সোমবার | ২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:২২
Logo
এই মুহূর্তে ::
পীযূষ পাঠ প্রস্তাব : ড. পুরুষোত্তম সিংহ চর্যাপদে সমাজচিত্র : নুরুল আমিন রোকন বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (শেষ পর্ব) : আবদুশ শাকুর ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর অনন্য লেখক মানিক : ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (একাদশ পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভেটকি থেকে ইলিশ, চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, হুগলির মাছের মেলায় শুধুই মাছ : রিঙ্কি সামন্ত দিল্লি বিধানসভায় কি বিজেপির হারের পুনরাবৃত্তি ঘটবে : তপন মল্লিক চৌধুরী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন — বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দশম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুর ও তৎকালীন বঙ্গসংস্কৃতি : অসিত দাস দধি সংক্রান্তি ব্রত : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (নবম পর্ব) : আবদুশ শাকুর সপ্তাহে একদিন উপবাস করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো : অনুপম পাল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র ভাষা : ড. হান্স্ হার্ডার সবগুলো গল্পেই বিজয়ার নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলের ছাপ রয়েছে : ড. শ্যামলী কর ভাওয়াল কচুর কচকচানি : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (অষ্টম পর্ব) : আবদুশ শাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল ও দ্বারকানাথের ধনপ্রাপ্তি : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পৌষ পার্বণ ও মকর সংক্রান্তির শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

পীযূষ পাঠ প্রস্তাব : ড. পুরুষোত্তম সিংহ

ড. পুরুষোত্তম সিংহ / ১৮ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

চেতন-অবচেতন-অর্ধচেতন অবস্থা নিয়ে ব্যক্তির যে অবস্থান সেই সমূহ সত্যকেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন পীযূষ ভট্টাচার্য। ঘুম-নিদ্রাভঙ্গ-তন্দাচ্ছন্নতা, স্বপ্ন-স্বপ্নময়তা-স্বপ্নে ভেসে যাওয়া ও স্বপ্ন থেকে প্রখর বাস্তবে উত্তরণ আবার বাস্তবকে ফাঁকি দিতে স্বপ্ন, অলীক জালে বন্দির মধ্য দিয়ে গল্পসজ্জা নির্মিত হয়েছে। সময় সম্পর্কে প্রখর জ্ঞান, তীব্র রাজনৈতিক বোধ ও সময়ের কালগ্রাসে দংশনক্ষত মানুষের বহুস্বরিক বিন্যাসকে তিনি ধরতে চেয়েছেন। জন্ম-মৃত্যুর রহস্য, যৌনতা, যৌন অক্ষমতা, বহুমুখী ইঙ্গিত ও ভাঙা মানুষের আর্তনাদকে যে ভাষায় ও বয়ানে উপস্থিত করেছেন তা বাংলা আখ্যানে নতুন। প্রচলিত গল্পের যে কাহিনি তা পীযূষ ভট্টাচার্যে খুঁজতে গেলে হোঁচট খেতে হবে। কাহিনির বদলে তিনি কেবলই জীবনের বাক্‌ আবিষ্কার করেন। সেখানে একটা ঘোর আছে। মিথ থেকে লোকপুরাণ, সময় থেকে ভূগোল, যৌনতা থেকে জীবনের দাবি-অক্ষমতা, জেদ-বিদ্রোহ নিয়ে মরাডালের ভাঙাকথন যেন এক ঔন্দ্রজালিক রুক্ষ বাস্তবতা সহ প্রাধান্য পায়। সমস্তের মধ্য দিয়ে তিনি একটা নিজস্ব তত্ত্ব উপনিবেশ খুঁজে চলেন। যা নিজস্ব বীক্ষণে ভাস্কর। প্রচলিত তত্ত্ব বা জীবন সম্পর্কিত মূল্যায়ন জীবনের বহুবিধ পাঠশালায় প্রয়োগ করতে গিয়ে বহুক্ষেত্রেই উত্তর মেলে না, সেই সমূহ ভুলকে সঙ্গী করে একটা নিজস্ব উপনিবেশ দাঁড় করান।

লেখক নির্মিত বয়ানকে লেখকের মতো করেই বুঝতে হবে এমন কোনো ফরমান উত্তর আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব রেখে যায়নি। সন্দর্ভকে সামনে রেখে প্রতিসন্দর্ভ গঠনের মধ্য দিয়েই লেখকের মুক্তি আসে। এক বয়ানকে সামনে রেখে পাঠক বহুবিধ সত্যকে আবিষ্কার করে নিজের পাঠসত্তাকে জানান দেবে এটাই সত্য। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল একজন লেখকের বয়ান কীভাবে ভিন্ন প্রতিসন্দর্ভ জানান দেবে। টেক্সটের ভিতরে যে কারুকাজ, তাৎপর্যময় ভাষ্য, জীবনস্রোত ও বিশ্লেষণ তাই বিবিধ সত্যের জন্ম দেয়। পীযূষ ভট্টাচার্য তেমনই একজন গল্পকার যার বয়ান নিয়ে সমস্ত পাঠক এক সত্যে নাও পৌঁছাতে পারেন। বয়ানকে সামনে রেখে পাঠকের প্রতিসন্দর্ভে মনন মেধা জানান দেবার যে বিস্তৃত পরিসর একজন লেখক রেখে যান সেইখানে লেখকের কালোত্তীর্ণতা। পীযূষ ভট্টাচার্য তেমনই একজন বিরল গোত্রের গল্পকার।

পীযূষ ভট্টাচার্য একরৈখিক কাহিনি দাঁড় করাতে চাননি। তিনি সময়কে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। সেই সময় লোকপুরাণ, লোকশ্রুতি ও জনপদজীবনের গভীর তল দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশ্বাস-সংস্কারকে বহন করে এগিয়ে গেছে। রাজনীতি, সময়-ইতিহাস, লোকাল পার্টি, গত শতকের সাত-আটের দশকের গ্রাম্য রাজনীতি, আইন, গ্রাম্য উৎসব, নদীর চালচিত্র, জমির চরিত্র, বর্গা, ভাগচাষি সমস্ত মিলিয়ে বড় সত্যকে আবিষ্কারে মত্ত থাকেন। সেই সত্য পরিস্ফুটনের জন্য অবধারিতভাবে চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। চরিত্রই যেহেতু স্থানীয় সংবাদ, জীবনের বর্ণমালা বহন করে যাবে তাই চরিত্রের উপযোগিতা থাকে। তবে চরিত্রের থেকেও তিনি টোটাল সিস্টেমটাকে ধরতে চান। সেখানে বসন্তের হাওয়ার মতো কিছু বাইরের সংবাদ, তথ্য, বক্তব্য-তত্ত্ব এসে জনপদজীবনের গায়ে হাওয়া লাগায়। সেই হাওয়ায় খুব যে পরিবর্তন ঘটে তা নয় তবে একটা রেস থেকে যায়। আসলে তিনি নির্মাণ করতে চান সময়ের অন্তঃক্ষরণকে।

পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্পের বদলে আখ্যান বলতে পছন্দ করতেন। তিনি গল্পের একমুখী বিন্যাস রচনা করতে চাননি। বিবিধ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে যে মানুষ সেই মানুষের নানামাত্রিক জীবন ও সমস্যার দ্বিরালাপকে প্রস্তুরীভূত করতে চেয়েছেন। একটি দৃশ্য বা একটি ঘটনা অপেক্ষা তিনি ঘটনার জটিলতায় প্রবেশ করেছেন। একটি ঘটনা, রহস্য বা দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহুবিধ ঘটনা। সমস্ত ঘটনার জ্বালামুখ মানুষকে কীভাবে হা করে গ্রাস করে সেই রহস্য খুঁজতে অগ্রসর হয়েছেন। চেতন-অবচেতন, স্বপ্ন-তন্দ্রাচ্ছন্নতা এগুলি তাঁর উপস্থাপনের মাধ্যম। বাস্তবের একাধিক ঘটনা ব্যক্তির মনে যে ক্ষোভ, চিন্তার জন্ম দেয় তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে চলেন তিনি। তিনি পুরোপুরি জটিল জীবন যন্ত্রণার ভাষ্যকার। গল্পের সহজ সরলতার পথ বাতিল করে ঘটনার গভীর তলদেশে প্রবেশ করে সমাজ জীবনের পুরো চিত্র ধরতে চেয়েছেন। সে যাত্রায় যে সফল হয়েছেন তা বলাই শ্রেয়।

পীযূষ ভট্টাচার্য আখ্যানে বারবার দৃশ্যান্তর বদল করেন। অপ্রস্তুতভাবেই এক দৃশ্য থেকে ভিন্ন দৃশ্যে, এক সত্য থেকে আরেক সত্যে পৌঁছে যান। পাঠক কিছুটা ধন্দে থাকে, পাঠ এগিয়ে যেতে যেতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে অজস্র তত্ত্ব বিদ্যমান। কেবল দেখা জানলেই তার সারসত্য জানান দেওয়া সম্ভব। তত্ত্বছাড়া তো কিছু নেই। কার্যকারণের আড়ালেও জীবনের বড় সমীক্ষা দাঁড়িয়ে আছে জীবনদর্শনের উপর। সেই তত্ত্ব ও জীবনদর্শনের খোঁজে আখ্যাননদীকে তিনি ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন। সেই ভাসন প্রক্রিয়ায় সঙ্গী হয়েছে মিথ ও লোকপুরাণ। যা আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান ছিল সেই সত্য যা কালবিভাজিত রেখায় অনুপস্থিত অথচ যার রেশ জীবন এখনও বহন করে চলে তার বহুবিধ মানচিত্র এঁকে চলেন। পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানে দুটি সত্য বহমান থাকে। একটি ঘটমান বাস্তবের সত্য। একটি অতীতে ঘটা চিত্রমালার প্রবাহিত গন্ধ। স্মৃতিনির্ভর মানুষের সত্তার সঙ্গে অতীতের গন্ধ কোনো না কোনোভাবে বয়ে চলে। বাস্তবের সমূহ ঘটনার মধ্যেও অতীতের ছাপ খুঁজে চলে সত্তা। তা যতই ভিত্তিহীন, অলৌকিক হোক না কেন ব্যক্তিমানুষের সত্তা তার প্রভাবকে বিচ্যুত করতে চাইলেও পারে না।

একটা রহস্যময় ঘোর পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানের মূলসূত্র। বাস্তবের পাশ দিয়ে যে অলীক বাস্তব বা অদৃশ্য বাস্তব বিচরণ করে তাই তিনি নির্মাণ করে চলেন। অস্তিত্বের সারথি হয়ে অনস্তিত্ব যে সর্বদাই বর্তমান তা জানান দেন। চেতন মনের পাশাপাশি অবচেতনও যে প্রখরভাবে ব্যাপ্তময়, চেতনের বিশ্রাম নিতেই যে অবচেতন ক্রিয়াকলাপ বা জাগ্রত সমীক্ষার সূত্র ধরেই স্বপ্ন, তন্দ্রাচ্ছন্নতা বর্তমান এসব ঘুরে ঘুরে আসে। ব্যক্তির সচেতন মনে মৃত ব্যক্তিও যে অবস্থান করে থাকে, এমনকি ব্যক্তির চিন্তাসূত্রকে মৃতের অস্তিত্ব ছিন্নভিন্ন করে দেয় তার সমূহ অবস্থান নিয়ে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। রাজনীতি থেকে রাষ্ট্রীয় শোষণ, লোকপুরাণ থেকে বিজ্ঞান, মিথ থেকে মাটি সংলগ্ন জীবন, নদী সংস্কৃতি থেকে লোক সংস্কৃতি, টোটেম-ট্যাবু থেকে প্রথা মানা-না মানার মধ্যবিন্দু, যৌনতা থেকে খিস্তির মেটাফোর রেখে জীবনকে যে নিপুণ ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেছেন তা আখ্যানের বিপ্রতীপ ধর্মে জরুরি আয়োজন। শূন্য, অস্তিত্বের বিবিধ লীলা, ব্যক্তির মনে নানা রহস্যের খেলা ও সংস্কার বিশ্বাসকে অতিক্রম করার চেষ্টা ও আটকে যাওয়া মিলিয়ে মানবিক জীবনচিত্রের গভীর প্রদেশে প্রবেশ করেছেন।

পীযূষ ভট্টাচার্য কোথা থেকে শুরু করে কোথায় শেষ করবেন তার তল পাওয়া মুশকিল। এমনকি গল্প শুরু করে তিনি পাঠককে কোনো ধারণাতেই পৌঁছতে দেবেন না। প্রতিমুহূর্তে নতুন খাদ আবিষ্কার করে পাঠককে বিভ্রান্ত করবেন। পাঠকের মস্তিষ্কে রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করবেন। বারবার দৃশ্যবদল করে পাঠকের নির্মিত ধারণাকে ভেঙে দিতেই তাঁর উৎসাহ। পাঠক এখানে আবিষ্কারক নয় লেখকের যাত্রার সঙ্গী। তিনি যেদিকে নিয়ে যাবেন সেদিকেই যেতে হবে। বারবার ভিন্ন বয়ান, দৃশ্যান্তর, বাস্তব-অবাস্তব, বাস্তবের ভ্রম, পুরাণ, লোককথা, প্রাচীন সংস্কার-পদ্ধতি এনে জীবনের সমূহ আয়োজনকে এমন এক ঐন্দ্রজালিক ফর্মে উপস্থাপন করেন যা বিশ্বাসযোগ্য। বিভ্রম-অলৌকিক বয়ান এলেও তা বাস্তবের সমান্তরাল ফ্রেমে রেখে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার মধ্য দিয়েই আখ্যানের উত্তরণ ঘটে। তিনি বারবার অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছেন। বর্তমানের চিন্তা-চেতনা, জীবনসমীক্ষা অনেক এগিয়ে গেলেও তা কোথায় অতীতের সঙ্গে সংযোগসূত্রে আবদ্ধ তার পথনির্দেশ আখ্যানে বড় ভূমিকা গ্রহণ করে।

বাস্তবের স্বপ্ন, স্বপ্নের বাস্তবতা নিয়ে পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যান পরিক্রমা সম্পূর্ণ হয়েছে। আলো থেকে অন্ধকারে, অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছতে চেয়েছেন আখ্যানের উপান্তে। আলো-অন্ধকারের অভিযানে মাঝপথে বারবার ছায়া পড়েছে। ছায়া-কায়া-মায়ার প্রসারিত সত্যকে বহন করে তিনি মস্তিষ্ক সঞ্চালিত বোধ ও ব্যক্তির আত্মসমীক্ষণের যে ভাষ্য রচনা করেছেন তা মারাত্মক। প্রচলিত পথকে অতিক্রম করে নির্জনে নিজস্ব ভাবনার অক্ষিগোলকে চরিত্রের দোদুল্যমান সত্তার খণ্ড-বিখণ্ড অবয়ব নিয়ে তাঁর পথ চলা। তিনি কখনও স্টোরি টেলার, কখনও নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে চরিত্রের রহস্য রোমন্থনে জীবনকে বোঝার সমূহ আয়োজন আখ্যানের বিপ্রতীপ স্বরকে ক্রম উধ্বোমুখী করেছে। অন্ধকারের চিত্রনাট্য, দৃশ্যান্তর ও পুরাণের অনুষঙ্গ এনে ব্যক্তি মানুষের মনস্তত্ত্ব ও চেতন-অবচেতনের দোদুল্যমান রূপান্তর এমন বয়ানে উপস্থিত করেছেন যা যথার্থই আন্তর্জাতিক। লোকক্রিয়া, নদী, লোকাচার, মিথের পুনর্নির্মাণ করে জীবনের আয়োজনকে এমন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন যা বাংলা গল্পের উপস্থাপন শিল্পকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।

পীযূষ ভট্টাচার্য কোনোভাবেই সমান্তরাল কাহিনি শোনাতে চাননি। ফলে গল্পের অবয়ব একেবারেই স্বল্প। ছয়/সাত/ আট/দশ বা একটু কম বেশি পৃষ্ঠার মধ্যে পাঠককের বোধকে দোল খাইয়েছেন। বহু ক্ষেত্রেই পাঠককে চিন্তার সঙ্গী করেছেন। জীবন সম্পর্কে বিচিত্র বোধ ও তার বহুমুখী প্রকাশ কত ব্যাপ্তময় এমনকি তার আনাচে-কানাচে তত্ত্ব, ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা,  লোকানুষঙ্গ ও মিথের প্রয়োগ কত জটিলভাবে লুকিয়ে আছে তার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্যসহ উপস্থাপনের নিজস্ব বিন্যাস আখ্যানকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র। বৃত্ত ভেঙে বৃত্ত, অবয়ব ভেঙে অবয়ব, দৃশ্য ভেঙে দৃশ্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে আখ্যান। অনেকটা সাদাকালো টিভিতে কাটা কাটা দৃশ্যের মতো। জীবনের অচেনা প্রান্তরকে চিহ্নিতকরণের কবি পীযূষ ভট্টাচার্য। গদ্যভাষা থেকে পীযূষ ভট্টাচার্যের কাব্যসত্তা আবিষ্কার অসম্ভব নয়। যদিও সাহিত্য জীবনের সূচনা হয়েছিল কবিতা দিয়েই। আবার অচেনা প্রান্তর বলতে কিন্তু অঞ্চল বা ভূগোল নয়। তা মানব ভূগোল। মানব মনের বহুব্যাপ্তময় যে পরিসর তার খোঁজে তিনি উদগ্রীব। ভাঙা মানুষ, পরাজিত মানুষ, সহজ সত্যকে মানতে শেখা মানুষ, জীবনের বাক্‌বদলের পথে নিত্য আবিষ্কারের মানুষ বহুক্ষেত্রে নায়ক হয়ে উঠেছে। সেখানে চরিত্রের অন্তঃসত্তা বা আত্মবলয়ের প্রতিকৃতি নির্মাণ বড় হয়ে উঠেছে। চরিত্রের গহন রহস্য উন্মোচন করে তিনি স্পষ্ট করতে চান জীবনের নজরানা। চরিত্র নিজের সত্তা নিজেই ভেঙে ফেলে। একটা আপেক্ষিক ভাব নিয়ে পতনশীল অন্ধকারে ডুবে যায়। কিন্তু সেখান থেকে উত্তরণও ঘটান লেখক। তবে তা কোনো মার্কসীয় তত্ত্ব দ্বারা নয়। মৃত্যুর থেকে জীবনই বড়, মৃত্যুর অন্ধকার থেকে জীবনের আলো অনেক বড়।

পীযূষ ভট্টাচার্য গত শতকের আটের দশকে গল্প লেখা শুরু করলেও মাঝে কবিতাচর্চা করে নয়ের দশকের আশপাশ থেকে গল্পবলয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করে চলেছেন। গত শতকের নয়ের দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত একটা পর্ব ধরা যেতে পারে। নতুন শতাব্দীর শুরু থেকেই গল্পের জটিলতা, ঘোর ও আখ্যানের জাল ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। তীব্র আকর্ষণ, জীবনের বহুমুখী ভাবনার সংমিশ্রণ ও জীবনের নানামুখী সমস্যা নিয়ে এমন এক গদ্যজাল রচনা করেছেন যা থেকে পাঠকের মুক্তি নেই। গল্পপাঠে প্রবেশ করেই পাঠক যেন ডুবে যান এক গভীর বলয়ে। যেখান থেকে মুক্তির পথ নেই। এই পর্বে এসে গদ্য কাঠামো বদলে যাচ্ছে। আরও ঘোর, অদ্ভুত মায়াবী ও রীতিমতো বিপদজনক গদ্যসজ্জায় জীবনের ভিতর বলয়ের সমূহ সমস্যার নামাবলি যে কেন্দ্রবিন্দুতে নির্মাণ করেছেন তা অভূতপূর্ব। ব্যক্তি মানুষের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, জীবন জিজ্ঞাসার নিগূঢ় ধারাপাত জটিল থেকে জটিলতর বিন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে চলে।

সামনে থেকে শুরু করে পিছনে যাত্রা, আগের কাহিনিকে পরে এনে, পরের কাহিনিকে আগে এনে, এলোমেলো বিন্যাসে জীবনের তালগোল পাকিয়ে জীবন সম্পর্কে তিনি নির্ধারিত সত্যে পৌঁছতে চান। এমনকি সবটাই পরিকল্পনামাফিক। কাহিনি যেমন ভেসে গেছে বীক্ষণ সেদিকে এগিয়ে গেছে জীবনের টানে তেমন নয়। বরং লেখক পরিকল্পনামাফিক শক্ত কব্জিতে কাহিনির রেশ টেনে রেখেছেন। এমনকি সমাপ্তিটা যেনে বুঝেই তিনি সম্পূর্ণ করতে চেয়েছেন। কাহিনির আড়ালে তিনি জীবন বীক্ষণের অতলান্ত প্রকাশ পাঠককে শোনাতে চান। জীবনকে নেড়েঘেঁটে, জীবনের নাড়িভুড়ি ছিন্নভিন্ন করে তিনি অনেকগুলি রহস্যে উদ্‌ঘাটন করেছেন—জন্ম-মৃত্যু-শূন্যতা-অস্তিত্ব-স্বপ্ন-যৌনতা-অন্ধকার-লড়াই। মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার পথ কত জটিল হতে পারে তা তিনি দেখাতে চান। সেই দেখানোয় উপরিক্ত রহস্যগুলি বড় ভূমিকা পালন করে। উপস্থাপন টেকনিকে জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তব, মিথ, টোটেম, ট্যাবু হাজির হয়। কখনও ভৌগোলিক পরিসর থাকে বটে, দক্ষিণ দিনাজপুরের স্থান-কাল-নদী একটা ভূমিকা নেয় বটে তবে গল্প ভৌগোলিক সীমারেখায় আটকে থাকে না। বরং স্থান-কাল-পাত্র অতিক্রম করে তিনি মানুষের অস্তিত্ব-অন্ধকার-শূন্যতা-নিঃসঙ্গতার আখ্যান শোনাতে চান। সে মানুষ হয়ে ওঠে জটিল সময়ের মানুষ। পরিবর্তিত পৃথিবীর নব ভাষ্য। সময় বদলে যাচ্ছে, সময়ের মানুষ হিসেবে মানুষের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তেমনি অস্তিত্ব সংকটের নানা ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। সেই জটিল জীবনের বর্ণমালা লেখক শোনাতে চান। স্বাভাবতই পীযূষ ভট্টাচার্যের পূর্বসূরী হিসেবে কাউকে মনে আসে না। মনের আনাচে কানাচে জগদীশ গুপ্ত থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে দেবেশ রায়ের কথা ঘুরপাক খেলেও মিল পাওয়া যাবে না। উপস্থাপন ও টোটেম-ট্যাবুর প্রয়োগ, জাদুময়ী গদ্যভাষা ও সংকটের বহুবিধ ব্যাধির সমূহ রহস্য উদ্‌ঘাটনে তিনি হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র।

পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানে ছায়া নিজেই একটা সত্তা হয়ে ওঠে। নিজেই অস্তিত্বের গোপন সারথি হয়ে বিদ্যমান থাকে। অন্ধকার, ছায়া, বিন্দু, বিম্ব-প্রতিবিম্ব নিয়ে লেখকের বিশেষ আয়োজন, বিশেষ চিন্তা লক্ষণীয়। চরিত্রের অস্তিত্ব, কার্যকলাপকে যেমন ছায়া ঢেকে দেয় তেমনি ঘটনার মধ্যবিন্দু হয়ে একটা আড়াল সৃষ্টি করে। সেই আড়ালের বাজনা বাজানোর নিমিত্তই যেন এক কৌশল। তিনি নিবিড়ভাবে চরিত্রের বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, দ্বিধা, মনস্তত্ত্ব, মানসিক সংকট নিয়ে আখ্যান উপনিবেশ উপস্থাপন করেন তাই ছায়ার বড় ভূমিকা থেকে যায়। ছায়াপুতুলের খেলার অংশীদার হিসেবে অস্তিত্বের দরবার এমন বয়ানে নির্মিত হয় সেখানে ছায়া কেবলই জীবন জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। তাঁর চরিত্র কেবলই অন্ধকারে ডুবে যায়, ছায়ার আড়াল খোঁজে। সূর্যের প্রখর তেজের উত্তেজনা থেকে আলো পৃথিবীর স্থির-অস্থির সত্যের জানান দিতে ছায়ার তাৎপর্যপূর্ণ প্রয়োগ ও বীক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তেমনি আছে রক্ত নিয়ে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী। হিংসার পৃথিবীতে রক্ত নিয়ে এত জঘন্য খেলা ও কতরকমভাবে, কত চক্রান্তে জীবননাশের আয়োজন তার অন্ধকারময় কালো দিক আখ্যানে সন্নিবেশিত হয়। যাপিত পৃথিবীতে কত মানুষ বোধে আক্রান্ত, কেউ মানসিক সংকটে ভুক্তভোগী, কেউ লোভের তাড়নায় হিংসার সত্য বহন করে চলে, কেউ নিজের বীক্ষণকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে অক্ষম। সুস্থ সমাজ মানস থেকে আউটসাইড অথচ বহুক্ষেত্রে মানুষগুলি জগৎ সংসারের চলাচলের প্রকৃত সত্য জানে-বোঝে। সেই ভাঙা, অর্ধবিকৃত, অর্ধচৈতন্য, অস্থির, অসংলগ্ন মানুষ নিয়ে পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যান স্বর থেকে স্বরান্তরে পৌঁছে গেছে।

পীযূষ ভট্টাচার্য ছায়া, অন্ধকার, অমাবস্যার চিত্র আঁকলেও তিনি আলোর দিশারী। আলো, পূর্ণিমার প্রসারিত উজ্জ্বলতায় আখ্যানের সমাপ্তি ঘটান। অন্ধকারের ঘোর রহস্য উপলব্ধি করিয়ে তিনি মানুষের মুক্তির পথ খোঁজেন। সেই বীক্ষণে প্রকৃতি বড় ভূমিকা নিয়েছে। চাঁদ, নদীর বহুবিধ খেলা ও মানচিত্র ব্যক্তির মনচিত্রের উপর সমূহ প্রভাব সৃষ্টি করে। তেমনি তিনি প্রবলভাবে সময়পর্বকে নির্মাণ করতে চান। সময়ের অন্তঃসারশূন্যতা, সময়ের দংশনক্ষত চিত্রলিপি অঙ্কনের মধ্য দিয়ে কালিক সত্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু বাজার চলতি বয়ানকে খুব সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে শব্দ, বোধ ও ঘটনার রোমন্থনে এমন এক ঘূর্ণি সৃষ্টি করেন যা পৃথকভাবে চিহ্নিত করে দেয়। সরাসরি কাহিনি উপস্থাপনের বদলে তিনি যাঁতাকল সৃষ্টি করেন। পেষাইকলে সমস্ত মিশ্রিত শস্য যেমন তালগোল পাকিয়ে ঘুরতে থাকে তেমনি তাঁর আখ্যানেও মানুষ, সময়, প্রেম, হিংসা, রক্ত, অন্ধকার, শোষণ ঘুরতে থাকে। রাঁধুনি যেমন কড়াইতে সময় মতন, পরিমাণ মতন মশলাসহ সমস্ত চালান করেন তেমনি লেখকের বয়ানেও পরি, অন্ধকার, জ্যোৎস্না, বোধ, অবচেতন, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব চালিত হতে থাকে। কিন্তু সমস্ত রেশটা রাঁধুনির মতো লেখকের হাতেই থাকে। তিনি পুতুলনাচের মতন ইচ্ছামতো চরিত্রকে দুলিয়ে যান। দোলার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে যা যা আবশ্যক তা জাদুকরের মতো ক্ষণিক বিচ্ছুরণে এসে আবার বিদায় নেয়। চরিত্র ও সময়ের মন্থনজাত সত্যকে দেখিয়ে দিয়েই লেখক বিদায় নেন।

এক মেধাবী মনন, জীবনকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখার অভিপ্রায়, অস্তিত্বকে টেবিলে রেখে ক্রমাগত অপারেশন করা ও সময়ের ধ্রুবককে সঙ্গী করে তিনি আখ্যানের ছক নির্মিত করেছেন। ব্যক্তি মানুষের মানসিক সংঘাতকে কীভাবে, কতভাবে বিশ্লেষণ করা যায় ও জীবনের পরতে পরতে সেই বিশ্লেষণ কত প্রখর, তীব্র হতে পারে, এমনকি স্থান-কাল-পাত্রভেদে সেই বয়ানের জটিলতা কত মারাত্মক হতে পারে তার বিবিধ দিক তিনি নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। তবে সেই বিশ্লেষণ বাস্তব হলেও, বাস্তবের চলতিপথ দিয়ে নয়, লোককথা, কিংবদন্তি, পুরাণ টোটেম, ট্যাবু, জাদুবাস্তব, অধিবাস্তবকে সঙ্গী করে। এমনকি তা সাধারণ পাঠকের গণ্ডি অতিক্রম করে দীক্ষিত পাঠকের বোধে তীব্র আঘাত সৃষ্টি করে। দীক্ষিত পাঠকের মেধা, মননই পীযূষ ভট্টাচার্যের কেন্দ্রবিন্দু। এজন্য চারদশকের সময়কাল ধরে লিখেও গল্পের সংখ্যা স্বল্প। তবে অল্প লিখলেই যে তা গুণে ভালো এসব বাজার চলতি কথা দূরে রেখে টেক্সট পড়া পাঠক মাত্রই সেই সত্যে অবধারিতভাবে পৌঁছে যাবে। যে পাঠক একবার পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানে ডুব দিয়েছে সে আর মুখ ফিরিয়ে নেয় না। আখ্যানে ডুব দেওয়াটাই মূল কথা। কিন্তু সেই ডুব দেওয়ার জন্য পাঠকের একটা দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। দীর্ঘ চারদশকের বেশি সময় ধরে তিনি যে কেবল লিখেছেন তাই নয় নিজেকে ভেঙে ভেঙে প্রস্তুত করেছেন। সেখানে শুধু জীবনকে দেখা জানা নয় ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা নিতে হয়েছে। তবে প্রভাবিত হননি। খুব সচেতনভাবে নিজের একক পথ গড়ে তুলেছেন। শুধু ধারণাই নয় আমাদের রূপকথা, লোককথা, কিংবদন্তির সত্য-মিথ্যা, ফাঁকফোকর খুব ভালো করে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, ফলেই এমন আখ্যানের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানের মূলসূত্র কিছু বক্তব্য। দার্শনিক মনন, জীবনকে দেখার বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনের তুচ্ছ-অতি তুচ্ছ বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রকৃত রসদ উঠিয়ে আনা ও মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণের চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আখ্যানকে করে তুলেছেন সমাজতাত্ত্বিক ভাষ্য। তিনি গল্প বললেও গল্পের আড়ালে কিছু বীক্ষণকে স্পষ্ট করতে চান। মস্তিষ্ক সঞ্চালিত সেই বীক্ষণই পীযূষ ভট্টাচার্যের মূলসূত্র। জগৎ-জীবন, রাজনীতি, রাষ্ট্র, মানুষ, প্রান্ত-প্রান্তিকতা, মানসিক অবস্থা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্বতন্ত্র। তাঁর আখ্যান প্রবলভাবে ব্যক্তি মানুষের চিন্তা চেতনাকে অগ্রাধিকার দেয়। তিনি পাঠককে দেখাতে চান যা ঘটে চলেছে তার অন্তরালে একাধিক ঘটনা বা সমস্যা বর্তমান। সেই ঘটনার বীক্ষণ উপলব্ধি করতে পারলেই জীবনের সৌন্দর্য আবিষ্কার সম্ভব।

পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যান যত এগিয়ে এসেছে ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। জীবন ও সময়ের জটিলতাকে তিনি এমন রহস্যময়জালে, বীক্ষণে প্রকাশ করে চলেছেন যা অনবদ্য। শোষক-শোষিতের ভাষ্য, রাজনীতির প্রবাহ, মানুষের দাসত্ব-প্রতিবাদকে বাস্তব-পরাবাস্তবের সীমারেখায় টেনে চরম বাস্তবকে বহুস্বরে নির্মাণ করে চলেছেন। সময়ের রাজনীতির স্রোতকে নানা বীক্ষণে কালস্রোতে ভাসিয়ে এমন এক শব্দছক গড়ে তোলেন যার জুড়ি মেলা ভার। ‘ঠাকুমার তালপাখা ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থ থেকেই সেই বহুমুখী শব্দছক, কুহকজাল, শোষক-শোষিতের ভাষ্য ক্রমেই বাক্‌ নিয়েছে। ‘শ্রীযুক্ত কিশোরীমোহন এবং তা মাদি মোষ’ (২০০৭) গল্পে সময় পরিসর, রাজনীতি, ইতিহাস, ঔপনিবেশিক ভাষ্য, স্বাধীনতোত্তর বয়ান যে কুশলী বিন্যাসে ব্যাপ্তি পেয়েছে যা পীযূষ ভট্টাচার্য যেন নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হন। বিগত পঁচিশ বছর ধরে গড়ে চলা বয়ান যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলছিল তা যেন এখানে এসে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যায়। লোককথা, টোটেম, প্রচলিত সংস্কার, বিশ্বাসে ভর করে ঔপনিবেশিক বয়ানকে সঙ্গী করে প্রান্ত, পরাজিত মানুষ ও শোষিতের যে উপনিবেশোত্তর ভাষ্য স্পষ্ট করে যান যা বাংলা গল্পবলয়ে একক  অশ্বরোহী।

