“কধুরখীল থেকে কাদা ভেঙে গোমদন্ডী চলেছি। জায়গাটা অজ পাড়াগাঁ। রাস্তার দুপাশে জঙ্গলের জটলায় আকাশ আছে কি নেই টের পাওয়া যায়না। দু-পা গেলেই একটা করে এদোঁ ডোবা, তার একগলা শ্যাওলা। শুকনো পাতা জলে ভিজে বাতাসে পাঁক পাঁক গন্ধ। একটু এগিয়ে বাঁ হাতে ছ্যাতলা পড়া একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা। এই রাস্তার শেষে কবিয়াল রমেশ শীলের বাড়ি। রমেশ শীলের নাম জানে না চাটগাঁয়ে এমন গাঁ নেই।” ১৯৮৮ সালে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনির প্রকাশিত “বাংলা আমার বাংলাদেশ” নামক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ভ্রামনিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা সমৃদ্ধ গদ্য লেখা থেকে সম্প্রতি পঠিত উদ্ধৃতাংশটি আমাকে সত্যিই এক অজানা রোমাঞ্চে শিহরিত করে তুলল। ভাবা যায় রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের যশস্বী একজন কবি, যাঁর অনেক কবিতার পংক্তি এখনো মানুষকে উদ্দীপ্ত করে সেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৪৪ সালে বোয়ালখালীর গ্রামে গ্রামে আমাদের চিরচেনা পথে প্রান্তরে কাদামাটিতে হেঁটেছেন চারণ কবির মেজাজে ও আকন্ঠ বিপ্লব পিপাসায়। এক ধরনের সুখানুভূতি ও নস্টালজিয়ায় আমার হৃদয় মন আপ্লুত হচ্ছে এই ভেবে যে, বোয়ালখালী উপজেলা সে সময় বিপ্লবী রাজনীতি ও প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চায় এতই এগিয়ে ছিল যে, এই বোয়ালখালীর পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন সুভাষ, সুকান্ত প্রমুখ বাংলার প্রগতি সাহিত্যের দিকপালরা। গ্রাম বাংলার প্রবহমান জীবনের অন্দরে-বাহিরের সেই ভাল-মন্দ, স্পষ্ট-অস্পষ্ট, ব্যর্থ-চরিতার্থের জটিল সংমিশ্রণ থেকে তিনি খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন জীবনের উপাদান। সংগ্রহ করেছেন তাঁর কথা ও কাব্যের অনবদ্য সব আখ্যান। “পদাতিক” পথিকের এই পথ চাওয়াতেই ছিল অপার আনন্দ। এপার বাংলায় ফেলে যাওয়া বাস্তুভিটা ও এর বিস্তীর্ণ জনপদ পরিভ্রমণের স্মৃতি ও নস্টালজিয়া থেকে ১৯৫৪ সালে লিখছেন-
দুয়োরে খিল।
টান দিয়ে তাই
খুলে দিলাম জানালা।
ওপারে যে বাংলাদেশ
এপারেও সেই বাংলা।
এই বাংলার পথ চলতি সহজ কথাগুলো অত্যন্ত সহজিয়া সুরে উঠে এসেছে পদাতিকের কবিতায়, উপরোদ্ধৃত তাঁর গদ্যের মত অসংখ্য সব লেখায়। ফেলে আসা জীবনের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, অসুন্দর-বৈষম্যকে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে তুলে ধরেছেন অসংখ্য কবিতায়, ছন্দের ব্যতিক্রমী দক্ষতায়। তিনিই পথিকের জবানিতে গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে বলতে পারেন-
রাস্তায় ছোট ছোট গর্তে
জমানো ছিল
আমাদের চোখের জল
একটুও না দাঁড়িয়ে
তার ওপর দিয়ে
লাফাতে লাফাতে চলে গেল
সময়।
শুধু একজন হাঁটু মুড়ে
নিচু হয়ে
জলে পড়া আকাশটাকে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয়-
কে সে? তিনি কি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা কোন সমাজকর্মী? নাকি কবি নিজে? বিংশ শতাব্দীর ৩০ এবং ৪০ এর দশক সারা পৃথিবীর জন্য যেমন আমাদের এই উপমহাদেশের জন্য বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার জন্যও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি এ সময়ে আত্মনির্ভর ও স্থিতিশীল হয়ে উঠে অন্যদিকে পুঁজিবাদের ইতিহাস খ্যাত “মহা সংকটের” পরপরই ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে মুসোলিনির সাথে মিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা শুরু করে। সে সময়েই চট্টগ্রামে মাষ্টার ’দার নেতৃত্বে সংঘটিত যুব বিদ্রোহের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র বিশেষত বাংলার যুব সমাজের মধ্যে। ’৪২ সনের ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ’৪৩ সালের মন্বন্তর, ’৪৬ এর অভাবনীয় দাঙ্গা, ’৪৭ এ দেশভাগ এ ছিল চল্লিশের দশকের কবিদের সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমি। সাম্রাজ্যবাদী দুঃশাসন ও ফ্যাসিবাদী উত্থানের প্রতি ঘৃণা ও আতংক থেকে এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতি মুগ্ধতায়, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত কবি-সাহিত্যিকরা এসময় মার্কসীয় সাহিত্য ভাবনায় অনুপ্রাণিত হন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আহবানে প্রগতিশীল বৃটিশ লেখক কডওয়েল, রালফ ফক্স ও স্পেনের লোককবি লোরকার আত্মদান অভিভূত করে তোলে তাঁদের। ৩০ এর দশকেই গঠিত হয় প্রগতি লেখক সংঘ। বলতে গেলে চল্লিশের দশকে বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব কবি ও লেখকরা বাম ভাবধারা ও ফ্যাসিবিরোধী সোভিয়েতের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের সাফল্যে প্রাণিত হন। বুদ্ধদেব বসুর মত কমিউনিস্ট বিরোধী কলা কৈবল্যবাদী শক্তিমান লেখক ও কবি পর্যন্ত “সভ্যতা ও ফ্যাসিজম” নামক বিখ্যাত এক প্রবন্ধে ফ্যাসিজমের তথা প্রচলিত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে বিবেকবান কবি-সাহিত্যিকদের সভ্যতা ও মানবিকতার প্রয়োজনে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে রক্ষার সংগ্রামের পথে নামার আহ্বান জানান। কিন্তু মার্কসীয় ভাবাদর্শে তথা বস্তুবাদী নন্দনতত্ত্বে বিশ্বাসী খ্যাতিমান লেখক শিল্পী সাহিত্যিক গোপাল হালদার, বিষ্ণু দে, সমর সেন, মনীন্দ্র রায়, গোলাম কুদ্দুস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে দৃঢ়ভাবে সেদিন সমাজ প্রগতির সংগ্রামে অংশ নেন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিজয়ের সাথে তাঁরা আমাদের দেশেও শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উদ্বেলিত হন এবং গল্পে-নাটকে-কবিতায় তা নানাভাবে প্রকাশ করে পরিবর্তন প্রত্যাশী দ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই হল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখক ও কবি হয়ে উঠার সময় ও পটভূমি। তিনি কবিতার ভাষা ও প্রকরণে, প্রকাশের চমক ও চমৎকারিত্বে, কবিতার উপাদান ও উদ্দিষ্টের অনন্যতায় বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৯৪০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশের পরপরই বাংলা সাহিত্যের সে সময়ের সবচেয়ে বোদ্ধা সমালোচক বুদ্ধ দেব বসু বললেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে বোধ হয় প্রথম বাঙালি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন শুরু করলেন না এমনকি প্রকৃতি নিয়েও কবিতা লিখলেন না। দ্বিতীয়ত শ্রী বসু “পদাতিকের” অসামান্য ছন্দের প্রকরণ ও কাব্যকৌশলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বললেন যে প্রথম কবিতার বইয়ের মাধ্যমেই সুভাষ অনেক অভিজ্ঞ কবিদের ছাড়িয়ে গেছেন। ছন্দ বিশেষজ্ঞ, সাহিত্য সমালোচক প্রবোধ চন্দ্র সেন সুভাষের কাব্য প্রকরণ নিয়ে “বাংলা ছন্দের নতুন সম্ভাবনা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে ফেললেন সুভাষের সহজাত প্রতিভা ও বৈদগ্ধ্য নিয়ে, ছন্দের কারুকার্য নিয়ে।
মার্কসীয় সমাজ ভাবনায় ঋদ্ধ, বিপ্লবী মানবতাবাদে অনুরণিত, পার্টির নিবেদিত তরুণ কর্মী ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চল্লিশের দশকেই ‘পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট” নামে পর পর তিনটি কবিতার বই প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিমান কবি হিসাবে জায়গা করে নেন। “পদাতিক” এর প্রত্যেকটি কবিতার মধ্যে ফুটে উঠে তাঁর যৌবনদীপ্ত আবেগ যে আবেগ সামষ্টিক কল্যাণ ভাবনায় প্রাণিত। সে সব কবিতায় স্বরে ও ব্যঞ্জনায় এক অদৃষ্টপূর্ব কাব্যিক প্রত্যয়ের উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়। “পদাতিক” নামক কবিতায় লিখছেন “যেখানে আকাশ চিকন শাখায় চেরা/চলো না উধাও কালেরে সেখানে ডাকি/ হা হতোস্মি সড়কে বেঁধেছি ডেরা/মরীচিকা চায় বালুচরী আত্মা কি? এর পাশাপাশি দেখি “মে দিবসের কবিতার” বিখ্যাত সেই লাইন-
চিমনির মুখে শোনো
সাইরেন শঙ্খ
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে
তিলতিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।
“অগ্নিকোণ” এ শুনি কবির বিপ্লবী সংগ্রামের আহ্বান-“দিন এসে গেছে/লাঙলের ফালে আগাছা উপড়ে/ফেলবার। দিন আসে ভাই- কাস্তের মুখে নতুন ফসল তুলবার”। “চিরকূট” এ দেখি একই ভাষা একই অভিব্যক্তি ও প্রত্যয়-
“ঐক্যবদ্ধ জনতার হুংকৃত জোয়ারে/ চোখের পলকে ভেসে যাবে/অহংকৃত মুখের চুরুট”। এ তিনটি কাব্যগ্রন্থকে সুভাষের কাব্যসৃষ্টির প্রথম পর্যায় বলা যেতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টির একজন আত্ম নিবেদিত কর্মী ও সদস্য হিসাবে তাঁর জীবন ভাবনার পরিচয় এখানে পাই। এর কিছুদিন পরেই তিনি জেলে যান এবং পার্টির কাজের চাপ, বিপ্লবী ভাবনা উৎসারিত অস্থিরতায় কিছু দিনের জন্য লেখালেখি ছেড়ে দেন।
এরপরেই দেখতে পাই তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদ করছেন সুভাষ, যে অনুবাদ তাঁর কাব্যিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞায় নিছক ট্রান্সলেশন থেকে সত্যিকার অর্থে ট্রান্সক্রিয়েশনে উন্নীত হয়েছে। শুধু নাজিম হিকমত নয় তিনি অনুবাদ করেছেন নেরুদা, লোরকা, ভাৎসারভ, সলজেনিৎসিন সহ বিশ্ব সাহিত্যের নাম করা সব প্রগতিশীল কবিদের কবিতা। অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন নিবিষ্ট কর্মী বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। মার্কসীয় আদর্শে প্রাণিত বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতা শুধু নয় তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম কাব্য চর্যাপদের বাংলা অনুবাদ করেন, অনুবাদ করেছেন গাথা সপ্তশতী। তিনি চেনাতে চেয়েছেন প্রাচীন বাংলা কাব্যের জীবন ঘনিষ্ঠ, মৃত্তিকা সংলগ্ন ভাবনা ও ঐতিহ্য। নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদ সুভাষের কাব্য প্রকরণ পাল্টে দেয়, কাব্য ভাবনাকে করে আরও সংহত। প্রথম পর্বের তুলনায় উপমা- উৎপ্রেক্ষায় সংযত হয়ে আসে পরবর্তী কাব্য সৃষ্টি ও ভাবনা। এরপরে প্রকাশিত হয় “ফুল ফুটুক” নামক কাব্যগ্রন্থ, যার বিখ্যাত কয়েকটি পংক্তি মানুষের মুখের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে- “ফুল ফুটুক/ না ফুটুক/আজ বসন্ত”। এরপরেই বেরুল যতো দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬), এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২) ইত্যাদি কবিতার বই। প্রথম জীবনের আবেগধর্মী রাজনৈতিক কর্মীর সহজ উচ্ছ্বাসের স্থলে কবিতা ক্রমে স্থিতধী হয়ে উঠতে থাকে- আঙ্গিকে ও স্টাইলে। “ফুল ফুটুক” এ “লাল টুকটুকে দিন” কবিতায় লিখছেন “তুমিই আমার মিছিলের সেই মুখ/এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাকে খুঁজে বেলা গেল/ ফিরে দেখি সে আগন্তুক/ ঘর আলো করে বসে আছে পিলসুজে”। এ যেন প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের অন্তর্মুখীযাত্রা। “কাল মধু মাস” কাব্যের “আমার কাজ” কবিতায় লিখছেন “আমাকে কেউ কবি বলুক/আমি চাই না, কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে/জীবনের শেষদিন পর্যন্ত/ যেন আমি হেঁটে যাই/আমি যেন আমার কলমটা/ ট্রাক্টরের পাশে নামিয়ে রেখে বলতে পারি এই আমার ছুটি”। কিন্তু তাঁর সাময়িক এই ছুটি তাঁকে বেশিদিন সাহিত্যের জগত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি আবার কলম তুলে নিয়েছেন, ফিরে এসেছেন দ্রুত তাঁর সৃজনশীলতার মায়াবী জগতে। পার্টির মধ্যে অনেকেই হয়তো পছন্দ করেনি তাঁর কাব্য-প্রকরণ, নির্যাস ও স্বাধীনচেতা কাব্যাদর্শ। কিন্তু তিনি কোনদিন তা খুব বেশি গ্রাহ্য করেননি বিপ্লবী মানবতাবাদে তাঁর দ্বিধাহীন কমিটমেন্টের কারণে। বিরুদ্ধ সমালোচনার মুখে ‘যতো দূরেই যাই” কাব্যের একটি কবিতায় লিখছেন “যে চক্রান্ত/ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে/ তাকে নখের ডগায় রেখে/ পট করে একটা শব্দ তোলো/ দরজা খুলে দাও/লোকে ভেতরে আসুক। মুখুজ্যে, তুমি লেখো।” তিনি লিখে গেছেন পায়ে পায়ে, পাথরের ফুল, মেজাজ, মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ, আশ্চর্য কলম, টানা ভগতের প্রার্থনা ইত্যাদি বক্তব্য ও আঙ্গিকের দিক থেকে অসাধারণ সব কবিতা। ফর্মের দিক থেকে করেছেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সুভাষের কাব্য জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ছড়া। ১৯৮০ সালে এসে অনেকটা পরিণত বয়সে বেরুল তাঁর ছড়া সংগ্রহ। আমরা জানি ছড়া অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠ শিল্প মাধ্যম। ছন্দ আর কথার এ যেন অনিবার সমাহার। এতেও সুভাষের সিদ্ধি মেলে। যেমন “সিঁড়ি রেলিং আলসে/দাদুর চোখে চালশে”, আমড়া তেঁতুল জলপাই/গরম দুধে বল পাই ইত্যাদি।
বাংলা কাব্য জগতে ১৯৪০-এর দশকে প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের মধ্যে অনেকটা স্তালিনীয় নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাবে সৃষ্ট মার্কসীয় সাহিত্য বিতর্কের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। প্রলেতারীয় সাহিত্যের স্বরূপ নিয়ে হীরেন মুখার্জি, ভবানী সেন, গোপাল হালদার, প্রমুখ অবস্থান নেন সোভিয়েত পার্টির সাংস্কৃতিক বিভাগের তৎকালীন প্রধান ঝানভের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গী তথা যান্ত্রিক প্রগতিশীলতার পক্ষে। তাঁরা এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও প্রগতিবিরোধী বলে অভিহিত করেন। আবার মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, চিম্মোহন সেহানবীশ প্রমুখ লেখক শিল্পীরা বিপ্লবী মানবতাবাদী কমিটমেন্ট থেকে সাহিত্যে মতাদর্শিক যান্ত্রিকতাকে মানতে চাননি। তাঁদের মত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও আমৃত্যু যান্ত্রিকতার চাপে, বিধি-নিষেধের ডোরে সাহিত্যিক সৃজনশীলতাকে স্তব্ধ হতে দেননি। পরবর্তীতে পার্টির দ্বিধা বিভক্তির সময়েও তিনি তাঁর সহজ ও অনাবিল কাব্যিক মূল্যবোধ দৃঢ় ছিলেন । ১৯৬৪ সালে পার্টির বিভক্তির পর পশ্চিমবঙ্গের পার্টির সামনের সারির প্রধান প্রধান শিল্পী সাহিত্যিক গোপাল হালদার, বিষ্ণু দে, হীরেণ মুখার্জী প্রমুখের মত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সিপিআইতে থেকে যান। ভাতিন্ডা কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিপিআই পশ্চিমবঙ্গে “সিপিএম” নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারে যোগ দেবার পরে তিনি পার্টি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট তথা সিপিএম এর ক্যাডারদের পার্টির কালচার বিরোধী কর্মকাণ্ড, গণবিচ্ছিন্নতা এবং ক্ষমতাচ্যুতির পর বর্তমান অবস্থান ও বিপর্যয় সুভাষের অবস্থানের যথার্থতা প্রতিপন্ন করে। মারাত্মক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কংগ্রেসের শক্তিহীনতা যে বাম আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপট ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে, ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতিকে যে হুমকির মধ্যে ফেলে দেবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অন্য অনেক বামপন্থীদের এ শংকা আজ সত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। প্রকাশ কারাতদের প্রভাবান্বিত বাম রাজনীতি ও বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ সুভাষ ১৯৯১ সালে “ধর্মের কল” নামক কাব্যে লিখেছেন- “সরকারকে সেলাম/ না করলে গেলাম”। যে পার্টি ও রাজনীতির জন্য আজীবন লিখেছেন, জেলে গেছেন তাঁর পচন ও পতন দেখে লিখেছেন-
“মনে রেখো বাপসকল/লাঠিকে তোল্লা দিলে নিশান হয়/নিশানকে ওল্টালে লাঠি”। তাঁর এই প্রতিবাদী অবস্থানের জন্য তাঁকে কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু তিনি বলছেন “আমি জটায় বাঁধছি বেদনার আকাশ গঙ্গা”। তাঁর সেই ক্ষোভ ও দুখের সহজ প্রকাশ দেখি অন্য একটি বিখ্যাত কবিতায় “ফুলগুলো সরিয়ে নাও/আমার লাগছে/মালা/জমে জমে পাহাড় হয়/ফুল জমতে জমতে পাথর/পাথরটা সরিয়ে নাও”। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রতি তিনি ছিলেন আজীবন অনুরক্ত। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে একটি সহনশীল সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য গ্রহণ বর্জনের বিবেচনা প্রসূত পথে চলতে তিনি ছিলেন সদাসচেতন। তিনি লিখছেন “আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/নিকোনো উঠোনে/সারি সারি/লক্ষীর পা/ আমি যতো দূরেই যাই” সর্বজনীন সংহতি, সাম্প্রদায়িক সহমর্মীতার গভীর ব্যঞ্জনা ফুটে উঠে কবিতার পর কবিতায়-
“দেখো, জপমালা হাতে/তোমার মা আর আমার আম্মা/জগত জোড়া সুখ আর দুনিয়া জোড়া শান্তির জন্য/ একাসনে/ একাকারে প্রার্থনা করছেন”। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অব্যাহত ধারালো আক্রমণ অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার উত্তাল অগ্রযাত্রায় দীপ্ত ১৯৬০ এর দশকের প্রোজ্জ্বল প্রতিবাদী প্রেক্ষাপট, স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা, চীনা নেতৃত্বের কমিউনিস্ট ঐক্য বিরোধী অবস্থান, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ও বিভ্রান্ত মাওবাদের পরাজয়, ৯০ পরবর্তী বিশ্ব সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় সব মিলিয়ে আশা-নিরাশার টাল-মাটাল বৈপরীত্যের মাঝে আপন বিশ্বাস ও কর্তব্যে স্থির সুভাষ পরপর লেখেন “এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২), একটু পা চালিয়ে ভাই (১৯৭৯), জল সইতে (১৯৮১), ধর্মের কল (১৯৯১), শেষ পর্যন্ত ছড়ানো খুঁটি (২০০১) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পথে বিশ্বব্যাপী নানা চলমান ঘটনার নিস্পৃহ, নির্মোহ প্রতিচ্ছবি আমরা এসব কবিতায় দেখতে পাই।
সময়ের সাথে সব বদলায়, বদলায় বিশ্বাস, মতাদর্শিক অবস্থান ও ভাবনার অভিমুখ। পৃথিবীর রাজনৈতিক ভূগোল পাল্টেছে কিন্তু তাই বলে মুক্তির শাশ্বত আকাঙ্ক্ষা একটুও পাল্টায়নি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত যৌবনের সেই রাজনৈতিক কাঠামোতে ছিলেন না বটে কিন্তু সত্য, শিব, সুন্দরের সাধনায়, মানব মুক্তির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে যাননি। শেষ পর্যন্ত স্থির ছিলেন নিজস্ব অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতিতে। তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রশ্নে ছিলেন সৎ ও আন্তরিক। তিনি এই বৈষম্য ভারাক্রান্ত সমাজ বদলে মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ বিনির্মাণের মহান সংগ্রামে নিবেদিত ছিলেন কর্মে-মননে, প্রতিজ্ঞা ও প্রকাশে। সে লক্ষ্যে কবিতা তাঁর কাছে ছিল প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার। সুকান্তের মতই এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার দৃঢ় অঙ্গীকারে স্থির ছিলেন আমৃত্যু। প্রলেতারীয় সাহিত্য সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপকার, বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে জননন্দিত কবি সুভাষিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক; প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট