পরিবারের সবাই মিলে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি পাহাড়ে, সেখানে কয়েকটা শর্ত যোগ হল এবার। তার কয়েকটি নিম্নরূপ —
১. সপরিবারে একসাথে এক যাত্রায় গেলেও সবার থাকার ব্যবস্থা আলাদা আলাদা জায়গায়। এমন কি যার যার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আলাদা আলাদা লাগেজে রাখতে হবে, কারোর জিনিস পরিবারের অন্যদের ব্যাগে ভরলে চলবে না।
২. এখানে প্রতিটি থাকার জায়গা ঘর হতেও পারে বা ডরমিটরি টাইপ, যেখানে পর্যাপ্ত খাট-বিছানা নাও থাকতে পারে, দরকারে মেঝেতে শুয়ে পড়ার নিজস্ব সামগ্রী সঙ্গে রাখতে হবে।
৩. এক একটি থাকার জায়গায় ৩/৪ থেকে ৯/১০ জন পর্যন্ত থাকবো, এমন মানসিকতা নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়োতে হবে। সেই থাকার জায়গায় সমবয়স্ক নারী বা পুরুষেরা দলবদ্ধ ভাবে কয়েকটা দিন থাকবে, যেখানে কেউ কারোর পূর্ব পরিচিত নাও হতে পারে।
৪. খাবার ব্যাপারে কোন ছুঁতমার্গ রাখলে চলবে না। ওখানে গিয়ে নিজের পছন্দের মত কোন খাবার আশা করার কোন প্রশ্ন নেই বা খাবারের বায়না করলেও চলবে না৷ সবাই মিলে এক রকম খাবার সময় মত নিজে নিয়ে খেতে হবে।
৫. খাবারের প্লেট মগ বা বোতল যে যার মত বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে এবং খাবার পরে নিজ নিজ বাসনপত্র নিজেকেই ধুয়ে নিজ দায়িত্বে রাখতে হবে। এটা বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যতই সঙ্গে অভিভাবক থাকুক।
৬. থাকার জায়গায় কোনরকম ঝা চকচকে হোটেল অনুভূতি রাখলে তো চলবেই না, কোন হোমস্টে-র মত ব্যবস্থাপনাও নেই। অনেকটা ট্রেকাররা পথ চলতি যেমন জায়গায় থাকে, কোন পাহাড়ের উপরে বা জঙ্গলের মধ্যে।
৭. ওখানে শৌচালয়ের ব্যবহারও সীমিত। স্নান করার কোন প্রশ্ন নেই এই শীতের সময়ে আর সে সুযোগও অতি ক্ষীণ। কারণ একটি ওয়াশরুম বা টয়লেট একসাথে অনেকে ব্যবহার করবে। তার ফলে নিজস্ব পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিজের মত করে ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. জঙ্গলে বা দূর্গম জায়গায় থাকার জন্য পোকা মাকড়, জোঁক, মাকড়সা বা নানা রকম কীটপতঙ্গের আনাগোনা লেগে থাকবে। সে ব্যাপারে নিজেদের আগাম সতর্কতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে যেতে হবে।
৯. নিজস্ব মালপত্র-সহ জামা কাপড়ের পরিমাণ খুব কম নেওয়াই শ্রেয়। কারণ বাচ্চা বড় অসুস্থ প্রত্যেককে যার যার নিজের লাগেজ বহন করে স্টেশন থেকে থাকার জায়গায় যেতে হবে। তাই লাগেজের বহর যত কম হবে, বহন করার ভার কমবে।
১০. স্টেশন থেকে পাহাড়ি পথ যাওয়ার সময়ে গাড়ি নিয়ে কোন বায়নাক্কা করা চলবে না। ১০-১২ জন মিলেমিশে গাড়িতে বসে অনেক সময় কাটানোর মানসিকতা রাখতে হবে।
১১. সকালে হুইসেলের আওয়াজে সবাই একজায়গায় জড়ো হতে হবে। সে খাবার সময় বা কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া সব সময়েই নিয়ম মেনে বাইরে বেড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানাতে হবে। ঘুরতে এসে আরেকটু ঘুমাবো… এটা মন থেকে বের করতে হবে।
১২. দলের প্রত্যেককে দাদা-দিদি বা নাম ধরে ডাকতে হবে। সে যতই সম্পর্কে তারা স্বামী-স্ত্রী বা বাবা-মা হোক। বড় দাদা বা দিদিদের না জানিয়ে একা কোথাও ঘুরতে যাওয়া চলবে না। যা কিছু করার তা দলগতভাবে করাটাই এখানেই নিয়ম।
এই সব বাদে এই যাত্রায় আরেকটা বিষয় যা খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হল… মোবাইলের ব্যবহার। হিলের জঙ্গলের মধ্যে আমরা যেখানে থাকবো সেখানে মোবাইলের টাওয়ার থাকে না। ফলে এই কয়েক দিন বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন থাকবে প্রায়। এ কথা বাড়ির লোকেদের আগাম জানিয়ে রাখা দরকার যাতে তারা অযথা চিন্তা না করেন।
উফ্, এত সব নিয়ম অনুশাসনের বাঁধনে এই বুড়ো বয়সে ঘুরতে যাবো… এটা ভেবে প্রথমে বেশ মনটা খচখচ করছিলো। এরপর নতুন এক অভিজ্ঞতা নিজের ঝুলিতে ভরবো বলে বেড়িয়ে পড়লাম এক অজানা পথে। সবার আগে মনকে তৈরি করলাম এটা দিয়ে যে, এটা কোন অবসর সময় কাটানোর মত বিলাসী ভ্রমণ নয়। এটা Summer Camp, যেখানে অনেকে মিলে একটা নিয়মের মধ্যে প্রকৃতির মাঝে কয়েকদিন কাটিয়ে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনের সাথে নতুন মানুষের থেকে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করবো। সেই সাথে নিজের সাথে নিজেরও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। দলগতভাবে থাকতে পারার বৈশিষ্ট্য, যেমন ভাগবন্টন, সাহায্য, ধৈর্য, নিয়মানুবর্তিতা, নতুন বন্ধুত্ব, নিজের মনের বাধাবিপত্তিগুলোকে কাটিয়ে এগিয়ে চলা, সহমর্মিতা, সহনশীলতার শিক্ষা লাভ করা প্রকৃতির মাঝে ভ্রমণের মাঝে।
এবার আসি, এত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আরামের ছুটি কাটানো ছেড়ে কি পেলাম, তা নিয়ে কিছু কথা বলি।
আমার মেয়ে গত তিন বছর ধরে কলকাতার পুরনো ট্রেকিং ক্লাব climbers circle এর সাথে Winter Camp-এ পুরুলিয়াতে যায়। ওর মুখে গল্প শুনে এটা বুঝেছি যে, ওনারা তথাকথিত বানিজ্যিক কোন সংস্থা নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি সুপ্রতিষ্ঠিত পাহাড়প্রেমি ট্রেকিং ক্যাম্পের বিশারদ মানুষেরা এক জায়গায় হয়ে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাঁদের কাজের পরিধি ব্যাপ্ত করতে বছরের নানা সময়ে নানা রকম ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা করেন। বাচ্চা-সহ তাদের অভিভাবকদেরও উৎসাহ দেন যাতে তাঁরাও এগিয়ে আসেন। এছাড়া যে সব ছেলেমেয়েদের সম্ভাবনা থাকে ট্রেকিং বা ক্লাইম্বিং-এ সক্রিয় হওয়ার, তাদের ভবিষ্যতের পথ দর্শন করানো-সহ নানা রকম মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের সন্ধানও দিয়ে থাকে এই ক্লাব।
যাই হোক, এই climbers circle এবার Summer Camp আয়োজন করেছিল ১১ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত, সিকিমের হিলে বার্সে ট্রেকে যাওয়ার। আর এবার এই ক্যাম্পে সপরিবারে সবার যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ বছর আমাদের গরমের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কোন প্ল্যান আগে থেকে ছিল না। তাই এই ক্যাম্পে যেতে নাম লিখিয়ে দিলাম তিনজনেরই। ৪২ জনের গ্রুপের সব সিট দ্রুততার সাথে ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু মে মাসের শুরুতে নানারকম বিভ্রান্তির কারণে অনেকেই যেতে পিছপা হলেন। কারণ ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে এ বছর গরমের ছুটি ১৬ মের পরে পড়েছে এবং হঠাৎ দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ৪২ জনের গ্রুপ ৩৫ জনে পরিণত হলো। তবু যারা যাবেন, তাঁদের উৎসাহের শেষ নেই। যাওয়ার কয়েকদিন আগে অনলাইন মিটিং-এ ক্যাম্প-সহ এই ভ্রমণের বিস্তারিত বিশ্লেষণ দিলেন এই উদ্যোগের প্রধান আহ্বায়ক প্রবীর কুমার বিশ্বাস বাবু। পূর্বে যে যে বিশেষ সাবধানতাগুলো উল্লেখ করেছিলাম, তা ওনাদের থেকেই শোনা।
১১ মে, রবিবার দুপুর ৩ টের সময়ের তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসের যাত্রা দিয়ে শুরু এই ক্যাম্প। শিয়ালদহ স্টেশনে যে যার রুকস্যাক বা ট্রলি ব্যাগ গুছিয়ে এক জায়গায় জড়ো হলাম। সেই প্রথম মুখোমুখি পরিচয় পর্ব শুরু, বিশেষত বড়দের মধ্যে আলাপ পরিচয়ের সূত্রপাত ওখানেই। কারণ যে বাচ্চারা এই ক্যাম্পে যাচ্ছে, ওরা আগেই ওদের winter camp-এ একে অপরকে চেনে এবং ওদের মধ্যে বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে আছে। পাঁচজন মেয়ে এবং তিনজন ছেলে বাচ্চা মিলিয়ে এই আটজনের গ্রুপে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য দুজন ছিল, যাদের বয়স মাত্র ছয় বছর। পরবর্তী যাত্রাপথে এই দু-জনই আমাদের কাছে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বাতাসের মত, পারমিতা আর ঋভু। পারমিতার ফোকলা দাঁতের হাসির ফাঁকে দুষ্টু মিষ্টি কথাতে আমরা এই কটা দিন মুগ্ধ ছিলাম। আর ঋভু… সে প্রথম এই রকম ক্যাম্পে যাচ্ছে তার মায়ের সাথে। স্বভাবতই তার এত নিয়মকানুন মাথায় ঢোকে নাকি!! সে তো ঘুরতে এসেছে… ট্রেকিং করে পাহাড় চড়তে হবে, কিংবা মা কে ছেড়ে আলাদা থাকতে হবে সে তো তার কল্পনায় আসে নি। বাস্তবে ঋভু এক স্বপ্নের জগতেও বাস করে, আমি এত ছোটবাচ্চাকে এমন গড়গড় করে অংকের নামতা-সহ যোগ বিয়োগ করতে দেখি নি। কিন্তু ঋভুর মুখে কথায় কথায় একটাই ডায়লগ, যা আমাদের ক্যাম্পের সবার স্লোগানও হয়ে গেছিলো…. ” ভালো লাগছে না….”।
এছাড়া রয়েছে আদৃত, যে ক্লাস ফোরে পড়ে তার আছে এক মেরিন জগত, জলীয় সব প্রাণীদের নিয়ে সে ছেলের এক তীব্র আকর্ষণ। সব কঠিন নাম, তাদের গঠন, বৈশিষ্ট্য সব মুখস্থ তার। এদের মধ্যে আছে প্রজ্ঞা, ক্লাস ফাইভ… কিন্তু চিন্তা ভাবনায় সে যে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে হার মানাবে। এত পরিণত চিন্তা এবং বাংলা সাহিত্য নিয়ে তার পড়াশোনা বেশ অবাক করার মত। এরপর আসে আমার মেয়ে তিতির-সহ সম্পূর্ণা এবং আত্রেয়ী, যারা তিনজনই ক্লাস সেভেন। তাই ওদের তিনজনের মনের মিল খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গেলো। পুরো সফরে ওরা একটা নিজেদের মধ্যে এমন বন্ধনে বেঁধে ফেললো যে, আমাদের বড়দের দরকার পড়ে নি। নিজেরাই নিজেদের পরিপূরক। আর সবার বড় সৃজন, ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর মধ্যে ট্রেকিং নিয়ে প্রচুর উৎসাহ এবং সবাইকে যে কোন প্রয়োজনে সাহায্য করতে সবার আগে এগিয়ে এসেছে। এমনই ছিল বাচ্চারা সবাই, যে যার আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে স্বতন্ত্র।
ট্রেনে সবার এক জায়গায় সিট না পড়ায় কিছু জনের সাথে আলাপ এগোলো। রাতে যে যার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবার ভাগাভাগি করতে করতে কথার পরিমাণ বাড়তে লাগল। তারপর মাঝরাতে প্রায় ভোর তিনটের সময়ে সবাই যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসলাম, ধীরে ধীরে মুচকি হাসি দিয়ে আমাদের বড়দের মধ্যেও একটা অলিখিত পরিচয় বন্ধুত্বের দিকে হাত বাড়ালো। শিয়ালদহ স্টেশনেই সবাইকে summer camp লেখা সবুজ টুপি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যা কোন জায়গায় যাতায়াতের সময়ে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। কারণ তাহলে আমরা যে একত্রে এসেছি সেটা বুঝতে পারা সহজ হবে। তারপর ওয়েটিং রুমেই সকালের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করে চা খেয়ে আমরা ভোর পাঁচটা নাগাদ রওনা দিলাম হিলে ফরেস্ট গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে। মোট চারটে গাড়িতে পূর্ব থেকে যার যার আলাদা নাম বরাদ্দ করা ছিল৷ সেই অনুযায়ী আরেক ধাপ গাড়ির নতুন যাত্রীদের সাথে সখ্যতা বাড়তে লাগলো।
এই গ্রুপে বাচ্চাদের বয়স যেমন ছয় বছর, তেমনই ৭০ বছরের বেশি বা তার কাছাকাছি কয়েকজন ছিলেন৷ কিন্তু বয়স তাঁদের কাছে সংখ্যা মাত্র, এই মানুষগুলোকে এই চারদিন কাছ থেকে দেখে আরও বেশি জীবনের প্রতি ভালবাসা জাগলো। এমন করেই মনে হয় ভালো থাকা যায়। পেশায় কলেজ, স্কুল শিক্ষক থেকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসের কর্মকর্তাও যেমন ছিলেন, তেমনই সিনিয়র ডাক্তারবাবু যিনি ফিটনেস বিশারদ তিনি এবং সদ্য পাশ করা বাচ্চা ডাক্তারবাবুও ছিলেন। এছাড়া তরুণ প্রজন্মের এক ঝাঁক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত ছেলে বা চিকিৎসা কর্মীও আমাদের দলের সদস্য ছিলেন৷ তবে পেশাগত এই পরিচয়ের বাইরেও এক একজনের এক বিষয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বেশি। কেউ পক্ষী বিশারদ, অনেকেই মাউন্টেনিয়ারিং এর কোর্স করা, প্রচুর কঠিন ট্রেকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, আবার কেউ কেউ ফটোগ্রাফিতে বিশেষজ্ঞ, কেউ নানারকম পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত, সমাজসেবী… এমন আলাদা নানা রকম কাজের ক্ষেত্রের মানুষ তাঁরা। (পরের পর্বে সমাপ্ত)
কভারের ছবি মাউন্ট পান্ডিম