পীযূষ ভট্টাচার্য চরিত্রকে নিঃসঙ্গ করে তোলেন। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে তিনি চরিত্রসহ সমাজবাস্তবের সমূহ সত্যকে ব্যক্ত করতে চান। তা স্পষ্ট করার জন্য অবধারিতভাবে ছায়া, অন্ধকারের আগমন ঘটে। ছায়ার ভিতর দিয়েই তিনি ভুবনকে দেখতে চান। ছায়া, অন্ধকার, শূন্যতা নিয়ে এত বীক্ষণ বাংলা সাহিত্যে আর কোনো গল্পকারের মধ্যে দেখা যায় না। তেমনি এমন এক বৃত্ত থেকে শুরু করে এমন এক বলয়ে এসে শেষ করেন যার তল পাওয়া মুশকিল। কোনটাই কিন্তু বানিয়ে তোলা আর্ট বা গল্পের শিল্পের জন্য নয়। ইতিহাস, সময়ের সত্যকে সামনে রেখে তিনি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে যান। পীযূষ ভট্টাচার্যের আখ্যানশিল্পের উত্তরণ ঘটেছে ইতিহাস, সময় সত্যের কাঁধে পা চলতে চলতে। তাই সমাজতাত্ত্বিক ডকুমেন্ট ও ঔপনিবেশিক থেকে উপনিবেশোত্তর কাল পর্বের এক জটিল বীক্ষণ তিনি বারবার আখ্যানে ধরে রাখেন।

পীযূষ ভট্টাচার্য মৃত্যুর ডাইমেনশন নিয়ে বিবিধভাবে ভেবেছেন। মৃত্যু, মৃত্যুর রেশ, মৃত্যু পরবর্তী শূন্যতা, মৃতের ছায়া, বাস্তবে মৃত্যুর উপস্থিতি, এমনকি জাদুবাস্তবে মৃতের কার্যকলাপ দ্বারা তিনি বাস্তবের সমূহ সত্যকে জানান দিতে চেয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে এত বিবিধ ভাবনার বয়ান বাংলা ছোটোগল্পে এভাবে উঠে আসেনি, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। জীবনের বিপরীত পিঠ হিসেবে মৃত্যু সমাপ্তি বা অন্তিম আর্তনাদ হলেও তা যেন জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। বরং যাপন ক্রিয়ায় মৃত্যুর অবিরত উপস্থিতি জীবনকে এক খাত থেকে অপরখাতে চলতে সাহায্য করে। স্বপ্ন, অবচেতন, দ্বিরালাপ, বিষণ্ণতা, অস্তিত্বহীনতায় মৃত্যুর উপস্থিতি অনিবার্য করে জীবনের বহমান সত্যকে এমন বিন্যাসে দুলিয়েছেন যা চমৎকার।

পীযূষ আখ্যানে ইতিহাসের ছিন্নসূত্র নানাভাবে ঝুলে থাকে। প্রবাহমান ইতিহাসের বদলে ইতিহাসের কবল থেকে টুকরো ঘটনা, স্মৃতি, তথ্য তুলে এনে কাহিনিকে একটা দোলা দেন। অবিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহের প্রতি লেখকের দৃষ্টি নেই। বরং বিচ্ছিন্ন ও একাধিক ঘটনাপুঞ্জের মালা গাঁথতে গাঁথতে তিনি একটি সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করেন। বহুক্ষেত্রে তা বিচ্ছিন্ন হয়েই ঝুলতে থাকে। একাধিক বয়ান, বহু সত্য, তথ্য, আলো-অন্ধকার, চেতন-অবচেতন, সংস্কার-বিজ্ঞান, ভাব-ভাবহীনতা, গভীর মনোযোগ দ্বারা একটা অদৃশ্য তার গড়ে ওঠেন। পাঠক একটু এলোমেলো হলেই যেন ভাবপ্রবাহ থেকে যেন ছিটকে যান। একটা ঘটনার সঙ্গে উপস্থাপিত ভিন্ন সত্যের বারবার সম্পর্কে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পীযূষ পাঠ সম্পূর্ণতা লাভ করে। বহুক্ষেত্রে সম্পর্ক নাও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। সেই অনুপস্থিত সত্যই আখ্যানের আরেক পরিসর। তিনি পাঠককে শেখান এইভাবেও বাংলা গল্পের চলন হতে পারে। সেই রীতির সঙ্গে পাঠক নিজের সংযোগ গড়ে তুলতে পারলেই পীযূষ আখ্যানের শিল্পরীতি উপলব্ধি সম্ভব। মোটামোটিভাবে এই হল পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্পভুবনে প্রবেশের প্রাথমিক পাঠ প্রস্তাব। গল্প নিয়ে অন্যখানে, ভিন্ন পরিসরে বলা যাবে। আপাতত বিদায়।

লেখক : অধ্যাপক, রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন