হিন্দু ধর্মে একাদশীর উপবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এবছর ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম একাদশীকে খুব বিশেষ বলে মনে করা হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক কখন এই একাদশী কখন পড়ছে এবং কেন এটি বিশেষ।
কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় প্রবোধিনী একাদশী তিথি। এই একাদশী তিথি তার ভক্ত ও সাধকদের মনের সমস্ত মোহ অপসারণ করে বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রদান করেন, যে জ্ঞান হয় মোক্ষ লাভের সহায়ক। প্রবোধ শব্দে বিশুদ্ধ জ্ঞান বোঝায়। শ্রীশ্রীপ্রবোধিনী একাদশী তিথি আরো নানান নামে অলংকৃত হয়েছেন যেমন হরিবোধিনী, উত্থানৈকাদশী, কৌশিকী, কার্তিকী একাদশী প্রমুখ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি ভগবান শ্রী বিষ্ণু আষাঢ় মাসের শায়নী একাদশীতে নিদ্রায় যান। তিনি নিদ্রা থেকে উত্থিত হন কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে প্রবোধিনী একাদশী তিথিতে। আমরা যাতে জাগ্রত হই, কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের যোগ্য হই, এমন লক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে আমাদের ঋষিগণ এইভাবে ভগবানকে শায়িত করেছেন। বাস্তবে ভগবানকে জাগ্রত করা অর্থাৎ নিজেকেই জাগ্রত করা।
“God helps those who help themselves.” যার নিজের প্রতি আস্থা নেই, তাঁরা কখনোই ভগবানের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারেনা। যারা গভীর নিদ্রায় শায়িত এবং অলস, ভগবান কখনো তাদের সাহায্য করেন না। এমন ভাব্য পুরুষার্থবাদী মন্ত্র কেবল ভারতীয় সংস্কৃতি দিতে পারে। যারা ঘুমিয়ে আছেন তাদের জাগায়, যারা জেগে আছেন তাদের দাঁড় করায়, যারা দাঁড়িয়ে আছেন তাদেরকে হাঁটায় আর যারা হাঁটছেন তাদের দৌড়বার প্রেরণা দান করে আমাদের এই তেজস্বী সংস্কৃতি।
প্রবোধিনী একাদশী মানবকে নানাভাবে নিদ্রা হতে জাগ্রত করার বার্তা নিয়ে দ্বারে দ্বারে উপস্থিত হয়। এ বিষয়ে একটি গল্প বলি।
রামায়ণে রাম ও সুগ্রীবের বন্ধুত্ব ছিল অতুলনীয়। তারা একসাথে জীবন অতিবাহিত করে একসাথে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এমন অতুলনীয় বন্ধুত্ব দুর্লভ
পরস্পরের বন্ধুত্বের মূলে ছিল একে অপরের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি। সেই অনুযায়ী রাম বালিকে হত্যা করে সুগ্রীবের মনস্কামনা পূর্ণ করেছিলেন। নিজ কার্য সিদ্ধ হওয়ার পরে সুগ্রীব প্রমাদের বশে সহজে সুখ উপভোগে মগ্ন হয়ে রামকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলেন। ফলে রামচন্দ্র খুবই ব্যথিত হলেন। তার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রাম লক্ষণকে পাঠালেন সুগ্রীবের কাছে।
ক্রোধাগ্নিতে প্রদীপ্ত লক্ষণ আসছেন শুনেই সুগ্রীব ভীত হলেন। রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন। সম্মুখে নারীকে দেখে লক্ষণ শান্ত হলেন। তবুও তিনি সুগ্রীবকে বললেন, ‘রামের কাজের শিথীলতা এনে তুমি কৃতঘ্ন হয়েছ আর এই পাপের কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই।’
‘এখনো যদি তুমি রামের কাজে মন না দাও তাহলে এটুকু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে পথে বালি এই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন, সে পথের দরজা এখনো বন্ধ হয়নি।’ প্রমাদী সুগ্রীবকে এইভাবে সাবধান বাণীতে লক্ষণ সেদিন জাগিয়ে ছিলেন। সেই দিনটি হল প্রবোধীনি একাদশী।
মহাভারতীয় যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার প্রাণপ্রিয় পান্ডবদের এই তিথি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্মরণ করেন পিতামহ ব্রহ্মা এবং দেবর্ষি নারদকে। তাঁদের কথা স্মরণ করে দেবর্ষি নারদকে পিতামহ ব্রহ্মা বলেছেন, এই দিন নারায়নের পূজা বন্দনা করা উচিত শাস্ত্র মেনে। তফাৎ শুধু এটুকুই থাকবে এই দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বিল্বপত্র দিয়ে পূজা অর্চনা করা উচিত।
পিতামহ ব্রহ্মা দেবর্ষি নারদকে সম্বোধন করেছেন কলিবর্ধন বলে। একই সঙ্গে পূজার বিধান দিয়ে বলেছেন এই দিন নারায়ণ শিলায় তুলসীপাতা মঞ্জরী সমেত দেওয়া আবশ্যক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, এই ব্রত উপবাস একাগ্র চিত্তে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলে সাধক বা ভক্তের পুণ্য লাভ হয় অফুরন্ত। মৃত্যুর পর তার অবস্থান হয় দেবলোকে।
হিন্দু ধর্মে একাদশীর উপবাসের গুরুত্ব রয়েছে। এক বছরে মোট ২৪টি একাদশী হয়, অর্থাৎ প্রতি মাসে দুটি একাদশীর উপবাস পালন করা হয়। প্রথমটি কৃষ্ণপক্ষে এবং দ্বিতীয়টি শুক্লপক্ষে পড়ে। শ্রীহরি বিষ্ণুর জন্য একাদশীর উপবাস রাখা হয়। বিশ্বাস করা হয় এই উপবাস পালন করলে জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান হয়।
নভেম্বর মাসে প্রথম একাদশীর উপবাসটি খুব বিশেষ। নভেম্বর মাসের প্রথম একাদশী হল দেবোত্থানী একাদশী। শ্রী হরি বিষ্ণু যখন ৪ মাস পর যোগ নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এই একাদশীতে, তাই এই একাদশীকে অত্যন্ত বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
এই একাদশীর দিন থেকেই সব শুভকাজ শুরু হয়। দেবোত্থানী একাদশী প্রবোধিনী একাদশী নামেও পরিচিত। এই ব্রত পালন করলে মানুষ সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তি লাভ করে।
প্রবোধিনী একাদশীর তিথি : এই একাদশী তিথি শুরু হবে সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ০৬ টা ৪৬ মিনিটে। এই একাদশী তিথি শেষ হবে মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ০৪ তে ০৪ মিনিটে। তাই উদয়তিথির কারণে এই একাদশীর উপবাস পালিত হবে ১২ নভেম্বর। ১৩ নভেম্বর ২০২৪, বুধবার উপবাস ভাঙবে।
আষাঢ় মাসের শুক্ল একাদশীতে দেব-শয়ন সংঘটিত হওয়ার পর, কার্তিক শুক্লা একাদশীর দিনে দেবোত্থান উৎসবের মাধ্যমে চাতুর্মাস শেষ হয়।হিন্দুমতে, চতুর্মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ। তাই প্রবোধিনী একাদশী থেকে হিন্দুদের বিবাহের কাল শুরু হয়।
এই একাদশীর দিনে কোন কোন স্থানে তুলসীর সাথে ভগবানের বিবাহ দেয়ার প্রথা প্রচলন আছে। অনেকেই বলে থাকেন, ভগবান দীর্ঘ চার মাস ঘুমিয়ে থাকেন বলে আমরা যা কিছু উল্টোপাল্টা কাজ করেছি তার হিসেব যাতে না চাইতে পারেন সেই কারণেই তার দৃষ্টিতে অন্য পথে মোর দেয়ার জন্যই হয়তো এই তুলসীর সাথে বিবাহ করে প্রচলিত রয়েছে। যাইহোক এসব গল্পের মাধ্যমে বোঝা যায়, একাদশীর দিন ভগবানকে তুলসী পাতা দিয়ে পুজো করা উচিৎ।
কর্মসূত্রে আমরা প্রায় সময় হলদিয়ায় যাই। এখানে ক্ষুদিরাম নগরে (ডা. বি সি রায় হসপিটালের পাশে) রাধা কৃষ্ণ জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামের এক অপূর্ব ভব্য ইসকনের মন্দির রয়েছে। ‘আইকেয়ার’ এর চেয়ারম্যান লক্ষ্মণ চন্দ্র শেঠ ইসকন মন্দির তৈরি প্রকল্পে তাঁর প্রথম স্ত্রী তমালিকা পন্ডা শেঠের স্মৃতি রক্ষার্থে এক একর জমি দান করেন মন্দির কর্তৃপক্ষকে। মন্দিরের কাজ এখনও শেষ হয়নি। রাধা কৃষ্ণের মন্দিরটি ১৭ ই নভেম্বর ২০২২ এ উদ্বোধন করা হয়।
এই মন্দিরে ১৭ই অক্টোবর থেকে ১৫ই নভেম্বর অব্দি দামোদর মাস উদযাপন করা চলছে। কার্তিক মাস বা দামোদর মাস এমন একটি মাস যা শ্রীশ্রী রাধামদন মোহনের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
প্রবোধিনী একাদশীর দিন থেকে অর্থাৎ ১২ই নভেম্বর থেকে ১৬ই নভেম্বর ভীষ্ম পঞ্চমব্রত পালন করা হবে।
কার্তিক মাসের এই শেষ ৫দিনে পিতামহ ভীষ্ম তাঁর দেহ ত্যাগের প্রস্তুতির জন্য উপবাস করেছিলেন। ভীষ্মদেবকে কার্তিকের শেষ ৫দিনে সমস্ত প্রেম ও ভক্তি সহকারে উপবাস করতে দেখে প্রভু অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।
ভীষ্ম পঞ্চকের এই পাঁচ দিন যারা জপ, গান, শ্রবণ, পাঠ, উপাসনা এবং উপবাস করেন তাদের প্রতি শুদ্ধ ভক্তির ভালোবাসা দিতে সম্মত হন হরি ।
ভীষ্ম পঞ্চক ২০২৪ উপবাস কার্তিকের দিনে ভীষ্মদেবকে স্মরণ করে শুরু হয় এবং পূর্ণিমার দিনে শেষ হয়।
যারা চতুর মাস ব্রত পালন করতে ব্যর্থ হন, তারা ২০২৪ সালের কার্তিক মাসের শেষ পাঁচ দিনে উপবাস করে চার মাসের উপবাস পালনের পুণ্যফল লাভ করতে পারবেন।
কখনো পূর্ব মেদিনীপুর বা হলদিয়ায় গেলে অবশ্যই ঘুরে আসুন এই মন্দিরে। ভব্য সুন্দর এই মন্দিরে কিছুক্ষণ সময় কাটালে মন এক পবিত্র অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে। মন্দির খোলার সময় বন্ধ ভোগ আরতি সবকিছুর লিস্ট আমি ছবিতে দিলাম। সকলে ভালো থাকুন।
হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।।
আমি গিয়েছি। ভালো লেগেছে।
এই মন্দিরে কিছুক্ষণ বসলে এক অনাবিল পবিত্র সুখানুভূতিতে ভরে ওঠে মন