পরভিন ববিকে ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা অভিনেত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ২০২২ সালে, তিনি আউটলুক ইন্ডিয়ার ” ৭৫ সেরা বলিউড অভিনেত্রী” তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন।ববি হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে স্টাইলিশ এবং সুন্দরী অভিনেত্রীদের একজন ছিলেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া তাকে তার “৫০ সুন্দর মুখ” তালিকায় রেখেছে। Rediff.com ববিকে তার “সর্বকালের সবচেয়ে সেক্সি বলিউড তারকা” তালিকায় সপ্তম স্থানে রেখেছে। ববিকে সর্বকালের হটেস্ট বলিউড অভিনেত্রীদের মধ্যে বিবেচনা করা হয়।
এই সফল অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই কষ্টের এবং বিতর্কে মোড়া। অভিনেতা-পরিচালক ড্যানি ডেনজংপার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন পরভিন।চার বছর সম্পর্কে থাকার পরও কখনই এই সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলেননি ড্যানি।অথচ সাহসী ও সুন্দর অভিনেতা ড্যানি ছিলেন পরভীন ববির প্রথম প্রেম। মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, প্রথম সাক্ষাতের পরেই দুজন একে অপরকে পছন্দ করতে শুরু করেন।দুজনে একে অপরকে একান্তে দেখা শুরু করে এবং দ্রুত ডেটিং থেকে লিভ-ইন সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যায়। পারভীন কোনো মূল্যে ড্যানির সঙ্গে বিচ্ছেদ চাননি। সে তাকে খুব ভালবাসত। তাই ব্রেকআপের পরও বন্ধুত্ব বজায় রেখেছেন তারা।
এরপর ড্যানির জীবনে কিম আসেন এবং পরভীন কবির বেদীর সাথে ডেটিং শুরু করেন। পারভীন প্রায়ই কবিরকে না জানিয়ে ড্যানির কাছে যেত। কবির বেদীর সঙ্গে এই প্রেমও টিকলো না পরভীন ববির।
এর পর যাঁর সঙ্গে নিজেকে প্রেমের বাঁধনে বাঁধলেন তিনি ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক মহেশ ভট্ট। ১৯৭৭ সাল থেকে বলিপাড়ার অন্যতম চর্চিত বিষয় ছিল মহেশের সঙ্গে পরভীনের প্রেম। স্ত্রীকে ছেড়ে পরভীনের সঙ্গে মহেশ একসঙ্গে থাকতেন। তবে সেই প্রেমের পরিণতি ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হয়নি। যতদিন গড়িয়েছে উথাল পাতাল হয়েছে তাদের জীবন।
একটা ঘটনার উল্লেখ করি, সময়টা ১৯৭৯। একদিন ঘরে ঢুকে দেখলেন ঘরের কোণে হাতে ছুঁড়ি নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে বসে আছে পরভিন। মহেশকে ইশারায় পরভিন বোঝানোর চেষ্টা করছে চুপ করে থাকতে কারণ ঘরে অন্য কেউ রয়েছে যে পরভিনকে হত্যা করতে চায়।
পরভিনের এই অবস্থা দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মহেশ। পরে বুঝবেন পরভিনের কোন সমস্যা হয়েছে, ছুটে গেলেন ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষার পর জানা গেল তিনি আক্রান্ত হয়েছেন স্কিৎজোফ্রেনিয়ায়।
পরভিনকে সুস্থ করতে মরিয়া মহেশ ছুটিছিলেন বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীর কাছে, যদিও সেরকম কিছু লাভ হয়নি। ধীরে ধীরে প্রচন্ড সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছিল পরভিন। তাকে খাবার দেওয়া হলে সে আগে জোর করে খাওয়াতো মহেশকে, খাবারে কিছু মেশানো আছে কিনা জানতে। প্রায় সময় বলতো তার গাড়িতে কেউ বোম রেখে দিয়েছে। মেকআপ করতেও ভয় পেতো, মনে করতো মেকাপের মধ্যে কোন বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে তার ত্বকের ক্ষতির জন্য। এমনকি ওষুধ ঠিকমতো খেতে চাইত না পরভিন। শান ছবির শুটিং এর সময় একটি ঝাড়বাতি তলায় শর্ট দিতে চাননি পরভিন। তার মনে হয়েছিল ঝাড়বাতি ফেলে তাকে মেরে ফেলতে পারে অমিতাভ বচ্চন এবং পরিচালক রমেশ সিপ্পি।
খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও ধীরে ধীরে পতনের পথে এগিয়ে গেলেন পরভিন। মহেশ ভাটের সঙ্গে পরভিনের আড়াই বছরের মত সম্পর্কও ইতি টানলো।
১৯৮২ সালে মহেশ ভাট তৈরি করলেন তার বিখ্যাত সিনেমা ‘অর্থ’। ইতিমধ্যে চাউর হয়ে গিয়েছে ‘অর্থ’ সিনেমাটির অন্যতম প্রধান নারী চরিত্রটি আসলে পরভিন ববির আদলে তৈরি। নিজের স্ত্রী আর পরভিনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়নের বাস্তব কাহিনী যেন চিত্রনাট্য স্থান পেয়েছে কল্পনা হিসেবে। সেখানে স্মিতা পাটিল আর শাবানা আজমির চরিত্র দুটির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে স্ত্রী আর প্রেমিকার ছায়া।
