বৃহস্পতিবার | ১৩ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৪৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রা (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সিঙেরকোণ-এর রাধাকান্ত এখনও এখানে ব্যাচেলর : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন যাত্রা (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত বাজারে ভেজাল ওষুধের রমরমা দায় কার : তপন মল্লিক চৌধুরী বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য ‘কুড়কুড়ে ছাতুতে’ ক্যানসার নিকেশ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বোলপুর কি সত্যিই বলিপুর : অসিত দাস রাখাইন পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের উপর প্রভাব : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন অসুখী রাজকন্যাদের লড়াইয়ের গল্প : রিঙ্কি সামন্ত বিশ্ব থেকে ক্যানসারকে নির্মূল করতে গবেষণায় একের পর এক সাফল্য রূপায়ণের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কল্পনার ডানায় বাস্তবের রূপকথা : পুরুষোত্তম সিংহ হাইকোর্টের রায়ে ভাবাদিঘীতে তিন মাসের মধ্যে কাজ শুরুর নির্দেশ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কমছে, সঙ্কটে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল : তপন মল্লিক চৌধুরী ফল্গু নদীর তীরে একটি ছোট শহর এই বুদ্ধগয়া : বিজয় চৌধুরী শাহিস্নান নয়, আদতে কথাটি ছিল সহিস্নান : অসিত দাস মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি-র ভূতের গল্পো ‘হোমস্টে’ রহস্য ঘেরা বলিউডের নক্ষত্রপতন : রিঙ্কি সামন্ত বাঁকুড়ার দু-দিন ব্যাপী দেশীয় বীজ মেলায় দেশজ বীজের অভূতপূর্ব সম্ভার পেজফোর-এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২৫ এত গুণী একজন মানুষ কত আটপৌরে : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সরস্বতীর উৎস সন্ধানে : অসিত দাস ‘সব মরণ নয় সমান’ সৃজনশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে যথোচিত মর্যাদায় স্মরণ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সিপিএম-এর রাজ্য সম্মেলন, তরুণ প্রজন্মের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে খামতি রয়েছে দলে : তপন মল্লিক চৌধুরী প্রথম পাঠ — মার্কসবাদের বিশ্বভ্রমণ : সন্দীপন চক্রবর্তী বঙ্গবিভূষণ কাশীকান্ত মৈত্র স্মারকগ্রন্থ : ড. দীপাঞ্জন দে ‘খানাকুল বাঁচাও’ দাবিতে সরব খানাকুল-সহ গোটা আরামবাগের মানুষ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় হরি হরের কথা এবং বীরভূমের রায়পুরে বুড়োনাথের বিয়ে : রিঙ্কি সামন্ত ত্র্যম্বকেশ্বর দর্শনে মোক্ষলাভ : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী কুম্ভমেলায় ধর্মীয় অভিজ্ঞতার থেকে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশি : তপন মল্লিক চৌধুরী রাজ্যে পেঁয়াজের উৎপাদন ৭ লক্ষ টন ছাড়াবে, কমবে অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘হিড়িক’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি অধরা, আমার আলোকপাত : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বসন্ত পঞ্চমী ও সরস্বতী পুজোর  আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্য পুরাণের নবরূপায়ণ লিখেছেন পূরবী বসু

পূরবী বসু / ৮৮৭ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১

সম্প্রতি মনজুরে মওলা সাহিত্যপত্রিকা কালি ও কলমে লিখেছেন, ‘পুরাণ ব্যবহার করার স্বাধীনতা যেমন সব শিল্পীরই আছে, পুরাণ থেকে সরে আসার অধিকারও তেমনি সব শিল্পীর আছে। পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তাকে ঠিক তেমনি করে তুলে ধরার দায় শিল্পীর নেই। সত্যি বলতে কী, পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তা ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করলে শিল্পরচনার কোনো মানে থাকে না, যদি না, যা আছে, তার কোনো বদল না করেও শিল্পীতার মধ্যে নতুন জীবন সঞ্চার করতে পারেন, তাকে নতুন অর্থ দিতে পারেন, তাকে সমকালীন করে তুলতে পারেন, জীবনকে তিনি নিজের মতো করে যেভাবে দেখেন, সেভাবে তুলে ধরতে পারেন। উৎসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা অসম্ভব নয়, কিন্তু বিশ্বস্ত থেকে তাকে নতুন করে তোলা সহজ নয়।’

সাহিত্যে পুরাণের নবরূপায়ণে পরিবেশন লেখকদের জন্যে একটি অতিপরিচিত, স্বীকৃত ও নন্দিত পদ্ধতি, যে-রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে। তবে বাংলা সাহিত্যে এর প্রচলন আগে আরো বেশি ছিল, বর্তমান সময়ে পৌরাণিক চরিত্র বা বিষয়ের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। শ্রুতিমধুর কাব্য ভাগবতপুরাণের প্রথম অনুবাদ হয় বাংলায়, করেন মালাধর বসু এবং এর বাংলা নামকরণ হয় ভাগবত। ১৪৭৩ সালে মালাধর ভাগবতপুরাণের বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যরচনা শুরু করেন। সেই কাব্যরচনা শেষ হয় ১৪৮০ সালে। এই কাব্যের আরেক নাম গোবিন্দমঙ্গল। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের উদ্দীপ্ত করতে এ-গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

পৌরাণিক যে-সকল নারী চরিত্র মহাভারতে বর্ণিত রূপে বা প্রতীকী সংকেতে বাংলা সাহিত্যে পুনঃপুন ব্যবহৃত হয়েছে, তাঁরা হলেন দ্রোপদী, রাধা, সীতা, শকুন্তলা, দুর্গা (পার্বতী, উমা, সতী, কালী), কুন্তি ও চিত্রাঙ্গদা। কবি ও নাট্যকারের অসীম কল্পনায় এবং তাঁদের নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় পুরাণের মূল কাঠামো (কাহিনি ও চরিত্রসহ) অতি সহজেই ভেঙে পড়ে। মেদ-মাংসহীন সেই কাহিনির কঙ্কালে তখন নিজের কল্পনা মিশিয়ে বিনির্মাণ করেন লেখক এমনসব চরিত্র ও কাহিনি, যা আবহমান কাল ধরে পাঠকের কাছে গৃহীত হয়, তাঁদের আন্দোলিত করে, দেশ-কাল-ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাঁদের হৃদয়কে দোলা দেয়। প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা এবং আধুনিক জীবনের বহু অনুষঙ্গ মিশিয়ে তৈরি করেন তাঁরা নতুন এক সাহিত্য যার গ্রহণযোগ্যতা, নান্দনিকতা ও নতুনত্বের আবেদন অনেক বেশি জোরালো ও স্থায়ী। এই নবরূপায়ণের সময়, বেশিরভাগ সময়েই আদিকালের পাত্রপাত্রীকে বর্তমান সময়ের নরনারীতে পরিণত করা হয়। নির্মলেন্দু গুণ যেমন আজকের সংসারকে সেকালের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ‘সূচ্যগ্র সুখের কণা কেহ কারে সহজে দেবে না/ সংসারযুদ্ধের সুখ পায় স্বেচ্ছাপরাজিত সেনা’ (‘কুরুক্ষেত্র’)।

এই নিবন্ধে নির্বাচিত পৌরাণিক পঞ্চনারীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত্র বর্ণনাকালে কারো কারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা পুরাণে কেমনভাবে বর্ণিত ছিল আর লেখক বা কবির কল্পনায় বা দৃষ্টিতে তা কেমনভাবে ধরা দিয়েছে তা উল্লিখিত হয়েছে স্ব-স্ব অধ্যায়ে। পুরাণের এই ধরনের নবরূপায়ণ বহু লেখক অনেককাল ধরেই করে আসছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা দেওয়া কঠিন। কিন্তু কেবল উদাহরণ টানার জন্যে এঁদের ভেতর মাত্র কয়েকজন লেখকের লেখা থেকে শুধু একটি বা কয়েকটি রচনার উদ্ধৃতি দেওয়া হলো নিচে :

মালাধর বসু (শ্রীকৃষ্ণবিজয় বা গোবিন্দমঙ্গল), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (শকুন্তলা ও সীতার বনবাস), মদুসূদন দত্ত (শর্মিষ্ঠা নাটক, মেঘনাদবধ কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘নরকবাস’, ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’), রাজশেখর বসু (হনুমানের গল্প, যযাতির জরা), বুদ্ধদেব বসু (রাবণ, প্রথম পার্থ, মহাভারতের কথা, তপস্বী ও তরঙ্গিনী), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (রাধাকৃষ্ণ), সুবোধ ঘোষ (ভারত প্রেমকথা), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (এক যযাতি, সাজানো ফুলের বাগান), আল মাহমুদ (কৃষ্ণকীর্তন), বিনয় মজুমদার (মহাদেবের জটা), পূর্ণেন্দু পত্রী (আমিই কচ, আমিই দেবযানী), নির্মলেন্দু গুণ (কুরুক্ষেত্র), মুহম্মদ নুরুল হুদা (শুক্লা শকুন্তলা, অর্জুন অর্জুন), সাদ কামালী (অনূঢ়া আখ্যান, সুবলাদাসীর ধর্মযুদ্ধ), শাহনাজ মুন্নী (রূপময়ীর ছয়টি হাত), সেজান মাহমুদ (অগ্নিবালক), মাহবুব সাদিক (দ্রৌপদীর শাড়ি), গজেন্দ্রকুমার মিত্র (পাঞ্চজন্য), প্রশান্ত মৃধা (যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী), পূরবী বসু (প্রতিমাপুরাণ, বারে বারে ফিরে ফিরে), লক্ষ্মীপ্রসাদ (দ্রৌপদী)। শামসুর রাহমান কবিতায় সরাসরি প্রাচ্য পুরাণ খুব একটা ব্যবহার করেননি। তবে বিধ্বস্ত নীলিমা গ্রন্থের ‘পুরাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন – ‘আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন, তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে’। এই কথার ভেতর দিয়ে তিনি পুরাণের অর্থহীনতা ও আজকের যুগে তার অচলতা ও অনুপযুক্ততা প্রকাশ করেছেন। তারপরেও, পুরাণদ্বারা, বিশেষত পশ্চিমি পুরাণদ্বারা তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয়। কোনো কোনো কবিতায় তিনি প্রাচ্য পুরাণের নানা অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ, চরিত্র ও ঘটনাও অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সীমিতভাবে ব্যবহার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় তাঁর কবিতার শরীরে গেঁথে আছে, ‘মায়ামারীচ’, ‘খান্ডবদাহন’, ‘জতুগৃহ’, ‘কালকূট’, ‘বাল্মীকি’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘শিখন্ডী’ প্রভৃতি শব্দ।

শুধু সাহিত্যে নয়, পুরাণের কথা ও লোকগাথা বহু বাংলা নাটকেরও উপজীব্য। কাজী নজরুল ইসলাম লেটোর দলে পালা গান লিখতে গিয়ে এবং গ্রামোফোনে রেকর্ড করতে গিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনি ব্যবহার করেন। এসবের অনেকেরই আজ আর হদিস পাওয়া যায় না। তবে অন্যদের মধ্যে তাঁর লেটোর দলের জন্যে লেখা পালাগান শকুনিবধ, দাতা কর্ণ, মেঘনাদবধ কাব্য উদ্ধার করা হয়েছে। শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয়ে করা নাথবতী অনাথবৎ নাটকে দ্রৌপদী ও তাঁর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও মনোভাবের কথা নবরূপে রূপায়িত হয়েছে। মনসা ও চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে শম্ভু মিত্রের লেখা চাঁদ বণিকের পালা নাটকটি ঢাকা ও নিউইয়র্কে মঞ্চস্থ করেছেন রওশন আরা ও জামালউদ্দীন হোসেন। বীরাঙ্গনা কাব্য অবলম্বনে কহে বীরাঙ্গনা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ হচ্ছে। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যটি মহাভারতের পটভূমিতে রচিত। প্রেম-বন্ধনে বাঁধা নরনারীর কথোপকথনকে উপজীব্য করে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। এখানে আমরা দেখতে পাই, একাকিনী পত্নী বা প্রেমিকাদের প্রত্যেকে (১১ জন) তাঁদের পুরুষকে পত্র লিখছেন। এই নারীদের মধ্যে রয়েছেন শোকাতুরা শকুন্তলা, ঈর্ষান্বিতা দ্রৌপদী, পতির অমঙ্গল-আশঙ্কায় অস্থির দুঃশলা এবং পুত্রশোকে কাতর, পতির ভীরুতার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনকারী জনা। ১১টি পত্র থেকে চারটির নাট্যরূপায়ণই কহে বীরাঙ্গনা। পৌরাণিক কাহিনি হলেও এতে উঠে এসেছে প্রাচ্যের চিরন্তন নারীর বিরহ, বেদনা, একাকিত্ব, হাহাকার। এই নাটকটি পুরোপুরি মনিপুরী সম্প্রদায়ের শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চায়িত। সুভাশিস সিনহার পরিচালনায় চারটি অঙ্কেই একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা।

আধুনিক যুগে চলচ্চিত্রেও পুরাণ- চরিত্রের নবায়ন অথবা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। বহু দেব-দেবী, রাধা-কৃষ্ণ ও শিব-পার্বতী, লাইলী-মজনু, এমনকি সরাসরি রামায়ণ, মহাভারত, আম্রপালী, এমনকি বাল্মীকিকে নিয়ে অসংখ্য ছায়াছবি বানানো হয়েছে, হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। এসব ছায়াছবির কাহিনি অনেক সময়ে সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতেও রচিত হয়। বেহুলা আখ্যান নিয়ে জহির রায়হান নির্মাণ করে গেছেন চলচ্চিত্র বেহুলা। কেবল বেহুলাতে নয়, পুরাণের ধারা অনুসরণ করে সাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে বাংলা ছায়াছবিতে। এখানে সাপ আসে নির্দিষ্ট একটি ভূমিকা পালন করার জন্যে অথবা প্রতীক অর্থে। ছায়াছবিতে তার আবির্ভাব ঘটে দুভাবে – কখনো চরিত্র হিসেবে এবং কখনো মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে। চলচ্চিত্র-শিল্পে সাপ একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনেক আগেই তা এসেছে পুরাণে, বিভিন্ন লোকগাথায় ও মঙ্গলকাব্যে।

এছাড়া প্রাচ্য পুরাণে নানারকম অনুষঙ্গকে বিভিন্ন মিডিয়ায় বিভিন্ন রকমভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন প্রাচীন পুরাণের আখ্যান বা চরিত্রের সরাসরি প্রয়োগে বা তার ছায়ায় রচিত অত্যাধুনিক ব্যান্ড মিউজিকের কথা থেকে শুরু করে, আরো নানান ধরনের গান (বিশেষ করে ভক্তিগীতি, লোকগীতি), গাজন নাচ, গাজির পট, যাত্রা, বিভিন্ন পূজা-পার্বণ-ব্রত, পথনাটক আজো দারুণ জনপ্রিয় ও সচল বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, উঠানে, ঘরে, মঞ্চে সর্বত্র। এই উপমহাদেশের প্রেমের গানের (ধর্মীয়/ লোকগীতি/ আধুনিক) একটা প্রধান অংশ জুড়ে আছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। দ্বাদশ শতাব্দীতে বড়ু চন্ডীদাস দিয়ে যার জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছিল, বৈষ্ণব সাধক শ্রীচৈতন্য যার প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, তাঁর আবেদন আজো একইরকম বা আরো বেশি প্রবল। মমতাজের গলায় ‘আজান শুনে ঘুম ভাঙ্গিল/ চোক্ষের পানি রাখতে নারি/ শ্রীদাম রে, ওরে ভাই শ্রীদাম/ কেমন আছে প্রাণেশ্বরী’র মতো গান আবহমান বাংলার যৌথ সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। এছাড়া, লৌকিক উপাখ্যান বা গাথা নিয়ে রামলীলা, কৃষ্ণলীলা, লখিন্দর-বেহুলা পালা, লাইলী-মজনু বা শিরী-ফরহাদ পালা, রাধা-কৃষ্ণের কীর্তন, গাজী কালু ও চম্পাবতী কন্যা নিয়ে গাজীর গান, সংগীতসহ নৃত্য, পাঁচালি, পুঁথিপাঠ এবং জলসা নিয়মিত পরিবেশিত হয়।

