি তার এই জন্মদিনটি উদযাপনের জন্যে ছেলে, মেয়ে, ছেলে বৌ এবং জামাইজন নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। এর পেছনে অবশ্য আরো একটি অন্তনির্হিত হেতু বিদ্যমান। কবি গুরুর সহকারী উইলিয়াম পিয়ার্সন কবিকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন সেই স্বপ্নটি যেন প্রতিনিয়ত এবং নিরন্তর কবিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পিয়াসর্নের এই ধারনাটি বদ্ধমূল হয়েছে যে, কবি গুরু একটু চেষ্ঠা ও দেন-দরবার করলেই আরাধ্য নোবেল পুরষ্কারটি পেতে পারেন। আর দেন-দরবার বলতে পিয়ার্সন বুঝাচ্ছেন পশ্চিমা বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের সামনে তাঁর এই অমূল্য সাহিত্য কর্মগুলো তুলে ধরা। কারন পশ্চিমা বিশ্বের সাহিত্যিকগণ তো বাংলা ভাষাটি বুঝবেনা না, তাদের তো আর এই ভাষাটি রপ্ত নেই। তাই তাঁর সাহিত্য কর্মগুলোর ইংরেজী অনুবাদ দরকার। সে জন্য বেশ কিছু দিন ধরে পিয়ার্সন কবি কে তাগাদ দিচ্ছেন তাঁর কিছু কবিতার ইংরেজী অনুবাদ করার জন্যে। বিভিন্ন কর্মব্যস্ততায় ও আলস্যে দিনগুলো যেন কিভাবে পার হয়ে যাচ্ছে। কবি গুরু কিছুতেই তা টের পাচ্ছেন না। কবি এবার মনস্থির করলেন যে করেই হোক তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্ম থেকে বেছে বেছে তিনি ওগুলোর ইংরেজী অনুবাদ শুরু করবেন। শান্তিনিকেতনে অবস্থান কালে বেশীর ভাগ সময়ই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ভারতের সমস্ত জায়গা থেকে কেউ না কেউ প্রতিনিয়ত তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থী হন। এ সমস্ত ব্যস্ততা দেখে পিয়ার্সন নিজেই কবিকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাহিত্যগুলোর ইংরেজী অনুবাদে কবিকে সাহায্য করতে। কিন্তু কবি পিয়ার্সনকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এই অনুবাদ কর্মটিও তিনি নিজেই করবেন।

এর পেছনে অন্য একটি কারনও রয়েছে বটে। সেটি হলো রবি দত্ত নামে এক সাহিত্যিক গীতাঞ্জলীর কিছু কবিতা অনুবাদ করে বই ছাপিয়েছেন। সেগুলো দেখে কবি খুবই মনক্ষুন্ন ও অসুন্তষ্ট হয়েছেন। রবিদত্তের তর্জমাগুলো একেবারেই দূর্বল ও গুণগতমান হীন এবং সেগুলো কাউকে দেখাবার যোগ্য পর্যন্ত নয়। আর এজন্যই কবি এবার শেলাইদহে এসেছেন পদ্মার নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশে তার মন প্রান ঢেলে দিয়ে তিনি নিজেকে অনুবাদে ব্যস্ত রাখবেন বলে। যদিও ইতোমধ্যে বয়সের কিছুটা ছাপ পড়েছে শরীরে, বিরামহীন কাজ কর্মে কবি কিছুটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত তার পরও কুঠি বাড়ীর অলিন্দে দাড়িয়ে নতুন কর্মযজ্ঞের উদ্দীপনা অনুভব করে পুলকিত হন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ। তিনি যথারীতি অনুবাদেও কাজ শুরু করেছেন। সকাল, দুপুর, মধ্যাহ্ন প্রতিটি মুহুর্ত কবি ব্যস্ত তাঁর কর্মযজ্ঞ নিয়ে।

