ওঁকারেশ্বর মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলার একটি নগর পঞ্চায়েত শাসিত শহর। ইন্দোর থেকে বাসে সুবিস্তীর্ণ স্নিগ্ধ শ্যামল শাল-পিয়াল-মেহগনির জঙ্গলে অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে চড়াই-উৎরাই প্রায় ৭৭ কিলোমিটার পথ চলে বাস এসে থামে মান্ধাতা বাসস্ট্যান্ডে। চারিদিকে পাহাড় আর তীর্থযাত্রীদের জমজমাট ভিড়ে ওঁকারেশ্বর।ওঁকারেশ্বর-মান্ধাতা একটি ছোট্ট দ্বীপ। কাবেরী এবং নর্মদানদী বেষ্টন করে রয়েছে এই ছোট্ট দ্বীপকে। আগে ছোট ছোট নৌকায় নদী পার হয়ে দ্বীপে আসতে হতো। ফলে সন্ধের পর বা বর্ষাকালে, ভিড়েতে নৌকা উল্টিয়ে পরার দুর্ঘটনাও ঘটতো। এখন আর সে ভয় নেই।
কারণ ১৯৭৯ সাল থেকে লোক চলাচলের উপযোগী একটি ২৭০ ফুটের পাকা সেতু নির্মাণ হয়েছে এখানে। এটি “ঝুলা পুল” নামে পরিচিত। এখান থেকেই ওপারে পাহাড়ের গায়ে দেখা যাবে ওঁকারেশ্বর মন্দির। সেতু শেষ হতেই পাহাড়ের কোলে গলি পার হয়ে শংকরাচার্যের গুহার পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভেঙ্গে নর্মদা নদীর ঘাটে নামা যায়। প্রবাদ বলে, “নর্মদা কি কংকর বিলকুল শংকর”। তাই এখানে এসে পুণ্য নর্মদা নদীতে ডুব লাগায় তীর্থযাত্রীরা।
নর্মদা নদীতে স্নান করার সময় ছোট বড় নানান জাতের মাছের দেখা পাবেন। দু-পাশে পাহাড়ের বুক চিরে নর্মদা নদী বয়ে চলেছে নৃত্যরতা উর্বশীর মত কোমড় বাঁকিয়ে। সবুজ জল, কোথাও কোন চঞ্চলতা নেই।
স্নান সেরে ভক্তজন যান জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনে। নর্মদার উভয় তীরে রয়েছে দুটি জ্যোতিলিঙ্গ। দুটিরই নাম মল্লেশ্বর। (মমলেশ্বর)।
কথিত আছে শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বসূরী ইক্ষাকু সূর্য বংশের রাজা মান্ধাতা একবার নাকি এখানে এসেই শিবের যজ্ঞ করেন। সেই যজ্ঞে সন্তুষ্ট হয়ে শিব মান্ধাতাকে দেখা দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন। কিন্তু শিবের দর্শন মাত্রই শিবের মহাজ্যোতি মান্ধাতার দৃষ্টি হরণ করে। মান্ধাতা শিবকে করজোড়ে বলেন, ‘আপনি আপনার মহামূর্তি সংবরণ করুন এবং এখানে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত হন। শিব প্রসন্ন হয়ে বলেন ‘তথাস্তু।’ সেই থেকেই এই ওমকার পর্বতে স্বয়ম্ভু শিব জ্যোতির্লিঙ্গর রূপেই বিরাজমান।
অন্য একটি মতে, মান্ধাতা নর্মদা পরিক্রমার সময় এই দ্বীপে আসেন এবং এখানে এসে রুদ্রযজ্ঞ করেন। শিব মান্ধাতাকে ছলনা করতে কিরাতের বেশে এসে সেই যজ্ঞাগ্নি নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। মান্ধাতা ও শিবের মধ্যে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধ চলাকালীন মান্ধাতা হঠাৎ ওঙ্কারনাদ করে উঠতেই শিব শান্ত হন। শিবের সাথে মল্লযুদ্ধ করেছিলেন বলেই এই স্থানে শিবের নাম মল্লেশ্বর।
ইতিহাস বলে পুনের পেশোয়া বাজিরাও যখন ওঙ্কারতীর্থ নর্মদা পরিক্রমায় আসেন, মন্দির এমন ভাবে জঙ্গলে ঢেকে যায় রাজা মান্ধাতা যে মন্দির স্থাপন করেছিলেন তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রথমে। মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে বীরখালা পাহাড়ের উপর একটি বিশাল মন্দির বাজিরাও নির্মাণ করেন। অনেক বছর পরে মান্ধাতার মন্দির আবিষ্কৃত হলে, উভয় মন্দিরেই পুজো করা হয়। নদীগর্ভের পলি ঘনীভূত হয়ে এই দ্বীপটির প্রাকৃতিক অবস্থান দেবনাগরী ‘ॐ’ (ওঁ) মতো বলে এই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম ওঁকারেশ্বর। প্রাচীন মন্দিরের চেয়েও এই নতুন মন্দিরে জাঁকজমক বেশি। ওমকারেশ্বর দ্বীপটি ২.৬ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত।
ওঁঙ্কারেশ্বর মন্দিরে শুরুতেই রয়েছে একটি নারায়ণের ভাঙ্গা প্রাচীন বিগ্রহ ও পঞ্চমুখী গণেশ মন্দির। গণেশ মন্দিরের বাঁয়ে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের উপর তাকাতেই চোখে পড়বে ৩০০ বছরের পুরনো ভীলরাজার বিরাট প্রাসাদ। ছোট বড় কয়েকটি দেবদেবীর মন্দির বাঁয়ে ফেলে এগোতেই পড়বে অহল্যাবাইয়ের দানে নির্মিত শ্বেত পাথরের শিবের বাহন নন্দীর মন্দির।
ওঁঙ্কারেশ্বর মন্দিরের মুখ্য প্রবেশদ্বারের দুপাশের দেওয়ালে খোদিত দুটি প্রাচীন গণেশের মূর্তি মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে মোট ১০১ স্তম্ভের উপর। গর্ভমন্দিরে ঢুকতেই বাঁদিকে তপস্যারত রাজা মান্ধাতার একটি ছোট মূর্তি। এই বিগ্রহের উপরেই আছে একটি অন্ধকারময় কুঠুরি, পূজারী জানালেন পৌরাণিক যুগে একসময় কিছুকালের জন্য ওই স্থানে বসে তপস্যা করেছিলেন ব্যাসপুত্র শুকদেব গোস্বামী।
গর্ভমন্দিরে বিরাজ করছেন রাজা মান্ধাতার পুজিত ওঁকারেশ্বর মহাদেব। প্রায় ইঞ্চি ইঞ্চি কালচে খয়েরী রং লিঙ্গের। শিবলিঙ্গের চারিপাশ বাধানো, জ্যোতির্লিঙ্গ স্বয়ম্ভু তাই এই লিঙ্গের কোন গৌরীপট্ট নেই। মন্দির দেওয়াল ঘেঁষে রয়েছে শ্বেত পাথরের পার্বতীর বিগ্রহ।
ওঁঙ্কারেশ্বর মন্দিরটি পাঁচতলা। একতলায় বিরাজ করছেন ওঁঙ্কারেশ্বর মহাদেব, দোতালায় স্থাপিত শিবলিঙ্গের নাম মহাকালেশ্বর, সিঁড়ি উঠে তিনতলায় শিবলিঙ্গ ভগবান সিদ্ধনাথ। এঁর ডান দিকে রয়েছেন মহাবীর হনুমান। চারতলার একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠে রয়েছেন নর্মদা লিঙ্গ গুপ্তেশ্বর। চার তলার নাট মন্দির থেকে দেখা যাচ্ছে নর্মদা দক্ষিণ তটে মান্ধাতা গ্রাম। বাঁয়ে দেখা যাবে কাবেরী-নর্মদা নদীর সঙ্গম। পাঁচতলার পথটি বড়ই সরু। সোনায় মোড়া মন্দিরের চূড়ার ঠিক নিচে গোলাকার একটি ছোট্ট প্রকোষ্ঠে রয়েছে ধ্বজেশ্বর মহাদেব। পাশে সিঁদুর মাখানো একটি ত্রিশূলের গায়ে বাঁধা লাল রঙের পতাকা। ওঁকারেশ্বরের পঞ্চম রূপ ধ্বজধারী।
মন্দির থেকে কিছুটা গেলেই পারে শঙ্করাচার্যের মন্দির বা গুহা। অন্ধকারে গুহায় একটি প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। একদা এখানে বসেই তপস্যা করেছিলেন শঙ্করাচার্য। মাত্র ৮ বছর বয়সেই বালক শঙ্কর তার গুরু ঋষিপতঞ্জলি থেকে শুনেছিলেন নর্মদা নদীর একটি গুহায় হাজার হাজার বছর ধরে সমাধিস্থিত হয়ে রয়েছেন মহাযোগী তত্ত্বজ্ঞ গোবিন্দপাদ।
ব্রাহ্মণ শঙ্করাচার্য গুরুগৃহ থেকে প্রায় দু-মাসের অধিক সময় পথ চলে উপস্থিত হয়ে নর্মদাতীরে ওঙ্কারেশ্বরে। ঋষিগুরু গোবিন্দপাদের দেখামাত্রই বুঝতে তার এতোটুকু অসুবিধা হলো না অমিততেজা শঙ্করই শিবঅবতার। যাকে অদ্বৈত ব্রহ্মবিদ্যা উপদেশ দেওয়ার জন্য হাজার হাজার বছর ধরে তিনি এই গুহায় অবস্থান করছেন। এই শঙ্করই ব্যাস দেবের ব্রহ্মসূত্র, দ্বাদশ-উপনিষদ, ভাগবত-গীতা, বিষ্ণুসহস্রনাম ও সনদসুজাতীয় এই ষোলটি গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করে প্রচার করেন জগতে।
আচার্য শঙ্করেরর মত অজস্র সাধক মহাপুরুষদের পদধূলিপুত শৈবতীর্থ এই ওঙ্কারেশ্বর। পৌরাণিক যুগে ঋষি নারদের আগমন ঘটেছিল এই মহতীর্থে। শংকরাচার্যের গুহার পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নর্মদা পর্যন্ত। সুন্দর বাধানো ঘাট। ঘাটের নাম কোটিতীর্থ।
ভক্তের ভগবান দেবাদিদেব মহাদেব। আত্ম উপলব্ধির পথ দেখান তিনি। তাঁর জীবন দর্শন আমাদের নিজেকে চিনতে সাহায্য করে। ওঁঙ্কারেশ্বরের মহাতীর্থে প্রকৃতির বিশাল সৃষ্টির মাঝে মহামিলন ঘটেছে ভক্তের সঙ্গে ভগবান আর নদী প্রকৃতির। জন্ম যেন সার্থক হয়ে যায় এখানে এসে দাঁড়ালে। হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় —
“সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ–
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো ॥
দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র —
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ ॥”