কয়েক বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেছিলেন, সরস্বতীকে দেখলে তাঁর মনে কামভাব জাগে (এছাড়া সুনীলের কবিতাতেও আছে, বাল্যকালেই সরস্বতীর মূর্তিকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন), অথবা কালী দেবীকে তিনি যখন ‘ন্যাংটো সাঁওতাল মাগী’ বলে আখ্যায়িত করেন, চারদিকে হইচই পড়ে যায়, কারো কারো ধর্মানুভূতিতে প্রচন্ড আঘাত লাগে। সুনীলের নামে কোর্টে কেস ওঠে, কিন্তু তাঁর জীবন সংশয় হয় না। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেনের মতো প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর কল্পনা মিশিয়ে অাঁকা দেশমাতৃকার অবয়বে বস্ত্রবিহীন সরস্বতীকে কিছুতেই সে-দেশের হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারে না। শিল্পীর স্বাধীনতার ওপর কট্টর হিন্দুদের এই স্বৈরাচারী আক্রমণে সন্ত্রস্ত ও হতাশ রোমান্টিক শিল্পী ফিদা স্বেচ্ছানির্বাসনে দুবাইয়ে জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়ে সম্প্রতি লন্ডনে ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সরস্বতী বা কালীকে নিয়ে সুনীলের এ-ধরনের মন্তব্য অবশ্য তাঁকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক বা প্রগতিশীল করে তোলে বলে তিনি মনে করুন না কেন, এর পেছনে নারী এবং উপজাতীয়দের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য ও অশ্রদ্ধাও যে ধরা পড়ে, সেটা তিনি হয়তো গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখেননি। লক্ষ্মীপ্রসাদকে তাঁর উপন্যাস দ্রৌপদীর জন্যে ডানপন্থী হিন্দু রাজনৈতিক দল ক্ষুব্ধ হয়ে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় গালাগাল করেছে, কেননা এই উপন্যাসে লক্ষ্মীপ্রসাদ দ্রৌপদীর যৌনতা, স্বামী হিসেবে পঞ্চপান্ডবের মধ্যে তাঁর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, সর্বোপরি কর্ণের দিকে তাঁর চোখ পড়ার কথাও উল্লেখ করেছেন। কট্টর হিন্দুদের কাছে মনে হয়েছে, যদিও এটি একটি উপন্যাস, তাহলেও সাহিত্য আকাদেমি একে পুরস্কৃত করে হিন্দু ধর্মকে অপমান করেছে। এটি নাকি পর্নোগ্রাফির সমতুল্য। আর সেটা করা হয়েছে হিন্দুদের পূজনীয় নারীচরিত্র দ্রৌপদীকে নিয়ে। তারা এই গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার অনুরোধ জানান সরকারের কাছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছেও লেখক ও তাঁর পুস্তকের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ যায়। কিন্তু দৃঢ়চেতা লক্ষ্মীপ্রসাদ সটান এবং স্থির দাঁড়িয়ে আছেন নিজস্ব স্থানে। এতটুকু সমঝোতা করার লক্ষণ নেই সেখানে। লেখকের কল্পনা ও তাঁর লেখার স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করেন। সাহিত্য অকাদেমি এই পুরস্কারটির নির্বাচনকালে এই অকাদেমির প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যতদূর জানি, তিনি এখনো সেখানে স্থলাভিষিক্ত। সুনীলের আমলে এমন একখানি গ্রন্থ অকাদেমি পুরস্কার পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লেখকের কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতাকে আর যে-ই হোক, অন্তত সুনীল গলা টিপে মারবেন না বলেই আমাদের ধারণা। আসলে, সৃজনশীলতার গতি বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই – থাকা উচিত নয়। প্রাচ্য মিথোলজির ঘটনা ও চরিত্রগুলো আজকের লেখকদেরও প্রবলভাবে আন্দোলিত করছে। তাঁরা পুরাণের আখ্যানকে, চরিত্রকে, বিশেষ করে নারীচরিত্রকে নবায়ন করছেন। আর তাই নবরূপে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সমকালীন সমাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উপস্থাপিত হচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরনো উপাখ্যানের অংশবিশেষ, এর বিভিন্ন অনুষঙ্গ, চরিত্রের নাম ও অন্তর্নিহিত দর্শন, যার আবেদন সর্বজনীন, চিরন্তন।


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে প্রাচ্য পুরাণের নবরূপায়ণ লিখেছেন পূরবী বসু”

  1. Shyamal Sengupta says:

    এই Page four এর সাথে সদ‍্য পরিচিত হয়েছি এই অসামান্য রচনা গুলি পড়ে। অত্যন্ত মুল্যবান এবং শিক্ষনীয় বিষয়সমৃদ্ধ যারা তাদের এই লেখাগুলিতে এত সহজভাবে আমাদের মতো সাধারণ পাঠক দের সামনে তুলে ধরেছেন সেই সমস্ত লেখক দের জানাই সশ্রদ্ধ নমস্কার এবং সেইসঙ্গে এই Page four এর উজ্জল ও চলমান ভবিষ্যত কামনা করি।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন