আজ সরস্বতী নদীর পাড় ঘেষা ব্যান্ডেলের দেবানন্দপুরের কেষ্টপুরে চৈতন্য মহা প্রভুর অন্যতম শিষ্য রঘুনাথ দাস গোস্বামীর বাড়ির পাশেই বসেছে ৫১৮ বছরের পুরানো উত্তরায়ণ মেলা, যাকে স্থানীয়রা বলেন ‘মাছের মেলা’। দূর দূরান্ত থেকে আসা বহু মাছ ব্যবসায়ী ছাড়াও হুগলি বর্ধমান হাওড়া নদিয়া উত্তর ২৪ পরগনা বাঁকুড়া থেকে অগণিত মানুষের পদধূলিতে মুখরিত হয়েছে আজকের এই মেলা।
চুনোপুটি থেকে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান উচ্চতার তেলিয়া ভোলা, রাঘব বোয়াল,রুই, কাতলা,ভেটকি, ইলিশ,বাটা, আড়,চিংড়ি থেকে কাঁকড়া,নানান ধরনের সামুদ্রিক মাছের পসরা সাজিয়ে জমে উঠেছে এই মেলা।এবছর এক বিশাল শংকর মাছের দেখা মিলল এই মেলায়।মেলা চলবে রাত অবধি।শুধু মাছ কেনাবেচাই নয়, এখান থেকে মাছ কিনে পাশের আম বাগানে পিকনিকের আমেজে মেতেছেন বহু মানুষ। একদিনের এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে বহু মানুষ সারা বছর।
মেলার সূত্রপাত পাঁচশো বছর আগে। স্থানীয় ইতিহাস বলে, জমিদার গোবর্ধন গোস্বামীর ছেলে ছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী।রঘুনাথ দাসের জন্ম ১৪৯৮ খৃষ্টাব্দে।তাঁর পিতা গোবর্দ্ধন দাস মজুমদার ও পিতৃব্য হিরণ্য দাস মজুমদার দিল্লীর তৎকালীন পাঠান শাসকদের কাছ থেকে সপ্তগ্রাম শাসনের অধিকার এবং ‘মজুমদার’ উপাধি লাভ করেন।রঘুনাথ দাস গোস্বামী সম্মিলিতভাবে বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামী নামে পরিচিত বৈষ্ণবগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। রঘুনাথ দাস তার সরলতা এবং ত্যাগের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
ধনী ঘরে জন্মেও অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স থেকেই রঘুনাথ দাস স্বাভাবিক ভোগ,সুখ, আনন্দের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিলনা বরং ধর্মীয় সাধনার প্রতি আগ্রহ ছিলো প্রবল। রঘুনাথের এই বৈরাগ্য তার পিতামাতার অসন্তোষের কারণ হয়েছিল। রঘুনাথ দাস আধ্যাত্মিক জীবন যাপনের লক্ষ্যে গৃহ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। অবশেষে তিনি তা করেও ছিলেন।শ্রীল রঘুনাথ দাস গোস্বামীর মহিমা সূচক গ্রন্থে বর্ণিত আছে —
শ্রীচৈতন্য কৃপা হৈতে রঘুনাথ দাস চিতে
পরম বৈরাগ্য উপজিল।
ছাড়া গৃহসম্পদ নিজ রাজ্য অধিপদ
মলপ্রায় সকাল ত্যজিল।।
অবশেষে শ্রীমহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রার সময় শান্তিপুরে রঘুনাথ তার পিতার অনুমতি নিয়ে চৈতন্যদেবের কাছে আসেন এবং ৭ দিন শান্তিপুরে মহাপ্রভুর সঙ্গে থাকেন এবং তার মনের কথা বলেন এবং অনুমতি চান মহাপ্রভুর সঙ্গে নীলাচলে যাওয়ার। রঘুনাথের মনোভাব বুঝে চৈতন্যদেব উপদেশের ছলে বলেন —
অন্তরে নিষ্ঠাকর, বাহ্যে লোক ব্যবহার।
অচিরাতে কৃষ্ণ তোমার করিবে উদ্ধার।।
স্থির হইয়া ঘরে যাও, হও না বাতুল।
ক্রমে ক্রমে লোক পায় ভবসিন্ধু কূল।।
নর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া।
যথাযোগ্য বিষয় ভূঞ্জ অনাসক্ত হইয়া।।
মহাপ্রভুর আদেশ শুনে শান্তিপুর থেকে পৌষ সংক্রান্তিতে রওনা দেন সপ্তগ্রামের উদ্দেশ্যে। পরের দিন ভোরে চন্দনপুরে পৌঁছান। তার মানসিক উত্তরণের জন্য নগরবাসীরা ওই দিন যে যা পেরেছিল তাকে উপহার দেন। প্রথমে রঘুনাথ গৃহে না ফিরে দুর্গা মন্দিরের দালানে বসে ছিলেন এবং সেখানেই গ্রামবাসীরা প্রণাম জানিয়েছিল। সেই দিন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর পয়লা মাঘ এই মেলা হয়ে আসছে।
অন্য একটি কাহিনী বলে, মহাপ্রভু চৈতন্যের পারিষদ নিত্যানন্দের কাছে দীক্ষা নেবেন বলে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি যান পানিহাটিতে। কিন্তু তাকে দীক্ষা দেননি নিত্যানন্দ। আসলে সেই মুহূর্তে নিত্যানন্দ রঘুনাথের ভক্তির পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। তিনি তাকে বাড়ি ফেরত চলে যেতে বলেন। দীর্ঘ নয় মাস পর বাড়ি ফিরে আসে রঘুনাথ। সেই আনন্দে বাবা গোবর্ধন গোস্বামী গ্রামের সকল মানুষকে ইলিশ মাছ ও কাঁচা আমের ঝোল খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
মাছ খাওয়ানোর জন্য জলাশয়ে জাল ফেলতেই মিললো জোড়া ইলিশ। অবাক হয়ে যায় সকলে। স্থানীয়রা বোঝেন ঈশ্বরের এ কোন চমৎকারই।সেই সময় থেকে প্রতিবছর ভক্তরা রাধাগোবিন্দ মন্দিরের দিন পুজো দেওয়ার পাশাপাশি মাছের মেলার আয়োজন করেন।
আরো একটি গল্প বলে নিত্যানন্দ গোস্বামী রঘুনাথের উপর খুশি হয় তাকে একটি মদনমোহন বিগ্রহ দান করেন। গ্রামে ফিরে এসে সেই মূর্তি নিয়ে এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রঘুনাথ। সেই দিনটি ছিল পয়লা মাঘ। আর সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম হয় কেষ্টপুর।
বাংলাদেশের জেলেদের মধ্যে একটি নিয়ম চালু আছে। লক্ষীপূজো থেকে সরস্বতী পূজা পর্যন্ত নদীতে তারা মাছ ধরবে না কারণ তখন মাছের পোনা বাড়ার সময়। মাঘ মাসে সরস্বতী পূজা। তাই পয়লা মাঘ রঘুনাথ বাড়িতে এলে তার পিতা স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরার অনুমতি দেন এবং তারা মাছ ধরে দুর্গা মন্ডপে উপস্থিত হন। সেই দিন সারা গ্রাম আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। জনশ্রুতি, মাছের মেলার কারণ সপ্তগ্রাম শাক্ত দেবী দুর্গার প্রাধান্য ছিল। ওই অঞ্চলে মাছ মাংসের প্রাধান্য থাকায় বৈষ্ণব বিরোধীরা পরবর্তীকালে মেলার নামকরণ করেন ‘মাছের মেলা’।
যাইহোক বর্তমানে রঘুনাথ দাস গোস্বামীর পাঠকে কেন্দ্র করে মেলা বসে, গ্রামবাসীরাই মেলার উদ্যোগ নেন। ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে দু-আড়াই হাজার টাকা কেজি অব্দি মাছ বিক্রি হয়। মাছ এখান থেকে কিনে তক্ষুনি ভেজেও দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে বিক্রি হয় নানা মশলাপাতিও। মেলায় এসে চড়ুইভাতীয় করেন অনেকে।
বিশাল আর দ্রুতগতির বয়ে যাওয়া সরস্বতীর আর নেই।দূর থেকে পূর্ণার্থীরা এসে মজা সরস্বতীতে স্নান সেরে তুলসী মঞ্চে জল দিয়ে রঘুনাথ দাস বাবাজির মূর্তিকে প্রণাম করেন। শ্রীপাঠে সকাল থেকেই চলে নাম সংকীর্তন। সেখানে ভোগের আয়োজন থাকে, থাকে বিখ্যাত মালপোভোগ। শ্রীপাঠে নিত্য পুজো হলেও এটা এখানকার বাৎসরিক উৎসব। লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে গোটা গ্রাম। গ্রামের রাস্তার দুদিকে বসে অস্থায়ী দোকান। ঝুড়ি হাঁড়ি কলসী, কুলো, মাছ ধরার সরঞ্জাম, খেলনা থেকে গৃহস্থলী প্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায়। এছাড়াও অস্থায়ী মোমো, চাওমিন চপের দোকান বসেছে।
এদিন এখানে ধেনো মদ ও প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসে। শ্রীপাঠের উওর দিকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট আছে। পুণ্যার্থী থেকে উঠতি যুবক যুবতীর ভিড় বেশি হয়। দুপুরের পর থেকে মেলা অন্য মাত্র নেয়। রাত বাড়ার সাথে মাতালের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অষ্টাদশ উনবিংশ শতকে এবং গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পর্যন্ত কলকাতার বাবুরা আসতো এখানে।তাঁবু খাটিয়ে বাইজি নাচ চলতো তাঁবুর ভেতর। চলত ভাজা মাছ সহ আকন্ঠ মদ্যপান।যাইহোক, সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুরই। সমাজে চিত্রটাও বদলে গেছে।
শীত মানেই মেলা আর বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করা। কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি।শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে ব্যান্ডেলের এই মেলা বাঙালির কাছে তাই আরো লোভনীয় হয়ে উঠেছে !
তথ্যঋণ : বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড.১,কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, হুগলী-চুঁচুড়ার ইতিহাস- সংগ্রাম, সংবাদ মাধ্যম ও নিজস্ব।
একবার স্কুলে রচনা লিখতে বলা হয়েছিল,বিষয়-
“তোমার ভালোলাগা” আমি লিখেছিলাম,”মাছের
ঝোল ভাত” ভালোই নম্বর পেয়েছিলাম।আজও
সামান্য মাছের গন্ধ থাকা ঝোল হলে আমার অন্য
কিছুর দরকার পড়ে না।
কিছু লোক মাছ খাওয়ার সাথে তাদের ভবিষ্যৎ
নিয়ে চিন্তা করে নিয়মিত ছোট বাচ্চা পোনা মাছ
মাগুর মাছের চারা নদীতে ঢেলে তাদের বেঁচে
বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটা ব্রত উদযাপনের মতো
এই মৎস ব্রত করে থাকেন।
ভীষণ প্রিয় মাছের ঝোল ভাত নিয়ে লেখার মধ্য
দিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম।মনে হচ্ছে একবার যদি যেতে পারতাম ঐ মাছ মেলায় তবে
মনের মতো মাছ কেনাকাটা করে,খেয়ে,খাইয়ে
আনন্দ পেতাম।
অযোধ্যা সহ বিভিন্ন দেবালয়ের গায়ে মাছের চিত্র
আঁকা হয়ে থাকে,মাছের পূর্ণ অবয়ব খোদাই করা
থাকে অর্থাৎ মাছ কে অতি দেবতার মর্যাদায় ঠাই
দেওয়া হয়ে থাকে লক্ষ করেছি।কারন ঈশ্বরের সমান মর্যাদার মাছ প্রতিষ্ঠিত।আমার উ প্রদেশের
প্রবাস জীবনে অযোধ্যায় থাকাকালীন সব মন্দির গাত্রে মাছের স্পষ্ট অবয়ব অহিংসক নিরামিষ
প্রিয়দের কাছে ঈশ্বর প্রণাম স্বীকার করে মাছকে
শ্রদ্ধা সম্মান প্রদান করা।
ভালোলেখা ভালোলাগা।