প্রথম দিন, সারাহানের পথে —
হিমাচল প্রদেশের প্রায় অনেক জায়গা দেখা হলেও কিন্নরের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় নি। তাই কিন্নর কৈলাসের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সময় হাতে কম থাকায় কিছুতেই যথাযোগ্য প্ল্যান করা যাচ্ছিলো না। ব্যাংকারের সাথে সংসার করার জ্বালা অনেক, আপাত দৃষ্টিতে ক্যালেন্ডারে ছুটি অনেক দেখালেও ব্যাঙ্কে চাকুরীজীবিদের ছুটি নেওয়া বড্ড মুসকিল। আমরা এত ঘুরে বেড়াই, কিন্তু তার পিছনে ছুটির হিসেব নিকেষ নিয়ে কতটা মাথা ঘামাতে হয় তা শুধু নিজেরাই জানি। আমার চাকরির ক্ষেত্রে এই সমস্যা কম, কিন্তু সংসারের অন্য মানুষটার কাজের প্রতি কর্তব্যকে সম্মান জানাতে আমরা প্রায় প্রতিবারই পুজোর সময়ে বেড়িয়ে পড়ি। এরজন্য আমাদের নিজভূমির সবচেয়ে বড় উৎসবের আনন্দকে ফেলে রেখে বেড়োতেই হয়। যাই হোক, এবারে অনেক ভেবে ঠিক করা হলো যে, ষষ্ঠীর দিন অফিস করে তারপর রাতের ফ্লাইট ধরে দিল্লি যাওয়া হবে। পরের চার দিন ছুটি এবং মাঝে দুটোদিন মাত্র নিজস্ব ছুটি নিয়ে লক্ষ্মীপুজোর দিন আবার ফিরে এলে টানা সাতদিনে এই ট্রিপ করা সম্ভব হবে। এর জন্য আমাদের কিছুটা হলেও শারীরিক কষ্ট সহ্য করে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, তবু কিন্নরের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।
ষষ্ঠীর দিন রাতে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নিউ দিল্লি স্টেশনের পাশের এক হোটেলে রাত প্রায় ১২ টায় এলাম। পরের দিন ভোর ৫.৫০ এর বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে করে চন্ডীগড়ে নামলাম সকাল ৮.৪০ এ। সেখান থেকেই আমাদের প্রথম দিনের দীর্ঘ পথ যাত্রা। আমরা সপ্তমীর দিন যত রাস্তা এসেছি, তার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা এবং পাহাড়ি পথে শরীরে যে সমস্যা থাকে তা থেকে মুক্ত হওয়াটা জরুরি। নাহলে চন্ডীগড় থেকে সারাহান পর্যন্ত দীর্ঘ পাহাড়ি প্রায় ২৭৫ কিমি পথ প্রায় ১০ ঘন্টায় যাওয়াটা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের ড্রাইভার দাদা বিচক্ষণ এবং শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় সকাল ৯ টায় যাত্রা শুরু করে সন্ধ্যা প্রায় ৬.৩০ টায় পৌঁছে দিলেন আমাদের প্রথম কিন্নরের গন্তব্য… সারাহান।
এই যাত্রাপথেই আরেক লোভনীয় জিনিস নজরে এলো… কিন্নরী আপেল বাগান এবং সারা রাস্তা জুড়ে আপেল বোঝাই গাড়ির আনাগোনা। সন্ধ্যায় যখন আমরা সারাহানে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছালাম, পথের সব ক্লান্তি দূর হলো হোটেলটির নিজস্ব লোকেশনের জন্য। আমরা হিমাচল টুরিজম এর ‘হোটেল শ্রীখন্ড’ এ ছিলাম। এই দীর্ঘ পথ অধিকাংশ যাত্রীরা একবারে আসেন না। একটা দিন সিমলাতে থেকে পরের দিন সারাহানে থাকাটাই ঠিকঠাক।
