ঘটা করে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার ইতিহাস খুব বেশিদিনকার নয়। কিন্তু আজকের দুর্গা পুজোর উদ্যোগ বা আয়োজন কিম্বা আনন্দের উৎসব শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই বাংলায় দুর্গা পুজো শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঠিক কবে কখন এই ঘটা করে পুজো চালু হয়েছিল তার কোনও নির্ভরযোগ্য দলিল ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে যতটুকু জানা যায় তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। তাহেরপুরের রাজা কংসশনারায়ন বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম দুর্গা পুজো করেন। এরপরে রাজশাহির রাজা এবং বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু রাজারা প্রতি বছর এই পুজো আরম্ভ করেন। আবার কলকাতায় ১৬১০ সালে বরিশার রায়চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গাপুজার আয়োজন করেছিল বলে জানা যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে দূর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। ১৯১০ সালে কলকাতায় প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে বারোয়ারি পুজোর শুরু হয়। সনাতন ধর্মতসাহিনি সভা, বাগবাজারে সার্বজনীনে একটি দুর্গোৎসবের সূচনা করেন জনসাধারণের সহযোগিতার সাহায্যে।
বাংলায় দুর্গাপূজার চল তখন থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার বা বনেদি বাড়িতে। আর প্রায় প্রতিটি বাড়ির পুজো হত সেই বাড়ির রীতি নীতি মেনে। আজ যা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সেই ঐতিহ্য বাঙালি জীবনের অহঙ্কার। বাংলার বুকে হয়ত তখন থিম পুজো ছিলনা, প্রতিযোগিতাও ছিলনা, কিন্তু পুজোতে ঐতিহ্যের আবেগ থাকত ষোল আনা। সেই আবেগ চিরন্তন। হাওড়া জেলার কুণ্ডু চৌধুরী জমিদার বাড়ির পরিবারিক ঐতিহ্য হল বছরে দুবার দুর্গা পুজো। একবার চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো, অন্যটি শরৎকালের শারদীয়ার অকাল বোধন। বাংলায় বছরে দুবার দুর্গা পুজোর রীতি মাত্র গুটি কয়েক বাড়ীতে ছিল, কুণ্ডু চৌধুরী জমিদার বাড়ি তাদের মধ্যে কেবল অন্যতম নয়, এখনও সেই রীতি বর্তমান। হাওড়ার আন্দুল বাজার বাসস্টপের কাছ থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থিত কুণ্ডু চৌধুরীদের বিশাল জমিদার বাড়ি। জায়গাটার নাম মহিয়ারী। এ বাড়িতে বছরে দুবার দুর্গা পুজো ছাড়াও এদের পুজোর আরও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
প্রথমত এই বাড়িতে যে দুর্গা পুজো হয় সেই দেবীমূর্তি মহিষাসুরমর্দিনী নয়, সেই প্রতিমা হরগৌরীর। দেবী যুদ্ধরত নন। তাই অসুর, মোষ, সিংহ কিছুই নেই এখানে। ষাঁড়ের পিঠে বসে আছেন শিব, তাঁর পাশেই মা দুর্গা অত্যন্ত শান্ত রূপে, তাঁদের ঘিরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশ– সম্পূর্ণ নিটোল পারিবারিক ছবি। বাসন্তী পুজো আর শারদীয়া– দুটি পুজোতেই এই বাড়ির একই মূর্তি। একই কাঠামোর উপরই দু’দুবার মূর্তি গড়া হয়, আর সেই কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন।
কুণ্ডু চৌধুরীদের গৃহ দেবতা লক্ষ্মী জনার্দন, সারা বছরজুড়ে নিত্য দিন তার পুজো হয়। জমিদারির আমল থেকেই এঁরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত ফলে এ বাড়ির পুজোও হয় বৈষ্ণব মতে। পুজোর কয়েকদিন কুণ্ডু চৌধুরীদের বাড়িতে আমিষের কোনও পাট থাকে না। দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পরেই এই বাড়িতে মাছ খাওয়ার প্রথা রয়েছে। এ বাড়ির পুজোর আরো একটি বৈশিষ্ট হল; হরগৌরী পুজোর পাশাপাশি এখানে গরুড়ের পুজোও হয়। এমনকি পুরনো প্রথা অনুযায়ী এখনও দুর্গা পুজোর সময়ে এই বাড়িতে নৌকো পুজো হয়। বহুকাল আগে কুন্ডু চৌধুরী পরিবার ছিল বড় ব্যবসায়ী। তখন তাঁরা নৌকোয় করে বাণিজ্যে যেতেন। তখন দুর্গম নদীপথ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও থাকতো নানা বিপদের আশঙ্কা। নৌপথে যাতে বিপদে না পড়ে তার জন্যই হাওড়ার কুন্ডু চৌধুরী পরিবারে শরৎকালে অকালবোধন দুর্গাপুজো শুরু হয়। তার সঙ্গে নিয়ম করে দশমীর দিন নৌকা উপযোগ অনুষ্ঠিত হত। নবমীর সন্ধ্যা থেকে পরিবারের মেয়েরা কাঠের নৌকাটিকে মুদ্রা, কড়ি, সিঁদুর নতুন গামছা দিয়ে সাজাতেন। দশমীর দিন পুজোর শেষ নৌকাটিকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেওয়া হয়। আবার ছ’মাস পর বাসন্তী পুজোর নবমীর দিন সেই নৌকোটিকে সাজানো হয়। সেই রীতি আজও বহাল।
এ বাড়ির পুজোয় একদিন হরিনাম-সংকীর্তন বসে। অষ্টমীতে পরিবারের বিবাহিত মেয়েরা ধূনো পোড়ান। বৈষ্ণব মতে পুজো ফলে এ বাড়িতে কোনরকম পশুবলি হয়না। কেবল প্রথা অনুযায়ী বাতাবি লেবু বলি হয় তাও প্রকাশ্যে নয়। বিজয়া দশমীর দিন পরিবারের মেয়েরা আজও নিয়ম করে ১০০ নারকেল দিয়ে নারকেলের মিষ্টি তৈরি করেন। আগে প্রায় ৯৬ মন চাল ঝাড়াই বাছাই করে বিশাল নৈবেদ্যর ব্যবস্থা করা হত। এখন সেটা কুড়ি কিলোতে এসে দাঁড়িয়েছে। আগে বিসর্জন হত সরস্বতী নদীতে। এখন নদী মজে যাওয়ায় বিসর্জন হয় গঙ্গাতে। আগেকার জমিদারি প্রথা অনেক কাল আগেই ঘুচেছে। দিনও বদলেছে, তবু কুন্ডু চৌধুরী বাড়িতে সারা বছরজুড়েই লেগে থাকে বিভিন্ন পুজো। সেসব চালানোর জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ১৯২৭ সালে এস্টেট তৈরি হয়েছিল। সেই সঙ্গে পুজোর বিভিন্ন নিয়মের জন্য রয়েছে কুন্ড চৌধুরী বাড়ির ‘পুজো অর্পণ নামা’।