ছত্তীশগঢ়ের নতুন সংসারে একটি শক্তপোক্ত লোহার বালতি কেনার দরকার পড়েছিল। হমারা বাজাজে চেপে তার গৃহ প্রবেশের ঠিক আগে রাস্তায় একজন চেঁচিয়ে বলল, “সাহাব আজ ধনতেরসকে দিন মে সব সোনা চাঁদি খরিদতে হ্যায়, আপ লোহা খরিদে!” ধনতেরসের হুজুগ তখনো বাঙালির অধরা। দেবতাদের ডাক্তার ধন্বন্তরি যে আজকের দিনে লোহা কিনলে বিরূপ হন, সেকথা তখন জানা ছিল না!
বিশ্বায়নের ফলে এখন ধনতেরাসের স্বর্ণ ধামাকা, নতুন ঝ্যাঁটা, হ্যালোউইনের কুমড়ো, দীপাবলীর কান্ডিল সব আমাদের আয়ত্তে।
গত বছর সন্ধ্যেবেলা ভূতচতুর্দশীর দিন মেয়েজামাইয়ের গোয়ার ফ্ল্যাটে বাচ্চারা ভূত সেজে tricks and treats অর্থাৎ চকলেট, টফি নিতে এল। আজ নাকি হ্যালোউইন ডে! অশুভ আত্মার হাত থেকে রেহাই পেতে শুকনো ডালপালায় সন্ধ্যেবেলা আগুন জ্বালাবে। দরজায় দরজায় ঘুরে তাদের ঝোলায় ভরবে ক্যান্ডি টফি, চকলেট। তাদের মধ্যে আবার এক ভূত আমরা বাঙালি জেনে উল্লসিত হয়ে বাঙলায় কথা বলে উঠল।
আমরা তার আগে ভূত তাড়াতে ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে চোদ্দ পিদিম জ্বালিয়েছি। বাঙালি ভূত আর সাহেব ভূত কি এইদিনে গলাগলি করে! ভূতেদের রাজত্বে বোধহয় সাদা-কালো-খয়েরির ভেদাভেদ নেই!
মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটকে দীপাবলীর আলোকোজ্জ্বল বাজারে এইসময় রঙবেরঙের ক্যান্ডিল ঝোলে। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি এই আলোর শেডগুলি কাগজের বা কাপড়ের তৈরি। নানা রঙের, বিভিন্ন সাইজের এই ক্যান্ডিল সবাইকে আকর্ষণ করবেই। মুস্কিল হয়, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব। রাস্তায় বসে দীপাবলীর শেষমুহুর্তেও ক্যান্ডিল তৈরী হচ্ছে, এমন ছবি এই অঞ্চলে হামেশাই দেখা যায়।
কান্ডিলের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি, শব্দটি আরবী। হজরত মহম্মদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। অটোম্যান এবং বলকান সাম্রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায় হজরত মহম্মদের জীবনের পাঁচটি বিশেষ ঘটনাবহুল রাতে মসজিদের মিনার গুলি আলোকিত করতেন, বিশেষ প্রার্থনা করতেন। ক্যান্ডিল শব্দটি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
সমুদ্রপথে এসে ব্যবসা বা ধর্মীয় সূত্র ধরে কবে এই কান্ডিলের ধারণা পশ্চিম ভারতে জনপ্রিয় হল কেউ জানে না। মসজিদের কান্ডিল রাত দীপাবলির তমিস্রাকে সুষমায় ভরিয়ে দিল। মুম্বাইয়ের এক গলির নাম হল কান্ডিল গলি। এক সুন্দর কুটির শিল্প গড়ে উঠল। এখন কান্ডিল বলতে বোঝায় দীপাবলির এক আলোকসজ্জা। যাতে এখনো মসজিদের মিনারের আদল রয়ে গেছে। তাতে জুড়েছে রঙিন ঝালর, ফুল, পাতা, আয়না, পুঁতি আরো কত অলংকার ।
দীপাবলি থেকে শুরু করে এই ইলেকট্রিক লন্ঠন বাড়ির ছাদে বা ব্যালকনিতে ঝুলবে বেশ কিছুদিন। আমাদের আকাশ প্রদীপের মতই তার মাহাত্ম্য। স্বর্গগত পূর্বপুরুষদের আলো দেখানো।
গোয়াতে দেখেছি দীপাবলীর কান্ডিলের রঙ ফিকে না হতে হতেই বাড়িতে বাড়িতে ফুটে ওঠে কান্ডিল তারা। বড়দিনের আগে তারার আলোই তো খবর দিয়েছিল যে “ঐ মহামানব আসে”। সে আলোর পথ ধরে তিন সন্ত মানুষ দেবতার সন্তানকে দেখতে এসেছিলেন।
শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা বিজয় করে অযোধ্যাকে গৌরবের আলোয় ভরে দিয়েছিলেন। পয়গম্বরের পবিত্র বাণী, যীশুখৃষ্টের জীবন আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছিল। আমরা সেই আলোর উত্তরাধিকার এখনো বহন করে চলেছি যদিও সঠিক পথটি বোধহয় চিনে নিতে পারিনি।