২০১৯ সালে ঠিক হয়েছিল আহমেদাবাদ ছাড়াও দেশের আরও ছটি বিমানবন্দরকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে। ঠিক সেই বছরেই আদানি বিমান বন্দর রক্ষণাবেক্ষণের কোম্পানি আদানি লখনউ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড (এএলআইএএল), আদানি ম্যাঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড (এএমআইএএল) এবং আদানি আমদাবাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট লিমিটেড (এএআইএএল) খোলেন। এবং কোম্পানি খোলার মাস ছয়ের মধ্যেই তিনি আহমেদাবাদ সমেত আরও ছ’টি বিমান বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার পেয়ে যান। এক্ষেত্রে কোম্পানির বয়স এক বছর না হলেও দেখা হয়নি আদানির কোম্পানি এর আগে বিমান বন্দরের কাজ করেছে কিনা। কিন্তু এয়ারপোর্টের রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, টার্মিনাল ইত্যাদি মেইনট্যানান্স-এর দায়িত্ব পেয়ে গেল আদানির কোম্পানি। এক্ষেত্রে দেখা হয়নি সামান্য গাফিলতি হলে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার তারা পেয়ে গেল যারা একটি বিমানবন্দর চালানোরও অভিজ্ঞ নয়।
১৯৩২ টাটা এয়ারলাইন্স চালু হয়েছিল, এর কয়েক বছর পর নাম বদলে হয় এয়ারলাইন্স। ১৯৫৩-তে কোম্পানির এয়ার ইন্ডিয়া নামকরণ করে রাষ্ট্রীয়করণ করা হল। একটা সময়ে দেখা গেল এয়ার ইন্ডিয়াকে রুগ্ন বানানোর চেষ্টা চলছে পুরোদমে, তাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যুক্ত। অথচ বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার জর্জ ফার্নান্ডেজ এয়ার ইন্ডিয়ার রিভাইভাল প্ল্যান তৈরির চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে এয়ার ইন্ডিয়াকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল। শেষ পর্যন্ত মোদী জামানায় আদানি, আম্বানি নয়, এয়ার ইন্ডিয়া তুলে দেওয়া হল টাটাদের হাতে। তখনও ভাবা হয়নি টাটাদের বিমান চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা, কিন্তু তাঁদেরই ভার দেওয়া হল। আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ দুর্ঘটনার পর টাটা যাত্রী পিছু ১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করতেই সবাই চুপ। উল্লেখ্য, এই ধরনের একেকটি বিমানের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তবে প্রতিটি এয়ারলাইন্স বিমানের উপর বিমা থাকে (Hull Insurance) ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১,৬০০ থেকে ২,৫০০ কোটি টাকা আর বিমার টাকাতেই দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কেবল তাই নয়, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রত্যেক যাত্রীরও আলাদা বিমা থাকে। সব মিলিয়ে অঙ্ক প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। তাহলে ২৪১ জন মৃত যাত্রীর প্রত্যেক পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে দেওয়া হলেও লাভবান হল কে?
অভিযোগ সস্তা পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ দিয়ে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার তৈরি। বিমানের ইমার্জেন্সি সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করে না। আপাতকালীন পরিস্থিতিতে চার বারের মধ্যে অন্তত একবার এই বিমানের মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খোদ বোয়িং সংস্থার পরীক্ষাতেই নাকি ড্রিমলাইনার বিমানটি একাধিকবার পাশ করতে পারেনি। আরও অভিযোগ, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটির নকশাতেই নাকি বহুরকম গণ্ডগোল আছে। এই বিমান তৈরির ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কোনও নিয়মনীতিই নাকি মানা হয়নি। বোয়িং কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় জানানো হলে তারা নাকি অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা স্বত্বেও ২০১১ সালে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটি এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য আমদানি করা হয়। তখন সংস্থাটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিল। ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই বিমানের যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে একাধিক অভিযোগ ওঠে, বিভিন্ন দেশের আদালতে মামলায় দায়ের হয়। বহু দেশে ড্রিমলাইনার বিমান নিষিদ্ধ হয়। এদিকে “বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হয়,” এই যুক্তি দিয়ে ২০২২সালে এয়ার ইন্ডিয়ার মালিক হয় টাটা। ২০২৫-এ পুরনো বিমান নতুন রঙে ঝাঁ চকচকে করে এয়ার ইন্ডিয়ার বদনাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। “বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হয়” এই যুক্তি দিয়ে প্রায় সত্তর বছর সরকারি মালিকানায় ‘ধুকতে থাকা’ এয়ার ইন্ডিয়াকে টাটার হাতে তুলে দেন মোদীজি। কিন্তু দেশের অসামরিক বিমান পরিবহণের ইতিহাসে একক বিমানের বৃহত্তম ও ভয়ঙ্করতম দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্যের আমেদাবাদ বিমান বন্দরে। কেবল তাই নয়, বোয়িং ৭৮৭-কে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ এবং বিভিন্ন দেশের আদালতে চলছে একাধিক মামলা, সব মিলিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর যেন মিললো সেই মোদীর রাজ্যের আমেদাবাদ বিমান বন্দরের অনতিদূরে।
কিন্তু ঘটনা যাই ঘটুক, বহু মানুষকে মরতে হল, তার থেকেও অনেক বেশি মানুষ তাদের স্বজন হারালেন। এই ক্ষয়ক্ষতি কেবল সীমাহীন নয়, এই ক্ষতি অপূরণীয়, যে ক্ষতির দায় তাদের কারও একজনেরও ছিল না। তবু তাদের প্রাণ দিতে হল। এবং একথা বলাই যায় যে সামগ্রিকভাবে বিমান পরিবহণ ব্যবস্থার গলদের কারণেই এই মর্মান্তিক পরিণতি। মুনাফার লোভ যখন মানুষের জীবনের থেকে বেশি দামী হয়ে ওঠে তখন শুধু বিমান নির্মাণ নয়, তার মেরামতি থেকে রক্ষণাবেক্ষণ সব কিছুই নির্মমভাবে অবহেলিত হয়। চাহিদা অনুসারে দ্রুত সরবরাহ করার জন্য বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন ত্রুটি থেকে যায় তেমনি গুণগতমানের ঘাটতি থাকে, কিন্তু বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলি যাত্রী সুরক্ষা বা নিরাপত্তার কথা না ভেবে তাদের নিজেদের লাভের ব্যাপারে বেশি সচেতন থাকে। অন্যদিকে আমাদের সরকার রাষ্টায়ত্ত সংস্থাকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন করতে সংস্থার অভিঙ্গতা বা দক্ষতার কোনো দিক না দেখে কেবল নিজেদের রাজনৈতিক সবার্থ সিদ্ধির কারণেই সেই সংস্থার হাতে দায়িত্ব সঁপে দেয় যাত্রীদের ন্যূনতম নিরাপত্তার ধার ধারে না। পাইলট ও কর্মী কম থাকায় অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। তেমনি বিমান সংখ্যা কম থাকায় বিশ্রামহীন ও রক্ষণাবেক্ষণহীনভাবে টানা চালানো হয়। সবটাই প্রতিযোগিতার নামে সর্বোচ্চ মুনাফা ও বাজার দখলের জন্য। কারণ, পুঁজি, বাজার, মুনাফা মানুষের জীবনের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কম বিপন্নতা বেশি।