আসমুদ্র ভারতের প্রায় সর্বত্রই অক্টোবর মাস পড়তে না পড়তে যে উৎসবের মরশুম শুরু হয় তা চলে প্রায় নভেম্বরের মাঝামাঝি অবধি। আরও নিখুঁত ভাবে বললে এই মরশুমের স্থায়িত্ব মহালয়া থেকে দীপাবলী পর্যন্ত। কোথাও কোথাও সেটা চলে জগদ্ধাত্রী পুজোর দশমী পর্যন্ত। আমার ছোটবেলায় এই মরশুম আরম্ভ ও শেষের সূচক ছিল যথাক্রমে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার শেষ এবং পুজোর লম্বা ছুটির পর শীতের হালকা আমেজে স্কুল খোলা। এইরকম আরও একটি সূচক ছিল আমাদের বাড়ির ছাদের LED বাল্বগুলোর জ্বলে ওঠা এবং নিভে যাওয়া। স্কুলের পাট চুকে গেছে বহুদিন। পুজোর মরশুম শেষে আগের মতো শীতও এখন পড়ে না। তবে আমাদের বাড়ির ছাদের বাল্বগুলো এখনও আগের মতোই আগমনীর বার্তা দেয়।
এ তো হল সাধারণ মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে উৎসবের আগমন এবং নিষ্ক্রমণ। কিন্তু ভারতের কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে একটি ভিন্ন ধরণের উৎসবের তাৎপর্য এর চেয়ে অনেক বেশি যা শুরুও হয় প্রায় একই সময়। এই উৎসবে পুজোর জিনিস একটাই — সিনেমা। নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাস দু’টি ভারতের আপামর চলচ্চিত্রপ্রেমী বা Cinephile-দের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি মাস। আমি নিজে যাদবপুরের Film Studies বিভাগের একজন গবেষক হওয়ার সুবাদে নিজেকে এই দলে রাখতেই পারি। অবশ্য বর্তমানে বিভিন্ন কারণে সিনেমাহলে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগ অতটা হয়ে ওঠে না। তাই ল্যাপটপ বা প্যাডে ছবি দেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এত ছবি এবং Web Series এখন প্রযুক্তির সুবাদে ঘরে বসেই দেখে ফেলা যায় যে হলে গিয়ে ছবি দেখার যে Cinematic Experience তা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে পা বাড়িয়েছে। সময়ের সাথে সাথে চলচ্চিত্রপ্রেমের সংজ্ঞাটাও পাল্টে যাচ্ছে ক্রমশ। তবে এই বিষয় নিয়ে না হয় অন্য আর একদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
এত দূর পর্যন্ত যারা ধৈর্য ধরে পড়ে ফেলেছেন (ধৈর্য কথাটা উল্লেখ করলাম কারণ বর্তমানে Tiktok আর Instagram Reel-এর সুবাদে সেটাও প্রায় বিলুপ্তপ্রায়), তারা বুঝতে পারছেন যে এই লেখাটা বিশ্লেষণাত্মক লেখা হবার সম্ভাবনা সেরকম নেই। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এর আগে এরকম লেখা আমি লিখিনি, তাই এই প্রচেষ্টাটি কতটা সফল হবে জানি না। এই লেখাটার মূল বিষয়বস্তু হল ভারতের দুই ভিন্ন প্রান্তে দু’টি ভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে আমার সামিল হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার পাঠকদের সাথে ভাগ করে নেওয়া। আমার স্কুলের বাংলার শিক্ষক মধু বাবু প্রায়ই বলতেন যে আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে আর দুঃখ ভাগ করলে কমে। বলতে পারেন কতকটা সেই উদ্দেশ্যেই আজ এই লেখা লিখতে বসেছি। এখন Web Series-এর যুগ। আমার এই লেখাটাও তাই দুই পর্বে লিখব — তা সে সিনেমা নিয়ে লেখা হলেই বা।
লেখার মূল অংশে যাবার আগে একটা Disclaimer দিয়ে রাখা দরকার। যেহেতু এটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা নয় তাই এখানে যা পড়বেন তা কিন্তু পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণ বা Objective Analysis নয়, বরং আমার Subjective অভিজ্ঞতা। তাই কোনো বিষয়ে যদি পাঠকের সাথে আমার মতের অমিল হয় তা আশা করি এই লেখাটি পড়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না। কারণ শত মতবিরোধ সত্ত্বেও আমরা সবাই অল্প বিস্তর সিনেফিলিয়ার ইন্দ্রজালে আবদ্ধ।
গোয়ায় যাবার সুযোগটা এল হঠাৎ করেই। অক্টোবর মাস সবে শেষ হয়েছে। বাতাসে বারুদের গন্ধে সদ্য সমাপ্ত কালীপুজোর স্মৃতি বহন করে আনছে। রাত্রি সাড়ে এগারোটার সময় আমার এক সহপাঠী বন্ধুর ফোন মারফত জানতে পারলাম যে NFDC (National Film Development Corporation) থেকে আমাদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (International Film Festival of India or IFFI) আমন্ত্রণ করা হয়েছে যা চলবে বিশ থেকে আঠাশে নভেম্বর পর্যন্ত। যাতায়াত এবং গ্রাসাচ্ছাদন বাবদ আমাদের প্রত্যেককে মাথা পিছু কিছু টাকা (পরিমাণ টা খুবই সামান্য) দেওয়া হবে এবং গোয়ায় বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আমার কাশ্মীর যাবার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। তাই প্রথমে সূচি নিয়ে কিছু সমস্যা তৈরী হলেও তার সমাধান বেরিয়ে গেল সহজেই, কারণ সিনেফিলিয়ার পোকা যার মাথায় একবার ঢুকেছে তার চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়া আটকানো শিবেরও অসাধ্য। এছাড়া গোয়া দেখার সুপ্ত বাসনাও অনেকদিন ধরেই ছিল। তাই কাশ্মীরের হিমশীতল শ্রীনগর থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যখন এসে পড়লাম গোয়ার উষ্ণ ডাবোলিম এয়ারপোর্টে তখন আমার সহপাঠী স্কলাররা তাদের নিজস্ব হোটেলে চেক-ইন করে গিয়েছে।
NFDC আমাদের আমন্ত্রন জানালেও এই উৎসবে ঠিকভাবে অংশগ্রহণ করার সমস্ত নিয়মকানুনই আমাদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়েছিল। তবে সৌভাগ্যবশত ইউনিভার্সিটির প্রোফেসররা এই ব্যাপারে আমাদের খুবই সাহায্য করেছিলেন। আমাদের সকলের নামে আলাদা করে লেখা Recommendation Letter পাঠানো হয়েছিল আমরা গোয়ায়ে পৌঁছনোর বেশ কয়েক দিন আগেই, তাই আমার Registration বেশ নির্বিঘ্নেই হয়ে গেল। সমস্ত Formalities মিটে যাবার পর হাতে এল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় Delegate Card। এই কার্ড দেখিয়েই সমস্ত ছবি দেখার সুযোগ মিলবে। এই পর্যন্ত নিয়মাদি প্রায় সবই আর পাঁচটা সাধারণ চলচ্চিত্র উৎসবের মতোই। তবে কার্ডটি ব্যবহার করতে গিয়ে বুঝলাম IFFI এবং KIFF-এর মধ্যে বিস্তর ফারাক এবং এই ফারাক শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং সংস্কৃতিরও বটে।
এমনিতে গোয়া রাজ্যটির সর্বত্র বেশ একটা Happy-go-lucky ব্যাপার রয়েছে যা এখানকার সাধারণ মানুষের সাথে একটু মিশলেই ঠাহর করা যায়। এখানে Weekday এবং Weekend-এর মধ্যে তফাৎ করাও বেশ মুশকিল কারণ সরকারি এবং বেসরকারি বাসগুলো সব সময়ই ফাঁকা ফাঁকা থাকে। পরিবেশ সচেতনতার কথা ভেবে পর্যটকদের বেড়াবার জন্য এখানে ব্যাটারি চালিত বাইক ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা আছে তবে তার জন্য লাইসেন্স লাগে। বাসের সংখ্যাও বেশ কম এবং রাত্রি আটটার পর সরকারি বা বেসরকারি কোনও বাসই আর সেরকম চলে না। এই কারণে এবং এর সাথে সর্বত্র প্রচুর গাছপালা থাকায় (যদিও বিলাসবহুল হোটেলের দাপটে এবং মানুষের লোভে তাদের সংখ্যাও কমছে) এখানকার বাতাস কলকাতা বা দিল্লির মতো বিষিয়ে যায়নি এখনও। কিন্তু ফেস্টিভ্যাল চত্বরের ভিতরে ঢুকলে ছবিটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। বাইরের গা-ছাড়া ভাব এখানে স্থানান্তরিত হয়েছে কর্পোরেট পেশাদারিত্ব দ্বারা। Delegate Card নেওয়ার সময় প্রত্যেককে একটা অ্যাপ ডাউনলোড করতে হল যেখানে সমস্ত ছবি এবং Master Class-এর সূচি দেওয়া আছে এবং এইসব ছবি বা সেশনের বুকিংও অ্যাপের মাধ্যমেই করতে হবে। অর্থাৎ আপনার কাছে যদি একটি অত্যাধুনিক এবং স্মার্ট চলভাষ যন্ত্র না থাকে তাহলে এখানে আসা আপনার একেবারেই বৃথা। আপনার পছন্দের ছবি এবং সেশন বুক করার সুযোগ আপনি পাবেন দুদিন আগে থেকে। বুঝতে পারলাম উৎসবের উদ্যোক্তারা অন্তত পরিকাঠামো এবং প্রজুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের যে কোনো চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে পাল্লা দিতে বদ্ধপরিকর। এই Technocracy-এর ভালো এবং খারাপ দু’টি দিকই রয়েছে তবে তার কথায় একটু পরে আসছি। আপাততঃ, এই পঞ্চান্নতম ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবের একটি সার্বিক বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।
এই বছরটা সিনেমা জগতের বেশ কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্মশতবর্ষ। এই চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁদের মধ্যে চারজনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাঁরা চারজনেই ভারতীয় — তপন সিংহ, রাজ কাপুর, অক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও, এবং মহম্মদ রফি। এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম সব বাঙালি পাঠকই জানেন তাই তাঁদের সম্পর্কে আর বেশি কিছু লিখব না। অক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও বা সংক্ষেপে ANR হলেন তেলুগু সিনেমার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম যিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাস দেবদাসের তেলুগু চলচ্চিত্রকরণ বা Adaptation দেবদাসু (১৯৫৩) ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। IFFI তে এই ছবিটি একাধিকবার Screening করা হয় এবছর। তপন সিংহের ছবি হারমোনিয়াম (১৯৫১) এবং রাজ কাপুরের অত্যন্ত জনপ্রিয় আওয়ারা (১৯৭৬) ছবিদু’টিও দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। বেশিরভাগ ছবির Screening পানাজির অত্যাধুনিক আইনক্সে হলেও কিছু কিছু ছবি দেখার জন্য মারগাও বা পাভরিমে যেতে হচ্ছিল। সেই যাতায়াতের জন্য অবশ্য কিছু সময় অন্তর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের ব্যবস্থা ছিল। পানাজি আইনক্স থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে নান্দনিক কলা অ্যাকাডেমি (Kala Academy)। এই অ্যাকাডেমিতে সবকটি মাস্টারক্লাসের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশ বিদেশের বিভিন্ন কলা কুশলীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল এই মাস্টারক্লাসে তাঁদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মের ফিল্মমেকারদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য যাতে তারা এই সাংঘাতিক প্রতিযোগিতামূলক একটা জগতে কাজ করার প্রেরণা পায়।
যারা নিয়মিত চলচ্চিত্র উৎসবে যান তাঁরা সকলেই জানেন যে সব চলচ্চিত্র উৎসবেই প্রত্যেক বছর একটি বিশেষ দেশের ছবির দিকে নজর দেওয়া হয়ে থাকে। গোয়ায়ে চলচ্চিত্র উৎসবের সেই বিশেষ নজর ছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রতি। স্বভাবতঃই অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা প্রচুর ছবি দেখার সুযোগ ছিল। উৎসবের উদ্বোধনও হয় সে দেশের ছবি Better Man দিয়ে। অস্ট্রেলিয় ছবির সাথে সাথে সেখানকার প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ফিলিপ নয়েস (Philip Noyce)-ও হাজির ছিলেন এই উৎসবে যিনি একটি ভীষণ সুন্দর এবং উপভোগ্য মাস্টারক্লাসও নেন। উৎসব কর্তৃপক্ষ তাঁকে সত্যজিৎ রায় লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারও প্রদান করে। বলা বাহুল্য অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ইরান, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, এমনকি বেশ কিছু আফ্রিকান দেশ থেকেও বিভিন্ন আঙ্গিকের এবং বিভিন্ন বিষয়ের ছবি এসেছিল এই উৎসবে। সব মিলিয়ে শুধু বাইরের আবরণ দেখলে মনে হতেই পারে এই চলচ্চিত্র উৎসব একেবারে একশ শতাংশ সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা একটু আলাদা। কতটা আলাদা? পরের পর্বে সেই কথাই বলব।
বেশ ভালো লাগল। সুন্দর সাজানো লেখা। তা ছাড়াও টাটকা অভিজ্ঞতার ছোঁয়া জড়িয়ে আছে।পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
Thank you very much. Hope you will find the second part equally compelling.
ভাল লাগল খুব। এরকম লিখতে থাকো।
Thank you. Much appreciated.
বেশ ভালো লাগলো। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
Thank you for your kind words. Next chapter will be published soon.
Khub sundor lekha,porer parbo kobe parbo kobe pabo?
Very soon, I hope.
Khub sundar lekha.
Thank you.
Excellent Drafting and presentation is very nice keeping the Layman’s Expectation in mind. The Common man will certainly take an opportunity in coming years to make it convenient to attend the Much acclaimed Goa FILM FESTIVAL and experience the difference.
Thank you very much.
Pratibedan valo laglo.sabalil vasa.content informative.