কবি যখন তার লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তখন প্রায়ই তার পুত্র বধু নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। অনুযোগ কিংবা অভিযোগের সুরে শ্বশুড় মশাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন- বাবা মশায় এই বিরামহীন পরিশ্রমে আপনি তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এই বয়সে এমন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আপনার দেহে সইবে কেন? কবি পুত্র বধু প্রতিমাকে আশস্ত করে বলেন তুমি আছো না। তুমি আমাকে সেবা যত্নে ভালো করে তুলবে কি বৌমা পারবে না, তোমার এই বৃদ্ধ বাবাটিকে সারিয়ে তুলতে? গীতাঞ্জলীর কবিতা গুলো কবি অনুবাদ করেছেন পদ্যে নয়, গদ্যে তাই অনেক চিন্তা শক্তি ক্ষয় ও শ্রম ঢেলে এই কাজ এগিয়ে নিতে হচ্ছে। বেশ কিছু দিন ক্রমাগত কাজ করে কবি বেশ খানিকটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। তাই তিনি পদ্মায় নৌ বিহারে যেতে মনস্থির করলেন। আর পদ্মার কূলে এসে পদ্মার জলে দেহ মন অবগাহন করতে না পারলে ভ্রমনটি যেন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাছাড়া লেখার সামগ্রী সব সাথেই যাচ্ছে। মনে প্রশান্তি এলে নৌকায় বসেও অনুবাদ কর্মটিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে। ছেলে রথীন্দ্রনাথ-সহ জামাইজনরাও তার সঙ্গি হতে চাইলেন। কিন্তু কবি কাউকেই সঙ্গি করলেন না। কবি মনে করেন নৌকার মাঝি মাল্লারাই তাঁর সেবার জন্যে যথেষ্ঠ উপরন্তু তাঁর বিস্বস্ত গফুর মিঞা বাবুর্চীও সাথে রয়েছেই।

ভরা বর্ষার মত পদ্মা নদীটি জলে থৈ থৈ না করলেও বৈশাখের শেষে লগ্নে পদ্মা নদীটি অনেকটাই ভরে উঠেছে। নৌকোয় বসে কবি পদ্মারভুবন মোহনী রূপ ও নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করতে লাগলেন। কবির “পদ্মা বোটের” সাথে বাঁধা থাকে ছোট একখানা নৌকা, সেখানে কবির মহানস বা পাকশালা। সেই পাকশালাটির সর্বময় ক্ষমতায় অধিকারী কবির প্রিয় রন্ধক গফুর মিঞা। নানা রকম ব্যঞ্জন রান্নাতে গফুর মিঞা সিদ্ধহস্ত। এর প্রধান কারন সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ একজন অসাধারণ খাদ্য রসিক মানুষ, খাদ্য রসিক মানে কিন্তু আবার ভোজনরসিক নন। কার কবি নানা রকম খাদ্য নিয়ে পরীক্ষা করেন বটে কিন্তু তিনি আহার করেন যৎসামান্যই। শিলাইদহে থাকতে একবার রুটি খাওয়া শুরু করলেন। মানুষ বলাবলি করতে শুরু করল রুটি খেয়ে থাকা মানে তো না খেয়ে থাকারই নামান্তর। কিন্তু কবিগুরু মনে মনে হাসেন তাঁরা কি কওে বলবে যে আটার খাদ্য গুন চালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আর একবার নিরামিষ খাদ্য ধরলেন। ডালবাটা সেদ্ধ সব্জি তাঁর বিশেষ প্রিয়। কখনও বা ভাতের বদলে শুধু ডাল সঙ্গে অবশ্য অন্য সবজি। কখনোবা গমের পায়েস। হর হামেশাই কবি নানাবিধ অনাসৃষ্টি খাদ্য তৈরী করবার ফরমাস দিয়ে তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে বিব্রত করে তুলতেন। কবি পাচক গফুর মিঞাকে উদ্দেশ্য করে জোরে হাক দিলেন “ওহে গফুর আজ মধ্যহ্ন ভোজে কি ব্যজ্ঞন পরিবেশিত হবে? গফুর প্রতি উত্তরে জবাব দিলেন হুজুর লাল মরিচ দিয়ে মোরগের দোপেঁয়াজী। আর সাথে থাকছে সহাজাদপুরের খাঁটি ঘিয়ে ভাজা গরম গরম পরোটা। কবি বলে উঠলেন, না না এই বয়সে খাঁটি ঘিয়ের ধকল পেট সইবে না। তুমি বরং বিশুদ্ধ রেড়ির তেলে সেঁকে পরোটা তৈরী করে দাও।

কবি একটি লেখা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। লেখাটি আর কারো নয় স্বয়ং তাঁর ভ্রাতুষপুত্র বলেন্দ্রনাথের। প্রবন্ধটি নাম পশু প্রীতি। প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে কবি লক্ষ করলেন গফুর মিঞার দৃষ্টি এড়িয়ে একটা মোরগ পদ্মার জলেতে ঝাঁপ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। শেষে মোরগটি সাঁতরে চলে গেলো নৌকা থেকে বেশ খানিকটা দুরে। কবি গফুর মিঞা কে উদ্দেশ্য করে বললেন ওটিকে বরং আজ রেহাই দাও। অন্য কিছু দিয়ে নাহয় আমরা আজ দুপুরের ভোজ সাঙ্গ করি। কবির পদ্মা বোটটি ভাটির দিকে চলতে চলতে পাবনা নাজিরগঞ্জ ঘাটে এসে নোঙ্গর করলো। ঘাটে মানুষ জনের সমাগম দেখে মনে হচ্ছে আজ এখানে হাটবার। বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ থেকে হাটুরেরা নানাবিধ পশরা সাজিয়ে বসেছে। পদ্মার জেলে কিংবা হলদার গণ নানাবিধ মাছের ঝাপি নিয়ে বসেছেন সারিসারি লাইন দিয়ে। নদী থেকে সদ্য তুলে আনা মাছ গুলো রূপোর মত চকচক করছে। এসব মাছ দেখেও অনেক সুখ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রমোদতরী থেকে নেমে এলেন হাটে। এক টাকায় কিনলেন পাঁচটি বৃহদাকার ইলিশ। গরম গরম ভাজা ইলিশ মাছ কবির অতি পছন্দের একটি ব্যঞ্জন। দুপুরের ভোজটি আজ একটু বেলা করেই সারতে হলো কবিকে। কিন্তু সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিল অতি স্বাদু গরম গরম ইলিশ ভাজাগুলো।

পড়ন্ত বিকেলে গরম গরম দিনমনি পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে আর এর তৈজদিপ্ত ভাবটি বেশ কমে এসেছে। পদ্মা নদীর হাওয়ায় কবির মন প্রাণ দুটোই জুড়িয়ে নৌকাটি এবার উজানে যেতে যেতে শিলাইদহের কাছাকাছি চলে এসেছে। কবি, গফুর মিঞাকে জিজ্ঞেস করলেন গফুর মিঞা তুমি কি জান এই শিলাইদহের আগের নাম কি ছিল? গফুর মিঞা তাঁর তরমুজের বিচির মত কৃষ্ণ বর্ণের দাঁত গুলো বের করে একগাল হেঁসে বলল — হুজুর শুধু আমি না, গ্রামের মোটামুটি সবাই জানে শিলাইদহের নাম ছিল খোরশেদ পুর, কিন্তু খোরশেদপুর নামটি বদলে কিভাবে শিলাইদহ হলো সেইটা আমার জানা নাই। কবি গুরু বললেন তাহলে শোন, এই গ্রামটি আমার পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেয়ার আগে এখানে একটি নীল কুঠি ছিল। আর এই কুঠিটির মালিক ছিলেন এক ইংরেজ নীলকর সাহেব, নাম শেলী। পদ্মা ও গড়াই নদীর সঙ্গম স্থলে একটি দহ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দহর সঙ্গে শেলীর নাম জুড়ে গ্রামটির নাম দাঁড়ালো শেলীদহ বা আজকের এই শিলাইদহ।

গফুর মিঞার সঙ্গে কথোপথনে কখন যে পুঞ্জপুঞ্জ কালো মেঘ সূর্যটিকে ঢেকে ফেলেছে কবি সেদিকে খেয়ালই করেন নি। ক্ষনেই চারধার অন্ধকার হয়ে এলো। ভাবে মনে হচ্ছে বড় ধরনের কাল বৈশাখী ঝড় হয়ে যাবে। দমকা বাতাসে কবির বোটটি টলমল করে উঠলো। কিছুক্ষণ আগে গফুর মিঞার সাথে শেলীর কথায় তার মনে পড়ে গেল দুই প্রধান ইংরেজী কবি বায়রন ও শেলীর কথা। সেই দুই কবি ও একদিন সুইজারল্যান্ড এক হ্রদে নৌকোয় প্রমোদ বিহারে বেড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাতের মতো কবি শেলীরও নদ-নদী, জল-সমুদ্র এসব বেশ প্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবেন তিনি নিজে মীন রাশির জাতক তবে কি শেলীর রাশিও মীন? কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই হ্রদে ঝড় উঠে এলো তাদের নৌকাটি যদি ডুবে যায় তবে কি উপায়ে শেলী তো এতটুকু সাঁতার জানা নেই। কবি বায়রন তৈরী হয়ে রইলেন কবি বন্ধুটিকে বাচাঁনোর জন্যে। ভাগ্য তাঁদের সুপ্রসন্ন ছিল সে যাত্রায় তারা প্রাণে বেঁচে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর প্রাণে বাঁচতেই পারলেন না শেলী। এর কিছুক্ষন পর ইটালীর সমুদ্রোপূকূলে শেলীকে সেই জলই তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিল সুমদ্র তার বুকে। নৌকা ডুবিতে মারা যাবার পর সমুদ্র থেকে যখন তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হলো তখল দেখা গেল শেলীর পেন্টের পকেটে কীটসের সদ্য প্রকাশিত কাব্যখানা রক্ষিত আছে। কবি গুরু ভাবলেন আঃ কি বিশ্বাকর প্রয়ান, মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও সম্ভবত শেলী তার বন্ধু কীটসের কবিতা পড়ছিলেন।

গীতাঞ্জলীর অনুবাদটি বেশ অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়েছে। বাকী অনুবাদটুকু কবি ইংল্যান্ডে যাত্রা পথে জাহাজে করবেন বলে ঠিক করলেন। কবি এবারের মত শিলাইদহের পাঠ চুকিয়ে শান্তি নিকেতনে ফিরলেন। ইংল্যান্ডে যাবার যোগার যন্ত্র শুরু হলো। ২৭ শে মে জাহাজ সিটি অফ গ্লাসকো বোম্বাই বন্দর ছাড়বে আর সেই জাহাজেই যাবার ব্যবস্থা হয়েছে কবি ও তাঁর পরিবারের। ২৪ শে মে ১৯১২ নাগপুরের ট্রেন ইষ্টিশন থেকে বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হলে কবি। তাঁর সাথে রয়েছে তার পুত্র রথীন্দ্র নাথ, পুত্র বধু কবির সুহৃদ ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সদস্য সুমেন্দ্র দেব বর্মন। ২৭শে মে, তাদের জাহাজটি বোম্বে ছেড়ে রওনা হল ইংল্যান্ডের পথে। ইংল্যান্ডে যাবার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কর্মব্যস্ততার ঝড় বয়ে গেছে কবির উপর দিয়ে। তাই জাহাজে উঠেই কবি টের পেলেন তিনি বেশ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। ক্লান্তি ও পরিশ্রান্ততা কাটাতে কবি জাহাজের কেবিনে শুয়ে বসে কাটালেন বেশ কয়েক দিন। তারপর শরীরটা ঝরঝরা হতেই পূর্ণ উদ্দোমে শুরু করলেন গীতাঞ্জলীর ইংরেজী অনুবাদ।

১৯১২ এর ১৫ই জুন রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস ষ্টেশনে নেমেই জানতে পারলেন ট্রাভেল এজেন্ট টমাস কুক ব্লুমসবেরি হোটেলে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। চেয়ারিং ক্রস থেকে তাদের ব্লুমসবেরি যেতে হবে টিউব রেলে। রবীন্দ্রনাথ কিংবা তাঁর পরিবার কারোরই পাতাল রেলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। আর সে জন্য পাতাল রেলে ভ্রমণের অতিশায্যে সবার মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা কাজ দেখা গেল। রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথ স্যুটকেস এ্যাটাচি গুলো সব বুঝিয়ে দিলেন, কিভাবে ভাবে রেল স্টেশনে থামতেই ঝটপট উঠে যেতে হবে রেলে। সুরঙ্গের মধ্যদিয়ে রেলটি সাপের মত এক গর্ত দিয়ে ঢুকে অন্য আর একটি গর্তে কিভাবে বের হয়ে যাচ্ছে । এরকম অভিজ্ঞতা জীবনে কমই হয়। কবি আর একটি বিষয়ে বেশ অবাক হলেন। লন্ডনের বিখ্যাত টেমস নদীর নিচ দিয়েও নাকি এই রাস্তা করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। তবে বলা যায় একটি প্রযুক্তিতে কলকাতা এখনও লন্ডনের চেয়ে এগিয়ে আছে আর সেটি হল কবি এখানে এসে দেখলেন এ বছর নাকি লন্ডনে ট্রাম চালু হয়েছে। কিন্তু কলকাতায় প্রথম ট্রাম চালু হয়েছে ১৯০২ সালে। একটি বিষয়ে অন্তত কলকাতা এগিয়ে আছে দেখে কবি গুরু একটি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন । এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ব্লুসমবেরি হোটলে এসে পৌছলেন কবি রবীন্দ্রনাথ । কবি জীবনে খুব কমই হোটলে রাত্রি বাস করেছেন। এ রকম ছোট ছোট প্রকষ্টে সাধারণত কবির ঘুম আসতে চায় না। সারারাত কবির ঘুম হল না। সেটি যে শুধুমাত্র হোটেলের জন্য তা নয় । তাঁর সদ্য গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ তাঁর বন্ধু রোটেন ষ্টাইনের পছন্দ হবে কিনা ? মনটি বেশ খুঁতখুঁত করছে তজর্মাটি যদি তাঁর বন্ধুর পছন্দ না হয়? খুব ভোরেই কবি স্নানসেরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ভালো জামা কাপড় পরে একে বারে ফিট ফাট হয়ে রইলেন। ভ্রমণের ধকলের জন্য হয়তো রথীন্দ্রনাথ দের ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হচ্ছে । কবির ডাকা ডাকিতে সবাই ঘুম থেকে ঝটপট উঠে রোটেনস্টাইনের বাড়িতে যাবার জন্য নিজেদের তৈরী করে নিলেন। স্যার উইলিয়াম রোটেনস্টাইন হচ্ছেন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এবং অত্যন্ত উঁচুদরের চিত্রকর। কবির অভিপ্রায় এই যে তার বন্ধু রোটেনস্টাইন গীতাঞ্জলীর অনুবাদের একটি কপি আইরিশ কবি ইয়েটসের হাতে পৌঁছে দিবেন এবং এটি যদি তার মনঃপুত হয় তবে এর একটি ভূমিকা তিনি লিখে দিবেন। রবীন্দ্রনাথ তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ কে ডেকে বললেন তাঁর আ্যাটাচিটি নিয়ে আসার জন্য। আ্যাটাচিটির মধ্যেই রাখা আছে গীতাঞ্জলীর অনুবাদের পান্ডুলিপিটি। বাবার কথায় যেন বিদ্যূৎ পৃষ্ঠ হলেন রথীন্দ্রনাথ। তার বাবা রবীন্দ্রনাথ কোন আ্যাটাচির কথা বলছেন? কারণ স্যুটকেস ও অন্যান্য বাক্স-পেটরার মধ্যে আ্যাটাচিটি দেখেননি রথীন্দ্রনাথ। কবির বুঝতে আর বাকি রইল না যে, পান্ডুলিপি সমেত আ্যাটাচিটি পাতাল রেলের কোথাও হারিয়ে ফেলছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ।

আকস্মাত এরকম একটি ঘটনায় হত-বিহ্বল হয়ে পড়লেন কবি। হতভম্ভ কবি কি করবেন বুঝে উঠতে পাড়লেন না। তার বরাদ্দকৃত রুমটিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। জীবন নোবেল পুরষ্কারটির জন্য যতটুকু আশা ভরসা করেছিলেন সবটুকুই নিমিষেই তলিয়ে গেল অন্ধকারে। অনুশোচনায় রথীন্দ্রনাথের আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করল। তিনি হোটেলের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন এই অবস্থায় কি করনীয়। কর্মচারীটি রথীন্দ্রনাথকে পরামর্শ দিলেন পাতাল রেলের লষ্ট এন্ড ফাউন্ড সংস্থাটিতে গিয়ে খোঁজ নিতে। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ তড়িৎ বেগে ছুটে গেলেন সেখানে। সেই সংস্থার লোকদের জিজ্ঞেস করতেই তারা জানাল যে জনৈক্য ব্যক্তি ওটা পেয়ে এখানে জমা দিয়ে গিয়েছে। তাঁর আ্যাটাচিটি রথীন্দ্রনাধের হাতে তুলে দিলেন সযত্নে। আ্যাটাচিটি পেয়ে রথীন্দ্রনাথের খুশি যেন আর ধরে না। সে দ্রুত সেটি নিয়ে কবির হাতে দিলেন যদি এই আ্যাটাচিটি আর না পাওয়া যেত তবে রবীন্দ্রনাথ হয়তো নোবেল পুরষ্কারটি জীবনে পেতেন না। কারণ গীতঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ অতি কষ্টসাধ্য একটি অধ্যায় । কবি যে এই কাজটি পুনরায় করতেন আমার সেটি মনে হয় না।

লেখক : গল্পকার ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, ইমেইল : barristershaifur@yahoo.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন