রবিবার | ১২ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:২৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (সপ্তম পর্ব) : আবদুশ শাকুর যে শিক্ষকের অভাবে ‘বিবেক’ জাগ্রত হয় না : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভিয়েতনামের গল্প (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (ষষ্ঠ পর্ব) : আবদুশ শাকুর দিল্লি বিধানসভা ভোটেই নিশ্চিত হচ্ছে বিজেপি বিরোধি জোটের ভাঙন : তপন মল্লিক চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুরের গানের চর্চা : অসিত দাস মমতা বললেন, এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দুষ্টচক্র হু জানাল চিন্তা নেই : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (পঞ্চম পর্ব) : আবদুশ শাকুর পৌষ পুত্রদা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (চতুর্থ পর্ব) : আবদুশ শাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় কবিগান ও যাত্রার আসর : অসিত দাস সসীমকুমার বাড়ৈ-এর ছোটগল্প ‘ঋতুমতী হওয়ার প্রার্থনা’ সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলনে সিনেমা : সায়র ব্যানার্জী নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘সুও দুও ভাসে’ বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (তৃতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর ভিয়েতনামের গল্প (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব নীলমণি ঠাকুরের মেছুয়া-যাত্রা, একটি ঐতিহাসিক পুনর্নির্মাণ : অসিত দাস বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (দ্বিতীয় পর্ব) : আবদুশ শাকুর কাদের প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিরা বাংলার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্রসাহিত্যে কবিয়াল ও কবির লড়াই : অসিত দাস নকল দাঁতের আসল গল্প : রিঙ্কি সামন্ত বাংলা গান থাকুক সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী (প্রথম পর্ব) : আবদুশ শাকুর মুর্শিদাবাদের কৃষি ঐতিহ্য : অনুপম পাল নক্সী কাঁথায় বোনা জসীমউদ্দীনের বাল্যজীবন : মনোজিৎকুমার দাস পঞ্চানন কুশারীর জাহাজী গানই কি কবির লড়াইয়ের মূল উৎস : অসিত দাস দিব্যেন্দু পালিত-এর ছোটগল্প ‘ঝালমুড়ি’ নকশালবাড়ি আন্দোলন ও বাংলা কবিতা : কার্তিক কুমার মণ্ডল নিঃসঙ্গ ও একাকিত্বের আখ্যান : পুরুষোত্তম সিংহ ভিয়েতনামের গল্প (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব অন্তরের আলো জ্বালাতেই কল্পতরু উৎসব : সন্দীপন বিশ্বাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই ২০২৫ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

পাওলো রোসি : খলনায়ক থেকে জনতার নায়ক : লিখছেন জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় / ৩৫৬ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০

১৯৮২ বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দলটি ছিল সেই দলটি। কি ছিল না সেই দলে। সাদা পেলে হিসেবে পরিচিত ফুটবল মহা তারকা জিকো। ছিলেন ফুটবলের দার্শনিক মিস্টার সক্রেটিস দলটির নেতার ভূমিকায়। ফালকাও, জুনিনহো, জুনিয়র, সার্জিনহোদের নিয়ে গড়া ছিল সেই দলটি। বিশ্বকাপ যখন শুরু হয় তখন ওই বিশ্বকাপে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ব্রাজিলকে অনেকেই নিশ্চিত ধরে নিয়েই হিসাব নিকাশ শুরু করেছিল। কেনই বা সেই হিসাব নিকাশ করবে না যেখানে আছে অন্যান্য দলগুলোর তুলনায় সব মহা তারকারা। গ্রুপ পর্বে সেই প্রতাপ ধরে রেখেছিল তারা। সক্রেটিস আর এডারের গোলে প্রথম ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-১ গোলে হারায় দলটি। পরের ম্যাচে স্কটল্যান্ডকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। জিকো, অস্কার, এডার ও ফালকাও করেছিল গোল। আর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারায় ৪-০ গোলে। গ্রুপ সেরা হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের গ্রুপে ব্রাজিলের সঙ্গে পড়ে আর্জেন্টিনা ও ইতালি। প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দেয় জিকো-জুনিয়ররা। একটি করে গোল করেন জিকো, জুনিয়র, সার্জিনহো। দ্বিতীয় ম্যাচ ইতালির বিপক্ষে।  ওই ম্যাচে ব্রাজিল ড্র করলেই হয়ে যেত। কিন্তু এই ম্যাচেই দর্শক, সমালোচক, সাংবাদিক এবং ফুটবল বোদ্ধাদের সব অঙ্ক উল্টে দিলেন ১৯৮২-র বিশ্বকাপের নায়ক পাওলো রোসি।

ম্যারাডোনার ৮৬ বিশ্বকাপটা যদি রূপকথা হয়, তাহলে রোসির ৮২ বিশ্বকাপ জয় তার চেয়ে খুব কম কিছু নয়। সেই বিশ্বকাপে রোসির খেলাটাই ছিল একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। দুই বছর আগে পেরুজিয়ার হয়ে খেলতে গিয়ে ম্যাচ ফিক্সিং কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন রোসি। অভিযোগ উঠেছিল, ইচ্ছে করে একটা ম্যাচ হেরে গিয়েছিল রোসির দল। তীর এসেছিল রোসির দিকে, তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। নিষেধাজ্ঞার কারণে পুরো ১৯৮০-৮১ মরসুমে ফুটবল মাঠ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিলো রোসিকে। তবে এই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ায় পুরনো ক্লাব জুভেন্টাস। ১৯৮১-৮২ মরসুমের একদম শেষদিকে বিশ্বকাপে খেলার কথা বিবেচনা করে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন রোসির নিষেধাজ্ঞা এক বছর কমিয়ে আনে, যার ফলে সেই মরসুমের শেষ তিন ম্যাচে জুভেন্টাসের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান রোসি। বিশ্বকাপের আগে দুই মরসুমে মাত্র তিন ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও ইতালিয়ান কোচ এনজো বেয়ারজট রোসির উপরেই আস্থা রাখেন এবং তাকে ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ করে দেন। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র দুই মাস আগে খেলার অনুমতি মেলে।

এনজোর আস্থার কারণে বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেও গ্রুপপর্বে সেই আস্থার মর্যাদা একদমই দিতে পারেননি রোসি। ইতালির প্রথম তিন ম্যাচে হাজারখানেক নয়, সম্ভবত লাখো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন রোসি। এই তিন ম্যাচে মাঠে দৌড়েছেন উদ্দেশ্যহীন, ফিটনেসের দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। যেন কেউ তাঁকে জোর করে নামিয়ে দিয়েছে মাঠে! সংবাদমাধ্যম তখন তাঁর ও কোচের মুণ্ডুপাত করছে। করবেই বা না কেন! প্রথম চার ম্যাচে রোসির পায়ে গোল নেই, খেলার ধারও ভোঁতা করাতের মতো। রোসি তাই বলেছিলেন, ‘সবাই আমার কাছ থেকে অলৌকিক কিছু দেখতে চায়। অথচ শেষ দুই বছর অলস সময় কেটেছে। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলাম। এ অবস্থায় ইতালিয়ান ফুটবলের সব সমস্যার সমাধান করাটা কেউ আমার কাছে প্রত্যাশা করে কীভাবে! শুধু পেলের মতো কেউ একটা দলকে পাল্টে দিতে পারে। আমি তো পেলে নই। জানি না সবাই কী প্রত্যাশা করছে, কিন্তু তা মেটাতে আমাকে অন্তত হাজারখানেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।’ তিন ম্যাচে তিন পয়েন্ট নিয়ে কোনোমতে গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের ছাড়পত্র পায় ইতালি। গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোতে রোসির অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে ইতালির এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন “রোসির খেলা দেখে মনে হচ্ছে একটা ভূত উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে।”

দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালি গ্রুপসঙ্গী হিসেবে পায় এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও ৮২ বিশ্বকাপের হট ফেভারিট ব্রাজিলকে। আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারায় ইতালি। তবে ঐম্যাচেও গোলশূন্য ছিলেন রোসি। অন্য ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে হারায় ব্রাজিল, যার ফলে শেষ ম্যাচে সমীকরণ এমন দাঁড়ায় যে সেমিফাইনালে যেতে হলে ইতালিকে ব্রাজিলের বিপক্ষে জিততেই হবে। অন্যদিকে ম্যাচটা ড্র করলেই ব্রাজিল উঠে যেত পরের রাউন্ডে।

সেবারের ব্রাজিল দলটাকে বলা হচ্ছিলো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল আর ইতালির ছন্নছাড়া অবস্থার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাই ইতালির ঘোরতর সমর্থকরাও জয়ের কথা জোর গলায় বলতে পারছিলো না। এমন বড় ম্যাচের আগে মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে আগের চার ম্যাচে গোলের দেখা না পাওয়া পাওলো রোসিকে একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এনজো তার শিষ্যের উপর থেকে আস্থা হারাননি। আগের চার ম্যাচে কোচের আস্থার মান রোসি দিতে পারেননি, কিন্তু এ ম্যাচে সব পাশার দান উল্টে দেন রোসি নিজেই।

খেলার শুরু থেকেই ইতালিকে চেপে ধরে ব্রাজিল। কিন্তু খেলার ৫ মিনিটে অ্যান্টোনিও ক্যাব্রিনির ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ইতালিকে ১-০ তে এগিয়ে দেন রোসি। এই গোলটি রোসির আত্মবিশ্বাসের পারদকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলো। এ ব্যাপারে তিনি বলেন “প্রথম গোলটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই গোলটার পরেই সবকিছু কল্পনাতীতভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। ওই গোলটার আগে কোনোকিছুই আমার পক্ষে যাচ্ছিলো না। কিন্তু ওই গোলটার পরে সবকিছুই যেন আমার পক্ষে যাওয়া শুরু করলো। একটা গোল সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে পারে আর আমার ক্ষেত্রে ওটা আমার পুরো জীবনকেই বদলে দিয়েছিলো। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য।”

রোসির একটা কথাও যে অত্যুক্তি না তা ওই ম্যাচের বাকি অংশ দেখলেই বোঝা যায়। ১২ মিনিটে সক্রেটিস ব্রাজিলকে সমতায় ফেরালেও ২৫ মিনিটের মাথায় আবারো রোসির ম্যাজিক! এবার ব্রাজিলের ফ্যালকাওয়ের ভুল পাস থেকে বল পেয়ে অসাধারণ এক শটে গোল করে ২-১ ব্যবধানে ইতালিকে এগিয়ে দেন রোসি। তবে ৬৮ মিনিটে দূরপাল্লার এক শটে ফ্যালকাও গোল করে ২-২ স্কোরলাইন করলে ইতালির সেমিফাইনালের স্বপ্ন প্রায় ভাঙ্গতে বসেছিলো।

কিন্তু আগের চারম্যাচে ভূত হয়ে থাকা রোসি যে এ ম্যাচে ফিরেছিলেন স্বর্গের দূত হয়েই তার প্রমাণ বিশ্ববাসী পেলো খেলার ৭৪ মিনিটে। মার্কো তারদেল্লির পাস থেকে আনমার্কড রোসি গোল করে ইতালিকে এগিয়ে দিল ৩-২ গোলে আর পূরণ করলেন নিজের হ্যাটট্রিক। যে রোসি আগের চার ম্যাচে একটাও গোল করতে পারেননি, সেই তিনিই এমন বাঁচা-মরার ম্যাচে করলেন হ্যাটট্রিক! রোসির এই গোলেই সর্বকালের অন্যতম সেরা দলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ইতালি। আর যে রোসিকে বাদ দেওয়ার জন্য মিডিয়া উঠেপড়ে লেগেছিলো, সেই তারই প্রশংসাতে পঞ্চমুখ হয়ে যায় ইতালি এবং বিশ্বের সকল সংবাদমাধ্যম! ৯০ মিনিটের একটা ম্যাচ কেলেই রোসি সারা বিশ্বের কাছে একেবারে জিরো থেকে হিরো বনে গেলেন। হট ফেভারিট ব্রাজিলকে বিদায় করার পর পুরো ইতালি দলের মনোভাবই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। এ ব্যাপারে রোসি বলেন, “ব্রাজিলকে হারানোর পর আমাদের আত্মবিশ্বাস একদম চূড়ায় উঠে গিয়েছিলো, মনে হচ্ছিলো বিশ্বের যেকোনো দলকেই আমরা হারাতে পারি। যদিও তখনো সেমিফাইনাল আর ফাইনাল বাকি ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিলো ঐ দুইটা ম্যাচ শুধুই আনুষ্ঠানিকতার জন্যই।” সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ইতালি আর সেখানেও পাওলো রোসির ম্যাজিক, রোসির জোড়া গোলে ভর করে পোলিশদের ২-০ গোলে হারিয়ে ইতালি চলে যায় ফাইনালে।

ফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি। দু-দলের সামনেই ব্রাজিলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডে ভাগ বসানোর হাতছানি। আসলে উইঙ্গার হলেও কেরিয়ারের দীর্ঘ সময় সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেছেন রোসি। বিরাশির বিশ্বকাপে তার মহানায়কোচিত পারফরম্যান্স আজও মনে রেখেছে ইটালি। খেলার প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে, দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিটে ডেডলক ভাঙ্গেন পাওলো রোসি, অ্যান্টনিও ক্যাব্রিনির ক্রস বাউন্স খেয়ে রোসির কাছে এলে তা জালে জড়িয়ে দলকে ১-০ তে এগিয়ে দেন রোসি।

রোসির গোলের পর পুরো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ইতালির কাছে চলে যায়। এরপর তারদেল্লি, আন্তোনিয়ো কাব্রিনি-র গোলে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয় ইতালির আর এর সাথে সাথে নিশ্চিত হয় ইতালির তৃতীয়বারের মতন বিশ্বজয়। যে রোসির বিশ্বকাপই খেলার কথা ছিল না, যিনি কিনা প্রথম চার ম্যাচে কোনো গোলই পাননি, সেই রোসি শেষ তিনটা বাঁচা-মরার ম্যাচে ছয় গোল করে জিতে নেন ওই আসরের গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। শুধু তা-ই নয়, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে গোল্ডেন বলও জিতে নেন পাওলো রোসি। গারিঞ্চা ও মারিও কেম্পেসের পরে মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একইসাথে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় হওয়ার গৌরব অর্জন করেন পাওলো রোসি।

তবে এসব ব্যক্তিগত পুরস্কারের চেয়েও রোসির কাছে মূল্যবান ছিল দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারাটা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেদিন থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করেছি সেদিন থেকে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলে বিশ্বকাপ জয়ের ফলে এতগুলো মানুষকে খুশি করতে পেরে যেই তৃপ্তি পেয়েছি সেটার কাছে ব্যক্তিগত সমস্ত অর্জন তুচ্ছ।”

শনিবার ভিসেঞ্জার সান্তা মারিয়া অ্যানানসিয়েতা ক্যাথিড্রালে সমাহিত করা হয় রোসিকে। করোনা অতিমারির কারণে মাত্র ৩০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন রোসির স্ত্রী ফেদেরিকাও। রোসির কফিন বহন করে নিয়ে যান ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলের সদস্যদের অন্যতম মার্কো তারদেল্লি, আন্তোনিয়ো কাব্রিনি। কফিনের উপরে সাজানো ছিল বিশ্বকাপে পরা রোসির বিখ্যাত নীল রংয়ের জার্সি। তাদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন রবের্তো বাজ্জো এবং পাওলো মালদিনি। ছিলেন রোসির পুত্র আলেসান্দ্রোও। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুজুপ্পে কোন্তে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘রোসি চিরদিন বেঁচে থাকবেন। ৮২-র আসরে তাঁর একেকটা গোল গোটা প্রজন্মকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে।’ মিলান কিংবদন্তি ফ্রাংকো বারেসিও টুইটারে লিখেছেন সে কথা, ‘তুমিই ইতালিয়ানদের স্বপ্নটা ধারণ করেছিলে, আর ভালোবাসায় জায়গা করে নিয়েছিলে আমাদের বুকে। তোমার তাই মৃত্যু নেই।’ ৮২-র স্পেন বিশ্বকাপে রোসির সঙ্গেই অসাধারণ খেলা দিনো জফ ৭৮ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে বন্ধুকে স্মরণ করেছেন, ‘অসাধারণ ফুটবলার ছিল রোসি, চমৎকার একজন সতীর্থ আর দারুণ বন্ধু। আমাদের  গ্রুপ থেকে তাকে আলাদা করা যাবে না কিছুতেই। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে যখন ফিরল, ওকে নিয়ে কোনো দ্বিধাই ছিল না আমাদের। কারণ আমরা জানতাম কী অসাধারণ ফুটবলার সে।’ শোকাচ্ছন্ন কাব্রিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু এক প্রাক্তন সতীর্থকেই হারালাম না, তারই সঙ্গে হারালাম এক বন্ধু এবং ভাইকে। আমরা মাঠে একসঙ্গে লড়াই করেছি। কখনও জিতেছি, কখনও আবার হেরেওছি। হতাশও হয়েছি। কিন্তু ওর এভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।’ প্রাক্তন ইতালি তারকা পাওলো মালদিনি বলেছেন, ‘রোসি ছিলেন ইতালি ফুটবলের গৌরব। এমনিতেই এই বছরটা খুব যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছে আমাদের সকলকে। তার মধ্যে রোসির মতো কিংবদন্তির বিদায় সামনের দিনগুলোকে যেন আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে।’

দুই

পাওলো রোসির জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ইতালির প্রাটোতে। মাত্র ছ’বছর বয়স থেকেই ফুটবলে হাতেখড়ি রোসির, সেসময়ে অবসরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে গিয়েই একসময় এই খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে যান। একপর্যায়ে রোসির জীবন পড়ালেখা ও ফুটবল এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সান্টা লুসিয়ায় খেলতে খেলতেই আস্তে আস্তে পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার দিকে ঝুঁকতে থাকেন। এরপর অ্যাম্ব্রোসনিয়ায় কিছুদিন খেলার পর চলে যান ফ্লোরেন্সের ক্যাটোলিকা ভার্চুসে। ১৬ বছর বয়সে ক্যাটোলিকার হয়ে শিয়েতি টুর্নামেন্ট খেলার সময়েই জুভেন্টাসের তৎকালীন ম্যানেজার ইতালো অ্যালোডির নজরে পড়ে যান। জুভেন্টাস ম্যানেজারে সেসময়েই তাকে জুভেন্টাস জুনিয়র টিমের জন্য দলে ভেড়াতে চাইলেও রোসির বাবা-মা তাদের ছেলেকে দূরের এক শহরে একা পাঠাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত রোসির জেদের কাছে হার মানেন তার বাবা-মা, জুভেন্টাসের হাত ধরেই রোসির পেশাদার ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়। এ ব্যাপারে রোসি বলেন “বাবা-মা কখনোই চাননি আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে ফুটবলের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কিন্তু জুভেন্টাসের অফারটা আসার পর থেকেই ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম আর বুঝতে পারলাম ফুটবলই আমার জীবনের সবকিছু, এই স্বপ্নই আমাকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।”

কিন্তু পাওলো রোসি সেসময়ে শারীরিকভাবে পেশাদার ফুটবলের জন্য পুরোপুরি তৈরি ছিলেন না, জুভেন্টাসে যোগদানের পরে তিনটি ইনজুরির কারণে দুই সিজন মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৭৪ সালে কোপা ইতালিয়ার এক ম্যাচে জুভেন্টাসের হয়ে অভিষেক ঘটে রোসির। এরপর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাকে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব কমোয় লোনে পাঠায় জুভেন্টাস, সেখানে সিরি আ লিগে অভিষেক ঘটে রোসির, তবে কমোয় ছয় ম্যাচ খেলেও গোলের দেখা রোসি পাননি। ১৯৭৬-৭৭ মরসুমে তৎকালীন সিরি বি এর ক্লাব ভিসেঞ্জায় লোনে যোগদান করেন রোসি আর এই ভিসেঞ্জা অধ্যায়ই হয়ে যায় রোসির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রোসি মূলত রাইট উইঙ্গার হিসেবেই খেলতেন। কিন্তু তৎকালীন কোচ জিওভান বাতিস্তা ২০ বছরের রোসির মধ্যে একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হওয়ার অমিয় প্রতিভা খুঁজে পান এবং রোসিকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানো শুরু করেন।

রোসির ফুটবল ক্যারিয়ারে বাতিস্তার ভূমিকা ছিল বাবার মতো। বাতিস্তার ব্যাপারে রোসি বলেন, “মানুষ হিসেবে উনি ছিলেন অসাধারণ, আমি যাতে নতুন ক্লাবে এসে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারি, সেব্যাপারে সবকিছু তিনি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম আমাকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন যা আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। বাবা যেমন ছেলেকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় সেভাবেই বাতিস্তা আমাকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন।”

রোসির বলা একটা কথাও যে অত্যুক্তি ছিল না সেটার প্রমাণ পরিসংখ্যান বেশ ভালোভাবেই দেয়। আগের সিজনগুলোতে যে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলো, সেই রোসিই ভিসেঞ্জায় নিজের প্রথম সিজনে করেন ২১ গোল, জিতে নেন সিরি বি-এর গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। রোসির এই পারফর্মেন্সের উপর ভর করেই ভিসেঞ্জা সিরি বি থেকে সিরি আ-তে উন্নীত হয়। তবে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল রোসি স্ট্রাইকার হিসেবে নিজের প্রথম সিজনেই এমন সাফল্য পাবেন, এটা সম্ভবত তিনি নিজেও ভাবেননি। আসলে রোসি শক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও তার ছিল গতি, অসাধারণ পজিশনিং সেন্স আর নিখুঁত শুটিং পাওয়ার। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো দু-পায়েই শট নেওয়ার দক্ষতা। এই সবকিছুই রোসিকে একজন পারফেক্ট স্ট্রাইকার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো।

ভিসেঞ্জাকে সিরি বি থেকে সিরি আ-তে তোলার পর সেখানেও গোলের ঝড় তোলেন পাওলো রোসি। ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে ২৪ গোল করে জিতে নেন সিরি আ-র গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। পাওলো রোসিই ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার যিনি টানা দুই মোরসুমে সিরি বি ও সিরি আ এর গোল্ডেন বুটের পুরস্কার জিতেছিলেন। রোসির এই অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের উপর ভর করেই সদ্য সিরি বি থেকে উঠে আসা ভিসেঞ্জা সেই মরসুম শেষ করে সিরি আ-এর রানার্স আপ হিসেবে!

ক্লাবের হয়ে টানা দুই মরসুমে গোল্ডেন বুট জয়ের পুরষ্কার হিসেবে ১৯৭৭ সালে রোসি প্রথমবারের মতো ইতালি জাতীয় দলে ডাক পান। এনজো বেয়ারজটের অধীনে নিজের অভিষেক ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে তিনি গোল না পেলেও ইতালি ঠিকই ম্যাচটা জিতে নেয় ১-০ গোলে। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার কারণে এনজোর ১৯৭৮ বিশ্বকাপ দলেও সুযোগ পেয়ে যান পাওলো রোসি। সেবার ফ্রাঙ্কো কসিও আর রবার্তো বেতেগার সাথে তার অ্যাটাকিং ট্রায়ো ছিল সেসময়ের অন্যতম বিধ্বংসী অ্যাটাকিং লাইনাপ। বিশ্বকাপে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ফ্রান্সের বিপক্ষে গোল পান রোসি, জাতীয় দলের হয়ে এটিই ছিল তার প্রথম গোল। ম্যাচটা ইতালি জিতে নেয় ২-১ গোলে। পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ইতালি জয় পায় ৩-১ গোলে, এই ম্যাচেও দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন রোসি।

গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে সব ম্যাচ জিতেই দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় ইতালি। এই ম্যাচে অবশ্য রোসি কোনো গোল পাননি। দ্বিতীয় পর্বের নিজেদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়ার মুখোমুখি হয় ইতালি, রোসির একমাত্র গোলে ১-০ গোলে ম্যাচটি জিতে নেয় ইতালি। পরের ম্যাচে সেসময়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয় ইতালি। এ ম্যাচে রোসি কোনো গোল পাননি, আর ইতালিও ডেডলক ভাঙ্গতে না পেরে ম্যাচটা গোলশূন্য ড্র করে। দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে ইতালি মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডসের। পরের রাউন্ডে যেতে হলে ইতালির সামনে জয় ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এই ম্যাচে রোসি জ্বলে উঠতে পারেননি। ইতালিও ডাচদের কাছে ২-১ গোলে হেরে গেলে সেবার আর ফাইনাল খেলা হয়নি রোসিদের। দল ফাইনালে না উঠলেও ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের জন্য রোসি জিতে নেন সিলভার বলের পুরস্কার। এছাড়া সেবার বিশ্বকাপের সেরা একাদশেও সুযোগ পান রোসি।

ইটালির হয়ে ৪৮ ম্যাচে করেছেন মোট ২০টি গোল। ক্লাব কেরিয়ারেও সমান সফল ছিলেন রোসি। জুভেন্তাস, এসি মিলানের মতো প্রথম সারির ক্লাবে খেলেছেন। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে মোট ৩৩৮ ম্যাচে ১৩৪টি গোল আছে তার। দু’বার জিতেছেন সিরি আ, রয়েছে ইউরপিয়ান ট্রফিও। কিংবদন্তি তারকার প্রয়াণে ইটালির ফুটবলে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হল। প্রিয় ‘পাবলিতো’র প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন সেদেশের ফুটবল মহল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন