প্রকৃতি ও পরিবেশ? খুব জানি আমরা। আমাদের চারপাশের জল, হাওয়া, মাটি, গাছ, নদী, সমুদ্র এইসব তো! পরিবেশ দূষণের কথাও বিলক্ষণ জানি। স্কুলে-কলেজে চালু করেছি পরিবেশবিজ্ঞান। পরিবেশ দূষণ সম্বন্ধে রচনা লিখতে হলে ফাটিয়ে লিখি। পরিবেশ দিবসের উপর চমৎকার ভাষণ দিয়ে ফেলি। তার মানে আমরা পরিবেশসচেতন। এবার একটা গোলমেলে জায়গা। সত্যই কি পরিবেশ সম্বন্ধে সচেতন আমরা? পরিবেশ সম্বন্ধে পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের তো কোন মিল নেই আমাদের। ঘরের পাশে গাছ হলে জঞ্জাল বলে অবলীলাক্রমে কেটে ফেলি। বন কেটে ফেলে আদিবাসীদের তাড়িয়ে খনি তৈরির সময় আমরা উন্নয়নের দোহাই দিই, নদীতে ময়লা জঞ্জাল ফেলে দিই অকাতরে, মাটি থেকে যেমন খুশি জল তুলি যেন তার ভাণ্ডার অফুরন্ত, ফসল ফলানোর জন্য বস্তা বস্তা রাসায়নিক সার দিয়ে বড় বড় বেগুন-মুলো-পটল-ঝিঙ্গের আশা করি। আসলে আমরা সবাই শুধু বর্তমানের কথা ভাবি। উট পাখির মতো মাটিতে মুখ ঢেকে ভাবি প্রলয়কে ঠেকানো যাবে। অথচ কবি সুকান্তের ভক্ত হিসেবে আমরা গলা ফাটাই এই বলে যে বিশ্বকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের বাসযোগ্য করে যাব।
আমাদের ঠাকুর কিন্তু পরিবেশ নিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ভেবেছিলেন। শুধু ভাবনা নয়, ব্যবহারিক জীবনে সেসব প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। ঠাকুর মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো! সোজা করে সেটাই বলুন না। তাঁর গোটা কয়েক কবিতা (১২৫টার মতো) পড়ে, গোটা কয়েক গান (১৫০টার মতো) শুনে, দু-চারটে নৃত্যনাটক দেখেছি তো। সেটাই মোদ্দা কথা। একটু তল্লাশ করলেই বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনামূলক গদ্য লেখা মন দিয়ে আমরা শতকরা এক ভাগ মানুষও পড়িনি। পড়িনি নি বলেই আমরা জানিনা পরিবেশ নিয়ে অনেকদূর ভেবেছিলেন তিনি। এতখানি গভীরভাবে ভেবেছিলেন যে আজ তাঁকে বিশ শতকের পরিবেশবিদ বলতেও দ্বিধা থাকে না।
শুনে আপনি লাফিয়ে উঠবেন। বলবেন, এ আর কি নতুন কথা! আমরা জানি ‘গুরুদেব’ (এ সম্বোধন ফাঁকিবাজদের) প্রকৃতি প্রেমিক কবি। তিনি ফুল, চাঁদ, গাছ এসব নিয়ে কত মধুর মধুর কবিতা লিখেছেন। আপনি কি ‘ছিন্নপত্র’ পড়েছেন? একটু ভালো করে পড়ে দেখুন। দেখবেন, শুধু প্রকৃতিপ্রেম নয়, প্রৃকৃতি সম্পর্কে ছেঁদো ভালোবাসা নয়। তিনি বলছেন তিনি প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ, বলছেন সুদূর অতীতে তিনি মাটি ছিলেন, তাঁর উপর শ্যামল বৃক্ষের হিল্লোল বয়ে যেত। তিনি বলছেন প্রৃকৃতির প্রাণের কেন্দ্রে তিনিও বিরাজমান। এমন কি তাঁর মৃত্যু হলেও ভয় নেই। মৃত্যুর পরে তিনি মাটি হলে, জল হলে, তৃণ হলে, ফুলদল হলে ভাবনার কিছু নেই, কেননা ‘যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে অন্ত্যবিহীন আপনা’।
একটা কথা বলা দরকার। প্রৃকৃতি সম্বন্ধে এই ভাবনা আমাদের ঐতিহ্যগত। এখানে পাশ্চাত্যের সঙ্গে বড্ড অমিল। পাশ্চাত্যে প্রকৃতির প্রভু হতে চেয়েছে মানুষ। তাকে শোষণে-লুণ্ঠনে রিক্ত করে দিতে চেয়েছে। শিল্প বিপ্লব থেকে প্রৃকৃতির উপর প্রভুত্ব করার ব্যাপক সূচনা হয়েছে। আমরা কিন্তু প্রৃকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা পাতিয়েছি, তার কাছ থেকে হাত পেতে নিয়েছি, অকৃতজ্ঞ হই নি, ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছি। প্রৃকৃতি সম্বন্ধে এই যে সর্বাত্মক দৃষ্টি, এই যে ‘হোলিস্টিক অ্যাটিটিউট’, আমাদের ঠাকুর এই ঐতিহ্যে লালিত। তাই প্রকৃতির উপর আঘাতের প্রতিবাদ করেছেন তিনি, প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা বলেছেন।
অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংকট এমন করে দেখা দেয় নি, জলবায়ু পরিবর্তন এমন চেহেরা নেয় নি, হিমবা্হ এমন করে গলতে শুরু করেনি, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে এমন করে উদ্যত হয়ে ওঠেনি বিশ্ব উষ্মায়ন। তবু তিনি তাঁর প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন আগামী দিনের অবস্থাটা। শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ উৎসব, ঋতুরঙ্গ, পল্লি উন্নয়ন আরও কত কি! সেদিন মানুষ এসবকে তাঁর কবি-খেয়াল বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি যখন বৃক্ষকে ‘আদিপ্রাণ’ বলেছিলেন, তাঁর বন্ধু জগদীশচন্দ্র নিজের তৈরি যন্ত্রে যখন আবিষ্কার করেছিলেন গাছের প্রাণস্পন্দন, তখনও আমরা তার গুরুত্ব বুঝিনি। আজও বুঝিনা। ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখি, কিন্তু মরা ধনের অভিশাপের কথা মনে রাখি না। ‘মুক্তধারা’র মূল কথাটা আমাদের উপলন্ধিতে গাঢ় হয়ে থাকলে নদীর উপর যত্রতত্র বাঁধ বাঁধার প্রতিবাদ তো আমরা করতাম এবং মেধা পাটেকর আর হরিদ্বারের ‘মাতৃ সদনে’র সাধুদের পাশে দাঁড়াতাম।
আপনি বলবেন, জনসংখ্যা বাড়ছে, উন্নয়ন তো দরকার; শিল্প দরকার, চাষের জন্য জল দরকার। বেঠিক নয়। কিন্তু প্রকৃতিকে ভোগ করে যে শূন্যতা তৈরি করা হচ্ছে, সেটা পূর্ণ করার চিন্তাও দরকার। না হলে যে বিপর্যয় নেমে আসবে। আসছে তো। দেখছেন না, ছ’টা ঋতুর মধ্যে পাঁচটা হাওয়া হয়ে গেছে, খরা-বন্যা পালা করে আসছে, রোগ-ব্যাধি নতুন নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। উন্নয়ন দরকার, কিন্তু এখনকার অর্থনীতিবিদ বলছেন ‘সাসটেইনেবল ডেভলাপমেন্টে’র কথা। সেটা নিয়ে ক’জনই বা মাথা ঘামাই! আর একটা কথা। প্রযুক্তির এই অভাবিত উন্নতি আমাদের ভেতরকার লোভ রিপুটাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। চাহিদা, চাহিদা, দ্রৌপদীর শাড়ির মতো অন্ত্যহীন চাহিদা। চাহিদার জন্য যোগান। আরও শিল্প। আরও প্রযুক্তি। আমাদের ঠাকুর এটাও উপলব্ধ করেছিলেন :
আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা,
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও।