রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদা হলেন পঞ্চানন কুশারী। অর্থাৎ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদার ঠাকুরদা। অর্থাৎ রামলোচন ঠাকুরের ঠাকুরদা। বাঙালি দ্বারকানাথ ঠাকুর পর্যন্ত খোঁজ নেয়। তার আগেকার কোনও খোঁজ কেউ করে না। কারণ সেখানে নোবেল নেই, বিলেতি গন্ধ নেই। বাঙালি নামের কাঙালি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের উপরে কে আছে, তা জানতে তার ভারি বয়েই গেছে।
কিন্তু খোঁজ তো করতেই হবে, না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। রবীন্দ্রনাথে রক্তে কবিতার এই জিন কোথা থেকে এল, তা তো জানতেই হবে।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেমেয়েদের প্রায় প্রত্যেকেই কেন শিল্পসংস্কৃতিতে, গানে-বাজনায়, সাহিত্যে, কবিতায় এত ধীসম্পন্ন হল, তার শিকড়টা কোথায়? তাঁদের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী তো জাহাজের খালাসি? ছো, গোবরে কি পদ্ম ফোটে? তবে পদ্ম ফুটল কী করে? গোবরের কী এমন মহিমা?
পঞ্চানন কুশারীর পূর্বপুরুষ জগন্নাথ কুশারী যশোরের চেঙ্গটিয়া পরগণা থেকে খুলনার পিঠাভোগে আসেন ভাগ্যবিড়ম্বনায়। সে অন্য এক গল্প। এখানেই তাঁর উত্তরপুরুষদের বাস। এই বংশেরই সন্তান পঞ্চানন কুশারী বাবা মহেশ্বর কুশারীর সঙ্গে কলহ-বিবাদের জেরে কাকা শুকদেবকে নিয়ে খুলনার পিঠাভোগের বাড়ি ছেড়েছিলেন। রূপসা ও ভৈরব নদী বেয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে এ বঙ্গে আসেন।
কলকাতার গোবিন্দপুরে পঞ্চানন ও শুকদেব নাকি জাহাজে পণ্যসরবরাহ করতেন। ইংরেজিতে তাদের বলত Stevedore। কেউ কেউ বলেন এর আগে তাঁরা জাহাজে খালাসির কাজ করতেন। Stevedore -এর কাজ জাহাজে পণ্য জোগানো। তার মধ্যে জল, খাদ্যসামগ্রী, পালের কাপড়, দড়ি যেমন থাকত, জাহাজ নোঙর করা অবস্থায় জাহাজের ডেকে আমোদপ্রমোদের আয়োজনও করতে হত।
খালাসি হন বা স্টিভডোরই হন, পঞ্চানন কুশারীর রক্তে ছিল সংগীতের বীজ। তিনি ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া সুরে ভেসে যাওয়া বঙ্গের পূর্বদিকের মানুষ। গান তো তাঁর রক্তে থাকবেই। তবে তাঁর বেড়ে ওঠার সময় তরজা, কীর্তন, গাজন, বোলান গান থাকলেও কবিগান ছিল না।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৪ সালে সংবাদ প্রভাকর কাগজে কবিয়ালদের নামধাম ও তাদের গাওয়া গানের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর মতে গোঁজলা গুঁই ছিলেন তাঁর খুঁজে পাওয়া প্রথম কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত গোঁজলা গুঁইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম খুঁজে পাননি। হরু ঠাকুর ছিলেন সে যুগের আর এক নামী কবিয়াল। তাঁর জন্ম ১৭৩৮-এ। তিনি রাজা নবকৃষ্ণ দেবের সভাকবি ছিলেন। অরুণ নাগ সম্পাদিত ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইয়ে কবিয়াল হরু ঠাকুর ও নীলু ঠাকুর নিয়ে সম্পাদনা বিভাগে অনেক তথ্য আছে। হরু ঠাকুরের আসল পদবি ‘দীর্ঘাঙ্গী’। ব্রাহ্মণ কবিয়াল হওয়ায় তাঁর পদবি পাল্টে ‘ঠাকুর’ হয়ে যায়। নীলু ঠাকুরের আসল নাম নীলমণি চক্রবর্তী। ব্রাহ্মণ হওয়ায় তাঁরও পদবি পাল্টে গিয়ে নীল ঠাকুর হয়ে যায়। এরকমভাবে কবিয়াল রামপ্রসাদ ঠাকুর, সৃষ্টিধর ঠাকুর (ছিরু ঠাকুর), রমাপতি ঠাকুর, নবাই ঠাকুর, রামকানাই ঠাকুর, মনোরঞ্জন ঠাকুর, নিমচাঁদ ঠাকুরের নাম আমরা পাই। এঁদের মধ্যে ছিরু ঠাকুর শুধু বদ্যিবামুন ছিলেন (পূর্বপদবি জানা নেই), বাকি সকলে নিখাদ ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ কবিয়ালদের পদবি বদলে পাকাপাকিভাবে ঠাকুর হয়ে যেত। উপরোক্ত সকল ঠাকুর পদবিধারী ব্রাহ্মণ কবিয়াল ছিলেন চক্রবর্তী পূর্বপদবির অধিকারী। কেবলমাত্র রমাপতি ঠাকুরের পূর্বাশ্রমের পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
পঞ্চানন কুশারী আসলে ছিলেন খালাসি-কবিয়াল।
তা কবির লড়াইয়ের বীজটা পঞ্চানন কুশারীর রক্তে ঢুকল কীভাবে? তিনি তো তাঁর পূর্বপুরুষের কারও কাছ থেকে এটি শেখেননি। তাঁর বংশে অতীতে কেউ সংগীতপ্রেমী ছিলেন কিনা জানা যায়নি।
তাহলে কি জাহাজের কাজ করতে গিয়েই তিনি কবির লড়াইয়ের আইডিয়াটি পেয়েছিলেন?
আমাদের রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ এখানে অর্থ উপার্জন নেই, এসব করলে নাম করা যায় না, বিদেশ ঘোরা যায় না।
জাহাজের খালাসি বা স্টিভডোর হলেও তিনি কি এমন কোনও সুযোগ পেয়েছিলেন, যা কাজে লাগিয়ে কীর্তন বা তরজার অন্য একটি রূপ দেওয়া যায়, আঙ্গিকে পরিবর্তন আনা যায়?
এ নিয়েই আমার তত্ত্ব-তালাস। কিছু খোঁজ নেওয়া, কিছু গবেষণা, কিছু কল্পনার মিশেল দেওয়া।
সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকেই জাহাজের ইউরোপীয় খালাসি (Crew) দের মধ্যে Sea-Shanty গানের চল ছিল। অনেকে এটিকে Sea Chanty -ও বলেন। এগুলো এক বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক গীতি, যা গেয়ে নাবিক তথা খালাসিরা তাদের কাজের একঘেযেমি দূর করত। নিজেদের মধ্যে মজামস্করা, আনন্দের পরিবেশ তৈরি করত।
এগুলি কোরাসে গাওয়া হত। একজন মূল গায়ক ধরতাই দিত। বাকিরা ধুয়ো ধরত। কখনও কখনও নিজেদের মধ্যে দল করে একদল অন্যদলের সঙ্গে গানের প্রতিযোগিতায় নামত। বন্দরে নোঙর করা জাহাজগুলিতেও Sea Shanties এর প্রতিযোগিতা হত। এক জাহাজের খালাসি বা নাবিকরা অন্য জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে গানের লড়াইয়ে মাতত কখনও কখনও। একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার লড়াই চলত। তাতে কখনও কখনও কুকথা ও গালমন্দও থাকত। বিশেষত লুকিয়ে থাকা পাইরেটসদের মধ্যে।
পঞ্চানন কুশারী হয়ত নিজে জাহাজে পণ্যসরবরাহ করতে গিয়ে কিংবা Crew-এর কাজ করতে গিয়ে এসব দেখার সুযোগ পেতেন।
এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি কীর্তন, তরজা বা যাত্রাগানের ভোল পাল্টে দিলেন। তার মধ্যে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার ব্যাপারটি আমদানি করলেন। এইভাবে সদ্য গজিয়ে ওঠন কবিগানের একটি নিরীহ ও নিরামিষ ধারাকে লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়ে দিলেন। শুরু করলেন কবির লড়াই। গোঁজলা গুঁই, রঘুনাথ দাস, লালু-নন্দলাল যা পারেননি, পঞ্চানন কুশারী তাই করে দেখিয়েছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে তিনিই কবির লড়াইয়ের স্রষ্টা। রাঢ়ী ব্রাহ্মণ ছিলেন তিনি। কবিয়াল হওয়ায় তাঁর পদবি তাই কুশারীর বদলে ঠাকুর হয়ে গেল।