ছোটবেলা থেকে দোল খেলার দিনের অপেক্ষায় থাকতাম। পুরনো বাতিল জামা পরে জল রঙ গুলে পিচকারি দিয়ে রঙিন করা, মাথা ফাটা রঙে হাত রাঙিয়ে ভূত বানানো আর যত রকমের রঙ আছে সবাই মিলে মাখামাখি করে অনাবিল আনন্দ…. এই আমাদের দোল উৎসব ছিল এতকাল। সময়ের হাত ধরে রঙের উৎসব কখন যেন বসন্ত উৎসব হয়ে উঠলো। সুন্দর করে হলুদ শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি পরে ছেলে মেয়েরা আবির রঙে নিজেদের সাজিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হচ্ছে ইদানীং কালে। মনে মনে বেশ সুপ্ত ইচ্ছে হত এমন কোথাও নিজেকে মিলিয়ে দিতে।
এবছরটা একটু অন্য রকম ছিল, তাই এবার দোল পূর্ণিমাতে চেনা গন্ডি থেকে পালাতে চাইছিলো মন অন্য কোথাও, অচেনা পরিবেশে। ঠিক সেই মুহূর্তে গত ডিসেম্বরে পুরুলিয়ায় যে হোম স্টেতে ছিলাম আমি, তাদের পলাশ উৎসব পালন করার খবর জানতে পারি। সেই মত ওনাদের কর্ণধার সুজিত বাবুর সাথে যোগাযোগ করি এবং তারপর ওনাদের পক্ষ থেকে ম্যানেজার বাবু আমাদের সব বুকিং করে দেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব পরিকল্পনা, তাই ট্রেনের টিকিট পাওয়া মুসকিল হচ্ছিলো। শেষে রবিবার রাতের পুরুলিয়া সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেসে টিকিট পেলাম। কিন্তু আমাদের থাকার জায়গা তো সেই বাঘমুন্ডিতে। চিন্তা হতে লাগলো, অচেনা পুরুলিয়াতে কি করে ওত রাতে পৌঁছাবো ওখানে। কিন্তু হোম স্টে কতৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেন যে, নিশ্চিন্তে আমাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা ওনারা করে দেবেন।
সেই মত রবিবার বিকেলে ৪.৫০ এর ট্রেনে চেপে বেড়িয়ে পড়লাম, প্রথম কোন বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে… সুদূর পুরুলিয়ার সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পে।
রাত ১০.৩০ টায় পুরুলিয়া স্টেশনে নামার আগেই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ির ড্রাইভার দাদা ফোন করে যোগাযোগ করেন। পুরুলিয়ায় নেমে আমরা চললাম মাঠা পাহাড়ের দিকে… প্রায় ৫২ কিমি দূরত্বে। ঐ রাতেও রাস্তার দুপাশে গাড়ির আলো পড়তেই চোখে পড়লো লাল পলাশে মোড়া গাছের সারি। রাত ১২ টা নাগাদ পৌঁছালাম গন্তব্যে, পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের মাঝে সুন্দর সাজানো টেন্ট ঘেরা বানজারা ক্যাম্পে। আমরা পৌঁছাতেই ওই রাতেও ওখানকার কর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাদের আপ্যায়ন করে নিলেন। এতরাতে গরম রুটির সাথে মাংসের ঝোল আর মিষ্টি খুব উপাদেয় লাগলো। তারপর আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেন্টে গিয়ে আমরা উঠলাম। প্রতিটা টেন্টের সামনে একটা খাটিয়া পাতানো, পরিবেশটা সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগলো। ঐ রাতেও ক্যাম্পের কর্মচারীরা খুব সক্রিয় ভাবে অতিথিদের বরণ করেন এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগান দেন।
