আমাদের দেশের সংবিধানকে স্পষ্টতই একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও এটাও ঘটনা যে আমাদের সংবিধান প্রণেতারা কিন্তু সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটির উল্লেখ রাখার ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি। কারণ, তাঁদের মনে হয়েছিল, ‘সেকুলার’ শব্দটি রাখা হলে দেশের সংবিধানকে অনেকে ধর্ম-বিরোধী বা অ-ধার্মিক ভেবে বসতে পারেন। সংবিধান প্রণেতারা মনে করেছিলেন, দেশ শাসন বা পরিচালনার জন্য দেশের সংবিধানে যে ধরনের নীতি ও আদর্শের পরিচয় থাকা উচিত, তাতে কোনো ধর্মীয় অনুশাসন বিধি না থাকাই বাঞ্ছনীয়। আর সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা সংবিধানে ‘সেকুলার’ শব্দটি ব্যবহার না করে কারও ভাবাবেগের উপর কোনোরকম আঘাত আনতে চাননি। উল্লেখ্য, সংবিধান রচনা পরিষদে সেকুলার শব্দটি সংবিধানে যুক্ত হবে কিনা তা নিয়ে দু-দুবার ভোটাভুটি হয়। আর দু-বারই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর গণপরিষদে যখন সংবিধানের প্রস্তাবনাটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন বিহারের একজন সদস্য ব্রজেশ্বর প্রসাদ প্রস্তাব করেছিলেন যে প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যটি শুরু হওয়া উচিত, “We the people of India, having resolved to constitute India into a secular (emphasis added) cooperative commonwealth to establish socialist (emphasis added) order and to secure to all its citizens…” ব্রজেশ্বর প্রসাদের সংশোধনীর বিষয়ে ডক্টর অন্বেদকর কোনো মতামত প্রকাশ করেছেন এমনটা কিন্তু সেই বিতর্কের নথিতে দেখা যায় না। এক আমেরিকান লেখক ডোনাল্ড ইউজিন স্মিথ ১৯৬৩ সালে তাঁর India as a Secular State Princeton University Press, Princeton. p.14 বইতে লেখেন, “many of India’s Constitutional anomalies regarding the secular state will have disappeared.” প্রসঙ্গত, দেশের ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দিরের ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করেন তখন স্বভাবতই সমালোচনা হয়। কিন্তু এর ৭৩ বছর আগে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। নেহরু রাজেন্দ্র প্রসাদকে লিখেছিলেন, “আমি যেটা আশঙ্কা করেছিলাম যে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, সেটাই হয়েছে। আমাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কীভাবে এরকম একটা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। বিশেষ করে যখন এই কর্মসূচিকে ধর্মীয় পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।…”
ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় “ধর্মনিরপেক্ষ” এবং “সমাজবাদী” শব্দগুলি প্রবর্তন করে। উল্লেখ্য, বিখ্যাত আইনী শিক্ষাবিদ, এম পি জৈন, তাঁর Indian Constitutional Law বইটিতে ওই সংশোধনী সম্পর্কে লেখেন, “৪২তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে একটি মৌলিক আপত্তি হল যে এটি দেশে জরুরী অবস্থার সময়ে করা হয়েছিল যখন বিরোধী দলের বেশিরভাগ নেতাকেই জেলে বন্দি রাখা হয়েছিল। ফলে যে বিষয়টি নিয়ে বিরোধী দলগুলির মতামতের উপর একটি খোলামেলা আলোচনার দরকার ছিল, প্রয়োজনে পরিবর্তনও কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। বরং সংসদের দুটি কক্ষে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেটি জাতীয় ঐকমত্যের পরিবর্তে একটি দলীয় বিষয় হিসাবেই প্রতিপন্ন হয়”। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে দেশের জনতা সরকার কন্সটিটিউশন বিল (৪৪তম অ্যামেন্ডমেন্ট)-এর প্রস্তাব দিয়েছিল, যদিও তা সেই সময় রাজ্যসভায় পাশ হয়নি। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে সংবিধানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে গেলে, অর্থাৎ অ্যামেন্ডমেন্ট করাতে গেলে, দেশজুড়ে রেফেরেন্ডাম বা গণভোট করাই যথেষ্ট। একথা বলাই যায় যে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পরিবর্তনের পক্ষে যে জনমত গড়ে তোলার অপচেষ্টা করা হত সে নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। হয়ত সে কারণেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এই বিষয়ে চিন্তিত হয়েই বলতে বাধ্য হয়, “ভারতবর্ষ এখনও অবধি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ… আমরা জানি না তা কতদিন থাকবে।”
দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নিয়মবিধিগুলি সম্পর্কে অনেকগুলি ধারা রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ছবিটি কী আশাব্যঞ্জক? যে আদর্শ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়েই সব মানুষকে কাছে টানার কথা ছিল, সেই কথাটি দিয়েই কী দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা হচ্ছে না? প্রসঙ্গত, মাধব গোডবোলে ‘Is India a Secular Nation?’ বক্তৃতায় হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজ থেকে যে আপত্তি এসেছিল এবং কংগ্রেসের বড় বড় নেতারাও সেই সময়ে হিন্দু আইনে সংস্কারের ক্ষেত্রে কতটা বিপক্ষে ছিলেন, সেই আলোচনায় বলেন, নেহরুর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত কারণ, তিনি অন্তত এই বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ করেছিলেন এবং প্রয়োজনীয় আইনগুলি যাতে পাশ হয় তার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেন নি। যদি মুসলিম পার্সোনাল আইনের সংস্কার সেই সময়েই করা হত, তাহলে এত দিনে দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে যেত। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক যেন না থাকে, এ বিষয়ে ১৯৪৮ সালের ৩ এপ্রিল, কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে (লেজিসলেটিভ) একটি রেজলিউশন পাশ হয়। নেহরু সেই রেজলিউশনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, সরকার তার ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টা করবে যাতে এই রেজলিউশনের মূল উদ্দেশ্য সফল হয়। কিন্তু তিনি ১৭ বছরে (প্রধানমন্ত্রী) এই রেজলিউশন লাগু করার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ওই প্রসঙ্গ ফের উঠে আসে, পিভি নরসিংহ রাও-এর আমলে ১৯৯৩ সালে পার্লামেন্টে কন্সটিটিউশন (৮০তম অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল এবং রিপ্রেজেনটেশন অফ দা পিপল অ্যাক্টের অ্যামেন্ডমেন্ট- দুটি বিল পেশ হলেও সাংসদদের সমর্থন না পাওয়ায় সেই বিল দুটি পাশ হয়নি।