অতীতে সংবাদ আদান-প্রদান করার জন্য পায়রা ছিলো এক অপরিহার্য বাহক। ক্ষমতায়নের যুদ্ধ যখন থেকে শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই মানুষ বুঝেছিল বার্তা বাহকের ভূমিকা কতখানি। মানুষকে দূত হিসেবে কাজে লাগলে সুবিধাও যেমন আছে তেমনি অসুবিধা তার থেকে বেশি। এছাড়া মানুষ সব দুর্গম জায়গায় পৌঁছতেও সহজে পারে না। কেবলমাত্র পাখিরাই খুব সহজে কম সময়ের মধ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যেতে পারে। পথ চেনার প্রাকৃতিক ক্ষমতার জন্য পায়রাকে মানুষ ব্যবহার করছে তাই বহুকাল আগে থেকে। এরা পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম। দুরদূরান্তে গিয়েও নিজের ঠিকানায় এরা সহজেই ফিরে আসতে পারে।
এই দক্ষতাকেই কাজে লাগানো হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ছাড়াও জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান ইত্যাদি ইতিহাসের বহুযুদ্ধে পায়রাদের অংশগ্রহণ ছিল এক অবাক করা ঘটনা। এই প্রসঙ্গে ৩ অক্টোবর, ১৯১৮ প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের একটি ঘটনার উল্লেখ করি।
মেজর চার্লস হোয়াইট হুইটলসি (একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি মেডেল অফ অনার প্রাপক যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিউস-আর্গোন আক্রমণে “হারানো ব্যাটালিয়ন”-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।) এবং ৫৫০ জনেরও বেশি লোক খাবার বা গোলাবারুদ ছাড়াই শত্রুপক্ষের সীমানায় আটকা পড়েছিলো। এমন একটা জায়গায় আটকে পড়েছিলো সেখান থেকে বেরোনোর রাস্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। জার্মানদের দ্বারা প্রহরাবেষ্টিত হয়ে অনেকে নিহত এবং আহত হয়েছিল। মাত্র ১৯৪ জন পুরুষ তখনও জীবিত ছিল।
পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো হুইটলসির যে বার্তাবাহক দৌড়বিদরা ছিলো তারাও জার্মানদের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে আটকা পড়ে বা নিহত হয়। এই পরিস্থিতিতে হুইটলসি তখন পায়রার মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে শুরু করেন। প্রথমে একটি পায়রার সাহায্যে বার্তা লিখে পাঠানো হয়, ‘গোলাবর্ষণ কারণে অনেকেই আহত। এখান থেকে সরতে পাচ্ছি না।’ কিন্তু আকাশে ওড়ার সময় পায়রাটিকে জার্মান সেনাবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে।
এরপর দ্বিতীয় বার্তা দিয়ে পাঠানো হয় অন্য একটি পায়রা দিয়ে, “মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। সমর্থন পাঠানো যাবে?” কিন্তু এবারেও ভাগ্যদেবী সহায় হলেন না। শত্রুবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারালো পায়রা দূত।
তখন তাদের কাছে আর একটি মাত্র প্রশিক্ষিত পায়রা বেঁচে ছিল ‘চের অ্যামি (Cher Ami)’। এই মিশন ব্যর্থ হলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত।
চের অ্যামি (ফরাসি ভাষায় অর্থ “প্রিয় বন্ধু”) ছিলো একটি পুরুষ হোমিং পায়রা যাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে ইউএস আর্মি সিগন্যাল কর্পস দ্বারা ব্যবহারের জন্য ব্রিটেনের পায়রা অনুরাগীদের দ্বারা দান করা হয়েছিল এবং প্রশিক্ষিত হয়েছিল আমেরিকান পায়রা দ্বারা।
চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে চের অ্যামির ডান পায়ে একটি ক্যানিস্টারে পেঁয়াজের কাগজে লেখা চিরকুট দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। বার্তায় লেখা হলো, ” আমরা ২৭৬.৪ নম্বর রোডের সমান্তরাল জায়গায় আটকে পড়েছি। আমাদের নিজেদের আর্টিলারি সরাসরি আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করছে। ঈশ্বরের দোহাই এটি বন্ধ করুন।”
পায়রাটি এই বার্তা নিয়ে সেখান থেকে উড়ে বের হতেই জার্মান সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। চারিদিকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ হতে লাগলো। কমান্ডার দেখলেন পায়রটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে । কিন্তু এক চোখে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়াতে অন্য চোখের সাহায্যে সে উড়তে শুরু করলো।
মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে ২৫ মাইল (৪০ কিমি) দূরে হেডকোয়ার্টারে সাহায্যের বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়ে ১৯৪ জন সৈন্যদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেন এই পক্ষী। এটাই ছিল চের অ্যামি’র শেষ মিশন। তার বুকে গুলি করা হয়েছিল, একটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং একটি পা শুধুমাত্র একটি টেন্ডন দ্বারা ঝুলে ছিল।
চের আমি ৭৭তম পদাতিক ডিভিশনের নায়ক হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা বহু চেষ্টা করেও তার সেই পা’টিকে রক্ষা করতে পারে নি। বুকে ক্ষতের চিহ্ন নিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হয়েছিল চের আমিকে।
যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠার পর এক পায়ের পাখিটিকে একটি নৌকায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল, জেনারেল জন জে পারশিং তাকে বিদায় দিয়েছিলেন।
Verdun এ ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান ও তার বীরত্বপূর্ণ সেবার জন্য পায়রাটিকে ফরাসীরা একটি পাম ওক লিফ ক্লাস্টার সহ ক্রোইক্স ডি গুয়েরে পদক দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধে প্রাপ্ত ক্ষত থেকে ১৩ জুন, ১৯১৯ তারিখে নিউ জার্সির ফোর্ট মনমাউথে মারা যায় এবং পরে ১৯৩১ সালে রেসিং পিজিয়ন হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও আমেরিকান রেসিং পিজিয়ন ফ্যান্সিয়ারের সংগঠিত সংস্থা থেকে একটি স্বর্ণপদক দেওয়া হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তার সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ।
শুধু চের অ্যামি নয় বেশ কিছু পায়রা তাদের পারদর্শিতা এবং বিশেষ গুনাবলীর জন্য আজো ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।।
Source : Adapted from various articles.
Darun laglo.khub ovinobo