সারাহান বিখ্যাত ভীমকালি মন্দির এর জন্য। এটি সতীর ৫১টি পীঠস্থানের মধ্যে একটি। আমাদের হোটেল থেকে হাঁটাপথে ২ মিনিট এই মন্দির। হোটেলের কটেজের ঘরটি সাবেকি ও বহরে এত বড় এবং সুন্দর যে রাস্তার ধকল মিটে গেলো রাতে আরামের ঘুম দিয়ে। রাতে মন্দির থেকে পুজোর ঘন্টার আওয়াজ এবং সকালের আরতির ধ্বনি মনকে প্রশান্তি দিলো। সেদিন ছিল অষ্টমী শেষে নবমী পুজোর দিন। সকাল সকাল স্নান সেরে সেদিন মন্দিরে পুজোও দিয়েছিলাম। তবে এ মন্দিরের বৈশিষ্ট্য আমাদের এখানকার মন্দিরের মত নয়। তিব্বতি প্যাগোডার আদলে তৈরি এ মন্দির বৌদ্ধ এবং হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করছে। রুপায় মোড়া গেট সহ ছোট্ট কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে মন্দিরের গর্ভগৃহের গঠন আলাদা রকমের। মন্দিরে পুজো দিয়ে আসেপাশে ঘুরে হোটেলে এসে আবার সব গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
ভীমকালি মন্দিরের ভেতরে মোবাইল ক্যামেরা নিষিদ্ধ এবং মাথা ঢেকে সবাইকে প্রবেশ করতে হয়।
মন্দির সহ সারাহানের হোটেল থেকে শ্রীখণ্ড মহাদেব শৃঙ্গ দেখা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় দিন, সারাহান থেকে সাংলার পথে —
সারাহান থেকে প্রায় ৮৫ কিমি দূরে কিন্নরের পুরনো এই জনপদ… সাংলা ভ্যালি অথবা যাকে বাসপা ভ্যালিও বলা হয়। বাসপা নদীর সৌন্দর্য এবং কৈলাস পর্বতের উল্টোদিকের বরফাবৃত শোভা এই ভ্যালিকে আরও মনোরম করে তুলেছে। সারাহান থেকে সাংলা যাওয়ার পথে পাহাড়ের নানা রকম ভঙ্গিমা নজর কেড়েছে। সাংলা ভ্যালি ঢোকার মুখেই বিখ্যাত কামরু ফোর্ট যাওয়ার রাস্তা এবং ছোট্ট সাংলা বাজার জুড়ে কিন্নরী আপেল বোঝাই দোকান, স্টোর রুম আর আপেল রপ্তানির নানা কার্যকলাপ চোখে পড়লো।
আমাদের থাকার জায়গাটি সাংলা ভ্যালি থেকে একটু দূরে প্রায় ২ কিমি, ছিটকুলের দিকে। দুপুর বাড়ার সাথে সাথে মনে দ্বিধা বাড়ছিলো যে, কোন দূরে নিরিবিলিতে কি পরিবেশে গিয়ে উপস্থিত হবো এই নির্জন জায়গায়। পথ সংকীর্ণ হওয়ায় এবং রাস্তায় বড় মিলিটারি গাড়ি আটকে থাকায় পৌঁছাতে দেরি হচ্ছিল, সাথে সাথে উদ্বেগও বাড়ছিল।
পাহাড়ি চড়াই রাস্তা ধরে নীচে নেমে যখন “sattva pine resort, sangla” তে পৌঁছালাম সব মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব একনিমিষে দূর হলো। নদীর আওয়াজ এবং সামনে বরফ ঢাকা পাহাড়ের শোভার মাঝে বৌদ্ধিক সাজে সজ্জিত এই ১০টি কটেজ নিয়ে তৈরি রিসোর্টটি নিজেই একটা দর্শনীয় স্থান। সেই সাথে ওখানের কর্মীদের আতিথেয়তা মনে জায়গা করে নিলো। পথের ক্লান্তি দূর করতে ওদের স্থানীয় ভেষজ চা শরীরকে আরাম দিলো। তারপর লাঞ্চের সাধারণ খাবারের পরিবেশন ছিল অনন্য… কাঁসার বাসন, পিতলের ঘড়ার জল, সাথে নিজস্ব বাগানের পালং শাকের পালংপনীর বড্ড মুখরোচক। খাবার দাবারের পরে আমরা কাছেই নদীর পাড়ে ছোট্ট ব্রিজের দিকে এগোতে লাগলাম।
স্থানীয় বাসপেরি গ্রাম, যা এই সাংলা ভ্যালির একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য তা এই রিসোর্টের কাছেই। আমরা বিকেলের হালকা রোদে সেই গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে বাসপা নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। কোন বাইরের ভীড়ভাট্টা ছাড়া স্থানীয় মানুষদের কাজ থেকে ফিরে আসার দৃশ্য মনে আলাদা অনুভূতি আনলো। এই ট্রিপে সব জায়গাই সুন্দর, কিন্তু এই সাংলার রিসোর্টটি অবস্থানগতভাবে ইউনিক হওয়ায় এর সৌন্দর্যের স্বাদ সবার চেয়ে আলাদা। ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার মুখে একটি মন্দির। আর তার ফাঁক দিয়ে সূর্য ডোবার আলো ঝকঝক করছে। তবে গ্রামে যাওয়ার পথটা একটু চড়াই এবং কিছুটা দূরে থাকায় বিকেলে আর যাওয়া হলো না। শারীরিক সমস্যার কারণে আমি পরের দিন সকালেও যাই নি, কিন্তু বাবা-মেয়ে প্রায় ১.৫ ঘন্টা ছোট্ট ট্রেকিং করে বাসপেরি ভিলেজ ঘুরে এসেছিলো। গ্রামের প্রতিটা বাড়ি সম্পন্ন এবং সব বাড়ির সামনে আপেল বাগান। সেখানে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছেন এবং আপেল পেড়ে গাড়ি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিলো। ওদের দেখে স্থানীয়রা বেশ কিছু আপেল উপহার হিসেবে খেতে দেয় এবং গাছের তলা থেকেও তিতির কয়েকটা আপেল কুড়িয়ে আনে। এই আপেলের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত রসালো মিষ্টি যেন অমৃতসম। আমাদের এখানে সাধারণত এমন আপেল পাওয়া যায় না। মন ভরে আপেল বাগানে আপেলের ঝাঁক দেখে এবং বাসপা নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখে সাংলা ভ্যালির অপরূপ শোভা ভীষণ রকমভাবে উপভোগ করেছিলাম।
এর সাথে রাতে রিসোর্টে বনফায়ারের ব্যবস্থা এবং ঘরোয়া ভেজ সুপ বাইরের প্রায় ৫-৬ ডিগ্রী উষ্ণতাকেও গ্রহণযোগ্য করে দিয়েছিলো। রাতে ডিনারে স্থানীয় হিমাচলী কড়াই চিকেন সহ স্থানীয় খাবারের ব্যবস্থা থাকায় হিমাচলী খাবারের স্বাদও নেওয়া হয়। রাতে ঠান্ডা ভীষণ ছিল, কিন্তু কটেজের ঘরে সবরকম আরামদায়ক ব্যবস্থা থাকায় কোন অসুবিধা হয় নি।
সাংলাতে বাসপা নদীর তীর-সহ আপেল বাগানে ঘোরার অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল।
সাংলা থেকে ছিটকুলের পথে…
সাংলা ভ্যালি থেকে মাত্র ২৩ কিমি মত দূরত্বে কিন্নর জেলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা… ছিটকুল। বছরের একটা বড় সময় বরফাবৃত থাকে এই ইন্দো-তীব্বতীয় সীমানার শেষ গ্রাম। সাংলা থেকে বেড়িয়ে ছিটকুলের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথেই পড়ে হিমাচলের আরেকটি সুন্দর ছোট গ্রাম রাকসাম। যত পথ এগিয়েছি ছিটকুলের দিকে, ততই পথের নৈসর্গিক দৃশ্য বদলাতে শুরু করে। পাহাড়ি বাঁকে পাথুরে ভাব স্পষ্ট, পাহাড়ের সবুজ সজীবতা কমে এক অন্য সৌন্দর্য দেখা দিচ্ছিলো। আর প্রতিটা বাঁকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কৈলাসের বরফ মোড়া চূড়া কাছে চলে আসছিলো।
ছিটকুলে ঠান্ডা হাওয়া এই বার্তা বহন করছিল যে, এখানে বিকেলের পরে আবহাওয়া প্রবল শীতল হবে। অধিকাংশ ভ্রমণার্থী সাংলা থেকে একবেলার জন্য ঘুরে আবার সাংলাতেই রাত্রিবাস করেন। এই প্রবল শৈত্যে রাতে থাকাটা বেশ কঠিন, আমি নিজেও ভীষণ শীতকাতুরে, তাই খুব চিন্তায় ছিলাম এখানে সারারাত কাটাবো কি করে!! বাসপা নদীর তীরেই আমাদের সেদিনের থাকার জায়গা “Sama resort-chitkul heights” ছিল। দুপুরবেলা হোটেলে চেক ইন করে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে বেড়িয়ে পড়লাম ইন্দো-চীনা বর্ডারে। যা হোটেল থেকে ৩কিমি মত দূরত্বে ছিল। সেখানেই চোখে পড়লো নানা রকম টেন্টে থাকার ব্যবস্হা এবং ট্রেকার সহ নানা বাইকারদের যাতায়াত। ইন্দো তিব্বতিয়ান বর্ডার পোলিশ (ITBP) পরিচালিত এই অঞ্চলে গেট দিয়ে বাইরের দর্শকদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুলিশের সাথে কথোপকথন থেকে এটা বুঝলাম যে, অনেক আগে এখান থেকে ভিতরে যেতে দেওয়া হত ভারত – চীন বর্ডার দেখাতে। কিন্তু পরবর্তীতে টুরিস্টদের মোবাইল ক্যামেরা এবং সোস্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের ফলে এখানকার গোপনীয়তা বজায় রাখা মুসকিল হচ্ছিল। তাই আমাদের ঐ বর্ডারের দিকে ITBP এর সেনা ছাউনির ছবি তুলতেও নিষেধ করলেন।একমাত্র উপর মহল থেকে জেলা শাষকের অনুমতিপত্র থাকলে তাদের ওঁনারা বর্ডারের দিকে যেতে দেন, তাও যথাযথ নিরাপদ ব্যবস্হায়। অগত্যা,ঐটুকু সীমানা দেখে ভারতের শেষ প্রান্তের রূপ দর্শন করে ফিরে এলাম আমাদের হোটেল সংলগ্ন বাসপা নদীর তীরে।
বাসপা নদীর পাড়ে সেদিন প্রায় ১.৫ ঘন্টার উপর কাটিয়ে আমরা হোটেলে প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এসেছিলাম। পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সহ দূরে কৈলাস পর্বতের শোভা আর নদীতীর জুড়ে পাইন বনের বাহার… ছিটকুলের রূপকে অপরূপা করেছিলো। সময় বয়ে যাচ্ছিলো যত সূর্য ডোবার পালাও তত এগোচ্ছিলো,সেই সাথে ঠান্ডার বহর বাড়ছিল শীতল হাওয়ার সাথে। তাই আমরা বিকেল ৫-৫.৩০ টায় আমাদের হোটেলের ঘরে চলে আসি। কিন্তু ঘরটি অবস্হানগতভাবে সম্পূর্ণ পাহাড়ের সামনে। তাই ব্যালকানি বাদেও ঘরের কাঁচের জানলা থেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে দেখলাম সূর্যের আলোর রকমারি কারুকার্য। সূর্য ডুবতে ডুবতে একফালি রক্তিম আলো পাহাড়ের চূড়াতে রেখে যখন এক মুহূর্তে ডুবে গেল,তখন চোখের সামনে সম্পূর্ণ পাহাড়টি সাদা কালো ছবির মত হয়ে গেলো।
সন্ধ্যা নামার পরে চারদিকে এক নৈশব্দ ঘিরে ধরলো ঐ ছোট্ট গ্রাম জুড়ে। ঠান্ডায় জমতে জমতে রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম। ভারী কম্বলের মধ্যেও শীতপোষাকে নিজেদের মুড়ে সকালে ঘুম ভাঙলো যখন চারদিকে শীতের আস্তরণ। সামনের রাস্তায় নর্দমার জল জমে আগাছাগুলো বরফ হয়ে ছিল। বোঝা যাচ্ছে রাতে তাপমাত্রা শূন্যর নীচে ছিল।
ছিটকুলে একদিন থাকার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। ঠান্ডার অনুভূতি ও সূর্যাস্তে পাহাড়ের অপরূপ শোভা দেখতে এবং সকালের ঝকঝকে রোদে নদীর পাড়ের শীতল অনুভূতি নিতে হলে এখানে একরাত্রি থাকাটা জরুরি। তবে হ্যাঁ, হোটেল সহ থাকা খাওয়ার ব্যবস্হা নিয়ে কিছুটা হলেও নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে যে, খুব আরামদায়ক নয় এবং সবরকম উপকরণ এখানে পাওয়া যাবে না।
চতুর্থ এবং পঞ্চম দিন, ছিটকুল থেকে কিন্নর সুন্দরী কল্পার পথে….
কিন্নর জেলার সদর শহর রিকং পিও-র একটি ছোট অংশ এই কল্পা, যেখানের প্রায় সব জায়গা থেকে কিন্নর কৈলাস পর্বতের বরফাবৃত শৃঙ্গ দেখা যায়। ছিটকুল থেকে সকাল ৯টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম কল্পার উদ্দেশ্যে। সাংলা রোড ধরে প্রায় ৬২ কিমি দূরে কল্পার পাহাড়ি রাস্তায় পৌঁছাতে ৩ ঘন্টা মত সময় লাগবে। ছিটকুলের ঠান্ডা থেকে প্রায় পালিয়ে আসার জন্য তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়া, তাই হাতে সময় থাকায় সাংলা শহরের সম্মুখে কামরু ফোর্ট ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সেই মত ফোর্টের রাস্তার মুখে শুনলাম প্রায় ২ কিমি খাড়াই রাস্তা অনেকে ট্রেক করে পায়ে হেঁটে যান। কিন্তু আমার অসুবিধা থাকার কারণে ড্রাইভার দাদা গাড়ি উপরে নিয়ে গেছিলেন। গাড়ি থাকার রাস্তা পেরিয়ে ফোর্টে যাওয়ার পায়ে হাঁটা পথে আপেল বাগান দেখতে দেখতে সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে ফোর্টের দরজার সামনে এলাম। তবে রাস্তায় যাওয়ার সময়ই বুঝলাম এ পথে এখন কোন টুরিস্ট আসে না, অযত্নের ছোঁয়া সর্বত্র। একজন লেডি পুলিশ আমাদের খালি পায়ে ভিতরে আসতে বললেন,এখানের মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী সবাইকে মাথায় টুপি এবং কোমর বন্ধ মত একটা ফিতে বেঁধে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরের বাইরে এই হিমাচলী টুপি এবং রঙিন ফিতে রাখা ছিল। ঐ মহিলা আমাদের সঙ্গে ঢুকে সব দেখালেন। তবে কামরু ফোর্টের ভিতরে যাওয়া নিষিদ্ধ। ফোর্টের কাঠের পাটাতন সহ পুরো কাঠামো প্রায় ভগ্নপ্রায়। ওখানে উপবিষ্ট কামাখ্যা দেবীর মন্দির দর্শন করে আমরা ফিরে এলাম।
এরপর কল্পার পথে যত এগোতে লাগলাম, সামনে কৈলাস পর্বত যেন এগিয়ে আসতে লাগলো। সদর শহর পিও বেশ বড় এবং এখানে সব রকমের অফিস দোকান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থাপনা নজরে এলো। আমাদের এই দুই-দিনের থাকার ব্যবস্থ ছিল হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডিপার্টমেন্টের “কিন্নর কৈলাস হোটেল”এ। কল্পায় থাকার সবচেয়ে ভালো দুটো হোটেলের মধ্যে এটিই সেরা, আমার মতে। এখানে প্রতিটা ঘরের জানলা থেকেই সামনে কৈলাস পর্বতের সুবিশাল বিস্তৃতি নজরে আসে। আমাদের রুমটা আরও মেন বিল্ডিংয়ের সামনের দিকে হওয়ায় অসম্ভব ভালো একটা অনুভূতি হচ্ছিল। এই ট্রিপে এই দুটো দিন শান্তিতে বিশ্রাম নিয়ে বসে বসে কিন্নরের সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম।
