প্রতিটি প্রাণীর বাঁচা-মরা ও জীবনযাপনের সঙ্গে তার বাস্তুতন্ত্রের ( Eco system) এক নিকট সম্পর্ক রয়েছে। পুমাদের কথাই ধরা যাক। এদের বাঁচা-মরার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পশ্চিম গোলার্ধের ৪৮৫ রকম প্রজাতি প্রাণীর। এককথায় পুমারাই ধরে রেখেছে পশ্চিম গোলার্ধের বাস্তুতন্ত্র। বছরের গোড়াতেই ম্যামাল রিভিউ পত্রিকায় বেড়িয়েছে এই খবর। হিংস্রতা, শক্তি ও শারীরিক গড়নের সঙ্গে মিল আছে বলে পুমাদের বলা হয় পাহাড়ি সিংহ। এই চতুষ্পদ প্রাণীটির দেখা পাওয়া যায় গোটা আমেরিকা জুড়ে। প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্য-খাদক-আশ্রয়দাতা-বাসিন্দা সবাইকে নিয়েই বাস্তুতন্ত্র। এতে আপাতভাবে যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়, দেখা যায় তারাই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। কোন প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা বা বিচরণের জায়গার সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সমীক্ষাটি করেছেন ডিফেন্ডারস অফ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড প্যান্থেরা নামে একটি গবেষণা সংস্থা।
যেমন ধরা যাক ইলক নামে একটি বিশেষ প্রজাতির হরিণ পুমাদের খাদ্য। আবার পুমাদের শরীরে বাস করা পোকাদের খায় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী নেকড়েরা। খাদ্য-খাদকের এই জটিল সম্পর্কের বহু গল্প পৃথিবীর প্রতিটি প্রজাতির প্রাণীর বাস্তুতন্ত্রের দিকে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সমীক্ষকরা পুমাদের নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন ১৯৫০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত। অন্য প্রাণীদের সঙ্গে পুমাদের ব্যবহার এবং বাস্তুতন্ত্রের ওপর তার প্রভাবই তাদের গবেষণার বিষয়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে এরফলে মানুষেরও উপকার হচ্ছে। যেমন, পুমারা সাদা ল্যাজওয়ালা হরিণদের যম। পুমাদের চারপাশে থাকা প্রায় ৪০টি প্রজাতির প্রাণীর ওপর এই ভয়ের প্রভাব কাজ করে। এদের মধ্যে বহু প্রাণী আবার মানুষের শত্রু, ক্ষেতের ফসল তারা শেষ করে দেয়। পুমারা এদের খেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় না রাখলে ফসল হারানো কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হত। পালে পালে রাস্তায় নেমে আসা তৃণভোজীদের চলাচলের কারণে দুর্ঘটনায় পড়তো বহু গাড়ি, মারা যেত মানুষ।
সমীক্ষাটি জানিয়েছে বাস্তুতন্ত্রে থাকা ২০৩ টি প্রজাতি প্রাণী পুমাদের শিকার। আবার ২৮১ রকমের প্রাণী পুমাদের শরীরকে ঘিরেই বাঁচে। কেউ খুঁটে খায় তাদের শরীরের পোকামাকড়, কেউ খায় তাদের ফেলে যাওয়া খাবার। এর পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রে থাকা ১২ রকমের প্রজাতি প্রাণীর সঙ্গে চলে তাদের শিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে। আমেরিকার উত্তর ডাকোটাতে পুমাদের একটা বসতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলে বহু হরিণের বাস। হরিণের পালের সঙ্গে যানবাহনের সংঘর্ষে বহু হরিণ মারা যেত, ক্ষতিগ্রস্থ হত গাড়ি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতো এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পুমারা আসার ফলে হরিণের সংখ্যা কমছে, কমছে যান দুর্ঘটনা। নিজেরা শিকার করে খাওয়ার পাশাপাশি পুমারা বহু প্রাণীর খাদ্যের যোগান দেয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বহু প্রাণী পুমাদের ফেলে যাওয়া মাংস খেয়ে বাঁচে। গবেষকরা হিসেব করে দেখেছেন পুমারা প্রতিদিন তাদের প্রায় ১,৫০৭,৩৪৮ কেজি মাংসের যোগান দেয়।
পুমাদের দেখা পাওয়া যায় আমেরিকার ২৮টি কাউন্টিতে। হিংস্রতার কারণে মানুষ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। তাই তাদের সংখ্যা কমছে। আইনি রক্ষাকবচ থাকা সত্বেও তীব্র হচ্ছে মানুষ-পুমার সংঘাত, কমছে পুমাদের থাকার জায়গা। পথ দুর্ঘটনাসহ নানা অসুখবিসুখে মারা যাচ্ছে পুমারা। এরফলে বিপন্ন হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র, বিপন্ন হচ্ছে মানুষ। পরিবেশের স্বার্থেই পৃথিবীতে পুমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন রয়েছে, তা জানানোর জন্যই ম্যামাল রিভিউর এই গবেষণা।