পরের দিন সকালের ঘুম ভাঙলো নানা রকম পাখিদের কলকাকলীতে। তারপর টেন্টের বাইরে বেড়িয়েই চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রতিটা টেন্টের মাথার উপরে পলাশ গাছ আর সেখানে লাল ফুলের আগুন। মাঝের মাঠে বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ আর তার ফাঁকেও পলাশ ফুল পড়ে সেই প্রাঙ্গন লাল গালিচা বিছিয়েছে। সেই সাথে নানা বয়সী পর্যটকে ভরে গেছে টেন্টের চত্ত্বর। সকালেই প্রতিটা টেন্টে কর্মীরা প্রাতঃপানের জন্য চা এবং বিস্কুট দিয়ে যান। তারপর সকাল ৮.৩০ থেকে মুখরোচক লুচি, ঘুগনী, ডিমসেদ্ধ আর জিলিপির সাথে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করা হয় খাওয়ার জায়গায়।
আমরা এরপর ক্যাম্প থেকে ঠিক করে দেওয়া গাড়ি করে অযোধ্যার আসেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখি। বামনি ফল্স, মুরুগুমা ড্যাম, সুইসাইড পয়েন্ট, ময়ূর পাহাড়, মার্বেল লেক, লোয়ার এবং আপার ড্যাম, লহরিয়া ড্যাম দেখে আমরা ফিরে আসি দুপুরে। এই মার্চের শুরুতেই দুপুর ১২টা হতেই এত গরম লাগলো, এরপর না জানি কি আবহাওয়া হয় সেখানে। আবার রাতের দিকে বেশ হালকা ঠান্ডার অনুভূতি হয়েছিল। তবে এবার পুরুলিয়ার দর্শনীয় স্থান দেখার চেয়েও বেশি দু-চোখ ভরে শুধু রাস্তার দু-পাশ দেখে গেছি। সে কি অপূর্ব শোভা… আগুন লেগেছে যেন গাছে গাছে। অনেক গাছে তো কোন পাতাই নেই… শুধু লাল পলাশে গাছগুলো ভরে আছে। এ দৃশ্য মনে হয় না কোন ক্যামেরার লেন্স নিতে পারবে… শুধু নিজের চোখে উপভোগ করতে হবে। সেই সাথে গ্রাম্য পুরুলিয়ার আলাদা এক আবেগ। মাটির বাড়ির দেওয়াল জুড়ে রঙিন আঁকিবুঁকি। জঙ্গলের মাঝে কাঠ কুড়িয়ে সে বোঝা মাথায় মহিলারা যে ছন্দে হাঁটছিলেন, সেখানে মনে হয় পরিশ্রমের অনেক ইতিহাস লুকিয়ে। এ এক অন্য জগৎ, এখানের মানুষগুলো বড্ড সহজ সরল। কিন্তু ভীষণ আন্তরিক আর পরিশ্রমী।
দুপুরে ফিরে এসে স্নান করে ঘরোয়া ভাত ডাল তরকারি মাছ সহযোগে খেয়ে বেশ পরিতৃপ্তি হলাম। বাইরে খাটিয়ায় বসে পাহাড় জঙ্গলের মাঝের পলাশ ফুলের আগুন দেখতে দেখতে সময় কাটলো। তারপর বিকেলে আবার খয়েরবেড়া এবং চড়িদা গ্রাম ঘুরে দেখলাম। মুখোশ তৈরিই পেশা এ গ্রামের ঘরে ঘরে। সেও এক বিচিত্র জগৎ আর তাঁদের হাতের নিপুনতাও অসাধারণ। তুলির টানে নানা রকম মুখোশ আঁকছে শিল্পীরা, দেখে মন ভরে গেল। এরপর আবার ক্যাম্পে ফেরা গেল সন্ধ্যায়। তখন এই ছৌবুরু গ্রুপের এখানকার বাকি দুটো হোম স্টে থেকেও অতিথিরা চলে এসেছেন। সবার জন্য রয়েছে সান্ধ্য আহার সহ চায়ের বন্দোবস্ত।
রাত একটু বাড়তেই সবাই মিলে ক্যাম্পের গেটের বাইরের চত্ত্বরে একজায়গা হলাম। সেখানে পূর্ণিমা আলোতে প্রাঙ্গন মাঝে তৈরি করা বুড়ির ঘর আর তাকে ঘিরে স্থানীয় সাঁওতালি নাচের শিল্পীরা। আগুন জ্বালানো হলো… ন্যাড়াপোড়ার আয়োজন শুরু। কত বছর পরে সে অভিজ্ঞতা হলো। আর আমার ছোট মেয়েটার চোখে এই প্রথম ন্যাড়াপোড়ানো বুড়ির ঘরের দৃশ্য। আর সে দৃশ্য অপরূপ হলো… যখন একঝাঁক মহিলারা তাদের পায়ের ছন্দে হাতে হাত রেখে ঐ আগুনের চারপাশে নাচ করলেন মাথায় ছোট ঘটি নিয়ে। সেই সঙ্গে মাদলের তাল আর নাচের ঘুঙুরের আওয়াজ, মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ। দোল পূর্ণিমার উৎসব শুরু… সবাই মিলে গালে আবিরের ছোঁয়া মেখে কখন যেন এতগুলো অচেনা মানুষ একাত্ম হয়ে গেলাম। তারপর আবার সাঁওতালি নাচের আসর চললো বেশ কিছুক্ষণ ক্যাম্পের মধ্যে। সেখানে হাতে হাত মিলিয়ে নানা বয়সী মহিলারা ওদের সাথে নাচের ছন্দে মিশে গেলেন। আর এ সব কিছু খুব নিপুণ ভাবে ক্যাম্পের কতৃপক্ষ লক্ষ্য রাখছিলেন, প্রতিটি অতিথির সাথে ওনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনও বেশ প্রশংসনীয়। তারপর একে একে রাতের খাবার খেয়ে যে যার টেন্টে যাওয়া। কিন্তু টেন্টগুলোর মাঝে যে প্রাঙ্গন, সেখানে একটা ঘেরা জায়গায় একদল অল্প বয়সী ছেলে অপূর্ব সুরে বাউল গান গেয়েই চলেছে। ঐ পূর্ণিমা রাত, বাইরে বসে সে গানের সুরে আরও মায়াবী হয়ে উঠলো। চারপাশের টেন্টের নানা বয়সীরাও জড়ো হয়েছিলো, আবার কেউ বাইরে খাটিয়ায় বসেও উপভোগ করছিল। সেই সাথে নানা জায়গা থেকে আসা বাচ্চারাও কখন যেন সখ্যতা স্থাপন করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে।তাই ঐ খোলা মাঠেও তারা দৌড়ে বেড়ালো কিংবা দোলনায় দুলে সময় কাটালো।
পরের দিন… দোল উৎসবের দিন। সকাল থেকে কি হইহই ব্যাপার। ক্যাম্পের সামনে সামিয়ানা পেতে বাঁধানো স্টেজ সাজানো হয়েছে। সামনে চেয়ার পাতা অতিথিদের জন্য। মাইকে বসন্তের গান বাজছে। আর টেন্টের সামনে অতিথিরা সব মত্ত পলাশ ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতে। আমারও কখন যেন অবচেতনে ইচ্ছে জাগলো মালা বানানোর। এত এত পলাশ ফুল চারপাশে পড়ে আছে, তাই কুড়িয়ে জড়ো করলো আমার ছোট্ট মেয়ে৷ আর আমি বসে বসে নানা সাইজের মালা গাঁথলাম। এরপর সকালের জলখাবার তাড়াতাড়ি সেরে সবাই নিজ নিজ পলাশ উৎসবের সাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর তখনই স্থানীয় নৃত্য স্কুল থেকে একঝাঁক কচিকাঁচা এলো তাদের নাচের ডালি নিয়ে।
অতিথিবরণ দিয়ে শুরু হলো উৎসব। খোলা প্রাঙ্গনে নানা রঙের আবিরের থালা সাজিয়ে রাখা। যে যার মত সেখান থেকে রঙ নিয়ে একে অপরকে মাখাতে পারে। পলাশ ফুলের মালা এবং হলুদ গামছা সহযোগে ক্যাম্প কতৃপক্ষ আমাদের সকলকে বরণ করে নেয়। ঐদিকে স্টেজে শুরু হয় ঐ বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর দারুণ সুন্দর নাচের অনুষ্ঠান। পলাশ ফুলের মাঝে, রঙিন আবিরে মাতোয়ারা হয়ে নানা বয়সী অচেনা মানুষ গুলো একাকার হয়ে গেল। কখন যেন দল গঠন করে একে অপরের হাত ধরে নাচ শুরু করলো। বেশ বয়স্ক অনেক মানুষও এসেছিলেন। তারা নিশ্চিন্তে বসে খুশি মনে সে দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এত অচেনা অজানা মানুষেরা বিভিন্ন পরিবেশ জায়গা থেকে এসে একত্রিত হয়েছেন। কিন্তু কোথাও কারোর মধ্যে কোন বিভেদ অশান্তির লেশ মাত্র নেই। দেখে মনে হয় যেন সবাই সবার পূর্ব পরিচিত। এক মুহূর্তও কোন বিশৃঙ্খলা চোখে পড়লো না।
অনুষ্ঠান চলতে থাকে, সবাই গানের তালে নেচে বেড়ায়। এর ফাঁকেই সেখানে উপস্থিত হোন স্থানীয় বিডিও, আই সি, স্বাস্থ্য অধিকর্তা-সহ প্রশাসনিক স্তরের নানা মানুষেরা। সেসব দেখে বোঝা গেল যে, এই ক্যাম্পের পলাশ উৎসব বেশ জনপ্রিয় এ অঞ্চলে।
আমারও এতদিনের সুপ্ত বাসনা পূরণ হলো। মাথায় পলাশের মালা দিয়ে সাদা শাড়ি পরে গলায় পলাশের মালায় শোভিত হয়ে নিজেকে আবির রঙে রঙিন করলাম। ছোট্ট বাচ্চাগুলোও মিলেমিশে একে অপরকে রঙ লাগিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে এলো। তারপর যে যার জায়গায় ফিরে রঙের ছোঁয়া জামা কাপড় ছেড়ে পরিষ্কার হলাম। কিন্তু মনের মধ্যে লেগে থাকলো… এমন রঙিন মুহূর্তের আবেশ। এরপর দুপুরের খাবারও বেশ ঘরোয়া আর উপভোগ্য ছিল। মাঠ জুড়ে রঙের চিহ্ন সর্বত্র।
বিকেলে আবার জলখাবার-সহ আয়োজন করা হয়েছিল বাউল গানের। তারপরের আকর্ষণ ছিল পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নাচ।
আমরা অবশ্য সেদিন রাতের চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে আসি। কিন্তু ক্যাম্পের অতিথিরা পরের দিন দুপুর পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো… ওখানকার কর্মচারীরা খুব ধৈর্যের সাথে প্রতিটি পরিবারের খেয়াল খুশির খোঁজ রাখছিলেন। ওঁনারা এত ব্যস্ততার মাঝেও সেদিন রাতে ট্রেনে খাওয়ার জন্য আমাদের এত যত্নের সাথে খাবার প্যাকিং করে দেন, তার মধ্যে অতিথিবৎসলতা স্পষ্ট।
এই সম্পূর্ণ পলাশ উৎসব অতি সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করেন ছৌবুরু টুরিজম কতৃপক্ষ। সেই সাথে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পের প্রতিটি কর্মীর আন্তরিকতা এবং ম্যানেজার সন্দীপ বাবুর ব্যবহার। আর সবার সাথে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে যোগাযোগ রেখে এত বড় উৎসব ঠান্ডা মাথায় পরিচালনা করলেন… সুজিত বাবু, গত ১০ বছর ধরে এই পরম্পরা বজায় রাখার কৃতিত্ব ওঁনারই প্রাপ্য।
মনের মধ্যে ইচ্ছে রইলো, সামনের বছর বসন্তেও আবার ওদের মাঝে মিশে গিয়ে রঙিন হওয়ার। যথেষ্ট কম খরচে দুই রাত তিন বেলার এই পলাশ উৎসব খুব মনোগ্রাহী এবং উপভোগ্য ছিল।