দুপুরে লাঞ্চ করতে গিয়ে আরও ভালো অভিজ্ঞতা হয়… খাবার টেবিলের সামনেই মনে হচ্ছে পাহাড়ের চূড়া। এমন সুন্দর জায়গায় বসে খাওয়ার সৌভাগ্যও মনে রাখার মত। হোটেলের পাশের রাস্তা জুড়ে আপেল বাগান৷ সেখানে দলে দলে নারী পুরুষ ভেদে শ্রমিকেরা রাতদিন বাগানের কাজে যাচ্ছে পিঠে ঝোলা নিয়ে৷ সারারাত ধরে ওখানে আপেল তোলা এবং প্যাকেটিং এর কাজ হয়। নীচে গাড়িতে তোলা হয়। কাজ করতে আসা স্থানীয় মানুষের দল রাতে টর্চ জ্বালিয়ে গল্প করতে করতে পাহাড়ি রাস্তা ধরে ঐ ঠান্ডায় উপরে বাগানে যাচ্ছে… সে দৃশ্যও অন্য এক কাজের জগতের পরিচয় করালো।
কল্পাতে বিখ্যাত হলো সুইসাইড পয়েন্ট। পাহাড়ের কিনারে এমন একটা জায়গা যেখান থেকে নীচে তাকালে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়!! কিন্তু সেই পাহাড়ের চারপাশের রূপ ভয়ঙ্কর সুন্দর। মুহূর্তের ভুলে কোন কোণে এলে যখন তখন বিপদ হতে পারে জেনেও এক সুন্দরের আহ্বানে ঐ জায়গা ঠিক আকর্ষণ করবেই। তবে প্রশাসন থেকে রেলিং দিয়ে রাস্তার পাশে বিপদের সংকেত দিয়ে রেখেছে। এছাড়া আছে… রোগি গ্রাম। কৈলাস পাহাড়ের সবচেয়ে ভালো দর্শন এই গ্রামের প্রতিটা কোণায়। আপেল বাগান কেন্দ্রিক এই গ্রাম হেঁটে, পাশে বরফ মোড়া শৃঙ্গকে সাথে নিয়ে গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়ার মধ্যে এক স্বর্গীয় সুখ ছিল। এছাড়া প্রাচীন প্রায় ৫০০০ বছরের নারায়ণ — নাগিন মন্দির, হু বু লান কার মনেস্ট্রি-সহ কল্পার মন্দির সব একজায়গায়।
এ বাদেও পাইন ফরেস্টে বিকেলের দিকে ঘুরে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে আনন্দ উপভোগ করা যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত ছোট একটা দুর্ঘটনার কারণে আমরা এই দুইদিনে কিছু জায়গায় কম সময় নিয়ে ঘুরে হোটেলে সময় কাটিয়েছি বেশি। কিন্তু এই হোটেল এবং আমাদের থাকার ঘরটিই যথেষ্ট ছিল কল্পার সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্য। সকালে সূর্যের আলোতে ঝলমলিয়ে ওঠা পাহাড়ের রূপ হোক কিংবা বিকেলে কালো মেঘের আড়ালে পাহাড়ের চূড়াতে বরফ পড়ার দৃশ্য… ঘরে বসে বসে দেখেছি। দুইদিন দারুণ কাটিয়ে পাশের আপেল বাগানে ঘুরে, মুখরোচক খেয়ে কৈলাস পর্বত থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
ষষ্ঠ দিন, কল্পা থেকে নারকান্ডার পথে….
কিন্নর কৈলাস-এর দর্শন আমাদের সাঙ্গ হয়েছিলো কল্পাতেই। দুইদিন কল্পাতে থেকে এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু দীর্ঘ রাস্তা হওয়ায় মাঝামাঝি সিমলা জেলার নারকান্ডাতে একটাদিন রাতে থাকা হয়েছিলো।
কল্পা থেকে প্রায় ১৬৫ কিমি দূরে নারকান্ডা পৌঁছাতে ৫ ঘন্টার উপরে সময় লাগে। সকালে কল্পার ঐ সুন্দর জায়গা ছেড়ে ১১টা নাগাদ রওনা দিয়েছিলাম। পথের বাঁকে বাঁকে কৈলাসের বরফ ঢাকা শৃঙ্গ উঁকি দিচ্ছিলো। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমরা লাহুল-স্পিতি ভ্যালির দিকে আর যাই নি৷ তবে প্রায় সবাই একসাথে কিন্নর এবং স্পিতি ভ্যালি একসাথে ঘুরে আসে, কয়েকটা দিন জুড়ে নিয়ে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, কিন্নরের এই সবুজ পাইন বন ঘেরা নদীর নীলজলের রূপের সাথে স্পিতি ভ্যালির পাথুরে অপরূপা শোভা একসাথে না মিলিয়ে ফেলাই ভালো। তাই যেতে যেতে নাকো-টাবো যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে আসার সময় মনে মনে ভাবলাম যে, আরেকবার এ পথে আসতে হবে… হিমাচলের আরেকটা রূপ দেখতে।
যাই হোক, এ পথ বেশ দীর্ঘ। নারকান্ডাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যাবে, তাই পথেই লাঞ্চ সেরে এক পাহাড়ি চড়াই রাস্তা ধরে নারকান্ডার বিখ্যাত ‘হাটু পিক’ এবং ‘হাটু মন্দির’ দেখার জন্য এগোতে লাগলাম। সংকীর্ণ ছোট রাস্তা ধরে শুধু পাহাড়ের উপরেই উঠতে লাগলাম। এতটা চড়াই পথে উঠে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘোরার মত অবস্থা!! প্রায় ৬ ঘন্টা যাত্রা করে আমরা বিকেল ৫ টা নাগাদ সূর্য ডোবার আলোতে পৌঁছলাম হাটু টেম্পল।
কথিত আছে যে, রাবণ পত্নী মন্দোদরীকে উৎসর্গ করে এই কালী মায়ের মন্দিরটি। হাটু মাতার মন্দিরের অবস্থান এবং তার কারুকার্য বেশ নজর কাড়া। পাহাড়ের মাঝখানে চারপাশ ফাঁকা এই মন্দিরের পরিবেশ খুব শান্ত। মন্দির থেকে একটু পথ হাঁটলেই সামনে সিমলা অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু এই হাটু শৃঙ্গের মাথা। সেখান থেকে চারপাশের শোভা অতি মনোরম। এখানে অনেক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী-সহ ট্রেকারের দেখা পেলাম। নারকান্ডা জনপদ থেকে এই হাটু পিক আসার দূরত্ব মাত্র ৭ কিমি। তাই অনেকেই ট্রেকিং করে এখানে আসে।
সূর্যাস্তের কিছু আগে চারপাশ ঘুরে এবার আমরা ফিরলাম সেদিনের জন্য আমাদের থাকার জায়গায়, হিমাচল টুরিজম-এর “হোটেল হাটু” তে। নারকান্ডা বাজার থেকে একটু উপরে নিরিবিলিতে থাকার এই হোটেলটিও অনন্য।
পরের দিন অর্থাৎ সপ্তমদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। নারকান্ডা থেকে চন্ডীগড় এয়ারপোর্টে যেতে প্রায় ৫ ঘন্টা মত সময় লাগে। তবে মাঝ পথে সিমলা শহর থাকায়, সিমলা মলে এক ঘন্টা মতো ঘোরার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না।
এই মনোরম সফর এক সপ্তাহে শেষ করে সাথে নিয়ে ফিরেছিলাম একরাশ ভাল থাকার অক্সিজেন।
ছবি : লেখক, দেবাংশু দত্ত