খবর পেলেন পরভিন, আবার মুষড়ে ভেঙে পড়লেন। পরভিন নিজেকে আদার ওম্যান হিসেবে ভাবতে পারছিলেন না।এই সিনেমায় পরিচালক সেই ভদ্রলোক যিনি কয়েক বছর আগেও ছিলেন পরভিনের সব থেকে কাছের মানুষ, তারা আস্থা অর্জন করা এক প্রেমিক। সেই লোকটিকে যখন কাজের সুযোগ পাচ্ছিলেন না তখন তাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করেছেন পরভিন। সেই বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি নিজের স্ত্রী সন্তানকে অবহেলা করেও পরভিনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন কিন্তু পরভিনের সঙ্গে একসময় যখন প্রবল ইগো নিয়ে দূরত্ব তৈরি হলো। আর সেই সময় থেকে পরভীনের মধ্যে দেখা গেল এক অসম্ভব মানসিক অস্থিরতা, সেই পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্কের বিচ্ছেদ হলো পরভিনের। আবার একা হয়ে গেলেন পরভিন। গভীরভাবে গ্রাস করলে তাকে মানসিক বিষাদ তবুও তিনি কাজের মধ্যে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন।
১৯৮৩ সালের ৩০ জুলাই ববি ভারত ত্যাগ করেন এবং দার্শনিক বন্ধু ইউজি কৃষ্ণমূর্তির সাথে আধ্যাত্মিক যাত্রার জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়া ও হিউস্টনে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ৭ এপ্রিল, জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা কর্মীরা জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে তার পরিচয় দিতে পারেননি। সেই সময় তাঁকে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। তিনি প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।
তিনি ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে মুম্বাইতে ফিরে আসেন এক অন্যরূপে। কোথায় সেই আবেদনময়ী গ্ল্যামার কুইন! পরভিন তখন মোটা, চামড়া খসখসে প্রবল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বম্বেতে নিজে পুরনো ফ্ল্যাট ছিল না, বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। মানসিক অসুস্থতা ডায়াবেটিস, সিগারেট, ড্রিংকস, এলএসডি ড্রাগের প্রতি টান একসঙ্গে মিলেমিশে পরভিনকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে গ্যাংগ্রিন হওয়ার জন্য তাকে হুইল চেয়ারের সাহায্য নিতে হতো। চলতে ফিরতে পারতেন না।জুহুর একটি ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন।
২০০৫ সালে ২২শে জানুয়ারি মুম্বাই পুলিশ স্টেশনে খবর দেয়া হয় তিনদিন ধরে ফ্ল্যাটের সামনে খবরে কাগজ, মুদিখানা ডেলিভারি সব বাইরে পড়ে রয়েছে। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকলে পুলিশ দেখতে পায় হুইল চেয়ারে মৃত অবস্থায় পরে রয়েছেন পরভীন। কুপার হাসপাতালে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা যায়, তিন দিন ধরে পাকস্থলীতে কোন খাবার ছিল না। তবে কিছু অ্যালকোহল (সম্ভবত তার ওষুধ থেকে) পাওয়া গেছে।
২০ সে জানুয়ারি তার মৃত্যুর পর মহারাষ্ট্রের রাজ্য প্রশাসক তার সম্পত্তি এবং সম্পদের একমাত্র অভিভাবক হয়েছিলেন। যদিও তার মৃত্যুর পর সম্পত্তির জন্য বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিভিন্ন দূরবর্তী আত্মীয়রা জুনাগড় ব্যাঙ্কের লকারে পড়ে থাকা তার সম্পত্তির উইলের বিষয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন, যা অভিনেতা এবং বন্ধু মুরাদখান ও ববি যৌথভাবে সম্পাদন করেছিলেন। উইলে বলা হয়েছে যে ববি পরিবারের দরিদ্র সদস্যদের সাহায্য করার জন্য তার সম্পত্তির ৭০% তার নামে তৈরি একটি ট্রাস্টে রাখতে হবে। ২০% মুরাদ খানকে দেওয়া হয় কারণ তিনি বাlবির কাছে “একটি পথপ্রদর্শক শক্তি” হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন এবং ১০% খ্রিস্টান মিশনারি তহবিলে দেওয়ার কথা উল্লিখিত ছিল।
কোন এক সময় সকলেই ভুলে গিয়েছিলেন পরভিন ববি নামক উল্কাকে। কিন্তু পরভিন ববিরা সম্পূর্ণ নিভে যায় না। মরে যাওয়ার পর রেখে গেলেন ‘জওয়ানি জানেমান হাসিনা দিলরুবার’ মোহময়ী গানের ছন্দে এক ধূমকেতু সুলভ উজ্জ্বল তারকাচিহ্নকে। (সমাপ্ত)