সরস্বতী পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। বাঙালির ঘরে ঘরে হবে সরস্বতী পূজা। মূর্তি এনে পুজো করার প্রচলন রয়েছে বাংলায়। চরম ব্যস্ততা এখন কুমোর পাড়ায়। মূর্তি তৈরির বরাত বেড়েছে, তবুও তৃপ্তির হাসি উধাও এদের মুখ থেকে। ‘বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’ নিয়ে কুমোরপাড়ার গরুর গাড়িগুলি আর চলেনা। দাম বাড়ছে মাটির, কমছে মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার। অনেক মৃৎশিল্পী নিরুপায় হয়ে ছেড়ে দিয়েছেন পারিবারিক পেশা। দেড়শ বছর আগে জমিদারদের অতিরিক্ত লোভ বিপাকে ফেলেছিল কুমোরদের। মাটিতে জমিদারি খাজনা, গ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল কুমোরদের। এখনো কি তাদের সেই সমস্যা মিটেছে? কিভাবে অক্সিজেন পাবেন শিল্পীরা?
মাটি নিয়েই তাঁদের কারবার। মাটি ছাড়া কুমোরপাড়া অচল।কিন্তু এই মাটির জন্য কুমোরদের সমস্যার অন্ত নেই। কবে থেকে এসে সমস্যার শুরু তার সঠিক নথিপত্র মেলেনা, তবে দেড়শ বছর আগে নথিপত্রে কুমোরদের মাটি নিয়ে সমস্যার কথা মিলেছে। সমস্যাটা এতটাই প্রখর ছিল যে কুমোররা গ্রাম ত্যাগ করেছিল, আর সে ঘটনা ঘটেছিল মেদনীপুরে।
১২০৭ বঙ্গাব্দের ১১ই আশ্বিন, ইংরেজির ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ। আজ থেকে প্রায় ১৭২ বছর আগে জনৈক সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশিত করেছিল একটি খবর, ‘কুম্ভকারেরা হাঁড়ি, কলসি ইত্যাদি মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে চাইছেন না। এর ফলে সাধারণ মানুষ বেশ কষ্টের মধ্যে পড়েছেন।’ কারণ হাঁড়ি, কলসির মত নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তখন দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম অঙ্গ কারন ধাতুর তৈরি জিনিসপত্রের চল অতটা হয়নি সেই সময়।
এখন প্রশ্ন হল, কুমোররা মাটির জিনিসপত্র তৈরি বন্ধ করে দিলেন কেন? এর কারণ জমিদারদের মাটি আর কাঠের উপর খাজনা বসানো। কুমোররা তাদের প্রয়োজন মত মাটি খুড়ে নেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য লাগে জ্বালানি, সেজন্য জল জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করেন তারা। মেদিনীপুরের কোন নতুন জমিদার নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন, মাটি আর কাঠের জন্য কুমোরদের অতিরিক্ত খাজনা দিতে হবে। “বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না।” বিখ্যাত এই লাইনটি তখনকার দিনের বাংলার জমিদারদের যেন প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছিলো। খাজনা না দিলে মাটি কোপানো, জঙ্গলে কাঠ ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয়ার হুকুম জারি হল।
কিন্তু তাতে রাজি হলে না কুমোররা। তারা জমিদারদের নির্দেশে বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিলেন। তবে তাদের এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট যুক্তি ছিল। যুক্তিটি হলো বিনিময় প্রথার। কুমোররা জানিয়েছিলেন, তারা কোনকালে কাঠ বা মাটির জন্য খাজনা দেননি। জমিদারদের প্রয়োজনমতো হাঁড়ি, কলসি, জালা ইত্যাদি সরবরাহ করেছেন বিনামূল্যে। আগের জমিদাররা তাই নিয়ে সন্তোষে থাকতেন।
জমিদারদের বিনামূলের মাটির জিনিসপত্র দেওয়ার পেছনে একটা সামাজিক রীতি ছিল। পেশাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় দৈনন্দিন জীবনে ন’টি জাতীয় প্রয়োজন — কুমোর, তাঁতি, মালাকার, ময়রা, নাপিত, তেলি ইত্যাদি। এদের একত্রে বলা হয় নবশায়ক। জমিদার নিজের প্রয়োজনে এই নবশায়কদের গ্রামে এনে বসাতেন, তাদের জমি দিতেন। এই জমিকে চাকরান ভোগ বলা হতো। জমির জন্য কর দিতে হতোনা নবশায়কদের। তার পরিবর্তে তাঁতিরা জমিদারকে কাপড় দিত, কুমোর দিত মাটির বাসনপত্র, তেলি দিত তেল ইত্যাদি। কুম্ভকারেরা এই সহযোগিতামূলক সহাবস্থানের উল্লেখ করে অতিরিক্ত খাজনা দিতে রাজি হলনা, কাজ বন্ধ হল কুমোর পাড়ায়।
তবে কুমোরদের রেগে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় জমিদারদের সেরকম কোন সমস্যা হয়নি বলেই মনে হয়। কারণ সেরকম কোন কিছুর উল্লেখ আর পাওয়া যায় না, বরং ক্ষতি হলো কুমোরদের। তারা মেদিনীপুর ছেড়ে চলে গেল অন্যত্র বসবাস করবার জন্য।
