পুরুলিয়ার মাজরামুড়ার কামারপাড়ায় পটুয়াদের পুরনো মহল্লা। কথা হচ্ছিল, সারথী, ভারতী, দুলালী, মালাবতী চিত্রকরদের সঙ্গে। জানা গেল, মাজরামুড়ায় আসার আগে শিল্পীরা ছিলেন পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের নন্দাড়ায়। সেখান থেকে মাজরামুড়ার নমোপাড়ায় ডেরা বাঁধেন তারা। এখানে কতদিন আছেন জিজ্ঞাসার জবাবে সামনের একটা গাছকে দেখিয়ে দুলালী বললেন, ওই গাছটা যতদিন লাগিয়েছি ততদিন, মানে ৩৭-৩৮ বছর। গাছই যেন ক্যালেন্ডার! এখানে বৃক্ষ পুজোর চল আছে। গাছতলার বেদীতে হাতি, ঘোড়ার ছোট ছোট মানত পুতুল। পৌষ পরবে মনসার পুজো হয়। পটুয়ারা জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা পুরুলিয়ায় এসেছিলেন ওড়িশা থেকে।
চিত্রকর পরিবারের পূর্বপুরুষরা প্রাচীনকালে বাস করতেন মগধ সাম্রাজ্যে। আলাউদ্দিন খিলজী ভারত আক্রমণের সময় তারা ছড়িয়ে যান রাজস্থান, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র এবং দক্ষিণ ভারতে। তাদের এক পূর্বপুরুষ নিরঞ্জন পাটিকার (চিত্রকর) পরবর্তীকালে মাজরামুড়ায় বসবাস করতে শুরু করেন। সেই সময় কাশীপুরের রাজা পটুয়াদের কিছু জমি দেন। এরা এখানে বসবাস করছেন চার পুরুষ।
আজকের মাজরামুড়া
মাজরামুড়া গ্রামের জনসংখ্যা এক হাজারের বেশি। গ্রামে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্কুল, একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র, দুটি অঙ্গনওয়াড়ি। গ্রামের পড়ুয়ারা গৌরাঙ্গডি এবং তালাজুড়ি গ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে যায়। গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার। চিকিৎসার জন্য মানুষ যান কাশীপুর কলোনী গ্রামীণ হাসপাতালে। সেটাও বেশ দূরে। গীতাঞ্জলী প্রকল্পে ৫৩টি চিত্রকর পরিবারের জন্য বাড়ি ও একটি অঙ্গনওয়াড়ি তৈরি হয়েছিল ২০১৪ সালে। এছাড়া টিউবওয়েল, একটি কুয়ো, দুটি পুকুর প্রয়োজনীয় জলের সমস্যা মেটায়। শৌচাগার নেই, তা ব্যবহারের অভ্যাসও নেই। এই লেখার সময় অবধি ১৪ জন শিল্পী মাসে ১০০০ টাকা করে শিল্পীভাতা পাচ্ছেন। সবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হয়নি।
গাঁয়ের পুরুষরা সকাল ছ’টা, সাড়ে ছ’টার সময় বেরিয়ে যান, ফেরেন বিকেল চারটের সময়। তারা পট দেখাতে যান, পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বাঁকুড়ার ছাতনা, ঝাঁটিপাহাড়ি এলাকায়। মেয়েরা ঘরের কাজের পাশাপাশি পুরুষদের আঁকায় সহায়তা করেন। তারা ছেলেদের আঁকার দুটি রেখার মাঝখানে রঙ ভরেন। কামারপাড়া থেকে কিছু মানুষ পাশেই সরকারি আবাসন প্রকল্পে গেছেন। গোড়ার দিকে অনেক ঘরই খালি ছিল। স্থানীয় মানুষ এই জায়গাটার নাম দিয়েছেন, কলোনিপাড়া। টিলাগোছের একটু উঁচু জায়গা। রাতে চাঁদ উঠলে একদম সিনেমার দৃশ্য! তবে একটু ন্যাড়া, পুকুর কাটলে, গাছ পুঁতলে ভালো হয়।
জীবিকা ও পট
বৃহস্পতিবার ছাড়া এরা প্রতিদিনই অন্তত ৫/৬ ঘন্টার জন্য গ্রামের বাইরে পট দেখাতে বেরোন। গড়ে ১৫টির বেশি পরিবারের কাছে পৌঁছতে পারেন না। কারণ পটের গান গাইতে সময় লাগে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ টাকা রোজগার হয়। এছাড়াও পান প্রায় ৩ কেজি চাল এবং আলু, বেগুন ও অন্যান্য সবজি। তবে যমপট নিয়ে লোকের বাড়িতে গেলে রোজগার ভালো হয়। মৃত ব্যক্তির বাড়িতে যমপট দেখিয়ে এরা টাকা ছাড়াও পান কাঁসা, পিতলের বাসন, চাল ও কাঁচা আনাজ।
গ্রামে পট দেখানোর সময় এরা পরেন ধুতি আর সুতি কিংবা সিনথেটিক কাপড়ের সাদা পাঞ্জাবী। প্রত্যেকের সঙ্গে থাকে অন্তত তিনটি করে পট। অনেকের থাকে নিজস্ব সাইকেল। নিজের পট না থাকলে বা একটু পুরনো হয়ে গেলে অন্যের পটও নিয়ে যান কেউ কেউ। পটের কাহিনিগুলির সঙ্গে স্থানীয় মানুষজন পরিচিত। পটুয়ারা গ্রামে ঢুকলেই তারা বলেন, ‘আজ কি ঠাকুর আনলে’? বোঝাই যাচ্ছে ধর্মীয় কাহিনিমূলক পটই বেশি জনপ্রিয়। ওরা যেতেই লোকজন জড়ো হয়ে যায়, অনেকে পটের গান শুনতে শুনতে বিশেষ মুহূর্তে কপালে হাত ঠেকান। দর্শকদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। পট দেখানোর জন্য এরা দিনে সাইকেলে প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার ঘোরেন। তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আঁকার কাজে খুব একটা বেশি সময় দিতে পারেননা। গ্রামগুলিতে ঢোকেন তিনজনের একেকটি দল।
মাজরামুড়ার পট নিয়ে আগের তুলনায় লোকের আগ্রহ বেড়েছে। গ্রামে বাইরের লোকের আনাগোনাও বেড়েছে। পট বিক্রির অবস্থা আগের তুলনায় ভালো। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ফলে এদের দক্ষতাও বেড়েছে অনেক। সবাই যে সরকারি মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বা আমন্ত্রণ পেয়েছেন এমন নয়। সব জায়গার মত এখানেও দলাদলি আছে। গ্রাম থেকে যারা পাশে টিলার ওপর সরকারি আবাসনে গেছেন সেই কলোনি পাড়ার লোকেদের সঙ্গে রেষারেষি আছে গ্রামের লোকেদের। পুরনো চিত্রকর পাড়া এবং কলোনি পাড়ার বিবাদে এদের উন্নতি ব্যহত হচ্ছে। কিন্তু একটা ভালো ব্যাপারও ঘটেছে। মদ খাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। কিন্তু তার সঙ্গে বিবাদ মেটা বা না মেটার কোন সম্পর্ক নেই। জীবিকার কারণেই এরা অভ্যাস বদলাচ্ছেন।
জীবনযাপন
গ্রামের উৎসব বলতে শ্রাবণ মাসের শেষে ঘটা করে মনসা পুজো। সেদিন পাঁঠা বলি হয়, সেই মাংস প্রসাদ হিসেবে সব বাড়িতে যায়। এরা সবজি খান কম, মাছ মাসে এক-দুবার, মাংস কদাচিৎ। ছেলেমেয়েরা আইসিডিএস থেকে যে সমস্ত আলু, মটর পায় তাই দিয়ে এদের কয়েক দিন চলে যায়। বিকেলে একবার রান্না হয়। তার কিছুটা সবাই সন্ধ্যার আগেই খেয়ে নেন, বাকিটা খান পরেরদিন সকালে। খাওয়াদাওয়া কম তাই পুষ্টির অভাব শরীরে প্রকট। গ্রামে ১৫ বছরের মধ্যে ছেলেরা এবং ১৩ বছরের মধ্যে মেয়েরা বিয়ে করে নেয়। এরা নিজেদের হিন্দু বলেন, এদের দাহ হয়।
মানুষগুলো সৎ, নির্লোভ, হয়তো যমপট দেখিয়ে নিয়মিত মানুষকে নীতিশিক্ষা দেন বলেই। এলাকার মানুষরাও ওদের এই সততার সার্টিফিকেট দিলেন। বললেন, ওদের সামনে কোন জিনিস ফেলে রাখলেও সে জিনিস ওরা নেবে না। শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। খুবই খারাপ অবস্থা! বেশিরভাগ মানুষই বেশিদিন বাঁচেন না। অপুষ্টি ও অর্ধাহার এর একটা বড় কারণ। স্থানীয় মানুষদের মতে, ওরা মৃতের জিনিসপত্র বাড়িতে নিয়ে আসেন। চক্ষুদান পট দেখানোর সময় তাদের বাড়ির লোকেরাও মৃত ব্যাক্তির জিনিসপত্র ওদের দিয়ে দেন। স্থানীয়দের মতে, ওরা এমনকি চিতার আধপোড়া কাঠকুটোও রান্নার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসেন, এসব জিনিস থেকে রোগ ছড়ায়। এটা করেন বলে বহু মানুষ এদের বাড়িতে চা পর্যন্ত খেতে চান না।
অঙ্কনরীতি
মাজরামুড়ার পটে রঙের ব্যবহার কম। বাহুল্যবর্জিত সহজ গঠন এর বৈশিষ্ট্য। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চাদপটেও অলঙ্করণ এবং রঙের ব্যবহার কম। অন্যান্য জায়গার পটুয়াদের মত এরাও কালো রঙের রেখা দিয়ে ছবির সীমানা এঁকে নেন। এর সুবিধা হল, পটের জমিতে থাকা বস্তুগুলি খুব সহজেই নির্দিষ্ট করা যায়। সরু, লম্বা, কালো রেখায় মূল পটটি আঁকার পর তা রঙ দিয়ে ভরাট করা হয়। এই পটে সামনে থেকে আঁকা চরিত্র কম। বেশিরভাগ চরিত্রই পাশ থেকে আঁকা। মুখ সাধারণত প্রোফাইল, শরীর সামনে থেকে, পা দুটি দেখা যায় পাশ থেকে। বেশিরভাগ পটেই শিল্পীরা দু-তিনটি রঙ দিয়েই কাজ সারেন। এরা প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করেন। বাজারের রঙ ব্যবহার করেননা বললেই চলে। ঘন রঙের ব্যবহার তেমন নেই। সত্যি বলতে কি, রঙের ব্যবহারও এই পটে একেবারে অন্যরকম।
উপকরণ
গেরু পাথর দিয়ে গেরুয়া রঙ, হলুদ পাথর দিয়ে হলদে আর খড়ি মাটি দিয়ে সাদা রঙ বানান এরা। ভুষো কালি দিয়ে তৈরি করেন কালো রঙ। এছাড়াও সিম পাতা দিয়ে সবুজ, পুঁই মেটুলি দিয়ে বেগুনি, বটের কুঁড়ি দিয়ে গোলাপি এবং ফণী মনসার ফল দিয়ে বানান হয় লাল রঙ। নীল রঙ বানান নীলের ডেলা দিয়ে। রঙ তৈরির আঠা হিসেবে ব্যবহার করেন নিমের আঠা। এদের রঙ রাখার পাত্র বলতে নারকেল মালা, খাবড়া এবং ঝিনুকের খোলা। এদের মতে, ঝিনুকে রঙ গুললে একধরণের উজ্জ্বলতা আসে। তুলি বানান ছাগলের ঘাড়ের কাছের লোম দিয়ে।
এছাড়াও এরা নানাধরণের মাটি দিয়ে রঙ তৈরি করেন। কাঠকয়লা আর দূর্বা ঘাস দিয়ে তৈরি হয় কালো রঙ। কালো, হলুদ, নীল, গোলাপি, ধূসর ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বেগুনি রঙের ব্যবহার আছে এদের পটে। তুলনামূলকভাবে লালের ব্যবহার কম। রঙের আধিক্য ও উজ্জ্বলতা বাংলার অন্যান্য জায়গার পটের তুলনায় কম।
এরা জমি হিসেবে সস্তার কাগজ ব্যবহার করেন। ফুলস্কেপ কাগজ বা চার্ট পেপারই মূলত ব্যবহার করা হয়। পটের জমি পোক্ত বা দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যাপারে এদের কোন আগ্রহ নেই। তবে জলের হাত থেকে বাঁচাতে পটের শুরুতে ৮ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট পর্যন্ত সহজলভ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করেন। পটের দুদিকে থাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি দুটি হাতল। এতে পট গোটানো ও দেখানোর সুবিধা হয়।
মাজরামুড়ার পটের বিশেষত্ব
মাজরামুড়ার পট নিয়ে যেকোন লেখাই সেখানকার মানুষ ও জীবনের মত সরল ও সংক্ষিপ্ত। বেশিকিছু বলার নেই। আপনি চাইলেও তা বলতে পারবেন না। বিষয় ও অঙ্কনরীতি দুদিক থেকেই পুরুলিয়ার আদিবাসী গ্রাম মাজরামুড়ার পট সম্পূর্ণ আলাদা। এই পট আপনাকে মনে করিয়ে দেবে প্রাচীন আদিবাসী গুহাচিত্রের কথা। প্রতিটি ছবি গতিশীল, চরিত্রগুলির অভিব্যাক্তি অর্থবহ। প্রতিটি পটের রেখা ও ভাবনায় বিমূর্ততার ছাপ স্পষ্ট। আপনি বুঝতে পারবেন শিল্পীরা এসব ইচ্ছে করে করেননি, তা হয়ে উঠেছে। যমপটে থাকে মানবজীবনে পৃথিবীতে পাপ করা মানুষদের শাস্তিদানের বর্ণনা। চক্ষুদান পট বস্তুত মৃত্যুর পর স্বর্গে পৌঁছনোর একটা আদিবাসী বিশ্বাস বা রীতি। মাজরামুড়ার পটুয়ারা একটা কাগজে আঁকা মুখের ওপর চোখ এঁকে দেন। চক্ষুবিহীন পাঁচটা মুখের ছবি দিয়ে তৈরি হয় চক্ষুদান পটের একটা সেট। আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস পটুয়ার চক্ষুদানের পর মৃত ব্যক্তি স্বর্গের পথ খুঁজে পাবেন। এছাড়া সাঁওতালদের দেবতা মারাংবুরু কীভাবে সাঁওতাল আর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তা নিয়েও পট আঁকেন এরা।
পটের বিষয়
মাজরামূড়ার পটুয়ারা পুরোপুরি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। পুরাণের কাহিনি, মনসামঙ্গল কাব্য, মহাভারতের গল্প, সাঁওতালি উপকথার কাহিনি নিয়ে এরা পট আঁকেন। বেশিরভাগ পটই শুরু হয় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ছবি দিয়ে। কোন কোন জায়গায় রয়েছে রামের বর্ণনা। আবার হরিশচন্দ্র পালার মত কিছু পালার পট শুরু হয়েছে ‘জয় রাম রামায়ন’ দিয়ে। আবার মহীরাবণ বধ পালা শুরু হয় পাতালকালী বন্দনা দিয়ে। এদিক থেকে দেখতে গেলে মাজরামূড়ার পটে নীতিশিক্ষার ঝোঁক বেশি, তবে তার মধ্যে কোন মাস্টারি বা জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা নেই। এরা বিশ্বাস করেন যার যেমন পাপ, তার তেমন শাস্তি। মানুষকে পরকালে শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া যমপালার মূল বিষয়। এই পটের ছবিতে আছে মৃত্যুর পর যমরাজার দরবারে দোষী মানুষকে যমদূতদের শূলে চড়ানোর বীভৎস বর্ণনা। কিন্তু এই শিক্ষাদান, গল্প কিংবা আঁকার গতি ও আনন্দকে আত্মসাৎ করতে পারেনি।
অচেনা অ্যাঙ্গেল
মাজরামূড়ার পটে পাওয়া যায় চেনা কাহিনির অচেনা অ্যাঙ্গেল বা দৃষ্টিকোণ। রামায়ণের একটা পটে দেখলাম, রাম-রাবণের যুদ্ধে রামের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন বানরসেনারা। ছবিতে তাদের উপস্থিতিই বেশি। গাছ, পাথর এমনকি একটা গোটা পাহাড় তুলে তারা তেড়ে যাচ্ছে ভীষণদর্শন রাক্ষসরাজের দিকে। আমাদের অভ্যস্ত দেখা এবং শেখার ছবিটা এখানে এসে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। এদের পটে কর্ণ একটা পজিটিভ চরিত্র। তার নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি দুর্যোধনের পক্ষে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর না যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তিনি স্বধর্মে স্থির ছিলেন। দুঃসময়ে বন্ধুর ঋণ শোধ করতে তাঁকে দুর্যোধনের পাশে দাঁড়াতে হয়েছিল। এদের পটের কাহিনি অনুযায়ী নারায়ণ দুনম্বরী করে কর্ণকে স্বয়ম্বর সভায় জিততে দেননি। লক্ষ্যভেদের সময় নানা কারসাজি করেছিলেন।
শক্তিনাথ চিত্রকরের মদনমোহন লীলা পালায় বর্ণনা করা হয়েছে কৃষ্ণের জন্মের শুরু থেকে তাঁর নানা লীলা বা চমকপ্রদ কার্যকলাপের কাহিনি। একটা ছবিতে দেখলাম, গোপিনীরা বস্ত্রহরণের পর সবাই উলঙ্গ। বেঙ্গল স্কুল বা সাধারণ ক্যালেন্ডারের বস্ত্রহরণের ছবির মত তাদের গায়ে নামমাত্র সেঁটে থাকা সিক্তবসন নেই। সিক্তবসনা সুন্দরীরা নেই কেন, এব্যাপারে শিল্পীদের বক্তব্যও পরিস্কার। তাদের মতে, কৃষ্ণ তো ছল করে গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করেছেন। তাই তাদের গায়ে কাপড় থাকবে কি করে? মহীরাবণ বধপালার পট দেখালেন, মানিক চিত্রকর। তার ব্যাখ্যায় এখানে হনুমান মা কালীর পুজো দিচ্ছেন। তিনি গান গাইছেন ‘মাগো তুমি মা কালী, নমো নমো তুমি পাতালকালী’। পটের কাহিনি অনুযায়ী হনুমানই কালীকে পাতাল থেকে মর্ত্যে এনে কালীপুজো চালু করেন।
সৃষ্টি তত্ত্ব
সৃষ্টি তত্ত্ব আদিবাসী পটের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাউল চিত্রকর জানালেন, আমাদের দেবতা মারাংবুরুই শিব। শিবই সৃষ্টির উৎস। তাঁর ডান চোখের জল থেকে পুরুষ আর বাঁ চোখের জল থেকে মেয়ে। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, দেবাদিদেব মহাদেব খামোকা কান্নাকাটি করতে যাবেন কেন? বাউলের মতে, শিব কেঁদেছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ পিলচু হারাম আর পিলচু বুড়ির কান্ড দেখে! তিনিই চিত্রকরদের ছবি আঁকার আদেশ দিলেন। আদিবাসী সৃষ্টি তত্ত্বের পটে আছে পিলচু হারাম আর পিলচু বুড়ির নানা কাহিনি। হাঁসের ডিম থেকে পিলচু বুড়ি আর পিলচু হারামের জন্ম। তাদের সাত ছেলে, আট মেয়ে। পিলচু বুড়ি দেবতাদের কাছে নালিশ করলেন, বাঙালিরা হরিনাম করেন কিন্তু আমাদের নাম করবে কে? শিব আদেশ দিলেন, তোমাদের নাম করবে চিত্রকররা। বাঙালি, আদিবাসী সবার ঘরেই আমরা যাই। শুধু ভাষাটা আলাদা হয়ে যায়।
ইতিহাসে পট
সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে রচিত বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থে আমরা যমপট ব্যবসায়ীদের উল্লেখ পাচ্ছি। রাজা প্রভাকর বর্ধনের অসুখ শুনে হর্ষবর্ধন রাজধানীতে ফিরে আসতে চাইলেন। নগরের প্রবেশপথে দোকানের সামনে তিনি দেখেন, অনেকগুলি কৌতূহলী ছেলেকে একজন পট দেখাচ্ছেন। তিনি বাঁ হাতে ধরেছেন লম্বা লাঠিতে ঝোলানো পট, ডান হাতে রয়েছে অন্য একটা লাঠি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মহিষের পিঠে বসা যমের এক ভীষণ দর্শন মূর্তি। তার হাতে যমদন্ড আর চারপাশে ছোট-বড় চেহারার যমদূত। পটুয়া গাইছেন – মাতা পিতৃ সহস্রাণি পুত্রদারশতানি চঃ / যুগে যুগে ব্যতিতানী কস্য তে কস্য বা ভবান্।।
অষ্টম শতকের মুদ্রা রাক্ষসেও যমপটের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। নানা দেশের খবর সংগ্রহ করে পটুয়ারা ঢুকছেন চাণক্যের বাড়িতে। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম ও মালবিকাগ্নি মিত্র নাটক এবং ভবভূতির উত্তর রামচরিতেও পটের কথা রয়েছে। এই পটে গানের মাধ্যমে যার যেমন পাপ তার তেমন শাস্তি এই নীতিশিক্ষাটিকে পাপ অনুযায়ী নানা শাস্তির বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এই কাজের সঙ্গী হয় পটুয়াদের গতিশীল ছবি। শ্বশুর-শ্বাশুরিকে না খেতে দেওয়া, বাবা-মা’কে না দেখা, সবকিছুরই প্রতিফল যমপুরীতে গিয়ে মানুষ পায়। যমপটে থাকে সেসব দৃশ্য এবং তার জন্য শাস্তির বর্ণনা। “মা-বাবা কত কষ্টে মানুষ করিল, মা-বাপ বয়স হতে খাতে নাহি দিল।” যমপালার বহু জায়গাতেই আছে নারী-পুরুষের দর্পচূর্ণের বর্ণনা। আরেকটা কথা যমপালায় খুব বলা হয় – ‘আসবে একা যাবে একা, এই ভবে লোভ করে কী হবে?’ ‘ভালো কর্ম করিলে ভালো পাবে ফল, কুকর্ম করিলে যাবে জীবন বিফল।’ পটুয়ারা নিজেদের জীবনেও একথা মেনে চলেন। কাপিষ্ঠা গ্রামের বাসিন্দা বাসুদেব মাহাতো জানালেন, এদের ছোট থেকে দেখছি। আগে বাবা-কাকাদের সঙ্গে আসতো, ওরা ভীষণ সৎ। চুরি করেনা, সবজি, চাল, টাকা পয়সা যা পায় তাতেই খুশি। বেশি দিলেও নিতে চায় না। আবার চাষ, বাগাল ইত্যাদি কাজও করতে চায় না।
বোঝাই যাচ্ছে যমপট একটা বিশেষ শ্রেণীর পট। অনেকে মানুষের মনে ভয় জাগাতে পটের শেষে ন্যায়নিষ্ঠ জীবন না কাটালে ঈশ্বর শাস্তি দেবেন এই নীতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যমপট আঁকেন। অনেকে আবার যমলোকের কাহিনি নিয়ে পুরো একটা যমপট তৈরি করেন। সেখানে দেখা যায়, যমদরবারে চিত্রগুপ্ত তার খাতায় একটা মানুষের সারা জীবনের কার্যকলাপ লিখে রেখেছেন। মৃত্যুর পর যমদরবারে উপস্থিত হলে কৃতকর্ম অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ধর্মের জয়, অধর্মের পরাজয়, এটাই এই পটের শিক্ষা। তবে যমদরবারে কোন নির্দোষ শাস্তি পায় না। যমপটে একটাই সাধারণ বাণী – তা হল, সাবধান হও, অনৈতিক কাজ কোরো না। তাহলে যমরাজ শাস্তি দেবে। যমপটের গানেই রয়েছে এই শাস্তির বর্ণনাঃ
১) যে জন ছোট শিশুকে হত্যা করে।
যমরাজ তারে তপ্ত তেলে কড়ায় ফেল্যে মারে।।
২) নিজ স্বামী থাক্যে যে অন্য পুরুষে ধায়।
যমপুরীতে যায়্যে সে উচিৎ শিক্ষা পায়।।
৩) রবিপুত্র যমরাজ যম নাম ধরে।
বিনা দোষে কারো বিচার না করে।।
চক্ষুদান পট
মাজরামূড়ার পটের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, চক্ষুদান পট। এই পট মূলত একটা ছোট চিরকুট সাইজে মৃত ব্যক্তির মুখের ছবি। এই মুখে চোখ থাকে না। আদিবাসী বিশ্বাস অনুযায়ী পটে মৃত ব্যক্তির চোখ না আঁকলে তিনি স্বর্গে যেতে পারবেন না। কাগজের ওপর চোখ আঁকার এই ছবিকে বলা হয় চক্ষুদান পট। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আদিবাসী আচার। মৃত্যুর পর পটুয়ারা খবর পাওয়া মাত্রই মৃত ব্যক্তির বাড়িতে পৌঁছে যান। তাদের চোখ আঁকার জন্য অর্থ ছাড়াও মৃত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেওয়া হয়। চক্ষুদান পটেরও গান রয়েছে, তবে সেই গান এখন খুব কম লোকই জানেন।
চক্ষুদান পটের ছবির ধরণটা অনেকটা কালির আঁচরের মত। পটুয়া মৃতের নিকট আত্মীয়কে সে ছেলে, মেয়ে, বউমা যে কেউ হতে পারে, হলুদ, কাজল, দিয়ে চক্ষুদান করে পটটি ধান,দূর্বা দিয়ে বরণ করে নিতে বলেন। এরপর পটুয়া পটগুলি বাড়ির লোককে দিয়ে দেন। তা গঙ্গায় অস্থির সঙ্গে বিসর্জন করা হয়। আকারে এটা চৌকো পট তবে পুরোপুরি চৌকো নয়, অনেকটা আয়তাকার। এই পটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এর চারপাশে মার্জিন থাকে না। চক্ষুদান করার পর পটুয়া মৃত ব্যক্তির সাংসারিক জীবন, পারিবারিক অবস্থা, ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি মৃত্যুর আগে তাকে কে কেমন যত্ন করেছে, কোন পথে তার মৃত্যু হয়েছে(চোখ, মুখ) এবং মৃত্যুর পর সে কোথায় যাত্রা করেছে, বৈকুণ্ঠলোক বা যমলোক এসব ব্যাপারে বাড়ির লোককে জানান। অবশ্য বেশিরভাগই বলেন, বৈকুণ্ঠলোক কারণ এতে ভালো দক্ষিণা মেলে। পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির পারিবারিক জীবন সম্পর্কে সব তথ্য নিখুঁতভাবে বাড়ির লোককে জানান। এমন সব কথা তারা বলেন, যা মৃতের নিকট আত্মীয়রাও জানেন না।
মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে তারা এত তথ্য কীভাবে সংগ্রহ করেন সে প্রশ্নের জবাবে পটুয়ারা জানান, ‘রাতের বেলা শোওয়ার সময় মাথার কাছে একটা কাঁসার থালায় হলুদ জল নিয়ে ঘুমোই। কেউ মারা গেলে থালার জলে উনার ছবি ওঠে। তখন উনার কাছে সব খোঁজখবর জান্যে লিই।’ তবে সবাই এই ছবি দেখতে পায় না। নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে জীবনযাপনকারী পটুয়ার কাছে মৃত ব্যক্তির ছবি ওঠে। এমনকি কোন অভিলাষ থাকা অবস্থায় যদি মানুষটি মারা যায় সেই জিনিসগুলি গরিব মানুষকে দান করে দেওয়ার কথাও পটুয়ার মাধ্যমে তিনি বাড়ির লোককে জানিয়ে দেন। তবে এখন কোন ব্যক্তির ছবিই পটে ওঠে না। আবার উঠলেও অনেকেই তা দান দক্ষিনার ভয়ে চেপে যান।
এসব বিষয় ছাড়াও যমলীলা, কর্ণলীলা, হরিশচন্দ্র, মহাভারত, মনসা, কৃষ্ণের অষ্টাত্তর শতনাম, ভক্ত রুইদাস এর জীবন নিয়ে পট আঁকেন মাজরামুড়ার পটুয়ারা। বসন্ত, হাম ইত্যাদি অসুখবিসুখের সময় দেখানো হয় শীতলা পট। সহজ অঙ্কনরীতি, সরল গল্প দিয়ে মাজরামুড়ার পট তার দর্শকদের নিয়ে যায় এক জাদু বাস্তবতায়। বলে, সৎ-অসৎ, ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্যয় মেশানো এক মানবজীবনের কথা। এই পটের দর্শকরা একথা বিশ্বাস করেন। এখানে তর্কে বহুদূর যাওয়ার কোন ব্যাপারই নেই। সরলরেখায় আঁকা এই বিশ্বাস এর দর্শকদের মর্মে গাঁথা রয়েছে। ছবির সত্য তাদের কাছে জীবনের সত্য হয়ে ওঠে।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত