রাজস্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা মনোরম পরিবেশে আরাবল্লি পাহাড়ের কোলে আছে এক রহস্যময়, অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির। যার নাম পরশুরাম মহাদেব গুহামন্দির। পরশুরাম নিজেই কুঠার দিয়ে পাথর কেটে তৈরি করেছিলেন এই গুহামন্দির। এই গুহা মন্দিরে পৌঁছতে আপনাকে ৫০০ ধাপ সিঁড়ি পাড়ি দিতে হবে। মন্দিরের ভিতরে একটি স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ আছে।মান্যতা আছে, বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম ভগবান শিবের বহু বছর ধরে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। সেই তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব এখানে স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ রূপে প্রকট হন।
দেবরাজ ইন্দ্রের কৃপায় মহর্ষি জমদগ্নি এবং মাতা রেণুকার পঞ্চম সন্তান পরশুরামের জন্ম হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়। দম্ভে পরিপূর্ণ ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের নিধনের উদ্দেশ্যে এই পাহাড়ের গুহায় বহু বছর শিবের কঠিন তপস্যা করেছিলেন পরশুরাম। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অক্ষয় ধনুক, তৃণীর এবং দিব্যি কুঠার দান করেন।
আশ্চর্যের বিষয় হল পুরো গুহাটি একটি পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। গুহার উপরের প্যাটার্নটি গরুর বাঁটের মতো দেখতে। প্রাকৃতিক স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের ঠিক উপরেই গোমুখ। সেই গোমুখ থেকে শিবলিঙ্গের উপর অবিরামধারায় জলাভিষেক হচ্ছে। গুহার ভিতরে একটি ধুনিও আছে।এটা বিশ্বাস করা হয় যে প্রধান শিবলিঙ্গের নীচে তৈরি ভগবান পরশুরাম শিবের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। এই গুহায়, একটি পাথরের উপর একটি দানবের আকৃতি রয়ে গেছে। পরশুরাম তাঁর মুষ্টিতে আঘাত করেছিলেন রাক্ষসকে। এই গুহামন্দিরে শংকর, পার্বতী এবং কার্তিকের মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও এখানে নয়টি কুন্ড রয়েছে যা কখনও শুকায় না। এটি একটি মনোরম এবং আনন্দদায়ক স্থান। এটিকে রাজস্থানের অমরনাথ মন্দির বলা হয় এবং ভারতের দ্বিতীয় অমরনাথ মন্দির নামেও এটি পরিচিত।
এই মন্দিরের শিবলিঙ্গকে ঘিরে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেকের মতে, শিবলিঙ্গের প্রথম প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন জমদগ্নি।
আরেকটি বৈধতা গুহা মন্দিরের স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গের সাথে যুক্ত। মন্দিরের গুহা শিবলিঙ্গে একটি ছিদ্র রয়েছে, যা বিশ্বাস করা হয় যে, প্রতিদিন দুধ দিয়ে অভিষেক করার সময় দুধ ছিদ্রে পড়ে না, শত জল ঢাললেও ছিদ্র কখনো ভরে না। যে রহস্য আজো কেউ সমাধান করতে পারেনি। এই স্থানেই পরশুরাম শিক্ষা দিয়েছিলেন দানবীর কর্ণকে।
পুরান অনুসারে, প্রতিদিন পরশুরামের মা রেণুকা মহর্ষির পুজার জন্য জল আনতেন নদী থেকে। একদিন ঋষি যখন যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত, স্ত্রী নদীতে জল আনতে গেলেন। সেদিন মার্তিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথ নৌকায় স্ত্রীদের সঙ্গে কামক্রীড়ায় লিপ্ত ছিলেন। রেণুকা সেই দৃশ্য দেখে কামাসক্ত হয়ে পরেন। সম্বিৎ ফিরে আসতে অনেকটা সময় চলে যায়। এদিকে পুজোর সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় ক্রুদ্ধ জমদগ্নি রেণুকার আত্মমর্যাদা বিরোধী মানসিক ব্যভিচারের জন্য দণ্ডস্বরূপ তাঁর সকল পুত্রদের মাতৃহত্যা করার আদেশ দেন। প্রথম চার পুত্র পিতার আজ্ঞা মানলো না। ফলস্বরূপ চার পুত্রই পিতার কাছ থেকে জড়ত্বের অভিশাপে জর্জরিত হলো। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতারা যে দুঃসাহস দেখাতে পারেনি, ছোট ছেলে পরশুরাম পিতার তপোবলে প্রভাবিত হয়ে আজ্ঞানুসারে মাতার শিরোচ্ছেদ করলেন। পিতৃ আজ্ঞা পালিত হওয়ায় জমদগ্নি পরশুরামের উপর খুশি হলেন এবং যে কোন বর চাইতে বললেন।
পরশুরাম একসাথে তিনটি বর চাইলেন। এক— মায়ের পুনর্জন্ম ও মৃত্যুর স্মৃতি যেন মায়ের স্মরণে না থাকে, দুই— ভাইদের জড়ত্বমুক্তি, তিন— নিজের দীর্ঘায়ু ও অজেয়ত্বের বর। পরশুরামের সকল প্রার্থনাই জমদগ্নি পূর্ন করলেন কিন্তু মাতৃহত্যাজনিত পাপে কুঠারটি পরশুরামের হাতেই লেগে থাকলো। পিতার আদেশে ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার পর মাতৃহত্যার পাপ থেকে তিনি মুক্ত হন এবং হাত থেকে কুঠারটি আলাদা হয়।
আবার অন্য একটি মতে, পরশুরাম তাঁর অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হন এবং তৎকালীন প্রখ্যাত ঋষিদের পরামর্শ নিয়ে লোহিত নদীর বিশুদ্ধ জলে হাত ধুতে আসেন। এটি তাঁর সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি পাবার একটি উপায় ছিল। তিনি জলে হাত ডুবানোর সাথে সাথে কুঠারটি অবিলম্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারপর থেকে তিনি যেখানে হাত ধুয়েছিলেন সেই স্থানটি একটি উপাসনালয় হয়ে ওঠে এবং সাধুদের দ্বারা পরশুরাম কুন্ড নামে পরিচিত হয়। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অঞ্চলভেদে অনেক গল্প রয়েছে যা উপরোক্ত ঘটনার বর্ণনা করে। সাধু দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পরশুরাম কুন্ডের স্থানটি ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল কিন্তু ভূমিকম্পের দরুণ তা নষ্ট হয়ে যায়। যদিও সেখানে নতুন একটি জলস্রোতের সৃষ্টি হয়। (“Parashuram Kund”)
পরশুরাম মহাদেব মন্দির রাজস্থানের রাজসমন্দ ও পালি জেলার সীমান্তে অবস্থিত। মূলগুহা মন্দিরটি আসে রাজসামন্দ জেলায় এবং কুন্ডধাম অবস্থিত পালি জেলায়। এটি পালি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে এবং বিখ্যাত বিখ্যাত কুম্ভলগড় দুর্গ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০ ফুট উঁচুতে আরাবল্লি পর্বত শ্রেণীতে অবস্থিত। দূরে সাদরী এলাকায় পরশুরাম মহাদেবের বাগান আছে। গুহা মন্দির থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত মাতৃকুন্ডিয়া, যেখানে পরশুরাম মাতৃকার পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এছাড়াও এখান থেকে ১০০ কিমি দূরে আছে পরশুরামের পিতা মহর্ষি জমদগ্নির তপোভূমি।
তীর্থস্থান দর্শন অভিলাষী হলে অবশ্যই এই দর্শনীয় মন্দিরটি চাক্ষুষ করে আসতে পারেন।
তথ্যসূত্র : রং রঙ্গিলো রাজস্থান এবং परशुराम महादेव गुफा मंदिर – मेवाड़ का अमरनाथ – स्वंय परशुराम ने फरसे से चट्टान को काटकर किया था निर्माण….আজব গজব | হিন্দি।
Eta. Jantam na
Thanks for the update
Lekha khub sundor hoeche…thank you so much
খুবই ভালো লেখা। আনন্দের সাথে পড়লাম। ভালো লেগেছে। সময় পেলে যেতে পারি।
I wish I be there in future.
পড়ে ভালো লাগলো
এতো বিস্তারিত ভাবে জানা ছিল না, ভীষণ ভাল লাগল, নিপুণ হাতের রচনা।