তবে এই ঘটনার ১৭২ বছর পরেও কুমোরদের সমস্যা সে রকম সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন কুমোর পাড়ায় যদি খোঁজ নেওয়া যায়, তাহলে দেখবেন মাটির জোগান পেতে সমস্যা বেশিরভাগ জায়গাতেই। সেই কারণেই হয়তো বহু পাড়ার চাকাও বন্ধ হয়ে গেছে, আক্ষরিক অর্থে শিকেয় উঠেছে তাদের এই জীবিকা।
কিছু কুমোরদের নদীর কাছে ঘর হলেও মাটি তোলা নিষেধ। এছাড়া শুধু নদীর মাটিতে ভালো ফল মেলেনা। মাটির সংকটের জন্য বেশিরভাগ কুমোর পাড়ার লোকজনই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। দু-এক ঘর মাটির জিনিস তৈরি করে বেশিরভাগটাই কেনা বাইরে থেকে। আগে চাষের জমি থেকেও মাটি নেয়া হতো। পুকুর, ডোবা যেখানে কাটানো হতো, সেখানে খবর পেলে এরা ছুটে যেত। পুকুরের উপরের এবং গভীরে দুরকম মাটি লাগে জিনিসপত্র তৈরি করতে।
বিভিন্ন জায়গায় খবর থেকে দেখা গেল, ডায়মন্ড হারবার থেকে মাটি বিক্রি হয়। এক লড়ি মাটির দাম ৪০ হাজার টাকা। পশ্চিম মেদিনীপুরে চন্দ্রকোনা রোডে কুমোররা ১০০ ঘনফুট মাটি কেনে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। আবার সেই মাটিও খুব সহজে পাওয়া যায় না। ফলে মৃৎশিল্পীদের মুর্তির দাম ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। মৃৎশিল্প আমাদের গৌরব, এই শিল্প বাঁচানোর দরকার আছে। কিন্তু কিভাবে?
মাটি পেতে সমস্যা একাধিক। কুমোররা মাটি কেনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। আর প্রশাসন থাকেন কুমোর এবং তৃতীয় পক্ষের মাঝখানে। এছাড়া, মাটি বহনেও কিছু নিয়ম আছে। অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাক্টর বা গরুর গাড়িতে বা ইঞ্জিন ভ্যানে করে মাটি আনতে দেয় না প্রশাসন। বাধ্য হয়ে সাইকেল বা বাইকে করে মাটি সংগ্রহ করতে হয়। পরিবেশ ও মাটির জন্য জলাশয়গুলি রক্ষাও করতে হবে। সমস্যা মেটাতে প্রশাসনেরই উদ্যোগী হওয়া জরুরী। পরিবেশ বাঁচিয়ে জলা জমি রক্ষা করে কিভাবে কুমোরদের জীবিকা রক্ষা করা যায় তাই নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন প্রশাসনের।
চায়ের দোকানে প্লাস্টিক, চিনামাটির কাপ কিম্বা কাগজের কাপে চা বিক্রি হয়। মাটির ভাঁড়ের দাম বেশি বলে অনেক দোকানেই মাটির ভাঁড় ব্যবহার করতে চান না। তবে আশার আলোর দেখা যাচ্ছে তন্দুরি চায়ের জন্য। তন্দুরি চায়ে আগ্রহ বেড়েছে খদ্দেরের, চায়ের দোকানে ব্লগারদের আনাগোনা তাই। তন্দুরি চায়ের জন্য চাই মাটির ভাঁড়। প্রশাসনের প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার জন্য, ভাঁড়ের যোগান অনেকটাই বেড়েছে।
এখন নানা জিনিষের উপর পটচিত্র আঁকার চল হয়েছে, এতে উপার্জন বেড়েছে পটশিল্পীদের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানা ছোঁয়া পেতে রেস্তোরাগুলিতে মাটির থালায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করানো হচ্ছে। সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করা মাটির পাত্রগুলির শুধু ঐতিহ্য বা ব্যবহারিক দিক নয়, এতে ফুটে উঠেছে মৃৎশিল্পীদের শৈল্পীক দিকটিও।
কুমোরদের পুরনো পদ্ধতির চাকটিও বেশ ভারী, চালানোও শ্রমসাধ্য। আধুনিক উদ্যোগের যন্ত্রপাতি নিতে হবে, নিতে হবে সরকারি উদ্যোগ। যাতে শিল্পীদের উন্নয়নের রূপরেখা সঠিক দিশা পায়।
জীবিকাগুলি এখন সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। মৃৎশিল্পীদের ঘরে আধুনিক বংশধরেরা পড়াশোনা শিখছে এবং চেষ্টা করছে অন্য জীবিকা অবলম্বন করার। বংশগত জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি উৎসাহ খুবই জরুরী। বিভিন্ন মেলাতে ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে মাটির জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ‘লক্ষীভান্ডার’ কে পিগি ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য সরকারি উৎসাহ দরকার। কুমোরদের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষজনকে।।
তথ্যঋণ : আনন্দবাজার জেলা ক্যাম্পাস এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।
খুবই সুন্দর হয়েছে।